পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

উদ্বাস্তু

  • 04 February, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 465 view(s)
  • লিখেছেন : কাকলি দেবনাথ
লাল টাই আর ধবধবে সাদা ইউনিফর্ম পরে তিন্নি দাদুর সামনে এসে দাঁড়াল । ‘দাদু ,এই দেখ আমার নতুন ড্রেস।’ এখন সকাল আটটা । তিন্নি এখানকার নামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। এ বছর ক্লাস ফাইভে উঠল । প্রত্যেক বছর নতুন ক্লাসে উঠলেই তিন্নিকে দু সেট ইউনিফর্ম বানিয়ে দেওয়া হয়। পুরোনোগুলো ভালো থাকলেও বাতিল হয়ে যায় ।

ব্যালকনির পাশে  বেড়ে ওঠা কচি সবুজ পাম গাছটা থেকে পিছলে পড়ছে সোনালি আলোর ঝরনা । ডাক্তারের পরামর্শ মত রোজ   এই  ঝরনায় স্নান করেন  সুবর্ন রায়। সকালের  রোদে নাকি ভিটামিন ‘ডি’ থাকে । ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়েন। নাতনির কথায় মুখ তুলে তাকালেন। ডল পুতুলের মত দু হাতে স্কার্টের দু কোণা ধরে ঘুরে ঘুরে তিন্নি বলল, ‘কি গো, বললে না তো আমায় কেমন দেখাচ্ছে ? ’সুবর্ন রায় দুচোখ ভরে নাতনিকে দেখছেন । ফুলো ফুলো গাল ,টকটকে ফরসা গায়ের রঙ । মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল । বিদেশী সিনেমায় দেখা  বাচ্চাদের মত  সুন্দর দেখতে তিন্নি।
‘ চুপ করে আছ কেন? ’
সুবর্ন রায় একটু হাসলেন । সেই হাসির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল ভালোবাসা ,অহংকার ,আর অতীতের দুঃখভরা ইতিহাসের খানিকটা আভাস ।
বাড়ির বড় গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলে । কিছুদিন আগে কেনা দুধ সাদা গাড়িটার দিকে তাকিয়ে গর্বে বুকটা ভরে উঠল সুবর্ন রায়ের ।
তিন্নির মা তিন্নিকে চামচে করে একটু দই খাইয়ে  দিল । কাজের মেয়েটি তিন্নির বইয়ের ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দিল । তিন্নি গাড়ির ভেতর থেকে দাদুকে ,মাকে , “টা টা ” বলতেই  মোড়ামের রাস্তার ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে চলল গাড়িটা ।  শুধু ধুলো তো নয় ,তার সঙ্গে সারা পাড়া জুড়ে উড়তে থাকল সুবর্ন রায়ের সফলতার সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম রেনু ।
নাতনিকে “টা টা ” জানিয়ে নিজের ঘরে এসে আরাম কেদারায় বসলেন সুবর্ণ রায় । মনের মধ্যে এক গভীর প্রশান্তি । বুকের অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসা এক স্বস্তির  নিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল  ঘরের প্রতিটি কোণায় । রায় মশাই আরাম কেদারায় চোখ বুজে পাড়ি দিলেন অতীতের গহ্বরে । পাকদন্ডী বেয়ে বেয়ে নামতে থাকলেন । সব কিছু আজও কেমন জ্বলজ্বল করছে । রাতের অন্ধকার । সামনে মাথায়  টিনের ট্রাঙ্ক নিয়ে  দ্রুত অথচ সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে  বাবা । পিছনে বোনের হাত ধরে মা । কাঁচা মাটির রাস্তা । বর্ষার জলে পিচ্ছল । বারবার পিছলে পড়ছে বোন। সবার পিছনে একটা বড় বোঁচকা মাথায় নিয়ে এক তরুণ । জানে না কোথায় চলেছে । শুধু জানে পালাতে হবে । না হলেই মৃত্যু ।

