পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গুণিন

  • 02 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 883 view(s)
  • লিখেছেন : অমর দে
জুলাইয়ের মাঝামাঝি। ক'দিন ধরে থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। এক পশলা বৃষ্টির পরই রোদ। সেই সঙ্গে ভ্যাপসা গরম। এক এক সময় আকাশ মেঘে ঢেকে গুমোট হয়ে থাকছে। পলাশডাঙা ছোট একটা আদিবাসী গ্রাম। চারপাশে বিস্তৃত চাষজমির মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এক একটা জনবসতি। সেই সব গ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। গত ত্রিশ চল্লিশ বছরে গ্রামগুলোর জীবনধারায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ সড়ক যোজনায় প্রায় প্রতি গ্রামে রাস্তা হয়ে শহরের সঙ্গে জুড়ে গেছে।

সরকারি একশ দিনের কাজে কিছু মানুষের হাতে টাকা আসছে। প্রায় গ্রামগুলোতেই এখন টিউকল বসে গেছে। অনেকের হাতে মোবাইল এসে গেছে। এমনকি, এখন এক দু টাকায় শ্যাম্পুর পাউচ পাওয়া যায় বলে, অনেকে এখন মাথায় সোডা-সাবানের বদলে শ্যাম্পু ঘষে। তবু গ্রামগুলো এখনও কুসংস্কার মুক্ত হতে পারেনি

পলাশডাঙার দক্ষিণে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বাবলাডাঙা। মোরাম ঢালা একটা সরু রাস্তা দুটো গ্রামকে যুক্ত করেছে। দুই গ্রামের মাঝে শুধুই চাষের জমি। এই জমিকে পলাশডাঙার লোকেরা বলে দখনের মাঠ। এই মাঠে ধানের সঙ্গে কিছু জমিতে আনাজপত্রেরও চাষ হয়। একটু দূর দিয়ে চলে গেছে হাইওয়ে। হাইওয়ের পাশে পাশে গজিয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি গঞ্জ। এখান আট দশ কিলোমিটার গেলে শহর। স্বাভাবিক নিয়মেই শহরের ঝাপটা এসে লেগেছে পলাশডাঙা সহ এই অঞ্চলের গায়ে। এই পলাশডাঙায় মঙ্গল হাঁসদার বাস। সাইকেলে চড়ে মঙ্গল কখনও গঞ্জে যায় বাজার-হাট করতে, কখনও শহরে যায় বিভিন্ন কাজে।

প্রতিদিনের মতো লালমণির কোঁকর কোঁ আওয়াজে ভোরবেলা মঙ্গলের আজও ঘুম ভেঙেছে। গতরাতে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে সেটা সে ঘুমের মধ্যেই টের পেয়েছিল। জানলা দিয়ে বৃষ্টিশীতল বাতাস ঢুকছিল। সেই হাওয়া মেখে আরও গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল। এখন আকাশ পরিষ্কার হয়ে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ভোরের আলো ফুটলেই লালমণি উড়ে গিয়ে মঙ্গলদের টিনের চালার টঙে বসে আওয়াজ ছাড়ে কোঁকর কোঁ। লালমণি মঙ্গলের আদরের পোষ্য। মাথার বালিশের পাশে রাখা মোবাইল টিপে দেখল ভোর পাঁচটা। রোজ এ সময়েই তার ঘুম  ভাঙে। বিছানায় বসে এক ঝলক ভেবে নিল আজ তাকে কী কী কাজ করতে হবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় পা দিয়ে দেখল দাওয়ার এক পাশে খলপা ঘেরা রান্নার জায়গায় উনুনে মা চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছে। লালমণি মায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। শহরে  লেখাপড়া করতে গিয়ে মঙ্গলের যে চায়ের নেশা হয়েছে এটা মা জানে। না হলে আগে তাদের বাড়িতে চায়ের চাষ ছিল না।

একটা গেলাসে চা ঢেলে মা মঙ্গলের দিকে বাড়িয়ে দিল। চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ তুলেই মঙ্গল দেখল সুবল সোরেন সাইকেল চালিয়ে তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। মঙ্গল জানে সুবল বিজ্ঞানের ছাত্র, সেই সঙ্গে এ অঞ্চলের বিজ্ঞান মঞ্চের একজন পাণ্ডা। সুবলের নানা রকম কার্যকলাপ দেখে মঙ্গল ওর ভক্ত হয়ে উঠেছে। ওর কাছে অনেক কিছু শিখেছেও। সুবল তাদের বাড়ির সামনে এসে সাইকেল থেকে নামতেই চায়ের গেলাস হাতে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মঙ্গল বলল -- এসো, এসো সুবলদা। তারপর, কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?

