পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

একজন ধর্ষিতা অভিযোগ জানানোর সময়ে আবারও ধর্ষিতা হন

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 202 view(s)
  • লিখেছেন : অরুন্ধতী দাশ
এ দেশে মেয়েরা অভিযোগ জানাবার সময় দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হয়। এ আমার কথা নয়, বিচারপ্রক্রিয়ার সাহায্য চাইতে আসা জিয়ন্তে-মরা মেয়েদেরই ভাষ্য। পরিসংখ্যান বলছে, এ দেশে মাত্র কুড়ি শতাংশ ধর্ষণের অভিযোগ আইনি পদ্ধতিতে দাখিল হয়, দুই-তৃতীয়াংশ ধর্ষণের ঘটনায় নিগৃহীতা সারাজীবনে হয়তো একজনের কাছে মুখ খোলেন, আর বাকি অন্ধকার জুড়ে থাকে অবিচ্ছিন্ন স্তব্ধতা।

ঠিক এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। কর্মসূত্রে যে কলেজটিতে পড়াই, যাতায়াতের পথে একটা বড়ো পাইকারি বাজার পেরিয়ে যাই রোজ। যখন ফিরি, সারা সকালের ডাকহাঁক, ভিড়ভাট্টা, ঠেলাঠেলি, দরাদরি তখন অনেকটাই শান্ত হয়ে আসে পড়ন্ত বিকেলের তেরচা আলোয়। স্তূপীকৃত সবজির খোসা, পচা টমেটো, ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা মাছের আঁশ ছাড়া ফুটপাতের দোকানগুলোর সামনেটা তখন জলছড়া পড়ে, ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করা বিকেলের বাজারে চট পেতে বেসাতি নিয়ে বসতে থাকে ছোটো ছোটো অস্থায়ী দোকান। সেদিনও আলগোছে পথের দিকে চোখ রেখে গাড়ির জানলায় মাথাটা হেলিয়ে দিয়েছি অভ্যাসবশে, হঠাৎ শিরদাঁড়া সোজা করতে বাধ্য হলাম, কারণ যে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল পিঠ জুড়ে, তাকে সামলানোর অন্য কোনো শারীরিক প্রতিক্রিয়া গাড়ির ওই ঘুপচি পরিসরে সম্ভব ছিল না। স্পষ্ট দেখলাম, পথের পাশে বসে আছে একটি মেয়ে, জামাকাপড় অবিন্যস্ত, বসে থাকার ভঙ্গি থেকে মনে হল মানসিক প্রতিবন্ধী। কাঁধের দিক থেকে জামা ঝুলে পড়ে নেমে এসেছে হাতের কাছাকাছি আর উলটো দিকের ফুটপাত থেকে দাঁড়িয়ে তার দিকে ক্যামেরা তাক করে আছে দুটি ছেলে। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে উঠতেই সিগনালহীন রাস্তায় গাড়ি ছুটে এল অনেকখানি পথ, আর আমার মাথাটায় যেন পেরেক গেঁথে দিল কেউ। হাতে হাতে ক্যামেরা আর দৃশ্যবন্দি করার এই ফাঁদ এড়িয়ে আমাদের ঠাঁই কোথায়?

কসবা ল কলেজের এই ভয়াবহ ধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে যখন আমাদের মিডিয়া তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রতিটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝে যাচ্ছি, এগুলো কোনোটাই ‘বিচ্ছিন্ন’ নয়। আর জি কর কাণ্ড, আইআইএম ইন্সটিটিউট কিংবা কসবা ল কলেজ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন ধরে অপরাধীদের হাত শক্ত করা হয়েছে। একটু একটু করে তারা শক্তি সংগ্রহ করেছে, দিনের পর দিন ধরে অপরাধের ঘুঁটি সাজিয়েছে, একাধিকবার আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রভাবশালী মুলো পুলিশের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অথচ, প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটার পর একদল স্বঘোষিত মিডিয়া গোয়েন্দা ধর্ষকের অপরাধের ইতিহাসের চাইতে অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে পড়ছেন ধর্ষিতার প্রেক্ষাপট আর পরিচয় খুঁজে বের করার দিকে। বাংলার একটি একেবারে প্রথম সারির একটি নিউজ চ্যানেল কসবা ল কলেজের ধর্ষণ দৃশ্যের ব্লারড ভিডিও চালিয়ে খবর সম্প্রচার শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। ব্লারড হলেও, তাতে নির্যাতিতার দৈহিক অবয়ব বোঝা যাচ্ছে, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে মেয়েটির গলা। ফলে, লক্ষ লক্ষ ভিউ সেই ভিডিওতে। ঠিক এটাই তো চেয়েছিলেন ওই মিডিয়ার কর্তৃপক্ষ! সবচেয়ে বড়ো কথা, তদন্তাধীন কেসের এই ভিডিও, যা যৌনতার নিরিখেও এতটাই স্পর্শকাতর, তা এইভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারছে কী করে, যদি না তদন্তের দায় যাঁদের, তাঁরাই এ ভিডিও জঘন্য মতলবে ছড়িয়ে দিয়ে না থাকেন? এর আগে অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিকের লিঙ্গনির্ধারণ কেসের ভিডিও-ও একইভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র।

