পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গপ্পে উদ্ধব গুছাইত

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 205 view(s)
  • লিখেছেন : ভূপাল চক্রবর্তী
নাম তার উদ্ধব গুছাইত। পিতা নগেন গুছাইত মরে ভুত হয়ে গেছে বছর ত্রিশ হল। মহা ফিকিরে মানুষ ছিল। বাঁধা রোজগার ছিলনা কিন্তু গপ্প ফেঁদে পেট চালাত দিব্যি। শেকড় চালিয়ে গেড়ে বসে আকাশ-বাতাস মায় ধুলো-বালি থেকে গপ্প নামিয়ে প্রহর কাটিয়ে দিলে শ্রোতাদের কেউ না কেউ বলত, দুটি ভাত খেয়ে যাও কথক ঠাকুর।

সেই সুবাদে আরও খানিক গপ্প নেমে আসত নগেন গুছাইতের খুলিতে তারপর পেটে দুটি ভাতের বন্দোবস্ত হলে নটে গাছ মুড়িয়ে সে বাড়ি ফিরত। সাথে কলাটা, মুলোটা, কিছু খুচরো পয়সাও ফিরত। উদ্ধব কোনো দিকে না তাকিয়ে সেই দিকেই মন লাগিয়েছিল। বাপের সাথে গাঁ গঞ্জ ঘুরে কায়দা কানুন রপ্ত করেছিল, কীভাবে পথ চলতে চলতেই গপ্প কুড়িয়ে পাওয়া যায় সেটা সে ভালই শিখেছিল। তবে নগেনের মতো গানের গলা ছিলনা বলে গপ্পে টান লাগলে উদ্ধব খানিক থিতিয়ে যেত। বাপের কাছ থেকে সেই তালিম নেবার ইন্তাম করতে করতেই বাপটা মরে গেল। বাপ চলে যেতে বলতে নেই উদ্ধবের কপাল খুলে গেল রাতারাতি। হাটে বাজারে দোকানে পথে ঘাটে যেখানেই সে বসে সেখানেই গপ্প নামে হামেহাল, আর তা শোনার জন্য মানুষের মেলা ভিড় জমে। নিজের গপ্প, সদ্য মরা বাপের গপ্প সব মিলিয়ে উদ্ধবের গপ্পের ঝুলি ফুলে ফেঁপে অফুরান হয়ে থাকে। তবে উদ্ধবের গপ্পের টান  অন্যখানে। নগেন গুছাইতের থেকে সে এককাঠি দড়। সে গপ্পকে মাঝপথে ছেড়ে দেয়। কাটা ঘুড়ির মতো তার সুতোর খেই ধরিয়ে দিয়ে সে হাঁ করে শুনতে থাকা মানুষজনকে বলে, সুতোটা ধরে একটা লাগসই ধরতাই দেন দেখি আপনারা, বেমানান হলে আমি মেরামত করে দেব। দেখেন দেখি কেউ যদি একখান ডানার যোগান দিতে পারেন আমার গপ্পে। গপ্পের কাটা ঘুড়ি লাট খেতে থাকে মাথার ওপর, সেই ফাঁকে উদ্ধব উড়িয়ে দেয় আর একটা নতুন গপ্প।        