 

-- হ্যাঁ ভাই, ব্যাপার গুরুতর। এবার কিছু একটা করতেই হবে। দাঁড়াও, তার আগে তোমাকে সব খুলে বলি।

-- চলো, ঘরে গিয়ে সব শুনব। তার আগে একটু চা খাও।

 ঘরে ঢুকে ক্ষীণ হেসে সুবল বলল -- সেই একই ব্যাপার। এবার বেস্পতি চোড়ে। এই অভিশাপ কি আমাদের সমাজ থেকে কোনও দিন ঘুচবে না মঙ্গল?

বেস্পতি চোড়ে এই গ্রামেরই মেয়ে। বছর ছয়-সাত আগে গ্রামের হোপনা মুর্মুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। একটা চারের ছেলে আছে। হোপনা  দক্ষিণ মাঠে পাট্টায় পাওয়া বিঘে দেড়েক জমি চাষ করত আর বাকি সময় শহরে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে মজুরের কাজ করত। মাস ছয়েক আগে করোনায় মারা যায়। একদিন কাজ থেকে ফিরে শরীর খারাপ হয়েছিল। ক'দিন কাজেও যেতে পারেনি। ভেবেছিল সামান্য জ্বরজারি হয়েছে, আপনি সেরে যাবে। কিন্তু শহরে কাজ করতে গিয়ে যে শরীরের মধ্যে কালসাপ ঢুকেছে, এটা বোঝেনি।
অনেক গরীব লোকের মতো হোপনাও বেঘোরে মারা গিয়েছিল। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল বাবলাডাঙার গুণিন ছিষ্টি হেমরম। বেস্পতির উপর ওর কুনজর পড়েছিল। সেই অসৎ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ছিষ্টি  বেস্পতিকে ডাইন অপবাদ দিয়েছে।

মঙ্গল হতবাক হয়ে সুবলের মুখের দিকে তাকায় -- সত্যি!

-- কেন তুমি জানো না! এই কথা তো চারদিকে ভালো মতোই ছড়িয়েছে।

-- ক'দিন একটা কাজের সন্ধানে আমাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। এই সময়ে গ্রামে কী ঘটেছে না ঘটেছে আমি কিছুই জানি না। আশ্চর্য, কেউ কিছু কেন বলল না আমাকে!
 সুবল আবার বলল -- তুমি তো জানো অনেক কুকর্ম করেছে ওই ছিষ্টি গুণিন। লোকদের ও নানা ভাবে ঠকায়। পুলিশ তো ওকে একবার ধরেওছিল। কি করে যেন সেবার ও বেঁচে যায়। বেস্পতিদিদি কম বয়সে বিধবা হল। ছেলেও খুব ছোট। এই সুযোগটাই নিয়েছে ছিষ্টি।

মঙ্গলের মনে অনেকক্ষণ ধরে একটা ভাবনা ঘাই মারছিল। বলল -- শুধুই কি বেস্পতিদিদি সুবলদা? নাকি ছিষ্টির অন্য মতলব আছে? না হলে ডাইন অপবাদ দেবে কেন?

-- তুমি ঠিকই বলেছ মঙ্গল। ছিষ্টির আসল মতলবটা কিছুতেই ধরতে পারছি না। লক্ষণকেও খবর পাঠিয়ে আসতে বলেছি। বেস্পতিদিদির যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সেটা আমাদের দেখতে হবে।

লক্ষণ সোরেন এই অঞ্চলের আদিবাসী গাঁওতার নেতা। ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকলেও মঙ্গল ওকে একজন যুক্তিবাদী মানুষ বলে জানে।

-- ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝতে একবার বেস্পতিদিদির কাছে যাওয়া দরকার। কী বল?

