একদিন রিক ধপ ক’রে পড়ে গেল। মাথার কোণে লেগেছিল টেবিলের পায়াটা। একটা কাঁচের গ্লাস পড়ে ঝন ঝন ক’রে ভেঙে গেল। মিলি অবশ্য দৌড়ে গিয়ে রিকের মাথার কাছে দাঁড়িয়েছিল। কাচ যেন ওর গায়ে না-লাগে খেয়াল রেখেছিল। টেবিলের পায়াটায় দু’বার নিজের পা ঠুকে দিয়েছিল। কিন্তু বাবা আর দাদা এসে মিলিকেই খুব বকল। রিকের কান্না থেমে গেছিল। মিলির গালে দু’বার মেরে দাদা জোর ধমক দিয়ে বিছানার দিকে পাঠিয়ে দিল। বয়েস হয়েছে, বোধবুদ্ধিগুলো লোপ পেয়েছে। আগে কত বুদ্ধি ছিল। বোঝা হয়ে গেছে। মিলি শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। নাঃ কম্বলটা ওর গায়ে কেউ টেনে দেয় নি আর। রিককে নিয়ে ব্যস্ত ছিল তো, তাই। মনখারাপ হয়েছিল মিলির। ভাগাও তো এটাকে। এমনিও শালা বুড়ো হলে অকেজো বোঝা হয়ে যায়। কোনদিন রিককে…। না, না, দাদার ওর’ম মারমুখী মেজাজ দেখে মিলির মনখারাপ হয় নি। রিক বাচ্চা, ওর খুব লেগেছে মাথায়, কেঁদেছে অনেক। রিকের বুকের ভেতর থেকে দুঃখ আর সমবেদনা মেশানো শব্দ বেরিয়ে এসেছিল। তারপর অবশ্য রিক ওর’ম করেছে। মিলির মাথাটা খাবলানো। কান মুড়ে দেওয়া দু-বার। তিনবার। মিলি মজা পেয়েছে। ওর ভেতর থেকে খুশির শব্দ। রিক দৌড়েছে। মিলি শুয়ে থেকেছে বিছানায়। ওঠে নি। আহা, রিক বাচ্চা, ও যদি পড়ে যায়, ব্যথা পায় আবার? রিক কয়েকদিন পর থেকে ব্যাপারটায় আর মজা পাচ্ছিল না। কি রে, কি রে। রান, মিলি। ধর, ধর, আমায়। মিলি দৌড়ায়নি। একদিন অভ্যাসবশে গা ঝেড়ে উঠে দৌড়তে গিয়েও দাদাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছে। বাপি, ও বাপি, মিলি বুড়ো। দৌড়াতে পারে না। ধুস্। ও বাপি… হাহা, বুড়ি বল! হুম, সন্ধ্যে। অনেকক্ষণ। শীত করছে। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এল। গাড়িতে। মুখ বাড়িয়ে, জানলা দিয়ে, হাওয়া খেয়েছে। দুপুরের রোদে, বিকেলের রোদে গরম লাগে নি। খুব আরাম। মিলি বরাবর ওর’ম করেই হাওয়া খায়। মাঝে একটা গাছপালা ঘেরা জায়গায় থামল। বাবা, দাদা, দিদি, রিক, ড্রাইভার নরেন, মিলি সবাই নামল। খাওয়া দাওয়া হল। সবাই একসঙ্গে বসে মাংস, ভাত, মাছ, মিষ্টি। রিক আর মিলি দৌড়াদৌড়ি ক’রে খেলল অনেকক্ষণ। মিলির জন্য সবজি দিয়ে সেদ্ধ মাংস আর ভাত এসেছিল। তার আগে অবশ্য বিস্কুট খেয়েছিল কয়েকটা। শরীরটা একটু খারাপ মিলির। দৌড়াদৌড়ি ক’রে রিকের পেছনে বসে পড়েছিল। হাঁপাচ্ছিল। গান চালিয়েছিল দিদি। মোবাইলে। খুব জোরে আওয়াজ হয় যে ছোট্ট যন্ত্রটা, স্পিকার, ওটা থেকে আওয়াজ হচ্ছিল জোরে। মিলির কানে লাগছিল। মাথাটা নামিয়ে শুয়েছিল। থাক, কতদিন বাদে সব্বাই বেরিয়েছে একসঙ্গে। মাথার ভেতরটা কেমন