উদ্ধব মনে করে সুয্যি ওঠা থেকে নামা অবধি সবটাই গপ্প। সারাদিন গপ্প বোনা হচ্ছে আর উদ্ধব সেটা সারা গঞ্জে রটিয়ে দিচ্ছে। এ’মাফিক বিচারে সে নিজেকে গপ্পের পাখি বলে মানে। তার গপ্প শোনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে তিন পাড়ার মানুষজন। গন্যিমান্যিরাও আসে, নিজেকে আড়াল করে শোনে, কখনও কখনও তার গপ্প তিন পাড়ার মাথা টপকে, তিন দফা রঙ মেখে যখন অন্যত্র যায় তখন তা আর চেনা গপ্প থাকেনা। বহু কথনে, ছেঁড়া কাপড়ে  শতেক তালি তাপ্পায় তখন হয়ত সে গপ্পের টান খানিক আলগা হয়ে গেছে, লোকে তেমন আমল  দিচ্ছেনা, শুনতে  চাইছেনা মোটে। তখন আবার সেটা উদ্ধবের  কাছে না আসা পর্যন্ত তার মুক্তি নেই। উদ্ধব সেই উনো-পাঁজুরে গপ্পটাকে মেরামত করে দেয়। যেমন তার সেই পালক খসে যাওয়া পাখির বিখ্যাত গপ্পটা। কী যেন এক ভারি রোগে পাখিটার পালক খসে যেতে থাকে। একদিন পাখিটা বাধ্য হয়ে ভুঁয়ে নেমে আসে। পালক নেই বলে তাকে কেউ চিনতে পারেনা। কেউ বলে এ’পাখি  পৃথিবীতে ডেকে আনবে ভয়ঙ্কর দূর্দিন, কেউ বলল এ হল যোমের দূত। কেউ বলে এ পাখিই নয়। মাটিতেই সে চলে ফিরে বেড়াত, মাটিতে চলাফেরা করা প্রাণী সকলের সাথেই   তাকে মিলেমিশে কাদায় গুণ ফেলে থাকতে হতো। অন্য পাখিরা তার সাথে কেউ মিশতো না। কিন্তু এক আশ্চর্য বসন্তে কুল-শীল বর্জিত সেই পাখিটা  ডিম দিল। সাদা ফটফটে দুটি ডিম। স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই নাম-গোত্র হীন পাখিটার মধ্যে অমঙ্গলের চিহ্ন দেখেছিল। অর্থাৎ যা হয়, তাকে গাঁ থেকে খেদিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হবে বলে যখন সবাই একবাক্যে রাজি, তখনই পাখিটা উধাও হল। এইখানে গপ্পের জাল কেটে দিয়ে উদ্ধব  শ্রোতাদের কাছে বাকিটা খুঁজে এনে জোড়া লাগাবার হুকুম দিয়েছিল। তারপর থেকেই উদ্ধবের মুখের এঁটো গপ্প দুনিয়া চষে বেড়িয়েছে কয়েক বছর। কয়েকশো সংস্করণের পর সেই পঙ্গু গপ্প যখন উদ্ধবের কাছে এল তখন উদ্ধব বলল, এ’তো পিরীতের গপ্প ছিল। মানুষের চোখ দিয়ে গপ্পটা দেখলে বলে সেটা ক্রমশ তোমাদের তরল বুদ্ধির জলে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। পাখিটার চোখ দিয়ে দেখলে সব পরিস্কার হয়ে যেত। সে গপ্পও ডানা মেলে দিত।   

তার গপ্প শূনে উচক্কা মরদ হাউ হাউ করে কাঁদে, বুড়ো হাড়ে মড়মড় করে শব্দ তুলে কিছু মানুষ যেন হারানো বল ফিরে পায়। উদ্ধবের হাঁটুর বয়সি মেয়েগুলো মাথায় উঠতে চায়। মাঝ বয়সি মাংস পিন্ড হয়ে যাওয়া রমণীরা  খল খল করে ওঠে সদ্য জল পাওয়া পোনার মতো।  

কয়েকশো বছর আগে একটি গিরগিটির মৃত্যু নিয়ে যে গপ্পটা বলেছিলে সেটি আরেকবার বল তো বাবা, এক বুড়ো চকচকে চোখে ঝিলিক তুলে নিয়ে বলে। ঝিলিক নয়, সে আসলে একই গপ্প বারবার শোনে আর হাউ হাউ করে কাঁদে। কেউ তাকে থামাতে পারেনা। অনেকে বুঝতেই পারেনা একটি গিরগিটি যে কিনা পশ্চিমের জামরুল গাছটায় থাকত, গ্রামের অনেক গরুর চোখ খুবলে নিয়েছে বলে অনেকের পশ্চিমের মাঠে গরুকে নিয়ে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে বহুকাল, আজও সেখানে গিরগিটির আত্মা ঘাপটি মেরে থাকে বলে বুদ্ধিমান মানুষেরা বিশ্বাস করে, তারজন্য বুড়োর এত কীসের কান্না! সবাই বুড়োকে ধমকে দেয় একদফা। বুড়ি বুড়োর মাথায় একটা ঠোসা দিয়ে বলে, কাঁদছেন কেন সব জানি আমি। উদ্ধব আমাকে বলেছে, সেই গিরগিটি  আপনার মধ্যে আছে। সেই গপ্প যেদিন উদ্ধব কইবে এই ভরা গপ্পের হাটে সেদিন আপনার মুক্তি। সবাই বুড়ির কথা শুনে বুড়োর দিকে তাকায়। তারা কেউ  কেউ বলে বুড়োর চোখ গরুর মতো, কেউ বলে গিরগিটির মতো। অনেকেই সোজা-সাপটা দেখেছে, বুড়োর খসখসে চামড়া গিরগিটির মতোই।     