মঙ্গল বলল -- ঠিক কথা। চলো, বেস্পতিদিদির কাছেই জেনে নিই।
 ***********

পলাশডাঙার দক্ষিণ প্রান্তে ছোট একটা খড়ের চালার ঘরে বেস্পতির বাস। ঘরের সামনে উঠোনে কয়েকটা মুরগি চরছে।সেখানে পৌঁছে মঙ্গলরা দেখল
 কয়েকজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে লক্ষণ সোরেন আগেই হাজির হয়েছে।

সুবলদের দেখে লক্ষণ একটু হেসে বলল -- ছিষ্টিকে ডাকতে তিনজন ছেলেকে বাবলাডাঙায় পাঠিয়েছি। এইসব লোকেদের জন্যেই আমাদের বদনাম হচ্ছে। দেখি ছিষ্টি এখন আসে কিনা।
 রোদ উঠলেও রাতে বৃষ্টি হওয়ার জন্য একটা ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বসার জন্য বেস্পতিদিদি দাওয়ায় চাটাই বিছিয়ে দিয়েছে। কয়েকজন সেখানে বসল। বাকীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছে। সকলের মুখে মাস্ক।
 সুবলই শুরু করল -- দিদি, ডর কোরো না। আমাদের সব খুলে বলো।

বেস্পতি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বিকৃত গলায় বলল -- কী-ই আর বুলবো, সি বড়া ঘিণ্ণার কথা। গুখেকোর ব্যাটা ঢেক দিন ধরে আমার দিকে খারাপ লজর দিছে। সেই সঙ্গে আমাদের উই দখিন মাঠের দ্যাড় বিঘে ভূঁইয়ের পানে শনির চুখে চেয়ে আছে ছিষ্টি।

এবার ছিষ্টির মতলব আর কারও বুঝতে অসুবিধা হল না। ছিষ্টির মেয়েছেলের দোষের কথা সকলেই জানে। এখন আসল রহস্যটা জানতে পেরে লক্ষণের মুখ রাগে থমথম করতে থাকল। গুম মেরে শজনে গাছের নিচে মাটির ঢিবির উপর গিয়ে বসল।

সুবল লক্ষণের কাছে গিয়ে বলল -- কি বলো লক্ষণদা, ছিষ্টি আসবে?

-- ছিষ্টি খুব ধড়িবাজ। মনে হয় না আসবে। ছেলেদের পাঠিয়েছি। দেখি ও কী বলে।

ঠিক সেই সময়ই লক্ষণের একটি ছেলেকে বাবলাডাঙার দিক থেকে রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে এদিকে আসতে দেখা গেল। ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে কাছে এসে দাঁড়াতে লক্ষণ তড়াক করে উঠে পড়ে বলল -- কী! কী হয়েছে রে রাজু?
রাজু তখনও হাঁপাচ্ছিল। কোনও রকমে বলল -- ছিষ্টি তো এলোই না, উল্টে দলবল নিয়ে ছোটন আর কার্তিককে আটক করেছে। আমি কোনও রকমে ছিটকে পালিয়ে এসেছি। তাও ওরা অনেক দূর পর্যন্ত আমার পিছু পিছু ধাওয়া করে এসেছিল।

লক্ষণ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভেবে নিয়ে  বেস্পতির দিকে ঘুরে বলল -- দিদি, চলো আমাদের সঙ্গে।

ভয়ে ভয়ে বেস্পতি জিজ্ঞাসা করল -- কুথা?

-- ভয় পেয়ো না, থানায়। আমরা সবাই তোমার সঙ্গে যাব। এর একটা হেস্থনেস্থ করেই ছাড়ব।

মঙ্গল দেখল লক্ষণের কথায় সুবল খুশি হয়েছে। মাথা নেড়ে লক্ষণকে বলল -- তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আমাদের থানাতেই যাওয়া উচিত। নাহলে ছিষ্টিকে বাগে আনা যাবে না।

***********
লক্ষণকে দেখে থানার বড়বাবু বললেন -- আরে লক্ষণবাবু যে! কী মনে করে?

মঙ্গল বুঝল থানায় লক্ষণের ভালোই প্রভাব আছে।

লক্ষণের মুখে বেস্পতি আর ছিষ্টি গুণিনের বৃত্তান্ত শুনে বড়বাবু ক্ষেপে উঠলেন। গাঁকগাঁক করে বললেন -- হারামজাদাটা আবার গোলমাল পাকিয়েছে! সেবার রেপ কেসে মেয়ের ইজ্জতের ভয়ে মা-বাপ কোনও কমপ্লেন না দিতে চাওয়ায় ব্যাটা খুব জোর বেঁচে গিয়েছিল। এবার শুয়োরের বাচ্চাটাকে উচিত শিক্ষা দেব। গুণিনগিরি ওর পিছন দিয়ে বের করে দেব।