করছিল, তবু মিলি সরে যায় নি। শুয়েছিল। বিকেল শেষ হব হব। শিরশিরে হাওয়া। সবাই গাড়িতে উঠেছিল। চলো, চলো। ওই মার্কেটের রাস্তাটা কাছেই। হার্ডলি টেন মিনিটস। ম্যাপ তো তাই বলছে। ইস্কুলটা মার্কেটের জাস্ট আগে। হুম, চলো। বেলাবেলি ফেরা হবে না। সন্ধ্যে নামার সময়ে ফেরাই ভাল। অন্ধকারে দৌড়াতে পারবে না রাস্তা চিনে। খুঁজতে পারবে না। রিক খুশিতে হাততালি দিয়েছিল। দাদু, জানো, আমি দেখেছি জেসন কাকুর বাড়িতে। ওর নাম দিয়েছি একটা- সোফি। ভাল না, নামটা? পরের শনিবারেই ওকে বাড়িতে… আঃ, চুপ কর, বড্ড বকবক করে। আর, ইয়ে, পরের শনিবারে একটু পাম্মি মাসির বাড়ি যাব। তার পরের বুধবার ছুটি আছে। ওইদিনই তোর সোফিকে… মিলি জানলা থেকে মুখ সরিয়ে দেখল রিকের খুশিটা দমে গেল। কীসের কথা বলছে? নতুন কেউ আসবে বাড়িতে? কে? মিলি চেনে? গাড়ি থামল। দাদা নামল। রিকও। বাবা নামেনি। দিদি কানে মেশিন গুঁজে গান শুনছে। ওদেরও শীত করছে। গায়ে চাদর জড়ানো। চা খাবে দাদা। মিলিও নেমেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল না। নেমেছে তবু। রিককে সঙ্গ দিতে। ছোট দু’টো দোকান। রিক একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিল। মিলি এখন খাবে না। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে। গাড়ি দারুণ জোরে চলে গেল। হঠাৎ। মিলির শীত করছে। অনেকক্ষণ। সন্ধ্যে এখন রাতের দিকে। দ্রুত। মিলিদের সাদা গাড়িটার মতোই। মিলি হাত-পা মুড়ে। এভাবেই। বসে থাকবে অনেকক্ষণ
#
মিলির চোখে এত মায়া। যে দেখবে, ভাল না বেসে পারবেই না। সাড়ে ছ’বছর বয়েস। তড়বড় ক’রে বেড়ে উঠেছে। চার মাস একুশ দিন বয়স, যখন এসেছিল। ফুটফুটে। তুলোর বল। কানগুলো নোটা নোটা। অবাক চাউনি। প্রথম দু-দিন চুপ ছিল। মনখারাপ হয়েছে, ইশ, ওর মায়ের থেকে চলে এসেছে।
-দেখো দেখো, চোখদু’টো কী সুন্দর। মুখ জরিয়ে ধরে চকাৎ চকাৎ ক’রে চুমু খেল বিল্টু।
-ইশ্, ইশ্, ছাড়। কতরকম ভাইরাস থাকে ওদের লালায়। আর, ধারালো দাঁত। একবার দাঁত লেগে কেটে গেলেই জলাতঙ্ক।
-না, না, ওর সবরকম ভ্যাক্সিন নেওয়া আছে। রোগ-ফোগ নেই।
-এঃ, একবার রক্ত বেরোলেই প্যাঁক প্যাঁক ক’রে চোদ্দটা ইঞ্জেকশন। পাছায় দেবে।
-পাছুতে দেয়, মা?
-আরেঃ, এই দেখো আমিও চুমু খেলাম। কী শান্ত। খুব মজা পেয়েছে দেখো। ল্যাজ নাড়ানো থামছেই না।
-অবশ্য, ভ্যাক্সিন দেওয়া থাকলেও আঁচড় বা কামড় থেকে জলাতঙ্ক হতে পারে। রেয়ার কেস। তবে, হয়। সেদিনই তো পড়লাম হোয়াটসঅ্যাপে। সমীরণদা পাঠিয়েছিল। নিউ ফ্লোরিডার কেস। কতদিনের পোষা। সবরকম ইঞ্জেকশন নেওয়া কুকুরটার। একদিন মালিকের সঙ্গে খেলতে খেলতে কামড়। তিনমাস পরে জলাতঙ্ক।
-ইশ্, বাঁচে নি?