উদ্ধবের ঘাড়ে গপ্পের ইমারত তোলা আছে। সে ফরমায়েশি গপ্প বলার ফুরসত বলতে গেলে পায়ই না। এখন তার মনে এল সেই সারেঙ্গ বাজানো বুড়োটার গপ্প।

রোসো, তোমাদের এক বুড়ো সারেঙ্গ বাদকের গপ্প বলি। বুড়োটা এদেশি না ভিনদেশি তা জানিনা। তার মুখের কথা কেউ শোনেনি কোনদিন। যা শুনেছে তা ওই সারেঙ্গের সুর। মাঠে ঘাটে নদীর পারে, যেখানে একচিলতে ফাঁকা জায়গা পেত সেখানেই সে বসে যেত সুর নিয়ে। তার সুরটাও ছিল বড় অদ্ভুত, সে সুর একবার শুনলে সারাদিন ভেতরে ভেতরে গুন গুন করে বাজবে কিন্তু তাকে বাইরে আনা যাবেনা। গাঁ শুদ্ধু লোক রাতদিন গুন গুন করে। সুরের ধারা একটু একটু করে এলাকার সব মানুষকে এমন অবশ করে দিল যে একদিন সেই সুরের মূর্ছনায় অপারগ একজন খুন করে দিল বাদ্যকারকে। সেদিন সে সুর নিয়ে বসেছিল শান্ত এক নেমে আসা সন্ধের নদীতীরে। নদীর কালচে ঘোলা জলে সারেঙ্গ ভেসে গেল তার শেষ সুরের আর্তনাদে। গপ্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত কিন্তু তা হয়নি। ধীরে ধীরে সেই গ্রাম জনশূন্য হয়ে গেল। অব্যক্ত সুরের যন্ত্রণায় পরস্পর হত্যা, প্রতিহত্যা এবং আত্মহত্যা শ্মশান করে দিল একটি জনবহুল গ্রাম। শুধু একটি মাত্র অন্তঃসত্ত্বা কুমারী বেঁচে রইল। তারই গর্ভসঞ্চারের  অপেক্ষায় যেন ধ্যনস্থ হয়ে ছিল একটি গোটা গ্রাম।  

নিবিষ্ট গপ্পের আঁচে উদ্ধব যেন ডেকে এনেছে শীতের ওম। ঘনিষ্ঠ শ্রোতাদের নীরবতায় ম্লান রৌদ্রে যেন চেনা সুরের মৌন উপস্থিতি।

 এ বড় নির্মম গপ্প হে কথক। বড় নির্মম। শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একটি তরুণী এগিয়ে আসে উদ্ধবের দিকে।  এতদিন মনে হয়নি, আজ তাকে দেখে সকলের মনেহল সে আসন্ন প্রসবা।

উদ্ধব তাকে দেখে হাসে। ম্লান হাসি। বলে, এ গপ্প তো তোমার জন্যই, তোমার বেদনাকে চিরস্থায়ী করার জন্যই। হনন যে কতটা রমণীয় হতে পারে সে তুমি ছাড়া কেউ জানেনা।

গপ্প শেষ হলে স্থবির শ্রোতাদের সামনে নেমে এসেছে তেরছা রোদ্দুর। উদ্ধব সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, সেই মৃত্যুর  মড়ক লাগা গ্রামে এখন সারেঙ্গ বাজছে। তোমরা কি কেউ শুনতে চাও! যদি শুনতে চাও তাহলে আর একটি গপ্পের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তোমাদের।

কতদিন কথক?

যেদিন তোমরা সবাই নবজাতকের কান্না আর কুমারী জননীর হাসি একসাথে শুনতে পাবে, সেদিন।

এমত গপ্পের স্রোতে উদ্ধব নিজেকে এবং তার চারপাশের তামাম শহরতলি মায় গাঁ-গঞ্জ, আকাশ-বাতাস, চন্দ-সুয্য-তারা ভাসিয়ে দিচ্ছে যখন নিতান্ত দুমুঠো অন্নের তাগিদে অথবা দুটি পয়সার বিনিময়ে তখন সে একটা কালো, ঢ্যাঙা, ক্ষ্যয়াটে আশ্চর্য মানুষ। অতিকথনে মুখ ভর্তি জমা থুথু খালি পেটে গিলে নিতে নিতে সে যখন বুঝতে পারে যে সে নিজেকেই যেন ভাঙিয়ে খাচ্ছে, তথাপি সে দুটি ভাতের কথাই ভাবে।    