লক্ষণ আবার বলল -- স্যার, বেস্পতিদিদির দিকে শুধু খারাপ নজর দেওয়াই নয়, একজন অসহায় বিধবার সামান্য চাষের জমিটাও ছিষ্টি গিলে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

এটা শুনে বড়বাবু রাগে গনগন করতে করতে হাতের মোটা লাঠিটা দেখিয়ে বললেন -- গেলাচ্ছি। এই নাদনখানাই এবার ওকে গেলাব।

তারপর থানার জুনিয়র ইন্সপেক্টরকে ডেকে বললেন -- সামন্তবাবু, ফোর্স নিয়ে একবার বাবলাডাঙা যান। ছিষ্টি গুণিন সেখানে এদের দু'জন লোককে আটকে রেখেছে। তাদের উদ্ধার করে ছিষ্টিকেও তুলে নিয়ে আসবেন। ব্যাটার পাপের ভারা বোঝাই হয়ে গেছে। এবার ওর একটু খাতির-যত্ন দরকার। লক্ষণবাবু, সামন্তবাবু না ফেরা পর্যন্ত আপনারা একটু অপেক্ষা করুন।
ঘন্টা দুয়েক পর সামন্তবাবু জিপ হাঁকিয়ে ছিষ্টি আর ছোটন ও কার্তিককে নিয়ে ফিরে এলেন। ছিষ্টিকে ঘাড়ে ধরে থানার ভিতর নিয়ে এলে বড়বাবু সপাটে ওর গালে একটা চড় কষিয়ে বললেন -- খুব পয়গম্বর হয়েছিস না? মেয়েছেলের দিকে নজর! বেস্পতিকে ডাইন বলে রটাচ্ছিস কি মতলবে? বল। নাহলে শালা
আজ তোকে গাছে ঝুলিয়ে পেটাব।

এবার ছিষ্টি হাউমাউ করে কেঁদে বড়বাবুর পায়ে পড়ে গেল। কঁকিয়ে উঠে বলল -- মিছে কথা ছ্যার,সব মিছে কথা। আমি কারুকে ডাইন-ফাইন বলি নাই। উরা আমাকে খামোখা ফাঁসাইছে।

বড়বাবু ওর গালে আর একটা থাপ্পড় কষিয়ে বললেন -- চোপ!একদম চোপ! তোকে ফাঁসাচ্ছে! এতগুলো লোক মিথ্যা বলছে! আর তুই ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। দেখ ছিষ্টি, তোর কীর্তিকলাপ আমরা সব জানি। সত্যি কথা যদি না বলিস, এমন কেস দেব যে সারাজীবন জেলের ঘানি টানবি। বল এবার তুই কি করবি?

ছিষ্টি এবার সটান শুয়ে পড়ে বড়বাবুর পা চেপে ধরল। ডুকরে উঠে বলল -- এমনটি করবেন না ছ্যার।বউ বাচ্চা নিয়ে ডাহা মরে যাব। ইবারের মতুন মাফ করে দ্যান ছ্যার। জেবনে আর কখুনও এমন কম্ম করব না।
 বড়বাবু ছিষ্টির হাত থেকে পা ছাড়িয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। ছিষ্টি তখনও ভেঙেচুরে বড়বাবুর পায়ের কাছে বসে। বড়বাবু এবার কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন -- তুই বেস্পতির জমি হড়পে নেওয়ার চেষ্টা করিসনি?

বড়বাবুর বাজখাঁই গলার আওয়াজে ছিষ্টি ভড়কে গেল। হাউমাউ করে বলল -- না বাবু। মা কালীর দিব্যি। বেস্পতিকে আমি শুধু শুধিয়েছিলাম উ আমাকে জমিটো বেচবে কিনা। ব্যাস। ইয়ার বেশি কুনোও কথা হয় নাই।

-- হ্যাঁ রে ধম্মপুত্তুর, আর মাঝ মাঠে তুই বেস্পতিকে কুপ্রস্তাব দিসনি? সামন্তবাবু, ঢোকান তো ব্যাটাকে লক আপে। আর গুপী সর্দারকে ডাকুন ওর সেবাযত্ন করার জন্যে।
 গুপী সর্দারের নাম শুনে ছিষ্টি থরথর করে কেঁপে উঠল। তারপর আবার বড়বাবুর পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল -- আপনার পায়ে পড়ি হুজুর, গুপীর হাতে আমারে দেবেন না। একদম জ্যান্তে মরে যাব।

