পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ওস্তাদ জাকির হোসেন এবং একটা দিন

  • 21 December, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 473 view(s)
  • লিখেছেন : অভিজিৎ কর গুপ্ত
আমরা সব মোহাবিষ্ট হয়ে শুনে চলেছি, বুঝি না কিছুই, তবু ঘাড়ও নাড়ছি মাঝে মাঝে, তালে তালে। জাকির তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মাঝেমধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে পাশে বসে থাকা আমাদের সাথে যেন কমিউনিকেট করছেন, আমরা এপ্রিসিয়েট করছি কিনা তা যেন বুঝতে চাইছেন। কী অনন্যসাধারণ এক অভিজ্ঞতা তা বলে বোঝানো যাবে না! জাকির হোসেনকে সামনাসামনি শোনার অভিজ্ঞতা তো এইরকমই হওয়ার কথা।

তখন মাদ্রাজ সবে চেন্নাই হয়েছে। ওখানে একটা রিসার্চ ইন্সটিটিউটে পোষ্টডক্টরাল কাজ করছি সেসময়। হঠাৎ পয়লা জানুয়ারি এসে গেলো! ঠান্ডার ছিটেফোঁটা নেই। খবর পেলাম, আজ সেখানকার মিউজিক একাডেমি হলে বিকেলের দিকে জাকির হোসেন-এর প্রোগ্রাম। কিসব নাচগানের অনুষ্ঠান আছে। তারপর, ওস্তাদ জাকির হোসেন নাকি বাজাবেন ওখানকার ভায়োলিন ব্রাদার্স-এর সাথে। টিকিট কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, কোনো আমন্ত্রণ পত্র যোগাড় করা যায় কিনা, ইত্যাদি কিছুরই ঠিক নেই। আমরা (আমি আর মাধুরি) আর কিছু রিসার্চ স্কলার, পোষ্টডক মিলে ঠিক করলাম, হলে গিয়ে একবার হাজির তো হই, তারপর দেখা যাবে। যদি ভাগ্যে কিছু জোটে।

আমাদের টীমে ছিলো নিউইয়র্ক থেকে অঙ্কে পোষ্টডক করতে আসা টিম জেনড্রন। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকতো সে। টিম ভারি মজার মানুষ, মাঝে মাঝে একটু গোলমালের। চেন্নাইতে এসেই লুঙ্গি পরতে শুরু করলো, এদিকে পায়ে হান্টার স্যু। বিশাল চেহারা, পুরোদস্তুর এক রকস্টার যেন। আসলে সে নিজেও একটা গীটার নিয়ে রাতদিন ট্যাঙ ট্যাঙ করতো। কানের মাথা খেত! ওর কিছু বন্ধুরাও নাকি আমেরিকা বা পৃথিবীর এদিক ওদিক বসে এরকমই ট্যাঙ ট্যাঙ, টিং টিং, ঢিস ঢিস করতো। তারপর একদিন সব মিলিয়ে টিলিয়ে একটা মিউজিক কম্পোজ হলো। সেটা শুনতে অবশ্য খারাপ লাগে নি। টিম জোর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুনিয়েছিলো। টিম কুমার আবার রাস্তার কুকুরদের ডেকে নিয়ে এসে নিয়মিত খাওয়াতো। তাদেরকে খুব সম্মান করতো। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ওর নিজের খাবার থালায় চিকেন-সাম্বার-রসম দিয়ে ভাত মেখে কুকুরকে খাওয়াচ্ছে আবার তারপর অবশিষ্ট খাবার সহ সিরামিক্সের প্লেট-টা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখছে পরের দিনের জন্য। টিমকে অনেক সময়েই দেখা যেত, ডিসেম্বরের প্রবল বৃষ্টির পর যখন হাই ড্রেন দিয়ে কলকল করে জল যাচ্ছে, সেখানে নিবিষ্ট চিত্তে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে। বলেছিলো, সাপ দেখছে, ধরতে চায় সে। একদিন, আই আই টি-র কাছে স্নেক পার্কে হাজির হলো, বড় কোনো সাপ পোষার বাসনা নিয়ে। ওদের কাছে সাপ চাইতে গিয়েছিলো। ওরা অবশ্য পত্রপাঠ বিদায় করেছিলো টিম-কে। টিম দমে যায় নি। বোধহয় তারপর থেকেই ভবঘুরের মতো নিজেই সাপ ধরার প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলো।

সেদিন টিমকে বলতেই রাজি হয়ে গেল। অনুষ্ঠান শুরুর কিছুটা আগে টিম সহ আমাদের টীম পৌঁছে গেল স্পটে। ভিতরে ঢুকে দেখলাম, একটা বড় টেবিল নিয়ে কিছু লোক বসে আছে। চারদিকে অনেক বয়স্ক, জ্ঞানীগুণী তিলক কাটা মানুষদের ভিড়। বোঝাই যাচ্ছিলো, এঁরা সব ক্লাসিক্যাল মিউজিকের একেবারে খোদ লোক। হলের ভিতরে তখন কিছু একটা প্রোগ্রাম চলছে। বোধহয় কোন একাডেমির বাৎসরিক পুরষ্কার বিতরণের অনুষ্ঠান আর শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স।