###

একদিন এক নিমগ্ন সন্ধ্যায় তার কপাল ফেরে। গপ্প শেষ করে খুচরো কটা পয়সা ট্যাঁকের কাপড়ে গুঁজে উদ্ধব দেখল সন্ধে নামছে। একে একে শ্রোতারা বিদায় নিয়েছে। একটি মজার গপ্প নিজের ইচ্ছের বাইরে গিয়ে কেমন বিষাদের গপ্প হয়ে গেল। সবাই বেশ হাসিমুখে শুনছিল, উদ্ধব চাইছিল গপ্পটা রসে আদ্র হয়ে থাকুক, কিন্তু বাপটার মৃত্যুদিন আজ। সেইটে মনে পড়তেই গপ্পটা পথ পালটে বিষাদে ডুবে গেল। গপ্প যে মনের অবস্থার সাথে বদলে যায় এটা সে নিজে কোনদিন ধরতে পারেনি। কিন্তু যায়, বদলে যায়। সেই থেকে বিষাদ লেগে রয়েছে পরিবেশটা জুড়ে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘাটের দুটো সিঁড়ি ভাঙতে যাবার সময় পেছন থেকে উদ্ধবকে কে যেন ডাকল। উদ্ধব ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে বিপিন তাকে ডাকছে। বিপিন তার গপ্পে এসেছে বার কয়েক। বাজারের মোড়ে  তার মুদির দোকান। উদ্ধব আন্দাজ করে শ্রোতাদের মধ্যেই কোথাও ছিল ঘাপটি মেরে। এখন যাবার সময় হয়ত মনে হয়েছে দুটো টাকা দিয়ে যাওয়া উচিৎ, তাই পিছু ডাকছে। মানুষটা ভাল, চালাকি করে বটে, দোকানদাররা যেমন টুকটাক করে, তবে পয়সা মারার লোক নয়। উদ্ধব সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বিপিন এগিয়ে আসে। অন্ধকার নামছে তখন। একটু কালচে লাগছে বিপিনের দেহটা। গলাটা সে খানিক নামিয়ে বলে, আমার দোকানে একবেলা করে সময় দেন কথক, তাইলে আমার কিছু বিক্রি বাড়ে আপনারও দু’পয়সা হয়। আপনি যেখানে যায়েন সেখানেই তো লোক জমে, তা না’হয় আমার দোকানেই সময় করে দুদন্ড বসলেন।

উদ্ধবের মাথায় চরকির মতো খেলে গেল চারপাশের গাঁ-গঞ্জ, শহরতলি, যার আনাচ-কানাচ, তার নখদর্পণের  মতো জানা। সারাদিন সে খালে-বিলে, মাঠে ঘাটে গপ্প ছড়িয়ে বেড়ায় পাখিদের বীজ ছড়ানোর মতো। সে কেন বিপিনের দোকানের এককোণে বসেই থাকবে গপ্পের ঝুলি নিয়ে? কোন ঠেকা পরেছে তার খামোখা পায়ে বেড়ি পড়ার?  বিপিনকে চোখের তাড়নায় ঝাঁঝিয়ে বেপরোয়া কিছু বলার জন্য দু সিঁড়ি মুখ ঘুড়িয়ে উঠে যাবার সময় মনটা আন-সান ভাবনায় জড়িয়ে গেল। বয়স হচ্ছে, একঠাঁই হয়ে থিতু থাকলে ক্ষতি কি। মুখের ফেনা তুলে ঘুরে ঘুরে অনেকদিন তো হল। মুহূর্তে ঠাঁইনাড়া জীবন যেন হাঁপিয়ে উঠল একটু থিতু হবার বাসনায়। বিপিন যেন খাঁচার দরজা খুলে তার তরে পলকহীন চেয়ে থাকে। উদ্ধবও যেন নিশ্চিত দানাপানির মোহে গপ্পের ঝুলি নিয়ে বিপিনের দিকে ধায়। বিপিন তাকে ছিপে গাঁথে।  

বিপিনের ঘুপচি দোকানে মুদিখানার মালের পসরা আর তার পাশাপাশি উদ্ধবের গপ্পের পসরা। যথারীতি বিপিনের দোকানে খদ্দেরের লাইন হয়, তিন পাড়া ঝেঁটিয়ে হুমড়ি খায় বিপিনের খুপরি দোকানঘরের সামনে। সবাই মাল  নিতে না আসলেও চক্ষুলজ্জার টানে কিছু খরিদ করে মানুষজন। নিদেন পক্ষে বিড়ি সিগারেট।

