পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

প্রচলিত ধারণার বাইরে ভাবা জরুরি।

  • 16 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1099 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
সমাজে একটা অতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে, নারী নির্যাতনকারী কিংবা ধর্ষণকারী কোনও ব্যক্তিকে ফাঁসি দিলে বা এঙ্কাউন্টার করে ধর্ষককে মেরে দিতে পারলেই আমাদের সমাজ থেকে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে। প্রচলিত এই ধারণাগুলো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও ভালোই বোঝেন, সেই জন্যেই প্রচলিত অনুভূতিতে উষ্কানি দেওয়ার কাজটা তাঁরাই করে থাকেন। সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জানেন, এই ধরনের প্রচলিত দাবীর পাশে মানুষকে সমাবেশিত করা অত্যন্ত সোজা কাজ এবং এই সোজা কাজটা করতে পারলে, অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী যে দাবী এই ধর্ষণ বন্ধ করার প্রসঙ্গে উঠে এসেছে, তাকে পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া যাবে।

অনেকে মনে করে থাকেন, সমস্ত কিছুতে রাজনীতি করা উচিৎ নয়। আরজিকর হাসপাতালের ঘটনাতে কেন রাজনীতি হবে, এই প্রশ্নও অনেকে তুলে দিয়েছেন। এই ধরনের যে কোনও ঘটনা যখন ঘটে, বিরোধীরা রাজনীতি করবেন, সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাকে কী করে মোকাবিলা করবে শাসক? তখন কি রাজ্যের শাসকদলের প্রধানের উচিৎ ছিল না, বিষয়টা দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার? তখন কি শাসকদলের পক্ষ থেকে বলা উচিৎ নয়, ভুল হয়ে গেছে। সেই ভুল মেনে নিয়ে যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সেইদিকে নজর দেওয়া কি উচিৎ নয়? তার বদলে এই রাজ্যের শাসকদলের প্রধান কিংবা সেই দলের অন্যতম মুখপাত্র যা বলেছেন এবং করছেন তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে, তাঁরাই কিন্তু রাজনীতি করছেন এবং তা সচেতনভাবেই করছেন, যাতে আরো জটিল হয় আরজিকর রহস্য। তাই ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে আরজিকর হাসপাতালের মর্মান্তিক ঘটনা।  

ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন, রাজ্যপাল স্বয়ং, যাঁর বিরুদ্ধে কিছুদিন আগেই এক অস্থায়ী মহিলা কর্মীর যৌন হেনস্থার দাবী উঠেছিল। নেমে পড়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি এবং সদ্য সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেকেই। দাবী উঠছে, রাজ্যে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। যাঁরা এই দাবী তুলছেন, তাঁরা কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন, মণিপুরের কথা, হাথরাসের কথা। তাঁদের দলের মানুষেরা, যখন কাঠুয়া বা উন্নাওয়ের ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করেছেন, জাতীয় পতাকা নিয়ে সেই কথা ভুলে গেছেন। উত্তাপের পারদ চড়ানোর জন্য অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু এই কথাগুলো না বলে, শুধু আরজিকর হাসপাতালের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে হবে না। আরজিকর হাসপাতালে অধ্যক্ষের দুর্নীতি নিয়ে অবশ্যই কথা বলতে হবে, কেন তাঁকে পদত্যাগ করিয়ে আবার কলকাতারই অন্য একটি হাসপাতালে কাজে যোগ দিতে বলা হলো, তা নিয়ে সোচ্চারে কথা বলতে হবে, কিন্তু তার সঙ্গে সর্বভারতীয় স্তরে নীট পরীক্ষার দুর্নীতি নিয়েও কথা বলা জরুরি।   

পপ্যুলার শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় প্রচলিত। সমস্ত ক্ষেত্রেই কিছু প্রচলিত ধারণা আছে। ধরা যাক, কেউ চুরি করলে, তাঁকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতে পারলেই, পরেরদিন থেকে চুরি বন্ধ হয়ে যাবে, এই প্রচলিত ধারণা অনেকেই পোষণ করে থাকেন। ডাকাতি বন্ধ করার কোনও প্রচলিত ধারণা আছে কি নেই, তা জানা নেই, তবে এইরকম কিছু একটা উপায় নিশ্চিত প্রচলিত আছে। ঠিক যেমন সমাজে একটা অতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে, নারী নির্যাতনকারী কিংবা ধর্ষণকারী কোনও ব্যক্তিকে ফাঁসি দিলে বা এঙ্কাউন্টার করে ধর্ষককে মেরে দিতে পারলেই আমাদের সমাজ থেকে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে।

সমাজে প্রচলিত এই ধারণাগুলো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও ভালোই বোঝেন, সেই জন্যেই প্রচলিত অনুভূতিতে উষ্কানি দেওয়ার কাজটা তাঁরাই করে থাকেন। সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জানেন, এই ধরনের প্রচলিত দাবীর পাশে মানুষকে সমাবেশিত করা অত্যন্ত সোজা কাজ এবং এই সোজা কাজটা করতে পারলে, অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী যে দাবী এই ধর্ষণ বন্ধ করার প্রসঙ্গে উঠে এসেছে, তাকে পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া যাবে। আরজিকরের ঘটনার প্ররিপ্রেক্ষিতে যখন মহিলারা, ‘রাতের রাস্তা দখল’ নেওয়ার দাবী তুললেন, তখন কিন্তু তার মধ্যে শুধু রাস্তা দখল করার ডাক ছিল না, তার মধ্যে ছিল, মহিলাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশ কিছু বুনিয়াদী দাবীদাওয়া। এই আন্দোলন কখনোই অরাজনৈতিক নয়, অদলীয় হতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে যে প্রশ্ন উঠতে পারতো, তাকে পিছন দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দল কেমন যেন ঐক্যমত্যে পৌঁছে গেল। শুরু হয়ে গেল তরজা, কেন পুরুষেরা ঐ আন্দোলনে সামিল হবেন না, অত রাতে মহিলারা বাড়ি ফিরবেন কী করে, এই সব কথা উঠে এল। তারপরে সেই রাতে, যখন এই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সারারাত আলো দেখা গেল তখন হলো আরজিকর হাসপাতালে হামলা। আলোচনা ঘুরে গেল, কে আরজিকর হাসপাতালে হামলা করলো সেইদিকে। যখনই এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তখনই মানুষের মস্তিষ্ককে অন্যদিকে ঘোরানো সহজ হয়ে যায়। বহু গুজব এবং অপতথ্য কে বা কারা সচেতনভাবে ছড়াতে শুরু করলেন। রাজ্য পুলিশের বদলে কেন সিবিআইকে তড়িঘড়ি তদন্ত করতে দেওয়া হলো তা নিয়ে আলোচনায় শুরু হল। এখানেও প্রচলিত ধারণা, রাজ্যের পুলিশ পক্ষপাতদুষ্ট আর সিবিআই তা নয়। অথচ প্রশ্ন ওঠে না, এই সিবিআই গত দশ বছরে ক’টা কেস সমাধান করেছে? এই প্রশ্ন অনেকে করছেন মহিলাদের 'রাত দখল' করা নিয়েও যাতে সমাজে কোনো আলোচনা না হয়, সমাজ মাধ্যমেও যাতে এই নিয়ে কথা না হয়, সেই জন্যেই সচেতনভাবে আরজিকর হাসপাতালে হামলা হলো ? আসলে আমরা সবাই পুতুল, আমরা সবাই বোড়ে। আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো হাতে। বিকল্প রাজনীতির কথা না বলতে পারলে, আগামীদিনে একইরকমই চলতে থাকবে? বিকল্প রাজনীতির কথাই তো বলতে চেয়েছিলেন মহিলারা। অদলীয়ভাবে আওয়াজ তুলতে চেয়েছিলেন, মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং আরো কিছু মূল দাবী। অদলীয় রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক হতে পারতো, এই ধরনের আন্দোলন কেন দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না, তা নিয়ে কথা হতে পারতো। সেই দাবীর পাশে তো রাজনৈতিক দলগুলো দাঁড়াতে পারতো, তা না করে গুজব এবং কিছু ভিডিও নিয়ে আলোচনাতে মজে থাকলেন মানুষ এবং রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রেরা, আর সামনে উঠে এলো শাসকদলের তরফে সেই প্রচলিত দাবী, ‘ধর্ষকদের ফাঁসি চাই’। যেন ফাঁসি দিলেই কাল থেকে আরো একজন মহিলাও ধর্ষিতা হবেন না। আর কেউ তিলোত্তমা নিয়ে কথা বলবেন না, সবাই ব্যস্ত, ভুয়ো অডিও ভিডিও ফুটেজ শুনতে এবং তা নিয়ে চর্চা করতে। এটাকেই বলে আ্যলগরিদম।এটাকেই বলে ন্যারেটিভ বদল করা। এই যেমন এখন আর কেউ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত স্বপ্নের কথা বলেন না, কিছুদিন পরে আর কেউ তিলোত্তমার কথা বলবেন না। সিবিআই এবং গণমাধ্যম প্রচলিত ধারণাকেই সামনে নিয়ে আসবে, তা নিয়েই আলোচনা হবে। সন্ধ্যের গণমাধ্যমের বিতর্কে প্রচুর চিৎকার হবে। সেই আওয়াজে চাপা পড়ে যাবে, তিলোত্তমা’র চিৎকার, তাঁর কান্না। চাপা পড়ে যাবে, আরো অনেক নির্যাতিতা মহিলার আওয়াজ, যাঁরা শুধু রাতে নন, দিনের আলোতে, নিজেদের পরিচিত মানুষদের দ্বারা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন।

 

 

0 Comments

Post Comment