টেবিলের কাউন্টারে গিয়ে কর্তাব্যক্তি মার্কা একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, জাকির হোসেন-এর প্রোগ্রামের কোন টিকিট বা কার্ড পাওয়া যাবে কিনা। মানুষটি দু:খের সাথে ঘাড় সুইং করে জানালেন, 'টিকিট ইল্লা'! টিকিট নেই (আশাই বা করি কী করে!)। কী আর করা! তবু হাল ছাড়লাম না আমরা। কাউন্টারের আসেপাশে মুখ চুন করে সবাই ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। খানিক পরে, সেই লোকটি হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলেন। কোথা থেকে আসছি ইত্যাদি জেনে নিলেন। তারপর খুব ইতস্তত করে আমাকে বোঝালেন, অডিটোরিয়াম তো ফুল, তাই কিছু করা যাবে না। কিন্তু তাঁরা আমাদের এরকম কিছু উৎসাহী লোকেদের জন্য মঞ্চের উপর একটা কোনরকম ব্যবস্থা করতে পারেন। মঞ্চের এখনকার অনুষ্ঠান শেষ হলে, জাকির আর অন্য শিল্পীরা ঢুকবেন। তাঁদের বসার জন্য বেশি জায়গা লাগবে না। তার পাশে একদিকে মঞ্চের একপাশে আমরা যদি কোনমতে আসন করে বসতে পারি, তাহলে সম্ভব। এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার! কিন্তু, তাঁরা সংগঠনের পক্ষ থেকে একপ্রকার যেন ক্ষমাই চেয়ে নিলেন। কারণ, আমাদেরকে যে কষ্ট করে মঞ্চের ফ্লোরে বসতে হবে! দশ টাকা করে টোকেন টিকিট ইস্যু করলেন তাঁরা। আমরা তখন যেন স্বর্গে পৌঁছানোর অপেক্ষায়।

টিম কে ফান্ডা দিচ্ছিলাম, জাকির হোসেন, তাঁর মিউজিক এবং ক্যারিসমা কী এবং কেন ইত্যাদি। মনে আছে, একদিক দিয়ে উঠে গ্রীনরুমে ঢোকার সিঁড়ি দিয়ে উঠে মঞ্চের ডানদিকের পর্দার পাশে আমাদেরকে চুপ করে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। মঞ্চের এই পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হলেই স্টেজের সামনের পর্দা পড়বে। তারপর জাকির এবং অন্য শিল্পীরা ঢুকবেন। তারপর আমরা বাইরে জুতো খুলে চুপ করে গিয়ে পাশে বসে পড়ব। অধীর অপেক্ষা। উত্তেজনা তখন তুঙ্গে! পর্দার এপাশ থেকে একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম নীচের এবং উপরের ব্যালকনি প্রায় ভর্তি। আরো কিছু মানুষ ঢুকছেন, ক্যামেরা ঢুকছে, নানান সেটিং হচ্ছে, আরো কত কী!

এরপর, একসময়... ওই তো ঝাঁকড়া চুল জাকির হোসেন দুটো তবলার প্যাক হাতে করে আমাদের পাশ দিয়েই হাসিহাসি মুখে মঞ্চে প্রবেশ করছেন। আমাদের দিকে যেন একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাসলেনও। সাথে অবশ্যই ভায়োলিন ব্রাদার্স-এর দুই ভাই বেহালা হাতে। মঞ্চের একটা জায়গা জুড়ে তাঁরা বসবেন। আশ্চর্য! জাকির উদ্যোক্তাদের যেন নির্দেশ দিলেন, ভায়োলিন ভায়েরা বসবে মঞ্চের ঠিক মাঝখানে আর তিনি এদিকটায় বসবেন, পাশে, সঙ্গত করতে।

সেটিং হতে থাকলো। এবার সব রেডি। ওস্তাদ জাকির হোসেন এবং অন্য শিল্পীরা, উদ্যোক্তারা আর আমরা, এদিকে মঞ্চে। আসন করে চুপ করে বসেছি সবাই। পর্দা উঠলো। বিপুল হাততালিতে ফেটে পড়ল হল। জাকির এবং শিল্পীরা দর্শকদের অভিবাদন করলেন হাত জোড় করে। সব স্টিল ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা জাকির-দের দিকে। পাশ থেকে আমরাও হয়ত ছবিতে উঠে যাচ্ছি। কী কান্ড!

শুরু হলো এক অসাধারণ মিউজিক্যাল জার্নি। আমরা সব মোহাবিষ্ট হয়ে শুনে চলেছি, বুঝি না কিছুই, তবু ঘাড়ও নাড়ছি মাঝে মাঝে, তালে তালে। জাকির তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মাঝেমধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে পাশে বসে থাকা আমাদের সাথে যেন কমিউনিকেট করছেন, আমরা এপ্রিসিয়েট করছি কিনা তা যেন বুঝতে চাইছেন। কী অনন্যসাধারণ এক অভিজ্ঞতা তা বলে বোঝানো যাবে না!