বেচা কেনার হাট জমে উঠলে উদ্ধব গপ্প ওড়ায়,

 উত্তরের গ্রামে থাকত এক গরিব শুদ্র দম্পতি। মেঙ্গে পেতে পেট চালাত। কিন্তু তাদের এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। খাবার আগে মনে মনে যে খাবার খেতে ইচ্ছে হত সেই খাবারের হুবহু স্বাদ পেত তারা। সাধারণ ফ্যানা ভাত মনের ইচ্ছাশক্তিতে হয়ে যেত পলান্ন! কেউ বিশ্বাস করত না এই অক্ষম বিলাসিতা। না করারই কথা। তথাপি এক হত দরিদ্র হাভাতের নজর পড়ল তাদের দিকে। আহা! তাদের প্রতিদিনের অখাদ্য যদি স্বাদু হয়ে ওঠে।

শুদ্র দম্পতি বলল, কেমন করে হয় তারা নিজেরাই জানেনা। তবে বহুদিন ভাবতে ভাবতে একদিন হঠাৎ তারা লক্ষ্য করেছিল তাদের কামনার স্বাদ তারা পাচ্ছে। হাভাতে সেদিন থেকে শুরু করল ভাবনা আর একদিন তাদেরও খাদ্যের স্বাদ বদলে যেতে লাগল তার ইচ্ছানুসারে।   

ধীরে ধীরে গরিব মানুষের মধ্যে এমত ভাবনার একটা স্থায়ী উপযোগিতা যখন প্রায় একটা আত্মদর্শনে নেমে এসেছে সহজ ভাবে, ঠিক তখনই গ্রামের এক ধনী মানুষের নজর পড়ল সেদিকে। তার তো সুস্বাদু খাবারের অভাব নেই, কিন্তু যা অখাদ্য তা যদি অনায়াসে স্বাদু হয়ে যায় তাহলে তার খাদ্যের কোন মুল্যই থাকেনা। তাছাড়া রসনার তৃপ্তি হাভাতেগুলোর আত্মবিশ্বাস আর জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দেবে ক্রমশ।  

ধনী মানুষটার এবার মনে হল হাভাতেগুলো যেটুকু খাদ্য সংগ্রহ করে সেটুকুও কেড়ে নিতে হবে। যেমন ভাবনা  তেমন কাজ। ফলত উত্তরের গাঁ উজাড় হয়ে গেল। ধনী মানুষ ছাড়া সেখানে আর কেউ বেঁচে নেই।

গপ্পশেষের থমথমে পরিবেশ আর বিপিনের দোকানদারির মাঝে শ্রোতারা অনুভব করে উত্তরের গাঁ থেকে না খেতে পাওয়া মরা মানুষের ভিড় যেন উপছে পড়ছে একশ গ্রাম কলায়ের ডাল, এক কেজি আলু , দুশো সরষের তেল অথবা আড়াইশো চিনির খরিদ্দারদের মধ্যে।  

গপ্প শেষ করে উদ্ধব বলে, এবার বলেন দেখি, সেইসব না খেয়ে মরে যাওয়া মানূষগুলো এখন কোথায়? কাল যখন দোকানে আসবেন উত্তরটা নিয়ে আসবেন। সেখান থেকেই আর একটা গপ্পের জোড়কলম হবে।

আর একটা জোড়কলম গপ্পের টানে জোয়ার খেলে যায় বিপিনের কারবারে। উদ্ধব তোতা পাখিটির মতো গপ্প আওড়ায়। মুঠো তার ছাপিয়ে ওঠে খুচরো পয়সায়। বিপিন খুশি হয়ে কিছু বড়তি পয়সাও গুঁজে দেয় তার হাতে হাসি মুখে। শুধু একটা ক্ষীণ মনমরা ভাব উদ্ধবকে কেমন যেন ঝিমিয়ে দেয়। কত নগর প্রন্তরের ধুলো মাখা গপ্পের ঝুলি যেন ফুরিয়ে আসে। কোথায় যেন সে টের পায় বুড়ো গাছের মতো তার শেকড় হয়েছে বিপিনের দোকানে। এক একবার মনে হয় বিপিনের এই চার-দেওয়ালে লাথি মেরে সে চলে যাবে। আবার নগরে প্রন্তরে ঘুরে ঘুরে গপ্পের বীজ খুঁটে খুঁটে তুলে আনবে। কিন্তু ওই! দুটি বাঁধা খুচরো পয়সার মায়ায় সে খাঁচার দরজা খোলা থাকলেও উড়তে ভয় পায়। বিপিন তাকে বলে, এই আমি, আমার দোকানের পসরা,আমার খদ্দের এ’সব নিয়ে নতুন গপ্প বাঁধো কথক, তাইলে মানুষের মনটা এ’দিক পানে খানিক টেনে রাখা যায়। উদ্ধব হাঁ করে শোনে বিপিনের কথা। সে চাইছে একটা গন্ডির মধ্যে তাকে ,তার গপ্পকে বেঁধে ফেলতে। ছিটকে বেড়িয়ে যাবার বাসনা তাকে স্বপ্নের মতো তাড়া করে। 