গলার স্বর পালটে এবার বড়বাবু বললেন -- বেশ, তাহলে তোর ক'জন শাগরেদ আছে বল। সব নাম বলবি। নইলে --

-- বলছি বাবু, বলছি। কুছু লুকোছাপা করব না।

-- সামন্তবাবু, নামগুলো নোট করে নিন। সবকটাকে ধরে আনবেন। ওদেরও একটু ওষুধ দেওয়ার দরকার। তাহলে ধম্মপুত্তুর, এবার বল লক্ষণবাবুর ছেলেদের আটকে রেখেছিলি কেন?
-- বডা ভুল হয়ে গেছে হুজুর। এমুন আর কখুনও হবে না। এই কান মলছি। এই নাক খত দিছি।

বলে ছিষ্টি সত্যি সত্যি নাক খত দিতে শুরু করে।

এক ধমক দিয়ে বড়বাবু ছিষ্টিকে থামিয়ে দিয়ে বলেন -- থাম, থাম বলছি। অনেক নাটক করেছিস।  গুণিনগিরি করে তোর এত বিষয় সম্পত্তি কী করে হল বল? তোর সব খবর আছে আমার কাছে। কাদের কত সম্পত্তি হড়পেছিস সব খুলে বল।
 --বলছি বাবু, সব বলছি।

শুধু বললেই হবে না। সব লিখে
সই করে দিবি। কী---- তুই সই করতে পারিস তো?

-- না বাবু, টিপসই।

-- তাহলে টিপই দিবি। আর এরা সকলে সাক্ষী থাকবে। পরে কথা পালটালে তোর কী অবস্থা হবে বুঝেছিস?

এরপর লক্ষণের দিকে ঘুরে বললেন -- তাহলে লক্ষণবাবু, এই হতচ্ছাড়াটাকে নিয়ে কী করা যায় বলুন তো?

লক্ষণকে চিন্তা করতে দেখে ওর কাছে গিয়ে মঙ্গল বলল -- লক্ষণদা, ছিষ্টি আর কোনও দিন গুণিনের কাজ করবে না এই মর্মে ওর কাছে একটা মুচলেকা নিয়ে নিলে কেমন হয়?
 শুনে সুবল কথাটা লুফে নিল। বলল -- মঙ্গল খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছে। এই মুচলেকা আমাদের হাতে থাকলে ছিষ্টি আর কোনও দিন গুণিনগিরি করতে সাহস পাবে না। আমরা ওর জবানিটা জেরক্স করে গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে পারব।

ওদের সঙ্গে একমত হয়ে লক্ষণ  বড়বাবুকে বলল -- স্যার, আইনত আপনি ওর বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিন। এ ব্যাপারে আমরা আর কী বলব। আমরা ওর একটা মুচলেকা চাই যাতে ভবিষ্যতে আর লোক ঠকাতে না পারে। মুচলেকার একটা কপি থানাতেও থাকবে।

বড়বাবু বললেন -- ভালো, খুব ভালো। এটাই ওর উপযুক্ত শাস্তি হবে। আর এই কেসে তো ওকে বেশি দিন আটকে রাখা যাবে না। শিগগিরই জামিনে ছাড়া পেয়ে যাবে। ভালো করে একটা বয়ান তৈরী করুন। আপনারা সকলে সাক্ষী থাকবেন। হারামজাদার টিপছাপের ব্যবস্থা আমি করছি।

***********
 লক্ষণ, সুবল, মঙ্গল আর বেস্পতিরা থানা থেকে বেরিয়ে এল, বেলা পড়ে আসছে। সূর্য পশ্চিম মুখো। ঢলে পড়তে আর দেরি নেই। দক্ষিণ দিক থেকে কালো মেঘের আনাগোনা আবার শুরু হয়েছে।

ছিষ্টির মুচলেকার বেশ কয়েকটা কপি করা হয়েছে। সবকটাতেই সাক্ষীদের সই আর ছিষ্টির টিপছাপ আছে। এবার আদিবাসী গাঁওতা এই মুচলেকাটা জেরক্স করে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেবে। বলবে সাবধান, ছিষ্টিরা দূর হটো।

 

0 Comments

Post Comment