মাঝে, টিম অনেক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎ যেন পা টান দিতে চাইল। তার লম্বা পা দুটো মেলে দিলো জাকির-এর দিকটায়। কী কান্ড! ও তো আর এসব বোঝে না। সেদিকে আমার চোখ যেতেই, তাকে কানে কানে বলে বোঝালাম। পা গুটিয়ে নিলো। সময় যেন সঙ্গীতের তালে তালেই চলছিলো। হঠাৎ দেখি ভিডিও আর স্টিল ক্যামেরার ঝাঁক স্টেজের দিক থেকে আমাদের দিকটায় স্টেজের লাগোয়া দর্শক আসনের প্রথম সারিতে বসা একটা লোকের দিকে ঘুরে গেলো। কে বেশ একজন টাক মাথা লোক, অল্প খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তাকেই ঘিরে ধরছিলো সবাই। লোকটা কে বেশ, কে বেশ! মনে করার চেষ্টা করছিলাম। মাথায় আসছিলো না। হয়ত মিউজিক সব গুলিয়ে দিয়েছিল।

জাকিরের বাজনা চলছে। তিনি শুনছেন। আমরাও মোহিত হয়ে আছি। ক্যামেরাগুলো আবার এদিকে ঘুরলো। পরে মাথায় এলো, আরে উনি তো সেই রজনীকান্ত (Rajanikant)! আহা! তামিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আর সঙ্গীত জগতের কত তারকাই যে এসেছিলেন সেদিন। সামনের কয়েকটা সারিতে তাঁরা বসে আছেন, আর আমরা স্টেজ থেকে দেখতে পাচ্ছি তাঁদের। আর এদিকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে ওস্তাদ জাকির হোসেন! চিরস্মরণীয় একটা দিন!

ওস্তাদ জাকির হোসেনের মিউজিক, তাঁর স্টাইল, তাঁর ক্যারিসমা সম্পর্কে প্রচলিত কিছু কথা যা সবাই বলতে ভালোবাসে এবং জানে, তা হয়ত আমিও জানি। এর বেশি কিছু না। আমি সঙ্গীত সেভাবে বুঝি না। শুধু শুনতে থাকি। শুনতে শুনতে কান তৈরি করার চেষ্টা করি, ভালোলাগা তৈরি করি। তবে, যে কারণে একজন মানুষ আমাদের হৃদয়ে থেকে যান, যাঁকে দেখলে আমরা আপ্লুত হয়ে পড়ি, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আমাদের, তা হল সেই মানুষটার সততা, তাঁর মনের  গভীরতা। জাকির এমনই একজন মানুষ ছিলেন। দেশে বিদেশে সঙ্গীতের জগতে তাঁর অবাধ বিচরণ, পন্ডিত রবিশঙ্করের মতো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটানোর ব্যাপারে তাঁর যা অবদান তা তো অসামান্য। তবে, এই মানুষটি যখন তাঁর জগতের অন্য শিল্পীদের সাথে কথা বলেন, মঞ্চে বসে যুগলবন্দী করেন, মিউজিক দিয়ে বা কথা দিয়ে কমিউনিকেট করেন তখন তা যেন এক বহতা নদীর মতো হয়ে ওঠে। আমি তাঁর কিছু বক্তব্য শুনেছি মন দিয়ে। তিনি বলছেন কি করে একজন সার্থক শিক্ষক হয়ে উঠতে হয়, কিভাবে জ্ঞান ও শিল্পের পরম্পরা তৈরি করতে হয়। একেবারে অন্য ভাবনা। নতুন এক দর্শন যেন।  আমাদের ভাবনার স্তরগুলোকেই যেন ওলটপালট করে দেয় তা। তিনি বলছেন, "A teacher never teaches. The student learns. Student must inspire teacher to teach." আমি নিজে একজন শিক্ষক হয়ে বলতে পারি, কজন মানুষ আর এভাবে ভাবতে পারেন!

মঞ্জুল ভার্গভ-এর নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অঙ্কের অধ্যাপক, ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ফিল্ডস মেডালিস্ট ওস্তাদ জাকির হোসেনের কাছে তবলায় তালিম নিয়েছিলেন একসময়। মঞ্জুল মনে করেন, জাকির একজন অসামান্য শিল্পী এবং অনুপ্রেরণাদায়ী শিক্ষক। সঙ্গীত শিক্ষা, তবলার তাল ও লয় এবং গুরুর জীবন দর্শন শিষ্য মঞ্জুল-কে অবশ্যই গণিতের সমুদ্রের ভিতর থেকে মণিমাণিক্য তুলে আনতে অনুপ্রাণিত করে।

একজন সার্থক শিল্পীর সমস্ত শিল্পকর্ম এক গভীর জীবনদর্শন হয়েই তো শেষপর্যন্ত থেকে যায়!

0 Comments

Post Comment