আপনার নাম উদ্ধব?  

কাঁধের ওপর গামছাটা ফেলে উদ্ধব বিপিনের দোকান থেকে বাড়ি ফিরছিল। দোকানের টিনের চাল থেকে আগুন নামে বেলা বাড়লে। তখন এই গামছাটাই উদ্ধবের রুমাল। অচেনা কন্ঠস্বরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সাদা পায়জামা- পাঞ্জাবি পড়া একটা লোক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

আঙ্গে কিছু কইবেন? উদ্ধব লোকটাকে কথাটা বলতে বলতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বোলায়।

একটা সংবাদ দিতে এসেছি। কাল সকাল দশটার পর পঞ্চায়েত আপিসে আপনার ভোটার কার্ডটা নিয়ে একবার দেখা করবেন।

ভোটার কার্ড বলতে উদ্ধবের মনে পড়ে একটা সাদা চকচকে পেলাসটিকে মোড়া একখান ছবিওলা শক্ত কাগজ। ভোটের সময় সাথে রাখতে হয়। নইলে ভোট দেওয়া যায়না। তা এখন তো ভোটের কথা নেই। তাইলে? গত দুবার ভোট সে দেয়নি, ভিন গাঁয়ে গপ্প শুনিয়ে রাতে ফিরেছিল। ভোটের বাবুরা খুব খাতির করেছিল, অনেকগুলো খুচরো পয়সা দিয়েছিল দুহাত ভরে। আবার কি তবে ভোটের বাবুদের গপ্প শোনাতে হবে? উদ্ধবের পয়সায় বড় লোভ জেগেছে ইদানীং। মুখে হাসি লাগিয়ে বলে, ভোট বাবুদের জন্য? গপ্প ?

সে আমি জানিনা, আপনি গেলেই বুঝবেন। বলেই লোকটা পা চালাল মুখ ঘুরিয়ে।  

###

 দশটার পর আসতে পারবেনা শুনে বিপিন মুখ শুকিয়ে তাকিয়ে ছিল উদ্ধবের দিকে, কেন? আসবেন না কেন?

পঞ্চায়েত আপিসে ডেকেছে। ভোটার কার্ড নিয়ে যেতে হবে।

কেন? কিছু ভাতা-টাতা পাবেন? ফরম জমা দিয়েছিলেন?

নাহ্। কিছুই জানিনা, গেলে জানতে পারবো।  

ভোটার কার্ডে উদ্ধবকে চেনা যায়না। কার্ডটা হাতে নিয়ে অপিসের মুখে দাঁড়িয়ে তার একটা গপ্প মাথায় আসে।  নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি হেসে সে বিড়বিড় করে, রাজার নথিতে প্রজা আর আসল প্রজা দুইটি মেলেনা কোনদিন। রাজা তাই বুঝতেও পারেনা নিজের প্রজাকে। নাকি বুঝতে চায়না। গপ্প বিলবিল করে মাথায়। এক ছিল রাজা। সে তার প্রজাদের নজরে গেঁথে রাখবে বলে একখান জাবদা খাতা বানিয়ে তাইতে গুষ্টির প্রজার সাকিন-পরিচয় লিখে রাখার হুকুম দিয়েছিল। রাজার লোক লিখতে গিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় আর দেখে অনেক প্রজার নাম আর রাজার নাম এক। কাউকে আবার দেখতে একইরকম। রাজা হুকুম দিলেন, ওই প্রজাগুলোকে মেরে ফেল।

আপনি উদ্ধব গুছাইত? বাবা নগেন গুছাইত? আপনার বাবার গল্প ছোটবেলায় শুনেছি। মজার মানুষ ছিলেন। একটা গল্প মনে আছে একটু একটু। লোকে বলে সাধুর পাল্লায় পড়লে চোরও সাধু হয়ে যায়, কিন্তু আপনার বাবার একটা চোরের গল্প ছিল সে আবার সব সাধুদের চোর বানিয়ে দিত। যাইহোক আপনাকে যে জন্য এখানে ডাকা হয়েছে।

 গপ্পটা ফিকে হয়ে গেল। উদ্ধব অচেনা লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনে। লোকটা তারই মতো চেনা-অচেনা সব মানুষের সাথে কেমন আপন করে কথা কয়। উদ্ধব খুশি হয় মানুষটার ভাব দেখে। এই মানুষটাকে নিয়ে সে একটা গপ্প বাঁধবে।     

কই আপনার ভোটার কার্ডটা দেখি?

