পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লাল লিফলেট

  • 27 November, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 889 view(s)
  • লিখেছেন : অর্ণব সাহা
গোলপার্ক ‘মৌচাকের’ সামনে যখন নামলাম, রোদ্দুর প্রায় নিভে এসেছে। আশেপাশের বাড়িগুলো, দোকানপাট, বিশেষত ফুলের দোকান, এক অদ্ভুত তামাটে অন্ধকার চাদরে মোড়া। মন বিষণ্ণ থাকলে আলোর অভাব চোখে পড়ে। সেন্টার থেকে বেরোনোর আগের মুহূর্তগুলো যতোবার মনে পড়ছিল, অক্ষম রাগ গুলিয়ে উঠছিল পেটের ভিতর। এরকম সময়ে যতোটা সম্ভব বাতাস টেনে নিতে হয় মগজে, শরীর হালকা করে দিতে হয়। আমিও সেটাই চেষ্টা করছিলাম। লোকটা অবশ্য হাত ধরেছিল, আর এগোয়নি। ওর অদৃশ্য আঙুল আমার বুকের আশপাশের শূন্যতায় কিছু খুঁজছিল। টের পেয়েছি আমি। মেয়েরা টের পায়।

আর গত ছ’মাসের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট? পুরোটা রাখা আছে আমার মোবাইলে। টার্ম পেপার জমা দেবার আগেই এই চেহারা রিসার্চ গাইডের? পুরো কোর্স তো এখনও বাকি! আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যাই উজ্জ্বল  সিসিডির দিকে। ভিতরে লোক সামান্যই। কোভিড পরিস্থিতি নরম্যাল হবার পরও দামি ক্যাফেগুলোয় ভিড় তেমন হচ্ছে না। সেটা অবশ্য একদিক থেকে ভালোই। আমি আজ যাঁর সঙ্গে বসব, কথা বলব, উল্টোপাল্টা ভিড়ের মধ্যে তিনি বেমানান। মানুষ নয়, আমি একটা অদেখা স্বপ্নের ইন্টারভিউ নিতে চলেছি আজ। যে স্বপ্ন আমি নিজে দেখিনি, কেবল আমার আশৈশব পড়াশুনো, বাড়ি-ইউনিভার্সিটি-আত্মীয়-বন্ধুদের পরিসরে দেখেছি সেই স্বপ্নের বিস্তার। আর এখন আকাশে কালো রং ঘন হয়ে উঠেছে। কিছুটা ক্রুদ্ধ অভিমান, ক্ষোভ, অসহায়তা নিয়ে আমি অটো থেকে নামলাম। কিন্তু আমার শরীরে রোমাঞ্চ আর রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। আমি এই হালকা শীতেও ঘামছিলাম। সিসিডির সিঁড়িতে পা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। না। যাঁর সঙ্গে কথা বলব বলে আজ এসেছি, তিনি এখনও অনুপস্থিত। আমি কাচের দরজা ঠেলে ভিতরের একটা কর্নারের টেবিলে গিয়ে বসলাম। নজর রইল দরজায়...

 

প্রায় মিনিট-দশেক বাদে একটা ভারী ছায়া পড়ল গেটে। তিনি ঢুকছেন। সেই মোনা চৌধুরীর ক্যামেরায়  তোলা ছবিগুলোতে যেরকম দেখেছি। আমাদের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের আর্কাইভে প্রায়  সব ছবিই ডিজিট্যালি সংরক্ষণ করা আছে। এখনও অসম্ভব স্বাস্থ্যবান, কালো পেটানো চেহারা। যদিও বয়সের ভারে একটু ক্লান্ত, ন্যুব্জ। চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, যা আমি আগে কোনও ছবিতেই দেখিনি। পরণে একটা ধুসর আধময়লা প্যান্ট, গায়ে চাদর জড়ানো। ভিতরে ঢুকে একটু দিশেহারা হয়ে গেলেন যেন। খুঁজছিলেন আমাকে। আমি নিজেই উঠে এগিয়ে গেলাম। আমায় দেখেই একটা অদ্ভুত শিশুসুলভ হাসিতে ভরে উঠল মুখ। গোটা ক্যাফের ভিতর যেন খানিকটা বেমানান উনি। চাপা মিউজিক বাজছে। টোনি মরিসন। আমি ওঁকে সঙ্গে নিয়ে এলাম আমার টেবিলে। উনি প্রথমে ক্যাফের ভিতরটা খুব খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর আমার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন :

--পুলকের মেয়ে তুমি?

--হ্যাঁ...কী বলে ডাকব ভাবছি তখন।  স্যার? জেঠু? দাদা?

--পুলক কেমন আছে এখন?

--বাবার বয়স হয়েছে। রিটায়ার করবে সামনের মাসে...

--ওকে যখন প্রথম দেখি, ঠিক তোমার মতো বয়স ওর...

--জানি। বাবা সারাক্ষণ বলে আপনার কথা...

--আমার কথা আর কীই বা বলার আছে...উনি যেন হাসলেন একটু...

--আপনি ছিলেন লিজেন্ড। আপনার সম্পর্কে বাবার মুখেই প্রথম শুনি। পরে রিসার্চ করতে এসে আরও পড়েছি, জেনেছি...

--কী জেনেছ?

--যেগুলো জানিনি সেইসব কথা জানতেই তো আজ এসেছি এখানে। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে প্রচুর খেটেছি আমি...

 

উনি মৃদু হাসলেন। একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা জড়ানো সেই হাসিতে...

 

--একটু দূরে, যোধপুর পার্কের ওখানে একটা বস্তি আছে না?