সুবর্ণ রায়ের ছেলে  সৌর ঘরে ঢুকে বাবাকে দেখল । কেমন অসহায়ের মত শুয়ে আছে্ন মানুষটা । সেদিনের সেই অপমানের পর থেকে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছেন । তিন্নি ছাড়া কারো সাথে মন খুলে কথাও বলেন না ।  
‘বাবা ? ঘুমোচ্ছো ? ’
ছেলের ডাকে ঘোর লাগা চোখ মেলে তাকালেন সুবর্ণ রায় ।
 ‘অসময়ে ঘুমোচ্ছো ? শরীর ঠিক আছে তো ? ’
‘হ্যাঁরে ,সব ঠিক আছে ’বলে  উঠে বসলেন । ‘ তুই তিন্নিকে স্কুলে পৌঁছে এত তাড়াতাড়ি চলে এলি ? ’
‘আরে দশ মিনিটের তো রাস্তা । গেলাম আর চলে এলাম ।’তারপর একটু থেমে গলাটা খাদে নামিয়ে  সৌর বলল, ‘বাবা ,মনে আছে তো ? কাল কিন্তু কোর্টের ডেট  । তোমায় যেতে
হবে ।’
সুবর্ণ রায় ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে গভীর শ্বাস ফেলে বললেন,  ‘মনে নেই আবার ? কবে যে এই অশান্তি মিটবে ?এই শারিরীক মানসিক  নির্যাতন  আর নিতে পারছি না । ’
‘কাল আমরা সাড়ে আটটায় বের হব। তুমি তৈরি থেকো । ’
                                          
                                                 (২)
‘দাদু ,তোমার পায়ের গিটগুলো এত শক্ত  আর কালো কেন ? ’
নাতনির কথায় সুবর্ণ রায় নিজের পায়ের দিকে তাকালেন ।
‘ বলো , শক্ত কেন ? ’এই এক স্বভাব তিন্নির  । যতক্ষন না নিজের প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে ততক্ষন প্রশ্ন করেই যাবে ।  
রায়  মশাই মনে মনে বিড় বিড় করলেন, বহু অত্যাচারের পরত পরে পরে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে তার শরীরের প্রতিটি গিট । হেসে বললেন , ‘সে অনেক কথা
দিদিভাই । ’
‘হোক অনেক কথা । তুমি বলো , আমি শুনব । ’
আজ শনিবার । তিন্নির স্কুল ছুটি । আজ সারাদিন তিন্নি দাদুর সঙ্গে লেপ্টে থাকবে ,দাদুর পাকা চুল বাছবে ,নেল কাটার দিয়ে  নখ কেটে দেবে আর গল্প শুনবে ।  
সুবর্ণ রায় আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন ।
‘ তুমি কিন্তু লাস্ট স্যাটারডে প্রমিস করেছিলে্‌ ,আজ তুমি আমাকে তোমার ছোটবেলার গল্প বলবে । ’
 রায় মশাই হাসলেন । নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করলেন , ‘জানিস তিন্নি  আমরা যখন বাংলাদেশ থেকে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে এদেশে চলে এলাম তখন আমাদের কাছে কিচ্ছু ছিল না । ’
 ‘লুকিয়ে এসেছিলে কেন ? ’
‘সেই সময়  যুদ্ধ চলছিল যে । ’
“ওহো , আমি একটা সিনেমায় দেখেছিলাম , ‘ মিলখা সিং।’ ” তিন্নি বলল ।
‘এদেশে এসে  এক আত্মীয়র বাড়িতে উঠলাম । কিন্তু কতদিন আর অন্যের বাড়িতে থাকা যায় । আমার বাবা পাশেই একজনের বাড়িতে তাঁতে গামছা বোনার কাজ করত । মা বাড়িতে চরকাতে নলি পাকাতো । সারা সপ্তাহ কাজ করে বাবা খুব  সামান্য পয়সা পেত। ’