-নাঃ, বাঁচে নাকি। ভুগে ভুগে মারা গেছিল। কুকুরটাকে কোন একটা রিহ্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কুকুরটাও নাকি মনের দুঃখে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ ক’রে দু-সপ্তাহের মধ্যেই মরে গেল।
-স্যাড কেস। তবে, মিলি ওরকম কামড়াবে না! তাই না রে, মিলি?
-দেখো, দেখো, কেমন মাথা নাড়ল! স্যুইট বেবি!
-সে তো সব কুকুরই তোর কাছে স্যুইট। আমার অত আদিখ্যেতা পোষায় না। তুই তো নাকি রাস্তার কুত্তা বিল্লিদেরও ডেকে ডেকে খাওয়াস।
-হ্যাঁ, খাওয়াই তো। ওদের খাবার কিনি অনলাইনে অর্ডার দিয়ে। শোন শোন, এরাই আসল লয়াল। এরাই আসল মানুষ, বুঝলি?
-থাম তো। যেদিন কামড়াবে, বুঝবি। কামড় তো খাসনি কখনও
-তুই ক’বার খেয়েছিস? নিশ্চয়ই ওদের পোঁদে লাগতে গেছিলি?
-কিচ্ছু না। অনেক আগে। তখন আমার আট-নয় হবে। পার্কে বলচোর খেলছিলাম। শীতের সন্ধ্যে। আমি, হাবু, রণেন, পুষ্পল। আমি দৌড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ দু’টো কুত্তা শালা হঠাৎ আমার দৌড় দেখে তাড়া করল। ব্বাপরে। খিঁচে দৌড় লাগিয়েছি। ওরাও দৌড়োচ্ছে। মিত্তিরবাড়ি অবধি দৌড়েছি, ভাব, কতটা রাস্তা। ওই যে বটতলার দিকে ভাঙাচোরা মিত্তিরবাড়িটা।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। ট্যাক্সি প্রমোটার হেব্বি হুজ্জুত ক’রে কিনে নিল। সাঁই সাঁই ক’রে আটতলা বিল্ডিং তুলে দিল। যাক গে, তারপর? কোথায় কামড়াল?
-না, কামড়ায়নি। আমিই দৌড়তে দৌড়তে হোঁচট খেয়ে ধপাস। পা মচকাল। মাথায় চোট। ভুগেছিলাম বেশ ক’দিন। সেই যে ট্রমা হল, উফফ্! শোন বাল, ডগি-স্টাইলই ভাল। ডগি-ফগি ডেকে বেশি আদিখ্যেতায় ঝাঁট জ্বলে যায়।
-আরে আরে, দেখো, স্নোয়ির সঙ্গে মিলির কেমন ইন্টুপিন্টু চলছে। স্নোয়ির চার বছর হয়ে গেল। ছোঁকছোঁকটা খুব বেড়েছে আজকাল। লাব্রাডর। ব্রিড করানোর ভাল অপশন পেলে-
-আচ্ছা, একটা জিনিস বল তো, মানে তোদের কুত্তাপ্রেম দেখেই মনে হল- ছা-পোষা মধ্যবিত্ত তো বুঝলাম। উচ্চবিত্তদের কী বলে? কুত্তা-পোষা উচ্চবিত্ত?
-হা হা হা! তুই কেন এসেছিস বল তো? আজ এ বাড়িতে কুকুরই প্রোটাগনিস্ট, জানিস তো!
-ধুস্, তানি রিকের বন্ধু তো। রিক ইনভাইট করেছে সিমিকে। জুনির মিটিং আছে। অগত্যা। তানির সঙ্গে আমাকেই আসতে হল।
-সে ভাল করেছিস। দেখাও হল। একসঙ্গে অনেকদিন পরে মা খাওয়া। লাস্ট বোধহয় সেই অবিনের বাড়িতে। আরে, অবিনরা সেই বেড়াল পুষত, মনে আছে?