উদ্ধব কার্ডটা এগিয়ে দেয়। মানুষটা চেয়ার থেকে হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিয়ে বলে, কিছুইনা, আপনাকে আমরা পার্টির কাজে নেব। আপনার মতো লোক চাই আমাদের দলে। তাই আপনার নামটা আজ থেকে আমাদের খাতায় তুলে নিলাম। আপনার বাবাকে যে সম্মান দিতে পারিনি তা আপনাকে দিয়ে আমরা প্রায়শ্চিত্ত করলাম।

উদ্ধব খুশিতে ডুবে যায় যেন। তার বাপটা বড় কষ্ট করে গেছে। খুব সামান্য রোজগার ছিল। উদ্ধব সে তুলনায় এখন যথেষ্ট পয়সা নাড়াচাড়া করে। আজ তার মনে হল বাবা যেন ওপর থেকে তাকে আশীর্বাদ করছে।

এবারে জমিয়ে কটা গল্প বানিয়ে ফেলুন দেখি।  

উদ্ধবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চশমা আঁটা লোক কথাটা বলে তাকে উদ্দেশ্য করে। উদ্ধব প্রথমে বুঝতে পারেনি যে লোকটাই তাকে বাকি কথা বলবার জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ চেয়ারে বসা লোকটা ভোটার কার্ডটা তার হাতে ফেরত দিয়ে আর তাকে যেন চিনতেই পারছেনা। মাথা নিচু করে কাগজ দেখছে।

লোকটা বলে, চিন্তার কিছু নেই,হাতে অনেক সময় আছে। আমরা চাপ দেবনা। আমি আপনাকে গল্পের  বিষয়টা বলে দেব। আপনি অডার মতো বানাবেন। অডার বলাটা ঠিক নয় আপনার মতো গুণি মানুষকে। অডার দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই , আমাদের অনুরোধ।    

গপ্প তো উদ্ধবের মাথায় চড়ে বসেই আছে। মুখ খুললেই হয়। একটা বৈশ্য গোত্রের মানুষের গপ্প তার মাথায় কাল থেকে জমে রয়েছে। সেইটে বললেই হয়। সে মানুষটা এই গাঁয়ে এয়েছিল কয়েকশো বছর আগে। সে একটা নতুন ফন্দি নিয়ে এসেছিল। সেটা হল, দুনিয়ার সব কিছুতেই মানুষের হক থাকলেও দুনিয়ার সব কিছুই কেনা-বেচা করা  যায়, মায় মাটিও। সেই ফন্দিটা লাগু করে দিতেই এই পিথিবীর সব কিছুর ওপর থেকে মানুষের অধিকার চলে গেল। ওই মানুষটার গুষ্টিকেই এখন বলে বণিক। সেই থেকে পিথিবীর সব মাথায় বণিক বসে আছে।  

গপ্পটা গুছিয়ে বলতে যাবে ভেবে উদ্ধব লুঙ্গি গুটিয়ে বসে গেছিল, কিন্তু চশমা আঁটা মানুষটা মানা করল বলে আর বলা হলনা।  উদ্ধব এই প্রথম গপ্প বলতে গিয়ে থেমে গেল বলে তার একটু ভিরমি লাগল। আরও ভিরমি লাগল যখন চেয়ারে বসা মানুষটার ইশারায় একটা গোটা কুড়ি টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দিল চশমা আঁটা লোকটা।

এতদিন গপ্প বলে মুখের ফেনা তুলে উদ্ধব খুচরো পয়সা পেত, আজকে মুখ না খুলেই টাকা হাতে নিয়ে উদ্ধবের মনে হল তার মুখ বন্ধ করা হল টাকা দিয়ে।