‘নলি কি দাদু ? ’
‘আমরা যে  জামা কাপড়  পরি, সেগুলো তো সুতো দিয়ে তাঁতে বোনা হয় । সেই সুতোগুলো একটা লম্বা কাঠের জিনিসে গোটানো হয় ওটাকে নলি বলে । ’
‘তারপর ? ’
‘আমার হাতের লেখা খুব ভালো ছিল । সেই আত্মীয় আমাকে জমি রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখার কাজে লাগিয়ে দেয় । সকালে একটু কিছু  খেয়ে চলে যেতাম । ওখানে মেঝেতে বসে  সারাদিন দলিল লিখতাম । কিচ্ছু খাওয়া হত না । ’
‘কেন খাওয়া হত না ? তোমার মা টিফিন দিত না ? ’
সুবর্ণ রায় হেসে নাতনির গাল টিপে বললেন , ‘আমার মায়ের আঁচল ভরা ভালবাসা ছিল, কিন্তু খাওয়ার ছিল না দিদিভাই । ’
তিন্নি দাদুর কথা ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে বলল, ‘তোমার পায়ে অমন দাগ হলো কী করে সেটা  বললে না   ? ’
 সুবর্ণ রায় উদাস ভঙ্গীতে বললেন , ‘একভাবে অনেকক্ষণ মেঝেতে বসে  লেখার জন্য  পায়ের গিটগুলো ওমন কালো আর শক্ত হয়ে গেছিল ।  তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে্‌ন, সময় চলে যায় দিদিভাই । কিন্তু তার চিহ্ন ঠিকই রেখে যায়   । ’
‘এই এই , এখানে কী রে ?এদের জন্য গাছে একটাও ফল হওয়ার জো নেই । আমটা, নারকেলটা যা পড়বে দেখ না দেখ , দৌড়ে নিতে চলে আসবে ? ’
ছেলের বউয়ের চেঁচামেচিতে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন রায়  মশাই । প্রায় আড়াই বিঘা জায়গার উপর বাড়ি, পিছনে বাগান ,পাশে পুকুর । পুকুরের ওপারে …। পুকুরের ওপারের কথা ভাবতে গিয়েই বারবার থমকে যান তিনি । এ তো শুধু পুকুরের ওপার নয় এ যেন পদ্মার ওপারের কাহিনী ।
‘ ও দাদু ,তারপর কী হল বলো ? তোমরা এখানে এলে কী করে ? ’তিন্নির আর তর সইছে না ।
সুবর্ণ রায় নাতনিকে পাশে নিয়ে শুয়ে নাতনির মাথায় হাত বোলাতে থাকলেন । মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে । এপ্রিলের মাঝামাঝি এখন । সূর্য দেবতা যেন পণ করেছেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে  পৃথিবীকে পুড়িয়ে নিঃশেষিত করে দেবেন ।
চক্রাকারে ঘোরা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে সুবর্ণ রায় বললেন , ‘ সবই ভাগ্যচক্র  । সেই সময় আমাদের এত অভাব ছিল যে ছোট বোনটা  প্রায় না খেতে পেয়ে মারা গেল । বাবার টি বি হয়েছিল ।  ঠিকমত চিকিৎসা করাতে পারলাম না । বাবা মারা যাওয়ার পর মা যেন কেমন হয়ে গেল । ’
 ‘দাদু ,তোমার মা পাগল হয়ে গেল ? ’ তিন্নি জিগ্যেস করল ।
‘ঠিক পাগল নয় । সারাদিন দু হাটুর ভিতর মুখ গুজে বসে থাকত । আর বলত ,সংসার অসার। অসার  সংসার । ’
‘সেইসময় পানাগড়ের অ্যামুনেশন ডিপোতে লোক নিচ্ছিল । আমাদের সেই আত্মীয়ই খবরটা দিয়েছিল । ভগবানের কৃপায় চাকরিটা হয়ে গেল আমার । খুব সামান্য টাকা