-আমার অবিশ্যি বেড়াল ব্যাপারটা মন্দ লাগে না। কুত্তার থেকে বেটার। নিজের মত থাকে। ঘাঁটায় না। তবে, অবিনদের বাড়িতে ওই পাঁচ-ছটা বেড়াল। বেড়ালের পেচ্ছাপ আর কেমন গুমো গুমো গন্ধ কেমন। অ্যাঃ, বমি পেয়ে গেছিল।
-চলো বাপি, কেক কাটা হবে। স্নোয়ির কী আনন্দ দেখো! আমাদের খুব ভাব হয়ে গেছে। শোনো না, মিলিকে দু’দিনের জন্য আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে? প্লিজ
-চলো, কেক কাটছে। খিদেও পেয়েছে। বাড়ি ফিরতে হবে। কাল রোহানের স্কুলের প্রজেক্ট জমা দিতে হবে। চলুন
মিলি খুব খুশি ছিল সেদিন। এর’ম ভিড় তো রোজ হয় না। নতুন লোক কতজন। সব্বার গন্ধ অবশ্য ভাল না। কে পছন্দ করে না, খুব ভাল বোঝে মিলি। মিলিও কাছে ঘেঁষে না তার। সামনে গিয়ে একবার পায়ে গা ঘষে দিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে চলে যায়।
#
ভাস্করই কথাটা পাড়ল। খাওয়ার টেবিলে। রাতে। পরোটা আর খাসির কষা মাংস। স্যালাড। কাচের বাটিতে পুডিং। রিক আর সুমনা ছিল। অম্বিকেশের খাওয়া প্রায় হয়ে এসেছে। দু’টো পরোটা আর দু’পিস মাংস। পুডিংয়ের বদলে একটা রসগোল্লা। সাতষট্টি চলছে। মেপেজুপে খাওয়া। একবার মিলিকে দেখে আসব ভাবছি। প্রথম পরোটার শেষ টুকরোটার ওপরে মাংসের ছেঁড়া একটা টুকরো আর ঝোল মাখিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলল ভাস্কর। আহ্, মাংসটা একদম মাখনের মতো নরম। কুরেশির মাংসের জবাব নেই, বিউটি রেঁধেছেও খাসা! চোখটা আধো বুজে চিবোচ্ছিল ভাস্কর। অম্বিকেশ রসগোল্লার রস চিপতে চিপতে তাকাল। কী দরকার? থাক না। মায়া বাড়িয়ে লাভ কী? সুমনা জাম্বো বাটি থেকে স্যালাড নিচ্ছিল। আমাকেও দাও তো দু’টো শশা। ভাস্কর প্লেট থেকে টমেটোর রিঙ মুখে তুলতে তুলতে বলল। ধুস্, মায়া-ফায়া না। আসলে, একটা এক্সপেরিমেন্ট করব ভাবছি। রিক খাওয়া থামিয়ে তাকাল। খুশি। এক্সপেরিমেন্ট? কী এক্সপেরিমেন্ট? সুমনাও সাগ্রহে তাকাল। দ্বিতীয় পরোটা ছিঁড়ে মাংসের চর্বি একটু নিল ভাস্কর। খাসির মাংস একদম লিন্ড হলে ভাল লাগে না। কিন্তু শরীরও ঠিক রাখতে হবে। তেমন ব্যালান্স করেই কুরেশির দোকান থেকে মাংস আনে ভাস্কর। চিবোতে চিবোতে পরোটা-মাংসের টুকরোটা গালের একদিকে ঠেলে বলল, আসলে রিক সেদিন হঠাৎ বলল মিলি কেমন আছে দেখে আসি চলো। তখন পাত্তা দিইনি। পরে মাথায় এলো। একটা এক্সপেরিমেন্ট করলে কেমন হয়! ওদের গন্ধশক্তি প্রবল। ওরা নাকি প্রিয়জনের উপস্থিতি টের পেয়ে যায় ঠিক। ন্যাচারাল ইনস্টিংক্ট। পাঁচ মাস হয়ে গেল। ও কি এখনও চিনতে পারবে আমাদের? ইনস্টিংক্ট বলো আর স্মেল সেনস্, মালিককে চিনতে পারবে? অম্বিকেশ খাওয়ার পরে বসে থাকে না। আজ রইল। চিনতে পারবে না কেন? এগার বছর এ বাড়িতে থেকেছে, খেয়েছে। খুব ভাল করেই বুঝতে পারবে। সুমনারও খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। মাংসের