অনেকদিন আগে আমার নিজের অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম একবার, একটি নারীদেহের ময়নাতদন্তের ভিডিও লোকে পর্নোগ্রাফির মতো হামলে পড়ে দেখছে, এ দৃশ্য চোখে পড়ে গিয়েছিল তার। অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তারপর। বলা বাহুল্য, সে ভিডিও বেরিয়ে পড়েছে মেডিক্যাল এথিক্সের শপথবাক্য পাঠ করে কাজে নামা মুখোশ-আঁটা জানোয়ারদের হাত দিয়েই। আর জি কর কাণ্ডের সময়েও মিডিয়াজগতের কেউ কেউ স্বতঃপ্রণোদিত খুল-এ-আম তদন্তসভার খাপ বসিয়েছিলেন সোশাল মিডিয়ায়, আর যাবতীয় শারীরিক তথ্য মুদিখানার খাতার মতো করে লিখে রাখছিলেন নিজেদের দেয়ালে, পস্থুমাস ডিগনিটির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই। প্রত্যেকদিন তাঁদের সোশাল মিডিয়া পেজে ফলাও করে লেখা থাকছিল নিগৃহীতার যোনির ওজন, স্তনের গায়ে আঁচড়ের সংখ্যা, আর যোনি থেকে প্রাপ্ত তরলের নমুনা নিয়ে সেই কুৎসিত বিতর্ক। শিউরে উঠেছি, ভেবেছি নিগৃহীতার বাবার কথা, মায়ের কথা, যাঁদের পাড়া-বেপাড়া জুড়ে সর্বত্র তাঁদের মেয়ের টুকরো টুকরো শরীরের ধারাবিবরণী আলোচিত হচ্ছে, যেন সে আস্ত একটা মানুষ ছিলই না কোনোদিন! এই ভয়াবহ স্বেচ্ছাতদন্তের ধ্বজাধারীদের অবশ্য কঠিন লক্ষ্য, তাঁদের মুখের মাংসপেশি এতটুকু শিথিল হয় না এইসব ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃত অর্ধমৃত নারীশরীরের চর্চা করতে। তাঁদের যুক্তি, অপরাধ সম্পর্কে জনসচেতনতা প্রয়োজন, সেই তথ্যের অধিকার রয়েছে আমজনতার।

এখন প্রশ্ন হল কীসের অধিকার? কীসের তথ্য? নিজের কর্মস্থলের মধ্যে বসে যাঁরা লাঞ্চ ব্রেকের অবসরে সহকর্মিণীদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু আমিষ রসিকতা চালাচালি করে নেন, সহকর্মিণীর পদোন্নতির খবর পেলে উচ্চপদস্থ কোন্‌ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর কী রসায়ন তার চুলচেরা বিশ্লেষণ বসান, সদ্যবিবাহিতা সহকর্মিণীদের শারীরিক পরিবর্তন খুঁটিয়ে লক্ষ করে কুমন্তব্যের স্রোত বইয়ে দিয়ে শিয়ালসভায় হাততালি কুড়োন, তাঁদের কাছে এইসব তথ্য ঠিক কোন্‌ খোরাক নিয়ে আসে, নেহাৎ চোখ বুজে না থাকতে চাইলে তা তো আমাদের না বোঝার কথা ছিল না! বানরের হাতের তরবারির মতো এইসব অনিয়ন্ত্রিত তথ্য মুহূর্তে তথ্যবিস্ফারের দুনিয়ায় ঠিক কোন্‌ উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, গড়িয়ে পড়ছে লোভী জিভ দিয়ে চাটা ঠোঁটের কিনার বেয়ে, তা কি আমাদের অজানা ছিল? তথ্যের অধিকার কথাটা শুনতে গণতান্ত্রিক, কিন্তু সেই গণতন্ত্র উপযুক্ত ক্ষেত্রে সংবেদনশীলভাবে প্রয়োগের ন্যূনতম শিক্ষা কি আমাদের আছে?