 বেতন । মাকে নিয়ে চলে এলাম এখানে । ’
তিন্নি বড় বড় চোখ করে দাদুর কথা শুনছিল ।
সুবর্ণ রায় অনেকদিন বাদে নিজের অতীতের কথা ,নিজের এগিয়ে যাওয়ার কথা আজ নাতনির কাছে মন খুলে বলতে থাকলেন । আসলে সব  সফল মানুষই হয়ত মাঝে মঝে এইভাবে নিজের জীবনটাকে ফিরে দেখতে ভালোবাসেন ।
 ‘জানিস তিন্নি আমাদের এই জায়গাটা  আগে রেলের ইয়ার্ড ছিল । ’
ইয়ার্ড মানে তো উঠোন দাদু । তিন্নি বলল ।
‘হ্যাঁ উঠোনই তো । রেল স্টেশনে সব গাড়ি তো থাকতে পারে না । বাতিল গাড়ি গুলোকে  এখানে রাখা হত ।  আমাদের অবস্থাও তখন  উঠোনের এক কোণে পরে থাকা পরিত্যাক্ত জিনিসের মতই । সেই সময় সরকার থেকে ঘোষনা করা হল- বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এখানে থাকার জায়গা দেওয়া হবে । ’
‘উদ্বাস্তু ? এর ইংরেজী কী ? ’
‘রিফিউজি । ’
‘আমরা রিফিউজি ছিলাম ছিলাম দাদু ? ’
সুবর্ণ রায়ের বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল । নাতনিকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে  বললেন ,  ‘না না  দিদিভাই ,তুমি উদ্বাস্তু নও  । আমরা মানে তোমার পূর্বপুরুষরা একসময়  এদেশে উদ্বাস্তু ছিলাম । ’
তিন্নি জানলা দিয়ে পুকুরের ওপারের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওই ওদের মত । ’
সুবর্ণ রায় একটু গম্ভীর হয়ে বললেন , ‘তুমি এখন ঘুমোও দিদি ভাই । ’

                                           (৩)

ছেলের চেঁচামেচিতে ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল রায় মশাইয়ের । তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে এলেন ।
‘কি হয়েছে  ? ’ উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করলেন ।
বিরক্তমুখে সৌর বলল, ‘আর কি হয়েছে ? দেখ,পুকুরের সব মাছ চুরি হয়ে গেছে । ’
পুকুর থেকে কেউ যেন মাছ চুরি করতে না পারে সেইজন্য সারা পুকুরে গাছের ডাল পুতে রাখা হয়েছিল । জাল ফেললেই ওই ডালগুলোতে লেগে জাল ছিঁড়ে যাবে । সুবর্ণ রায় দেখলেন, সব ডাল তুলে ফেলা হয়েছে । পুকুরের পাড়ে পড়ে রয়েছে জাল থেকে ঝেড়ে ফেলা গেড়ি গুগলি ।
তিন্নি এসে দাদুর পাশে দাড়াল । ‘ কে মাছ চুরি করেছে দাদু ? ’
তিন্নির বাবা পাশ থেকে বলল,  ‘কে আবার ? ওপারের ওরা ছাড়া আর কে করবে ? ’
তিন্নির মা বলল, ‘কবে যে এই আপদগুলো এখান থেকে  বিদেয় হবে ? ‘
সুবর্ণ রায়ের মনেও তো সারাক্ষন এই একটা প্রশ্নই তোলপাড় করে । কত বছর আগে রেলের বাতিল হয়ে যাওয়া ভাঙাচোরা কোয়ার্টারে  ভাঙাচোরা শিরদাঁড়া নিয়ে কিছু মানুষ থাকতে শুরু করে । তিনিও ছিলেন সেই দলে ।  পুকুরের ওই পাড়টা দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল । অন্য জমির তুলনায় কম পয়সা নিয়ে তখনকার জমিদার সেবায়ত হিসেবে  তাঁর  নাম  দিয়ে দেয় । সেই সময় ওই পয়সা জোগাড় করতে কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করতে হয়েছিল  তাঁকে । দিনে অফিসে কাজ করতেন রাতে লোকের বাড়ি টিউশন পড়াতেন । তার অনেক পরে এই বাড়ি ,বাগান, পুকুর কেনা হয় । মাঝে প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে । পনের বছর আগে  হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় বারোটা ফ্যামিলিকে পার্টি অফিসের ছেলেরা এই জমিতে বসিয়ে দিল ।