শেষ টুকরোটা বাটি থেকে পাতে নিতে নিতে তাকাল। আর, তাছাড়া, ও গাড়িটাও চেনে। ডিজায়ারটা নিয়েই তো যাবে, ওই গাড়িতে কতবার উঠেছে ও। বুঝতে পারবে না তোমাদের প্রেজেন্স? ভাস্কর উত্তেজনায় পরোটা মুখে তুলতে গিয়েও পাতে নামিয়ে রাখল। ওটাই তো এক্সপেরিমেন্ট! ডিজায়ারটা নিয়ে যাব না! রেন্টের গাড়ি নিয়ে যাব। ও চেনে না গাড়িটা। জানলাটা খুলে রাখব। ওই জায়গায় কিছুক্ষণ ওয়েট করব। বেশি না, মিনিট পাঁচেক। বড়জোর ছ’মিনিট। দেখব, ও দৌড়ে আসে কিনা। রিক হেসে উঠল। দারুণ হবে, দারুণ হবে! ওয়াও! মিলি বুঝতে পেরে গাড়ির কাছে এলে কাচ তুলে দেব, ভেতরে দেখতে পাবে না। চলে গেলে আবার কাচ নামিয়ে দেব। ওয়াও! সুমনার খাওয়া শেষ। কিন্তু, ও যদি ওখানে না থাকে? বলা যায় না, হয়তো অন্য কোথাও চলে গেছে। ডু য়্যু রিমেম্বার দ্য এক্স্যাক্ট পয়েন্ট হোয়্যার উই লেফট হার? বা, ইফ শি হ্যাজ… অম্বিকেশ বেসিনে মুখ ধুয়ে ব্রাশে পেস্ট লাগাচ্ছিল। নাঃ, মরবে না। বুড়িয়েছে ভালই। চেহারাটা একটু ঝরেছিল শেষ দিকে। এখন হয়ত ভাল খাবার-টাবার জুটছে না বলে খারাপ হয়েছে। ভাস্কর পুডিং খাচ্ছে। বাঃ, অসাম। পারফেক্ট ব্লেন্ড অব ইনগ্রিডিয়েন্টস! হ্যাঁ, ১৩-১৪ বছর তো বাঁচার কথাই। মিনিমাম ১২। আর, দেখাই যাক না চান্স নিয়ে। যদি ওখানে না থাকে, তাহলে এক্সপেরিমেন্টটা হবে না। সেক্ষেত্রে না’হয় একটু বেড়ানো হয়ে যাবে। ফ্রেশ এয়ার। টাইম পাস।
মিলির শীত কমে গেছিল। টের পেয়েছিল অনেকগুলো কুকুর ওর দিকে এগিয়ে আসছে। চোখ জ্বলছে। দাঁত বেরোচ্ছে। আর, কানফাটা চিৎকার। মিলি একা। দাদা, ঋক, বাবা, দিদি ফিরে এল না। আসবে। একটু পরেই আসবে। কিন্তু তার আগে এই দলটাকে সামলাবে কী ক’রে? সামলাতে পারল না। তিনটে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপরে। চার নম্বরটা দূরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। মিলি যেন পালাতে না পারে। মিলির শরীর ঘষটে যাচ্ছে শক্ত রাস্তায়। লোম খুবলে নিচ্ছে ওরা। মিলিরও দাঁত বেরোল। নখ। কিন্তু ধার নেই আগের মতো। পরশু সকালেই বাবা ওর নখ কেটে দিয়েছে। মিলির নাকের পাশে দাঁত বসিয়ে দিল একটা। মিলির পিঠে চেপে উঠে কোমরে দাঁত বসাচ্ছে আরেকটা। মিলি ঝটাপটি ক’রে সরাতে চাইছে নিজেকে পারছে না। মিলি দাঁত বসাল একটার কানের নিচে। কিন্তু ওর পেটে নখ বসে যাচ্ছে। মিলির নাকের পাশ থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। রতু বুড়ি লাঠি নিয়ে এসেছিল। ভাগ্, ভাগ্, লাঠি ঠুকে তাড়িয়েছিল বাকিদের কোনওমতে। হাতের গ্লাস থেকে জল ছুঁড়ে দিয়েছিল। মেরে ফেলল রে, আবাগীর ব্যাটাগুলো মাদিটাকে মেরে ফেলল। মিলি কোনওমতে একটা ঝাঁপ-বন্ধ দোকানের ভাঙা দরজার পাশে গিয়ে বসেছিল। আতঙ্ক। বাবা কোথায়? দাদা? মিলির ভয় করছে খুব। গাড়ি গেল একটা খুব জোরে। মিলির গা ঘেঁষে। দাদারা এল? নাঃ, এটা ওদের গাড়ি না। দোকানের দরজার নিচে শীতে কুঁকড়ে বসে মিলি গাড়ি দেখছিল। বাবা এল? ওই তো ঋক? ওই যে গাড়িটা আসছে? মিলি ঠিক বুঝতে পারবে দাদা ওকে নিতে এলে।