এ দেশে মেয়েরা অভিযোগ জানাবার সময় দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হয়। এ আমার কথা নয়, বিচারপ্রক্রিয়ার সাহায্য চাইতে আসা জিয়ন্তে-মরা মেয়েদেরই ভাষ্য। পরিসংখ্যান বলছে, এ দেশে মাত্র কুড়ি শতাংশ ধর্ষণের অভিযোগ আইনি পদ্ধতিতে দাখিল হয়, দুই-তৃতীয়াংশ ধর্ষণের ঘটনায় নিগৃহীতা সারাজীবনে হয়তো একজনের কাছে মুখ খোলেন, আর বাকি অন্ধকার জুড়ে থাকে অবিচ্ছিন্ন স্তব্ধতা। ধর্ষণের অভিযোগ জানানোর পরবর্তী যে তদন্ত প্রক্রিয়া, তার জের শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারেন মাত্র দুই শতাংশ নিগৃহীতা। কারণ, এই তদন্ত প্রক্রিয়ার পরতে পরতে যে ভয়ানক আত্মবিশ্বাস চুরমার করে দেওয়া প্রশ্ন আর পদক্ষেপের সামনে পড়তে হয় মেয়েদের, তার অভিঘাত সামলাতে না পেরেই সারাজীবনের জন্য ট্রমা আচ্ছন্ন করে ফেলে তাঁদের। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বহুদিন হল এই ফরমান জানিয়ে দিয়েছে যে, যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে শুধু স্পর্শ নয়, যৌন ইঙ্গিত, যৌন আলোচনা, বলপূর্বক পর্ন ভিডিও দেখানো, এমনকি অস্বস্তিকরভাবে দৃষ্টিপাতকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এমনকি, সরাসরি ধর্ষণ, বা ‘পেনাইল পেনিট্রেটিভ রেপ’-এর ক্ষেত্রেও শারীরিক সংঘর্ষ বা ক্ষতের নমুনা থাকা বাধ্যতামূলক নয়, বিশেষত বেশিরভাগ সময় নির্যাতিতা নিজেই নিজের শরীর এবং জামাকাপড় থেকে নমুনা পরিষ্কার করে ফেলেন। এর পরেও, ‘মেডিক্যাল টেস্ট’ নামক যে আর-একটি শরীর নিংড়োনো অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে অভিযোগকারিণীকে যেতে হয় অভিযোগ জানানোর ঠিক পরপরই, সেখানে শারীরিক বলপ্রয়োগের নজির না পাওয়াটা কোনোভাবেই ধর্ষণ হওয়া বা না-হওয়ার অকাট্য প্রমাণ যে হতে পারে না, পরীক্ষক ডাক্তারদের একটা বড়ো অংশও সেকথা মনে রাখছেন না। তাঁরা পরীক্ষার ভিত্তিতে ‘নমুনা পাওয়া যায়নি’টুকু না বলে, আরও দু-পা এগিয়ে ‘ধর্ষণ হয়নি’ বলে রিপোর্ট জমা করছেন। শারীরিক তথ্যের ভিত্তিতে ধর্ষণের প্রমাণ-অপ্রমাণ যেখানে সমুদ্রের ওপরের ফেনাটুকু মাত্র, সেখানে এই প্রচণ্ড ব্যক্তিগত শরীরী তথ্য এই হিংস্র জনসমুদ্রের মুখে মাংসখণ্ডের মতো ছুঁড়ে দিয়ে আজ যাঁদের ‘রিচ’ ফুলেফেঁপে উঠছে, মেয়েশরীরের গন্ধে ভিড় করে-আসা শ্বাপদসংকুল এই জনারণ্যে তাদের আমদানি করে-আনা প্রতিটি তথ্য আসলে এক-একটি মুখরোচক ফাঁদ। একদল খেলিয়ে খেলিয়ে এই শিকার তুলছে নিজের ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য, আর অন্যদল গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে এই ‘সংবেদনশীল’ তথ্য। গলায় বঁড়শির মতো শুধু আটকে থাকছে নির্যাতিতার জবানবন্দি। গেলা আর উগরোনোর মাঝখানে এই টোপের মুখে ঝুলে থাকছে আরও কয়েকশো মেয়ের বন্ধ হয়ে যাওয়া মুখ। মুখ খোলার নজির যেখানে এমন ভয়াবহ হতে পারে, সেখানে আর কতবার তারা শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে?

0 Comments

Post Comment