সুবর্ন রায় আর তার ছেলে বাধা দিতে গেলে পান  চিবোতে চিবোতে  ছেলেগুলো বলেছিল , ‘এ জমি দেবোত্ত সম্পত্তি । এতে আপনার কোনো অধিকার নেই । ’
‘আমরা এখনও ও জমির খাজনা দিই ,  তোমরা এভাবে  এটা  জবর দখল করতে পারো না।’ সুবর্ণ রায় চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন ।
ছেলেগুলো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলেছিল, ‘ওইসব খাজনা টাজনা জানি না কাকু ।  উপর থেকে অর্ডার আছে । ’
ছোট্ট বয়স থেকে এই ছেলেগুলোকে দেখে আসছেন। কয়েকজনকে টিউশনও পড়িয়েছেন একসময় । ওদের অমন উগ্র আচরনে রাগে ,দুঃখে অপমানে  নির্বাক হয়ে ঘরে চলে এসেছিলেন সুবর্ণ রায় ।
সেদিন বিকেলবেলায় রায় বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল বিরোধী পার্টির ছেলেরা । খুব শান্তভাবে  ওদের দলনেতা  বলেছিল, ‘কাকু আপনার কাছে যদি কাগজপত্র ঠিক থাকে তাহলে কোর্টে যাচ্ছেন না কেন ? আপনার মত মানুষেরা যদি এর প্রতিবাদ না করেন ,তাহলে সমাজে ন্যায় অন্যায় বলে তো কিছু থাকবে না । শাসক দলের লোকেরা গিরগিটির মত চুপিসাড়ে আরও এগিয়ে আসবে । একদিন  আপনার পুকুর, বাগান সব দখল করে নেবে । আমরা আপনার পিছনে আছি, ভয় পাবেন না ।’
সেই মুহূর্তে সুবর্ণ রায়ের বুকের ভেতর অপমানের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে । বিরোধী পার্টির নেতারা সেই আগুনকে আরও উস্কে দিয়েছিল ।
ছেলের তখন যুবক বয়স । রক্ত টগবগ করে ফুটছে । ওরা চলে যাবার পর ছেলে বলেছিল, ‘বাবা ,আমরা কোর্টে যাব , মামলা করব । অন্যায়ভাবে আমাদের জমি  দখল কিছুতেই মেনে নেব না । ’
সেই থেকে আজ পনের বছর ধরে এই মামালা চলছে । বিরোধি পার্টি যখন ক্ষমতায় এল সুবর্ণ রায় ভাবলেন এবার সমস্যা সমাধান হবে । কিন্তু ক্ষমতা পেয়েই ওরা অন্য সুর গাইতে শুরু করল ।
এখন রায় মশাই বুঝে গেছেন, যে রাজনৈতিক পার্টিই আসুক না কেন , তাঁকে কেউ সাহায্য করবে না । তাঁর  একার জন্য অতগুলো মানুষের ভোট , কোনো রাজনৈতিক দলই হারাতে চাইবে না। তাদের কাছে ন্যায় অন্যায়ের থেকে অনেক দামি ভোট ব্যাংক বাড়ানো ।


                                                       (৪)
 আজ রায় বাড়িতে খুব খুশির দিন । পনের বছর ধরে চলা  লড়াই আজ শেষ হয়েছে । সুবর্ণ রায় নিজের জমি ফিরে পেয়েছেন ।
সৌর বলল, ‘এবার ওই আপদগুলো বিদেয় হবে । বাবা ,ওটা তো দেবোত্ত সম্পত্তি ছিল ওখানে একটা মন্দির করলে কেমন হয়  ?’