--ওটা এখন আর নেই। লোকগুলো সরে গেছে ঢাকুরিয়া স্টেশনের দু’ধারে। ওখানে সুখিয়া বলে একটা লোক থাকে। আমি তারও ইন্টারভিউ নিয়েছি। লোকটা চেনে আপনাকে...

--তুমি জানো, আমি কলকাতায় ওদের বস্তিতেই অ্যাবস্কন্ড করেছিলাম...

--জানি। সুখিয়া, চমনলাল, ফুলমণি ওঁরাও—এদের কাছে আপনি এখনও ভগবান...

--সুখিয়ার বয়স এখন কতো? বহুকাল আগের কথা সেসব...

--সত্তর পেরিয়ে গেছে। সুখিয়া বলে জঙ্গল-ভগবানের কথা...

 

“যব কানু-জঙ্গল ছুটেগা/ জেল কা তালা টুটেগা”! কারা তৈরি করেছিল এইসব লাইন? কারা ফিসফিস করে উচ্চারণ করত ঝোড়ো হাওয়ার উদ্দাম শ্লোগান? আমার সামনে এখন বসে আছেন আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের চলমান কিংবদন্তী—জঙ্গল সাঁওতাল! কয়েকটা লোক, প্রেমিক-প্রেমিকা, ছাত্রছাত্রী, ছড়ানো-ছেটানো এই  ক্যাফেতে। কেউই জানে না, আমি আজ কার সামনে বসে আছি। এমন একটা লোক, কাগজে-কলমে যাঁর মৃত্যু হয়ে গেছে ১৯৮৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। কিন্তু নথি সবসময় সত্যি বলে না। এই তো, লোকটা আমার সামনে বসে আছে এখন...ভঙ্গুর শরীরটা দেখে মায়া হল। অথচ একবারের জন্যও মনে হল  না উনি নিজে কোথাও ভেঙে পড়েছেন। তাহলে ’৭৭-এ বামফ্রন্ট আসার পর যখন জেল থেকে বেরোলেন, তারপর আর সেইভাবে সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতে পারলেন না কেন? কেন ওঁর একদা-কমরেডরাই পরিত্যাগ করল ওঁকে? প্রশ্নটা কুরে কুরে খাচ্ছিল আমায়। যেদিন সিদ্ধান্ত নিই ওঁকে নিয়েই আমার এম.ফিল ডিসার্টেশন তৈরি করব,  সেদিন থেকেই। বিশেষত জঙ্গল সাঁওতালের জীবনের ওই শেষ অধ্যায়টাই আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষক ও কৌতূহলোদ্দীপক। আমি, মূলত, সেই শেষদিনগুলোর হদিশ খুঁজতেই আজ এসেছি এখানে। বহু কষ্টে ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করেছি। শুনেছিলাম চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এসেছেন। আমি আর দেরি করিনি। পুলক সরকার, আমার বাবা, একসময় কানু সান্যালের গ্রুপে সক্রিয় রাজনীতি করত। তখন বাবার বয়স কতো হবে? চব্বিশ-পঁচিশ মাত্র। সেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নব্বইয়ের গোড়ার দিক পর্যন্ত বাবা ছিল ওই সংগঠনে। সেসময় দিনের পর দিন উত্তরবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে পড়ে থেকেছে বাবা। ঘুরেছে একের পর এক চা-বাগানে। এখন একটা বিখ্যাত বিজ্ঞাপন এজেন্সির মাথায় বসে থাকা লোকটার পুরোনো কন্ট্যাক্ট যথেষ্ট। বাবা আমার এই গবেষণার কাজে সবচেয়ে বড়ো সহায়।

 

--কফি খাবেন?

--এখানে কফির প্রচুর দাম, তাই না?

--খাবেন?...নরম গলায় বলি আমি...

--কতো দাম এককাপ কফির?

--শ’দুয়েক টাকা হবে। খাবেন আপনি?

--তুমি  খাবে না?

--নিশ্চয়ই। আমরা দুজনেই নেব...অর্ডার করি?

--কী নাম যেন বলেছিলে তোমার?

--তৃষা। তৃষা সরকার...

--জানো, আমার শেষদিনটায় পুলকের একটা চিঠি পেয়েছিলাম...

--শেষদিন?

--আমার তো ইচ্ছামৃত্য রে বেটি...সেদিন বুকে ব্যথা হচ্ছিল দুপুর থেকেই। আমার বোন বাসন্তী আমারে  একটা গাড়ি করে নিয়ে গেল নকশালবাড়ি হাসপাতালে। সেখানে বেড নাই। সারারাত আমারে শুইয়ে রাখল মেঝেতে। পরদিন সকালে আমি নিজেই উঠে চলে এলাম বাড়ি। দুপুরে বেশ স্পষ্ট টের পেলাম দেহটা ছেড়ে আমি নিজেই বেরিয়ে আসছি...

--বাবার সঙ্গে তো অনেকবার দেখা হয়েছে আপনার...

--হ্যাঁ। অনেকবার। যেদিন কানুদার পার্টি ওপেন হল, সেইদিন তুমার বাবা আর ওই ফটোবাবু গেছিল। আমার  সঙ্গে দেখা হল। ওদের সঙ্গে ফেরার রাস্তায় কতো কথা হল। চা খাওয়া হল...

--ফটোবাবু কি মোনা চৌধুরী?

--হ্যাঁ। মোনা। তারিখটা আমার আজ আর মনে নেই...

--২৪ মে, ১৯৮৫...নকশালবাড়িতে...

--তার আগেই আমারে ফুটিয়ে দেছে পার্টি...আর সেই সভাতেও আমারে ওরা ডাকে নাই। আমি কেনে যাব?

--কিন্তু আপনি তো গিয়েছিলেন? সেই মিটিং-এ। একাধিকজন আপনাকে দেখেছিল...

--হ্যাঁ। গেছলাম। একধারে বসে ছিলাম। কেউ আমারে দেখে কিছু কয় নিকো। আমিও কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম...আচ্ছা, তুমি এতো কথা আমারে জিগাও কেনে?

--আপনাকে যে আগের দিন বললাম, আমি থিসিস লিখছি আপনাকে নিয়ে...

--থিসিসে সব সইত্য লিখতে পারবা?

--সত্যিগুলো জানার জন্যই তো আমি আজ এখানে এসেছি। আপনার সামনে বসে আছি...আপনি জানেন, আমি এ অব্দি অন্তত দু’ডজন লোকের ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলেছি...নর্থ বেঙ্গল গেছি। কানুবাবুর সিওআই এম.এল-এর লোকজনের সঙ্গেও মিট করেছি...আপনার ‘লাল লিফলেটের’ অরিজিনাল কপি আছে আমার কাছে...’তরাইয়ের কৃষকের পাশে দাঁড়ান’...নীচে স্বাক্ষর—‘জঙ্গল সাঁওতাল, সভাপতি, শিলিগুড়ি মহকুমা কৃষক সমিতি’। জেল থেকে বেরোনোর পর তো কানুবাবুর গ্রুপে আপনি জয়েন করেছিলেন শুনেছি...১৯৭৯ সালে...ওসিসিআর-এ...কিন্তু ১৯৮৩-তে পার্টি-ফর্মেশনের সময় আপনি সরে এলেন কেন?

 

--সরে আসি নাই...আমারে তাড়ায়ে দেল...

--সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন?

--ওই নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন আমি করছি...আমি...তোমরা তো এটা জিগাও না আমারে পার্টিতে প্রথম থেকেই কোনঠাসা কইর‍্যা রাখছিল কেন ওরা?

--১৯৭০-এ রাজ্য কমিটিতে আপনাকে রাখা হয়েছিল...কিন্তু প্রথম পলিটব্যুরোতে আপনি ছিলেন না...

--আমি সাঁওতাল। আমার পদবি কিস্কু। আমি লিখাপড়া শিখি নাই। মার্কসবাদ পড়ি নাই...আমি বাবুলোক নই রে বিটি...ওরা গোড়া থিক্যাই আমারে খাটো নজরে দেখত...  

--হ্যাঁ। এই কথাগুলো অনেকেই বলেছেন পরবর্তীকালে...

--লাল লিফলেট তুমি পেলা কুথায়?

--বাবার কাছে ছিল। কালো ঝুরঝুরে হয়ে গেছে পুরোটা। আচ্ছা, ওটার নাম ‘লাল লিফলেট’ হল কীকরে?

 

ফের শিশুর সারল্যে হেসে ওঠেন জঙ্গল। একবার গোটা ক্যাফেটেরিয়ার ভিতর চোখ বোলান...

 

--ওটা ছাপা হয়েছিল একটা লোকাল প্রেসে। ছাপার আগে লাল কালিতে কিছু একটা ছাপা হয়েছিল ওই মেশিনে। লাল কালি মুছে কালো কালিতে ছাপতে অনেক সময় লাগত। তাই ওই মেশিনেই ছাপা হল লিফলেট। নাম হয়ে গেল লাল লিফলেট...আমরা কিন্তু এই নাম দিই নাই!

--জানি। এই নাম কলকাতার পার্টিকর্মীরা দিয়েছিল...

--আমি পার্টিতে ছিলাম ১৯৭০ অব্দি। যখন জেলে যাই, তখনই জানতাম, চারুদার লাইন ভুল...

--কোনটা ভুল?

--কেন? খতম লাইন!

-- সেকথা আপনি তখন বলেননি কেন?

--বললে কেডা শুনত আমার কথা? চারুবাবুর লাইন ছিল ভুল। ওরা কেউই কৃষক না। আমি হালবলদ নিয়া মাঠে চাষ করা লোক। আমি চাষের কথা ওদের চ্যায়া ঢের ভালো বুঝি...চাষার মন আমি অনেক বেশি পড়তে পারি...আন্দোলন দেড় বছরেই শেষ হত না ওই ভুল না করলে...

--আপনি তো ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছেন...

--হ্যাঁ। দুইবার।

--তখনও আপনি অবিভক্ত পার্টিতে ছিলেন। প্রথমবার ১৯৬২ সাল...আপনি কংগ্রেসের কাছে হারেন...পিএসপির ঈশ্বর তিরকের সঙ্গে ভোট-ভাগাভাগি হয়ে যায়, আপনি ১৩,০০০ ভোট পেয়েছিলেন...দ্বিতীয়বার ১৯৬৭-তে সিপিএমের প্রার্থী হিসেবে...ফাঁসিদেওয়া কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী তেনজিং  ওয়াংদির কাছে ৬,০০০ ভোটে হেরে যান, নইলে যুক্তফ্রন্টের বিধায়ক হতেন...

--তুমি এতো কিছু জানলা কোত্থেকে?

--আমি তো এটা নিয়েই কাজ করছি...আমার গাইডও নকশাল রাজনীতি করতেন...তবে অন্য গ্রুপ...উনি বাবার চেয়ে বেশ কিছুটা বড়ো...

--কী নাম?

--প্রবীর রায়চৌধুরী...চেনেন?

--জালি মাল!

--আপনি চেনেন?

--ওরে চিনে আরও অনেকেই। সেকেন্ড সিসি করত। নিশীথ-আজিজুলদের সঙ্গে। পার্টির তহবিল তছরুপ করেছিল...পার্টি থেকে ওরে তাড়ায়ে দেছেল...

--হ্যাঁ। উনি এক্সপেলড হয়েছিলেন...

 

আমার চোখে-মুখে কি মুহূর্তের জন্য অন্য কোনও ধূসর ছায়া পড়েছিল? প্রেসিডেন্সি থেকে মাস্টার্স করে এই সেন্টারে আসি এমফিল করার জন্য। মাত্রই ছ-সাত মাস হয়েছে এখানে জয়েন করেছি আমি। বিষয়  নকশালবাড়ি, বিশেষত জঙ্গল সাঁওতালের কন্ট্রিবিউশন হওয়ায় এই বিষয়ে সবচেয়ে নামী এবং রিসোর্সফুল অধ্যাপক প্রবীরবাবুর সঙ্গেই যোগাযোগ করি। এবং ওঁর আন্ডারেই কাজ করতে শুরু করি। বাবার পরিচিত, তাই উনি প্রথম থেকেই একটু আলাদা গুরুত্ব দিতেন আমায়। যদিও ওঁর সম্পর্কে বেশ কিছু বিরূপ কথাবার্তাও শুনেছিলাম আগেই। কাজ শুরুর সময় থেকেই উনি ওঁর পাটুলির ফ্ল্যাটে যেতে বলতেন আমায়। সেখানেই তুমুল আড্ডা, পড়াশুনোর আলোচনা, মদ খাওয়া হত। একদম শুরুতে আমার সেরকম কোনও আলাদা অনুভূতি হয়নি। প্রবীরদার স্ত্রী ওঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। একমাত্র মেয়ে আমেরিকায় থাকে। অধ্যাপনা করে। কিন্তু যেদিন ফাঁকা ফ্ল্যাটে উনি প্রথমবার আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরলেন, আরও কিছুদিন পরে নিয়মিত নানা ছুতোনাতায় আমার শরীরে হাত দিতে শুরু করলেন, আমি রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়লাম। বাড়িতে কিছু বলিনি, কারণ, আমি মনে করি আমি যথেষ্ট স্বাবলম্বী, আর এইসব সমস্যা নিজে একলাই ট্যাকল করার মতো মনের জোর আমার রয়েছে। আমি একাই সামলে নেব। আসলে রাগের চেয়েও আমি আহত হয়েছিলাম বেশি। বাবাকে দেখেছি, অতো উঁচু কর্পোরেট পোস্টে চাকরি করেও নিজের যৌবনের রাজনীতি এবং  সংশ্লিষ্ট বন্ধুদের প্রতি বাবার শ্রদ্ধা ও দরদ কতোখানি গভীর। এখনও কলকাতায়  যেকোনও সিভিল রাইট মুভমেন্টের সামনের সারিতে থাকা মানুষটির নাম পুলক সরকার। প্রবীরদা অসম্ভব ভালো স্কলার। অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি। বহুবার বিদেশে গেছেন। কিন্তু ওঁর রাজনৈতিক অতীত আর আজকের উনি একেবারেই দু’মেরুর। বিপরীত। এখন জঙ্গলের মুখে শুনে টের পাচ্ছি, ওঁর ভিতরে অনেকরকম ভাইস একদম গোড়া থেকেই ছিল। এরপর রাতের পর রাত ড্রাঙ্ক অবস্থায় আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে উষ্ণ টেক্সট অথবা ভোররাতের দিকে ফোনকল—আমার কাছে পুরোটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। আবার একইসঙ্গে ভাবছি, মাত্র দু’বছরের এমফিল কোর্স। কমপ্লিট হয়ে গেলেই আমিও দেশ ছাড়ব।  এসবের মধ্যে ফের বাবা-মাকে জড়িয়ে ফেলা, বন্ধুবান্ধবকে জড়িয়ে, একটা স্ক্যান্ডাল তৈরি করে আমার নিজের কাজটা ক্ষতিগ্রস্ত হোক—এটা কাম্য নয়। হয়তো অন্য কোনও মেয়ে হলে এতোদিনে সেন্টারের  অ্যান্টি-হ্যারাসমেন্ট সেলে জানিয়ে, ফেসবুক পোস্ট করে বিরাট হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দিত। ইনফ্যাক্ট, এরকম কাজ আমার বন্ধুরাই আকছার করছে। কিন্তু আমি অকারণ নাটকীয়তা পছন্দ করি না। আমার জীবনযাপনে কিছুটা একাকিত্ব, নিজস্বতা জরুরি। নিভৃতি পছন্দ করি আমি। চাই না আমার কারণে আমার চারিপাশের লোকজন অকারণে ব্যতিব্যস্ত হোক। কিন্তু এমফিলের কাজ যে বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমার গাইডেরই কারণে, এটা নিশ্চিত। পুলক-স্যারের কাছে যেতেই একধরনের রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে নিজেরই ভিতর থেকে।

 

জঙ্গল সাঁওতাল কিছুক্ষণ কফির কাপটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতোক্ষণ। এইবার হাতে তুলে আলতো চুমুক দিলেন। তারপর চেয়ে রইলেন আমার দিকে! উনি কি কিছু বলবেন?

 

--প্রবীর তোমারে বিরক্ত করছে, তাই না?

 

আশ্চর্য! আমি তো কিছুই বলিনি ওঁকে। উনি কি অন্তর্যামী? কে উনি? অন্য কেউ? জঙ্গল সাঁওতাল সেজে এসেছেন আজ আমার সামনে? কফির কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে উনি বাইরের দিকে তাকান...

 

--৭ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২। হাতিঘিষা কৃষক সভার প্রথম সভাপতি আমি। জোতদার সেরকেত সিং-এর জমিতে তেভাগা নিয়ে একটা প্রচণ্ড গণ্ডগোল হয়। আমাদের কমরেডরা প্রচণ্ড মার খায়। আমরা পালিয়ে গেছিলাম।

--জানি। চা-শ্রমিক আন্দোলনের শুরুর দিকেও তো আপনিই ছিলেন, তাই না?

--১৯৫৫ সালে বোনাসের দাবিতে, আরও পরে বেনামী জমি উদ্ধারের দাবিতে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলায়। তখনও অতো আড়কাঠি ঢোকেনি পার্টিতে। এই প্রবীরের মতো লোকজন দেখলে এক কোপে মুণ্ডু আর ধড় আলাদা করে ফেলতে ইচ্ছে করত আমার...

--প্রবীর-স্যারকে আপনি চিনলেন কীভাবে?

 

উনি কিছুক্ষণ থামলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল যেন!

 

--কানুদা পরে আমার নামে যা-তা কুৎসা করেছে। আমি মদ খাই। পার্টির কাজে সময় দিই না। নারীসঙ্গ করি। আমার মধ্যে বাবুয়ানি ঢুকছে—আরও কতো কী!

--উনি বলেছেন, জেলে থাকার সময় থেকেই আপনার মধ্যে বদল আসছিল...

--না। আমি বাবুদের মত মানছিলাম না সেই ১৯৭০-৭১ থেকেই। জানতাম একটা দিন আসবে যেদিন আমি এদের সঙ্গে থাকতে পারব না...

--আমার স্যারকে কীভাবে চিনলেন আপনি?

--কানুদার পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে আমি বসে থাকিনি। লড়াইও ছাড়িনি...

--জানি। ১৯৮৪ সালে ‘সংগ্রামী কৃষক ঐক্য সমিতি’ তৈরি করেছিলেন। হাতিঘিষা থেকে বারো কিলোমিটার দূরে আপনাদের প্রথম সম্মেলন হয়েছিল। সেখানেই আপনি প্রথম বলেন, কৃষক আন্দোলনে পার্টি-নেতৃত্ব প্রয়োজন নেই...

--নেই তো। একশোবার নেই। উয়ারা কৃষকের কী বুঝে?

--বোঝে না? কিন্তু তার আগে-পরে এতোগুলো লড়াই পার্টির নেতৃত্বেই তো হয়েছে...

--ফাঁক ছিল। অনেক ফাঁক। আর সেই ফাঁক দিয়েই প্রবীরের মতো জোচ্চোরগুলা ঢুকে পড়ে। কৃষক সংহতি নষ্ট করে। তোমার স্যার ছিল আমার সঙ্গে, সেই সভায়...

--বলেন কী!

--হ্যাঁ। খুব চতুর...খুব সেয়ানা...যখন বুঝল আমাদের ছোট্ট সংগঠনে থেকে কিছু হবে না, তখন নিশীথ-আজিজুলদের সঙ্গে ভিড়ে গেল...ওদের নামডাক অনেক বেশি তখন...

--কিন্তু সেকেন্ড সিসি-র পার্টিলাইন তো আপনাদের থেকে একেবারেই আলাদা...

--পুরোটাই ভুল লাইন। চীনা পার্টির লিন পিয়াও লাইন। সেই ভুল খতমের রাস্তা...কিছু ছেলে মরে গেল আর প্রবীরের মতো কিছু ধান্দাবাজ নকশালি নাম ভাঙিয়ে করে খেল...নামডাক হল তাদের...

--আচ্ছা! কানুবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নষ্ট হল কেন? উনিই তো আপনার পার্টি মেম্বারশিপ প্রোপোজ করেছিলেন...সেই তিনিই আপনাকে জেল থেকে চিঠি লিখছেন ২৪ ন্ডিসেম্বর, ১৯৭৭। আপনাকে সঠিক পথে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন...

--উ আমারে হুকুম দিবার কে? কে উ? আমি জঙ্গল সাঁওতাল। আমি নিজেই নিজের মালিক...

--বামফ্রন্ট সরকার আপনাকে পুনর্বাসন দিতে চেয়েছিল...দিনাজপুর লাইনে বাসের পারমিট বের করে দিয়েছিল। আপনি সেই পারমিট নিয়েওছিলেন...কানুবাবু আপনাকে লম্বা চিঠি লিখে পারমিট নিতে বারণ করেছিলেন...বলেছিলেন, এটা দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি...

--আরে রাখো তুমার কানুবাবু...আমারে সিপিএম পার্টিতে ফিরে আসতে হাতে-পায়ে ধরেছিল...আমি যাই নাই...বেইমানি করি নাই...পারমিট আমি নিছি...কিন্তু রাখি নাই...বেইচ্যে দিছি...আমার পরিবার যখন না খ্যায়া মরতেছিল তখন কুথায় ছিল তুমার কানুবাবু?

--উনি কিন্তু বিপ্লবী হিসেবে আপনার বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলেছিলেন...

--আরে থামো। অতো বড়ো বড়ো বিপ্লবী পণ্ডিত উয়ারা...পার্টির নেতারা...উয়ারা কেউ কারো সঙ্গে বনাতি পারে নাই...আমি লিখাপড়া শিখি নাই...কিন্তু আমি বুঝছিলাম এই পথ ভুল...এখন তুই বল্‌ বিটি, আমি কী করতাম? আমি কোন্‌ পথে যেতাম?

--কোন পথটা আপনার ভুল বলে মনে হয়েছিল?

--উয়াদের কৃষিবিপ্লবের লাইন...আরে কৃষিই তো পালটে যাচ্ছিল গোটা দেশে...বামফ্রন্ট আসার পর তো আরও পালটে যাচ্ছিল সব...আমি একা লড়তাম কারে নিয়া?

 

আমার কফির কাপ প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। লক্ষ করলাম উনি তখনও দুয়েক চুমুকের বেশি খাননি। ওঁকে উত্তেজিত লাগছিল...গায়ের চাদর খুলে ফেললেন...কাঁধের ঝোলাটা একবার মেঝে থেকে তুলে নিয়ে ফের রেখে দিলেন...আজ এতো বছরের পর, সত্যি-মিথ্যার কুহকে পুরো আন্দোলনের ইতিহাস আর সেই  শিকল-ছেঁড়া মানুষদের কাহিনি একটু একটু করে মুছে গেছে...এইমুহূর্তে পুরো ক্যাফেতে যেকটা লোক, তারা কেউই কি জানে আমি কার সঙ্গে কথা বলছি? এক জীবন্ত কিংবদন্তীর মুখোমুখি বসে রয়েছি আমি, যার কফির কাপে ঠাণ্ডা হচ্ছে ফেনায়িত তরল।  জানি, উনি অস্বস্তিবোধ করছেন এই দামি ক্যাফেটেরিয়ায়। কিন্তু এই সিসিডিটা আমার বাড়ির খুব কাছে হয়। বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে আমাদের বাড়ি। এখান থেকে ওয়াকিং ডিস্ট্যান্স। এমএ পাশ করার পর যেদিন থেকে এই বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছি, আমার স্বপ্ন ছিল এই লোকটাকে মিট করব। ওঁর ইন্টারভিউ নেব। এখন কাচের টেবিলের উপর আমার মোবাইলের রেকর্ডার অন করাই রয়েছে। উনি যেন একটু ঝিমিয়ে পড়েছেন। আমার জন্ম ১৯৯৫-তে। আমরা সেই প্রজন্মের সন্তান, যারা বিশ্বাস করে এসেছে ‘নেতি’-তে। চূড়ান্ত ডিসটোপিয়ায়। যখন গোটা দুনিয়া জুড়ে ‘হ্যাঁ’ কথাটার মানেই সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বাবা-মায়ের জন্যই আমি হয়তো খানিকটা অন্যভাবে বড়ো হতে পেরেছি। অন্যভাবে চিন্তা করতে শিখেছি। আমার গাইডও হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চিত বিশ্বাস করবে না আমার সঙ্গে জঙ্গল সাঁওতালের আজ সাক্ষাৎ হয়েছিল। এতোক্ষণ কথা হয়েছিল। কিন্তু এই ইন্টারভিউয়ের কথা আমি কাউকে কোনওদিনও জানাব না। এটা শুধু ধরা থাকবে আমার রেকর্ডারে। ছোটোবেলা থেকে বাবার কাছে এই অসম্ভব রূপকথার নায়কের মতো লোকটার গল্প শুনে এসেছি। বাবা বলত, চারু-কানু-সৌরেন-সুশীতল-সরোজ-সুনীতি-অসীম এরা সকলেই ছিলেন উচ্চবর্ণের লোক—সান্যাল, রায়চৌধুরী, চ্যাটার্জি, দত্ত। ঠিক সেই অতীতের অবিভক্ত ও ভেঙে-যাওয়া পার্টির দাশগুপ্ত-বসু-মুখার্জি-ভট্টাচার্যেরই উত্তরসূরি এঁরা। একমাত্র ব্যতিক্রম এই জঙ্গল সাঁওতাল-খোকন মজুমদার, যিনি আসলে ছিলেন মুসলমান, প্রকৃত নাম—শামসুদ্দিন আহমেদ, এইসব মাটির সঙ্গে মিশে-থাকা লোকেরা, যাঁরা এক অর্থে নকশালবাড়ির অন্যতম স্রষ্টা হওয়া সত্ত্বেও আগাগোড়াই অবহেলিত থেকে গিয়েছিলেন। প্রথাগত অর্থে মার্কসবাদী শিক্ষায় এরা দড় ছিলেন না, জঙ্গলের তো স্কুলের শিক্ষাও সেই অর্থে সম্পূর্ণ হয়নি। ফলত, এমএল-পার্টিতেও ওই একই শিক্ষিত বর্ণ-কৌলীণ্য বজায় ছিল এবং শিক্ষিত মুষ্টিমেয় নেতার নিঃসপত্ন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এখানেও। সেই অধিকারীভেদ এবং সামন্তবাদী মানসিকতা এতোটাই দৃঢ়মূল ছিল যে একটা সময়ের পর জঙ্গলের মতো তীব্র স্বাধীনচেতা মানুষ এঁদের নিগড়ে থেকে হাঁসফাঁস করছিলেন। অবশেষে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমার নিজস্ব অনুমানে এটাই ছিল জঙ্গল সাঁওতালের পার্টিত্যাগের মৌলিক কারণ। আর একবার মূল পার্টির থেকে সরে আসার পর প্রথাগত ভঙ্গিতেই পার্টিনেতৃত্ব তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা আর অপপ্রচার শুরু করে। সেটাই জঙ্গলের মোহভঙ্গের আরও একটা বড়ো কারণ। আমি এগুলো বরাবর টের পেতাম, যখন থেকে ওঁর সম্পর্কে জেনেছি। আজ এই সামান্য আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সেই ভাবনা আরও পোক্ত হল। একচুমুকে পুরো কাপের কফি শেষ করে নিয়ে জঙ্গল বললেন:

 

--পেচ্ছাপ করব। বাথরুমটা কোথায়?

--ওইদিকে। আমি আঙুল তুলে দেখিয়ে দিই...

--আমি কাউরে কুনো দিন মানি নাই, জানিস তো?

--জানি...আপনার পরিবারের কথাও জানতে চাই আমি...

--প্রথম বউটো মর‍্যে গেল না খ্যায়া। আমি ফিরেও তাকাই নাই রে বিটি...আমার অতো সময় ছিল না...

যখন দিনের পর দিন জেলে ছিলাম, বউ-বাচ্চা কী খাইল না খাইল ফির‍্যাও দেখি নাই...আর আমারে কয় বিপথগামী...দালাল!

--আপনার ছেলে উপেন কিস্কুর সঙ্গে আমি মিট করেছি...

--হ্যাঁ। উয়ো কানুবাবুর পার্টি করে...আমার পথেই চলে...

--আর আপনার দুই বোন। তাদেরও সঙ্গে কথা হয়েছে আমার...আপনাকে এখনও ওই এলাকায় ভগবান বলে মনে করে লোকে, জঙ্গলদা...

 

‘দাদা’ সম্বোধন কীভাবে বেরিয়ে এল, আমি সত্যি জানি না। অবচেতনের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ আমরা পুরোটা বুঝতেও পারি না। বললাম—“যান। টয়লেট থেকে আসুন”। উনি উঠলেন। বিশাল শরীরটা যেন কাঁপছে...ফাইবারের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকলেন উনি...আমার অদ্ভুত লাগছিল। যেন আজকের সাক্ষাৎকার সত্যি নয়। পুরোটাই স্বপ্ন। আর স্বপ্ন জিনিসটাকে আমি বাস্তবের চেয়ে খুব একটা আলাদা করে দেখিনি কোনওদিন। বাবার লাইব্রেরিতে যখন সত্তরের বিপুল বই-পত্রিকার আর্কাইভ খুঁজে পেতাম আর গোগ্রাসে সেগুলো পড়তাম, যেদিন পোকায়-কাটা পুরোনো প্যাম্ফলেটে জঙ্গল সাঁওতালের অস্পষ্ট ধুসর ছবি দেখতাম, আমার মনে হত, এটাও তো একটা অধরা স্বপ্ন। আমাদের ইতিহাস যাকে সত্যির সমান্তরালে রেখে দিয়েছে অথচ পুরোটা সত্যি হতে দেয়নি।  আর সেই ছেঁড়া, বিক্ষিপ্ত, অসমান স্বপ্নগুলোকে রিফু করা, তাদের ফাটলগুলোকে সেলাই করার দায় ইতিহাসকারের, যে দায়বোধ থেকে আজ এইখানে এসেছি আমি। একটা তামাদি-হয়ে-যাওয়া লোক, ইতিহাস যাকে মার্জিনে ঠেলে দিয়েছে, যার অস্তিত্ব ইরেজার দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে, তাকে খুঁজে বের করার দুরূহ কাজে চ্যালেঞ্জ যেরকম রয়েছে, তেমনই রয়েছে এক অসম্ভাব্যতা। এক চূড়ান্ত অসম্ভবের পিছনে ছুটে বেড়ানোর দুঃসহ তাগিদ।

 

উনি টেবিলে এসে বসলেন। আমি রেকর্ডার অফ করলাম।

 

--বিশ্বনাথ মুখার্জিরে আমি ধুয়্যে দেছলাম, জানো তো?

--জানি। ১৯৫৯ সালের কৃষক সভার মিটিং।

--বেনামি জমি দখলের লড়াই চলছিল। পার্টির বাবুরা বুঝাতে চায় আইনের চৌহদ্দিতে থেক্যে লড়তি হবে...

--আপনি সরাসরি বিশ্বনাথবাবুকে যা-তা বললেন?

--আমি তো ভদ্দরলোক নই গো। প্রথম থেকেই উরা একটা দালাল পার্টি...

--আপনাকে নিয়ে অনেক অনেক মিথ জঙ্গলদা...

--হ্যাঁ। তুমারে তো কইলাম, আমি নিজেই ভগমান...

--আমার কাজের একটা আস্ত চ্যাপ্টার থাকছে নর্থ বেঙ্গলে আপনাকে নিয়ে যে মিথগুলো এখনও চালু রয়েছে, সেগুলোর উপর!

--কী কাজ করো তুমি? শিশুর সারল্যে হেসে জিগ্যেস করেন উনি...

--এমফিল করছি সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে...

--আমি ভাবতেছিলাম তুমি রিপোর্টার। একসময় শয়ে শয়ে রিপোর্টার হাতিঘিষা যেত আমার লগে কথা কইতে। আমি যখন জেল থিক্যা বেরোলাম...

--জানি। তাদের অধিকাংশ রিপোর্ট আমি পড়েছি...

--তুমি খুব ভালো মেয়ে। সাবধানে থেকো...

--আপনিও ভালো থাকবেন। এখান থেকে কোথায় যাবেন আপনি?

--যোধপুর পার্কের সেই বস্তিটা আর নাই, তাই না?

--না। নেই। কার সঙ্গে দেখা করবেন আপনি?

--আমার নেপালে যখন সংসার ছিল, তখনকার কিছু লোকরে খুঁজি আমি...জানি না উয়ারা এখন কোথায়!

--ইসলামপুরের পাটাগাড়ায় আপনি যখন গ্রেফতার হলেন ১৯৭০ সালে, তখন এক নেপালি আইবি আপনাকে শনাক্ত করেছিল, তাই না?

--হ্যাঁ। আমি তো নেপালে থাকতাম একসময়...

--আচ্ছা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চরণ সিং-এর সঙ্গে কি সত্যিই দেখা হয়েছিল আপনার?

--দূর! চরণ সিং তিহার জেলে আসেই নাই...আমাদের সঙ্গে দেখা করে বিহারের সত্যনারায়ণ সিং। আমাদের সাতজনারে ডাকছিল দিল্লি থিক্যে, সাতাত্তরে জনতা সরকার আসার পর!

--আপনাকে নাকি মুচলেকা দিতে বলেছিল?

 

মুহূর্তে দু’চোখ জ্বলে ওঠে জঙ্গলের। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওঁর!

 

--মুচলেকা আমি দিই নাই। মুচলেকা আমি দিব নাই। কুনোদিনও না...

 

উঠে পড়ি। ওঁকে নিয়ে ক্যাফের দরজা অব্দি হেঁটে আসি। উনি ধীর পায়ে সিঁড়িতে নামেন। আমি উপরের সিঁড়িতে। রাস্তায় নেমে হঠাৎ মুখ তুলে উপরে তাকিয়ে দেখলেন আমায়। আকস্মিকভাবে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অভিবাদন জানালেন আমায়। আমার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। এই অভিবাদন তো সংগ্রামী যোদ্ধারা জানায় তাদের কমরেডদের। আমি তো কোনও লড়াকু মানুষই নই। তবে কি আমার মধ্যে অন্য কাউকে টের  পেলেন তিনি? কীকরে সম্ভব? আমি তো সামান্য এক গাইডের অন্যায়েরই প্রতিবিধান করতে পারছি না বিগত ছ’সাত মাস যাবৎ। একসময় বাংলা-বিহার জুড়ে জঙ্গল সাঁওতাল ছিলেন কিংবদন্তীর নায়ক।  জামশেদপুরের গাঁওবুড়োরা রটিয়ে দিয়েছিল, তারা প্রায়ই জঙ্গলকে দেখতে পায়। কীভাবে? জঙ্গল না কি ‘উরাকল’-এ চড়ে নকশালবাড়ি থেকে সাঁওতাল পরগণায় এসে সকলকে জোতদারের জমি দখল করার ডাক দিয়ে গেছে। ফেরার সময় বলে গেছে, “আমি আবার আসব। তৈরি থেকো কমরেড”। কীরকম দেখতে তাকে? “বিরাট লম্বা। বিশাল চেহারা। বড়ো বড়ো চুল-দাড়ি তার”। অনেকেই নাকি দেখেছে তাকে। আমি উত্তরবঙ্গের গ্রামে গিয়ে শুনেছি জঙ্গল সাঁওতাল না কি এক বিশাল ধুমসো বাঘের পিঠে বসে জোতদার আর পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করত। বাঘের দাপটে শত্রুরা সকলেই পালাত। আর জঙ্গলের হাতে ছিল এমন এক অস্ত্র, যা দিয়ে অনায়াসেই একসঙ্গে পাঁচশো পুলিশ ঘায়েল করা যায়!

 

ওই তো! বাঘের পিঠে চেপেই তিনি এখন ক্রস করছেন লোকারণ্য গোলপার্ক। রাস্তা পেরিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের ফুটপাথ বেয়ে একলা হেঁটে চলেছেন তিনি। হালকা, দুলকি চালে। মহানগরের উপর ঘন রাত্রি নেমে এসেছে। আশেপাশের কোনও লোক তাঁকে দেখতে না পেলেও আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ডাক শুনলাম—“ম্যাডাম, এই কাগজটা আপনি ফেলে গিয়েছেন”। চমকে পিছন ফিরে  তাকাই। একটা ঝকঝকে ‘লাল লিফলেট’। যেন সদ্য প্রেস থেকে ছাপা। উপরে বোল্ড টাইপে আহ্বান—‘তরাইয়ের কৃষকের পাশে দাঁড়ান’। নীচে জঙ্গল সাঁওতালের স্বাক্ষর। আর, উপরের ফাঁকা অংশে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা—‘তৃষাকে, জঙ্গল সাঁওতাল’। কখন ব্যাগ থেকে এই অরিজিনাল লিফলেটের কপি বের করলেন উনি? কখনই বা সেটা চেয়ারের উপর ফেলে গিয়েছেন? আমার কাছে যে পুরোনো লিফলেটটা আছে, সেটা কালো হয়ে গেছে। মুচমুচে। যেকোনও দিন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। কিন্তু এই লিফলেটটা একদম তাজা। যেন আজই প্রেস থেকে হাতে এসেছে...

 

আরেকবার দূর রাস্তার দিকে তাকালাম। জঙ্গল সাঁওতাল আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছেন। কোত্থাও তাঁর কোনও চিহ্ন নেই। আদৌ কি তাঁর কোনও অস্তিত্ব ছিল এতোক্ষণ? কার সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম আমি? এই উজ্জ্বল সিসিডিতে? এই সুবেশ, উদাসীন, ম্যাটার-অফ-ফ্যাক্ট লোকজনের মাঝে?

 

আমি রাস্তায় নামি। একটা সিগারেট ধরাই। বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করি...প্রবীর-স্যারের কাছেই কাজ করব, নাকি গাইড বদলাব, ভাবতে থাকি...একটু শীত করে আমার...অদ্ভুত, এলোমেলো হাওয়া দেয়!

 

 

  • এই লেখায় প্রকাশিত সমস্ত মতামত লেখকের নিজস্ব।

 

 

0 Comments

Post Comment