প্রায় নীরবে নি:শব্দেই চলে গেল ১২ এপ্রিল। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৩৭ তম জন্মদিন। ইতিহাস পাগল, গবেষক, বিদ্বান এই মানুষটি নিজেই রয়ে গেলেন ইতিহাসের অন্ধকারে, উপেক্ষিত এক নায়কের মতো। কথা হচ্ছিল ভগবানগোলা হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক সুদীপ জোয়ারদারের সঙ্গে। যা বললেন তাতে চমকে ওঠার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাকরি গিয়েছিল ১৯২৬ সালে চুরির অভিযোগে। যদিও সেই অভিযোগ শেষ পর্যন্ত প্রমানিত হয়নি। এই ধাক্কার পর আর মাত্র চার বছর বেঁচে ছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩০ সালের ২৩ মে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন আধুনিক ইতিহাস চর্চার অন্যতম নক্ষত্র প্রাচীন লিপি ও মুদ্রার একজন জহুরি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রদীপ জ্বালানোর আগে যেমন সলতে পাকানো থাকে, লেখার আগে মুখবন্ধ, এই প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। সংক্ষেপে তা সেরে নিলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে। এপ্রিল মাসের এক সকালে হঠাৎ সাংবাদিক বন্ধু বিধান ঘোষের ফোন। এবছরটা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের শতবর্ষপূর্তি। ওঁরা মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন বহরমপুরে, আমাকে কিছু বলতে হবে। এতো বক্তা থাকতে এই অধম কেন ?
না, তুই হরোপ্পা, মহেঞ্জোদারো নিজের চোখে দেখে এসেছিস তাই। কথাটা মিথ্যা নয় আদৌ। সেই ২০০৩ সালে ভারত-পাক মৈত্রী সংগঠন, পাকিস্তান-ইন্ডিয়া পিপলস ফোরামের সদস্য হিসেবে বিয়ের পনেরো দিনের মাথায় আমার হানিমুন যাত্রা পাকিস্তানে। দু-সপ্তাহের সেই ছোট্ট সফরে লাহোর, করাচি, মুলতানের পাশাপাশি গিয়েছিলাম হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোতেও। পুরনো চাল ভাতে বাড়ার মতো সেই অভিজ্ঞতা যে প্রায় কুড়ি বছর পর আমাকে ডিভিডেন্ড দেবে কে জানতো ?
আর সভার স্থান হিসেবে বহরমপুরকে বেছে নেবার কারন হল বহরমপুর শহর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধাত্রীভূমি। বিশ্বখ্যাত এই মানুষটি এখানকার কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেছেন ১৯০০ সালে। এই বহরমপুর শহরের রাস্তা ধরেই হেঁটেছেন, আড্ডা মেরেছেন বন্ধুদের সঙ্গে। পরিতাপের বিষয় তার স্মৃতিটুকুও আজ এই শহর মনে রাখেনি।
কোভিডের কারণে এবং অফিসের কাজে সেবার আমার বহরমপুর যাওয়া না হলেও ফের সুযোগ মিলল ৬ জুন। উদ্যোক্তারা এবার কলেজ স্কোয়ারের ত্রিপুরা হিতসাধনী হলে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন। দ্বিতীয়বার ডাক আসায় আর সুযোগ নষ্ট করিনি।
আগেই বলেছি ১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবার নাম মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মা কালীমতি দেবী। বাবা মতিলাল ছিলেন বহরমপুর কোর্টের আইনজীবী। ফলে ছোটবেলা থেকে প্রাচুর্যের মধ্যেই বড় হয়েছেন তিনি। রাখালদাস মতিলালের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কালীমতির আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র জীবিত সন্তান। ফলে আদর যত্নের কোনও কমতি ছিল না। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল নবাবের শহরের স্থান মাহাত্ম্য। তাঁর নবাবি চালচলন ও বেপরোয়া স্বভাব তাঁকে যেমন পরিচিতি দিয়েছে, তেমনি সমস্যাতেও ফেলেছে বারবার। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম বহরমপুরে হলেও এন্ট্রান্স পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসেন তিনি। এন্ট্রান্স পাশের বছরেই নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে কাঞ্চনমালা দেবীকে বিয়ে করেন তিনি। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। আর এই সময়টাতেই মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার নিয়ে বহরমপুর থেকে পাকাপাকি ভাবে বনগার ছয়ঘরিয়া গ্রামে চলে আসেন। ১৯০৭ সালে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রি নিয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন রাখালদাস। ১৯১০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ পাশ করেন তিনি। বিএ পাশের আগেই কিন্তু নিজের জাত চিনিয়েছিলেন রাখালদাস। সেই সময়ই এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তার বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আগুনকে ছাই দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না, রাখালদাসও নজরে পড়ে গেলেন আর্কিওলজিকাল সার্ভের ডিরেক্টর জেনারেল জন মার্শালের । ১৯১০ সালে ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করার পরই ভারতীয় যাদুঘরের আর্কিওলজিকাল বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি পেয়ে গেলেন তরুন রাখালদাস। স্বয়ং জন মার্শাল তাঁর কাজে মুগ্ধ। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পদোন্নতি, হয়ে গেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট। বছর তিনেক পরই ফের প্রমোশন। ওয়েস্টার্ন সার্কেলের সুপার হয়ে কলকাতা থেকে বদলি হয়ে চলে এলেন পুনেতে। এখান থেকেই পরবর্তী ছয় বছর বোম্বাই প্রেসিডেন্সির দুরদুরান্তে তাঁর নেতৃত্বে চলে বহু প্রত্নতাত্বিক অভিযান। এই পর্বেই ১৯২২ সালে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করে বিশ্বকে চমকে দেন রাখালদাস ওরফে আর.ডি ব্যানার্জি। রাখালদাসের এই আবিষ্কারের কাহিনী আমাদের জানা। একদিন বিকালে জমি জরিপের জন্য সিন্ধু নদ দিয়ে নৌকা করে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই চোখে পড়ে এক বিশাল সুউচ্চ ঢিপির। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন জায়গাটার নাম মহেঞ্জোদারো। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ মৃতের স্তুপ। এখান থেকে প্রায়ই উদ্ধার হয় পোড়া মাটি, পাথরের নানান বস্তু, পশুর হাড়গোড়। স্থানীয় মানুষজন ভয়ে বড় একটা এদিকে আসেন না। উৎসুক রাখালদাস ঠিক করলেন এখানে খনন কার্য চালাবেন। কিন্তু তারজন্য অনুমতি নিতে হবে আর্কিওলজিকাল সার্ভের ডিরেক্টর জেনারেল জন মার্শালের।
অনুমতি পেতে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হল না, রাখালদাসের উপর তখন অগাধ আস্থা জন মার্শালের । তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। অনুমতি দিয়ে এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব বহির্বিশ্বে একপ্রকার চুরি করলেন জন মার্শাল । ঐতিহাসিক পি.কে মিশ্র তার বই রাখালদাস ব্যানার্জিঃ দ্য ফরগটন আর্কিওলজিস্ট-এ দাবি করেছেন ১৯২৪ সালের আগে মার্শাল সেভাবে মহেঞ্জোদারোর কথা জানতেনই না। পিকে মিশ্র তার বইতে স্পষ্ট করে লিখেছেন, “Marshall took direct charge of the excavation from winter 1925-26. By that time Banerjee had done all the work a discoverer should have done.”
ইংরাজিতে একটা কথা আছে, Before killing a dog, give it a bad name. বাংলায় তার ভাবার্থ করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরালেই পাজি । রাখালদাসকে দিয়ে কাজ হাসিল হয়ে গিয়েছিল। এখন তাঁকে রাখলেই বিপদ আরও বেশি । তাই তাকে ডিপার্টমেন্ট থেকে কৌশলে সরিয়ে দেবার প্লানও রেডি করে ফেললেন জন মার্শাল। নিন্দুকেরা বলেন তাঁর মদতেই রখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনলেন তাঁরই একদল সহকর্মী। আসলে সেসময় তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল অফিস। মার্শাল ছিলেন তাঁর গুনমুগ্ধ। সেই জন মার্শালের সঙ্গে বসে ধুমপান, আড়ালে নিজেকে তাঁর সমকক্ষ বলে বেড়ানো, সহকর্মীদের অনেকেই তা মেনে নিতে পারেননি। আশ্চর্যের কথা যে জন মার্শাল রাখালদাসের গুনমুগ্ধ ছিলেন, তিনি কিন্তু তাঁকে বাঁচাতে তেমন তৎপর হননি । চাকরি যাবার পর আর্থিক সংকটে পড়লেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয় সম্পত্তি কম ছিল না, বেতনও পেতেন প্রচুর। কিন্তু তার খরচও ছিল চোখে পড়ার মতো। বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে খানা-পিনা বাড়িতে লেগেই থাকতো। চালচলনে ছোটবেলা থেকে নবাবিয়ানা তো ছিলই। আর্থিক অসুবিধার সঙ্গে যুক্ত হল শারীরিক অসুস্থতাও। ডায়বেটিস আগেই ধরা পড়েছিল। এই অবস্থায় উড়িষ্যার ইতিহাস লেখার কাজ পেয়ে কিছুটা সুরাহা হল। ১৯২৮ সালে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হলেন। কিন্তু এই কাজে যতটা সম্মান ছিল ততটা অর্থ ছিল না। বিশেষ করে তার মতো খরুচে লোকের পক্ষে। এরমধ্যে বড় ছেলের মৃত্যুশোক আর সামলাতে পারলেন না। একজন অসুখী মানুষ হিসেবে প্রয়াত হলেন ১৯৩০ সালের ২৩ মে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ।
অনেক কাজ বাকি থেকে গেল। কিন্তু যা করে গেলেন তাও কম নয়। মহেঞ্জোদারো পাহাড়পুর সহ নানান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার তো আছেই তাছাড়াও রয়েছে প্রচুর গবেষণামূলক বইপত্র, ঐতিহাসিক, সামাজিক উপন্যাস। তার দুখণ্ডে বাংলার ইতিহাস, পাষাণের কথা, শশাঙ্ক, ধর্মপাল ইত্যাদি গ্রন্থগুলি সুখপাঠ্য, তথ্যানুগ, আজও পড়তে ভাল লাগে।
২০০৩ সালের ডিসেম্বরে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানেও স্মৃতি ফলকে দেখেছি স্যার জন মার্শালের নাম ও ছবি জ্বলজ্বল করছে। নিচে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহানীর নাম ও ছবি। তারা ভারতীয় তাই তাদের ছবি মলিন, পরিচয়টিও খুব কষ্ট করে পড়তে হয়। আসলে এখনো আমরা আমাদের রক্তে সেই উপনেবেশিকতাকেই তো বয়ে নিয়ে চলেছি। তাই তারা উপেক্ষিত নায়ক হিসেবেই থেকে যাবেন। ললাট লিখন আবিষ্কারের শতবর্ষ পরেও তো আর কাটল না।