বৌমা বলল , ‘কালই আমি  মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে যাব । বিয়ের পর থেকে দেখে আসছি এই কেস চলছে । এতদিনে নিষ্পত্তি হল। ’
 ‘এইবার ওই উদ্বাস্তুগুলো আমাদের জায়গা ছেড়ে চলে যাবে দাদু ? ’ তিন্নি জিগ্যেস করল ।
সুবর্ণ রায় কিছু উত্তর দিলেন না । চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এলেন।
পরেরদিন সকালের জল খাবার খেয়ে হাতের লাঠিটা নিয়ে  সুবর্ণ রায়  পুকুরের ওপারে গেলেন। কত বছর পর এদিকে পা রাখলেন আজ । সেই সেদিন ওই ছেলেগুলোর অপমানের পর আর এদিকে আসেননি । রাতারাতি বারোটা ফ্যামিলি নিয়ে এই বস্তিটা গড়ে তুলেছিল ওরা । এতটুকু জায়গার মধ্যে এতগুলো ফ্যামিলি ! চারিদেকে জঙ্গল। কেমন স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। আসলে এ জমিগুলো তো বসবাস যোগ্য জমি নয় । হবেও না কোনও দিন । কোন্ আইনে যে রাজনৈতিক নেতারা ওদের এখানে থাকতে দিল  ?  আজও দলে দলে  বাংলাদেশীরা ঢুকছে ।  ওদের যদি সুস্থভাবে বাঁচার পরিবেশই না দিতে পারবে তাহলে ঢুকতে দিচ্ছে কেন  সরকার ? সবই কি ভোট ব্যাংক বাড়ানোর খেলা ? সুবর্ণ রায় দেখলেন্, ছোট ছোট চিটেবেড়ার  ঘরগুলির কোনোটার মাথায়  খড়ের চাল ,কোনোটার আবার প্লাস্টিকের সিট দেওয়া । ঝড়ে বৃষ্টিতে কীভাবে থাকে এরা এখানে ? কারেন্ট নেই,জল নেই,  রাস্তা নেই ।  মেঠো আলপথ দিয়ে এদের যাতায়াত করতে হয় ।  কতজন তো  সাপের কামড়ে মারাও গেল । বসবাস করার সামান্য পরিকাঠামোটুকু নেই এখানে । একটা বাচ্চা ছেলে  ঘরের বাইরে মাটিতে বসে একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে । খালি গা, নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে । শরীরে এক ফোটা মাংস নেই । পাঁজরের হাড়গুলো সব গোনা যাবে । তাঁকে দেখে বাচ্চাটা চুপ করে গেছে  । এক ছুট্টে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল ।
ততক্ষনে ওই কয়েক ঘরের সকলেই টের পেয়ে গেছে তাঁর উপস্থিতি । এক এক করে সবাই বেরিয়ে এসেছে । ওদের মধ্যে একজন উঠতি যুবক  দাঁত মাজতে মাজতে এসে সুবর্ণ রায়ের  সামনে থু করে  খানিকটা থুথু ফেলল ।
একজন মহিলা  একটা ছোট টুল এনে রায় মশাইকে বসতে দিল ।
অন্যরা চেঁচিয়ে উঠল , ‘এই টুনি একদম বসতে দিবি না । এই লোকটাই আমাদের ভিটে মাটি ছাড়া করতে উঠে পরে লেগেছে । এত জায়গা লোকটার । তবু এইটুকু জায়গা ছাড়ল না  ? ’
পাশ থেকে আর একজন বলে উঠল , ‘যেই কাল কোর্টের ডিক্রি পেয়েছে ,অমনি সকাল হতে না হতেই আমাদের তুলতে চলে এসেছে । ’
সুবর্ণ রায় আর দাঁড়াতে পারছিলেন না । পা ভেঙে আসছে । ধপ করে টুলে বসে পরলেন । বললেন , ‘একটু জল হবে ? ’
একজন মহিলা গ্লাসে করে জল এনে দিল ।
সুবর্ণ রায় বাড়িতে জীবাণু মুক্ত জল খান । কিন্তু এদের দেওয়া জল থেকে তিনি বহুদিনের পুরনো স্বাদ খুঁজে পেলেন । তৃপ্তি ভরে  এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করলেন  ।  তারপর আস্তে আস্তে লাঠিতে ভর দিয়ে ঘর চলে এলেন ।

                                                           (৫)
আজকাল রাতে ভালো ঘুম হয়না সুবর্ণ রায়ের । একটু তন্দ্রা মত এসেই ঘুম ভেঙে যায়।  মনে মনে ভাবেন তিনি কোনও ভুল করছেন না তো ? জীবন মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় ,যখন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বুঝে উঠতে পারা যায় না ।
 ‘দাদু, দাদু, তাড়াতাড়ি ওঠো। দেখবে  চল । ’ সকালের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল  রায় মশাইয়ের । তিন্নির ডাকে   ঘুম ভেঙে গেল । ঘর থেকে বের হয়ে এলেন  ।
‘কি হয়েছে ?’
 তিন্নি আঙুল তুলে পুকুরের ওপারে দেখাল ।
সুবর্ণ রায় দেখলেন ,মাথায় পুরো সংসার চাপিয়ে ওই কালো , দুর্বল ,না খেতে পাওয়া মানুষগুলো লাইন ধরে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও ।
ঘরগুলো ভেঙে  দর্মা ,কাঠ ,বাঁশ সব মাথায় চাপিয়ে  নিয়ে চলে যাচ্ছে ওরা । জায়গাটা কেমন শশ্মানের মত খাঁ খাঁ করছে ।
সুবর্ণ রায় ছেলেকে জিগ্যেস করলেন , ‘ কোথায় যাচ্ছে ওরা ? ’
‘সরকার থেকে ওদের জায়গা দিয়েছে ’,ছেলে উত্তর দিল ।
‘হঠাৎ  ?এত তাড়াতাড়ি জায়গা দিল ? ’
‘হঠাৎ নয় বাবা । ওদের জায়গা অনেকদিন আগেই স্যাংশন হয়ে গেছিল , দলের নেতারাই দিতে চায় নি ।’
 ‘কেন  দেয়নি ? কত অসুবিধার মধ্যে ছিল মানুষগুলো । ’
‘আরে কেন তুমি বুঝতে পারছ না । ওরা যত অসুবিধায় থাকবে ততই তো নেতাদের লাভ । নেতারা যা বলবে ওরা তাই করতে বাধ্য হবে । ’
সুবর্ন রায় মনে মনে বলল ,এই ‘মাৎসন্যায় ’ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে ।
সৌর আরও বলল , ‘সেদিন আমরা কোর্ট থেকে ডিক্রি পাবার পরে ওরা বুঝে গেছিল এখানে আর থাকা যাবে না । তারপরই ওরা  গিয়ে পার্টি অফিসে ঘেরাও করে । নেতারা ওদের জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় । সামনে ভোট আসছে তো ,এতগুলো ভোট  হাতছাড়া হয়ে যাবে যে। ’
তিন্নির খুব কষ্ট হচ্ছে । সে দাদুর হাত ধরে বলল, ‘দাদু কোথায় যাচ্ছে  উদ্বাস্তুগুলো ? ’
সুবর্ণ রায় নাতনির হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, ‘আজ থেকে ওরা আর উদ্বাস্তু নয় দিদিভাই । এরপর ওদের সকলের নিজস্ব ঠিকানা হবে  । ঠিক যেমন তোমার দাদুর হয়েছে । ’
 শুধু তিন্নির নয় ,সৌররও মনটা ভার হয়ে আছে । মনে মনে ভাবছে ওখানে একটা স্কুল করলে কেমন হয় ,ওই নুইয়ে পড়া শিড়দাঁড়াগুলো সোজা করা যে ভীষণ প্রয়োজন ।
সুবর্ণ রায় নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছেন  ওই সর্বহারা, ঝুঁকে পড়া দলটার দিকে । তার চোখ জুড়ে এখন চারটে মানুষ । বাবা আগে আগে  চলেছে। মাঝে মা আর বোন । সবশেষে মাথায় বোঁচকা নিয়ে এক কিশোর …।

0 Comments

Post Comment