###

বিপিনের কাজটা ছেড়ে দিতেই হল। ব্যাপারটা যেভাবে ঘটল, সেটাও একটা গপ্পের মতো মনে হয়েছিল উদ্ধবের। সেদিন গপ্প বলার সময় একটা আনকা লোক উদ্ধবকে ঠায় দেখছিল। গপ্প শেষ হলে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে বলল, আপনি এসব ছেলেভুলোনো গল্প ছাড়ুন কথক মশাই, দিনকাল পালটাচ্ছে, সময়ের গল্প বলুন, আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের গল্প বলুন। সরকারের জনমুখি পরিকল্পনার গল্প বলুন, মানুষকে জানিয়ে দিন তার গণতান্ত্রিক অধিকারের  কথা। আগের দিন আপিসে আপনাকে সবকিছু বলার পরেও এখানে বসে গল্প বানাচ্ছেন!  

বিপিনের দাঁড়িপাল্লা থমকে যায়,উদ্ধবের মুখের লালা শুকিয়ে যায়, শ্রোতাদের চোখের চাউনি আজানা প্রস্তাবে উদাস হয়ে ওঠে। একটা অন্য ভাষা,অন্য মেজাজের দমকা হাওয়া যেন সব ওলটপালট করে দিল।

এখানে আপনাকে আর গল্প বলতে হবেনা,আপনি আজ বিকেল থেকে শহরে,গ্রামে জায়গায় জায়গায় রুটিন মাফিক গল্প বলতে যাবেন, সব গল্পের মেটিরিয়াল আমরা দেব, টাটকা মেটিরিয়াল। আজকে আপনি যাবেন হাড়পোঁতা গ্রামে। সেখানে কয়েক ঘর হাভাতে আছে। আপনি তাদের কাছে গিয়ে আমাদের ‘বিকাশ’ প্রকল্প নিয়ে গল্প বলবেন।    

হাড়পোঁতা গ্রাম বলতে উদ্ধবের মনে পড়ল সেই মানুষটার কথা যাকে রাতারাতি মেরে হাড় পুঁতে দিয়েছিল মাটিতে জমিদারের লোকেরা। উদ্ধবের একটি গপ্পে সেই মানুষটা আজও বেঁচে আছে। এখনও তার গপ্প শুনে মানুষের চোখে জল আসে। যতবার সে ওই গ্রামে গেছে ততবার সেখানকার মানুষ ওই একই গপ্প বারবার শুনতে চেয়েছে।

আনকা লোকটাকে উদ্ধব বলল, গপ্পটা আমি জানি। সে আমারই মুখের গপ্প। পেল্লায় গপ্প।  

ধুর মশাই!  আপনাকে বারবার বলছি আপনাকে আমরা মেটিরিয়াল দেব। পাঁচশো বছর আগের গল্প চলবে না।  ওখানে সামনের রথের দিন শপিংমল খোলা হবে। অনেক হিড়িক করে জমি পাওয়া গেছে। এখন মল হলে ওখানকার মানুষের সুযোগ সুবিধা, চটজলদি এক জায়গায় সব মালের পসরা, রাস্তাঘাট  সারাই করা এসব নিয়ে গল্প সাজান। বিকেলে আমাদের লোক আপনাকে নিয়ে যাবে গাড়ি করে। আপনাকে ওখানে সবাই মান্য করে, পয়দল গেলে মান থাকবেনা।

উদ্ধবের জীবনটা পালটে গেল হুশ করে। বিপিনের খাঁচা থেকে বেড়িয়ে সে এখন অন্য খাঁচায়। বেমালুম পালটে  গেল তার গপ্পের ভাষা, গপ্পের বিষয়। না খেতে পাওয়া মানুষের দেশে শপিংমল খোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তার গপ্প হইহই করে শ্রোতাদের ভিড়ে উড়ে গেল বেমালুম। গপ্প শেষে একঝাঁক মানুষের হাততালি তাকে বুঝিয়ে দিল হাড়পোঁতা গ্রামের সেই মান্ধাতা আমলের গপ্প শুনে চোখের জল ফেলার কেউ নেই আর। শুধু গলা ধরে আসার মুহূর্তে কিম্বা গলা ধরে আসার বিভ্রমে সে একটা মানানসই কাশি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল আবেগ। তারপর? তারপর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার গপ্প তার নখদর্পণে চকচক করে এখন।

 

ভূপাল চক্রবর্তী

২৩৩, মিত্রপাড়া রোড। নৈহাটি, উত্তর চব্বিশ পরগণা

পিন-৭৪৩১৬৫, মোবাইল-৮২৪০৪৪৪৬৪৭

 

  

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment