এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ যত বিতর্ক এনে দিয়েছে, যত মানুষকে প্রতিবাদী আর সোচ্চার করে তুলেছে তার উদাহরণ অন্য কোন বিশ্বকাপে হয়েছে বলে মনে পড়ে না। ১৯৩৪এর ফ্যাসিস্ট ইতালিতে আয়োজিত বিশ্বকাপ কিম্বা ১৯৩৬এর নাতসি জার্মানীর অলিম্পিকের সাক্ষীরা আজ যদি কেউ বেঁচেও থাকেন তাঁরা বয়োভারে ন্যুব্জ। অন্যদিকে বিশ্বকাপ বা অলিম্পিক আয়োজক ঔপনিবেশিক কেন্দ্র প্যারিস, লন্ডন, ওয়াশিংটন, মস্কোর কপালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি বা জার্মানীর মতো পরাজয় জোটেনি বলে ৭৮এর আর্জেন্টিনা নিয়ে যেটুকু ওজর আপত্তি দেখা যায় সেই দেশগুলির বেলায় তাও দেখা যায়নি।বহির্বিশ্বে এইকবছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ক্রমশ গ্রহণীয় হয়েছে সমকামিতা, ইরানে কুর্দ যুবতী মাশা আমিনীর মৃত্যুতে শুরু হয়েছে গণঅভ্যুদয়। রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেনকে। অন্যদিকে যে কাতারে বিশ্বকাপ হচ্ছে, সেখানে ইসলামী আইন অনুযায়ী মদ্যপান, সমকামিতা দণ্ডনীয় অপরাধ। কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনেও শ্রমিক মৃত্যুসহ অজস্র ইস্যু আছে। তাই এক বিরাট জনতা যেমন কাতারের কড়াকড়ি নিয়ে প্রতিবাদে উত্তাল, তেমনি ইরান বিক্ষোভেরও প্রভাব পড়েছে কাতারে। সাথে জুড়েছে গোয়েন্দা দফতরের দাপটে ভারতছাড়া জাকির নায়েকের কাতারে উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ।
পাশাপাশি কাতারে আরেক প্রতিবাদও চলছে। দখলরাষ্ট্র ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সাধারণ কাতারিদের প্রতিবাদ। কেউ ইজরায়েলী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেও অস্বীকার করছেন, কেউ সরাসরি বলছেন ওই ভূখণ্ডটা প্যালেস্টাইন, কেউ সাংবাদিকের মাইকেই উগরে দিচ্ছেন সমস্ত ক্ষোভ। ভারতেও এক বড় অংশ পশ্চিমা মূল্যবোধভিত্তিক প্রতিবাদ নিয়ে ক্ষিপ্ত। ২০১০এর একটি ভিডিও দেখিয়ে তাঁরা বলছেন ভিডিওতে যে ছেলেমেয়েদের দেখছেন তারা লন্ডনের সেন্ট জেমসের ছাত্রছাত্রী। আরা আবৃত্তি করছে একটি সংস্কৃত শ্লোক। দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসের ব্যাটন হস্তান্তর অনুষ্ঠান ছিল এটা। হয়েছিল ব্রিটেনের মাটিতে। যারা এখন কাতার বিশ্বকাপে কুর'আনের আয়াত তিলাওয়াত করা নিয়ে আপত্তি করে গলা ফাটাচ্ছেন তাঁদের দিকে প্রশ্ন উঠছে কমনওয়েলথ গেমসের দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা উঠলেও তখন কারও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের আয়োজনে খ্রীস্টান ব্রিটেনের মাটিতে ঘটে চলা এই অনুষ্ঠানে শ্লোক আবৃত্তির আপত্তি ছিল না কেন? যে বিবিসি কুর'আন তিলাওয়াত বয়কট করেছে তারাও দিল্লি গেমসে শ্লোক আওড়ানো নিয়ে কিছু সমস্যা দেখেনি। কুর'আন নিয়ে আপত্তিকারীদের গলাবাজির মধ্যে অঙ্গহারা এক মানুষের বিশ্বমঞ্চে উঠে এসে মর্গ্যান ফ্রিম্যানের মতো মানুষের সামনে নিজেকে নিজের দেশকে নিজের সংস্কৃতিকে উপস্থাপনা করার প্রয়াসও চাপা পড়ে যায়। আপত্তিওয়ালাদের কোলাহলের মধ্যে তিলাওয়াত করা কুর'আনের আয়াত "হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার।" এই মহান বার্তাটাকেও চেপে রাখার এক কদর্য প্রয়াসও দেখা গেল। তারও জবাব আসছে সামাজিক মাধ্যমে। প্রশ্ন উঠছে কেন এই Selective Outrage? সাথে এও প্রশ্ন করছেন অনেকে তাহলে কলকাতা ময়দানে খুঁটিপুজোতে আপত্তি নেই কেন? যাঁরা ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সংগীত গান নি বলে বাহবা দিচ্ছেন তাঁদেরও প্রশ্ন করা হচ্ছে রিহানা কৃষক আন্দোলনের সমর্থন করা ট্যুইটের প্রতিক্রিয়ায় যেসব ভারতীয় খেলোয়াড়রা উঠে পড়ে নেমেছিলেন সেই সময়টা এঁদের তরফ থেকে কোনও প্রতিবাদ চোখে পড়েনি কেন?
মুখ ঢেকে সমকামিতার প্রতিবাদ জানানো জার্মানীও হয়েছে ব্যাপক ট্রোলের শিকার। তাঁদেরও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে র্যোমের মতো নাৎসি নেতারা সমকামীই ছিলেন। আজকে মিমের যুগে তেড়ে আসছে ট্রোলবাহিনী। যার একটাই বক্তব্য "Your Values Aren't Universal."
কেবল কাতারপন্থীরাই নয়, ফিফা কর্তা ইনফ্যান্তিনো বলেছেন, "I think for what we Europeans have been doing for 3,000 years around the world, we should be apologising for the next 3,000 years before starting to give moral lessons to people." He asked, "how many of these European companies who earn millions and millions from Qatar or other countries in the region—billions every year—how many of them have addressed migrant worker rights? I have the answer: none of them, because if they change the legislation it means less profits. But we did. And FIFA generated much, much, much less than any of these companies, from Qatar."
প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক অবরোধ কাটিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করা কাতারে এসব দেখে ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই মন্তব্য করছেন পশ্চিমী মূল্যবোধের বিশ্বব্যাপী প্রভাব আজ ক্ষয়ের সম্মুখীন।