কাদের বাড়ির কুকুর, ছেড়ে দিয়ে গেছে। কি, এ পাড়ায় দেখিনি তো আগে। না, না, এটা অ্যালসেশিয়ান। ধুর ল্যাও, তুই অ্যালসেশিয়ান চিনিস? এটা স্পিৎজ। কায়দা ক’রে বলেছিল জগা। হ্যা হ্যা ক’রে হেসে উঠেছিল চাঁদু। ইংরিজি মারাস না। কায়দা ক’রে বললি তো স্পিৎজ, বানামটা বল তো! নিলু নিশ্চিত এটা ডোবারম্যান। মাঝে মাঝে এসব আলোচনা হত মিলিকে নিয়ে। মিলি তখন রতু বুড়ির বাড়িতে খায়। পাড়ার কেউ কেউ হাড় বা কাঁটা দিলে মিলি এহন খায়। বাবা ওকে কখনও মাছের কাঁটা দেয় নি। মাংসের হাড় চিবিয়ে কী মজা পেয়েছে মিলি। কিন্তু, এগুলো বড্ড শক্ত। মিলি চিবোতে পারে না ভাল ক’রে। দেরি হয়। ততক্ষণে অন্য কুকুরগুলো ভাত-মাছের কাঁটা-মাংসের হাড়-ঝোল সব সাফ ক’রে দেয়। মিলি একটু একটু খায়। অবশ্য রতু বুড়ির বাড়িতে একসাথে খায় বলেই হয়ত কুকুরগুলো আগের মতো ওকে ছিঁড়ে ফেলতে চায় না। পাড়ার সব বাড়ির দরজায় দরজায় দৌঁড়ে গিয়ে খাবার খায় বাকিরা। মিলি যায় না। সেইজন্য ওকে আগের মতো শত্রু ভাবে না কুকুরগুলো। মিলি আরেকদিন খুব জখম হয়েছে পাটকিলে কুকুরটার নখে। একটা বেড়ালছানা চলে এসেছিল দোকানের সামনে। ব্যাস, দু’টো কুকুর নখ বের ক’রে তেড়ে এসেছিল। ওর পেট ছিঁড়ে দেবে। ঘাড় কামড়ে ভেঙে দেবে। মিলি বুঝতে পেরেছিল। মিলি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বেড়ালের বাচ্চাটা ভয়ে কাঁপছে। মিলি ওকে আগলে দাঁড়িয়ে। তখনই পাটকিলে কুকুরটা ওর ওপর লাফিয়ে নখ বসিয়ে দিয়েছিল। দ্যাহ শালা, কেমন বাঁচাল বেড়ালটাকে। এরাই জানবি আসল প্রাণী। ভাগ্ শালা, অন্যগুলোও তো কুত্তা, ওরাই তো মারতে গেছিল বেড়ালটাকে। ভুতো জল ছিটিয়েছিল দোকান থেকে। চলে গেছিল বাকি কুকুরগুলো। মিলি বাচ্চাটাকে ঠেলতে ঠেলতে ওই বন্ধ দোকানের ভাঙা দরজার নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। চিড়বিড় ক’রে উঠেছিল কোমরের নিচে। গলার পাশে। চুলকোচ্ছিল মিলি। আগে একবার এর’ম হয়েছিল। দিদি ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল তিনদিন। ব্যাস, আর অসুবিধে হত না মিলির। কিন্তু কতদিন হয়ে গেল, এই ঘা বেড়ে যাচ্ছে। নাকের পাশ থেকে মাঝে মাঝেই রক্ত পড়ে। দিদি কবে আসবে ওষুধ নিয়ে?
#
ঋকের ভাল লাগছে না মিলিকে। ঝিমোয় খালি। আগে তাও দৌড়াদৌড়ি করত, খেলত। এখন খেলে না। ঋক কোথাও থেকে বাড়ি ফিরলে অবশ্য একইভাবে পায়ে এসে নাক দিয়ে ধাক্কা মারে। তারপর জড়িয়ে ধরে কোলে ওঠে। কিন্তু, ঋকের মন ভরে না। সেদিন খাবার টেবিলে লোম পড়ে ছিল। ছড়ানো ছেটানো। সুমনা খাবার টেবিলে বা পাতে চুল একদম নিতে পারে না। খুব ঘেণ্ণা লাগে। বমি পায়। বাকি খাবার ফেলে দেয়। অম্বিকেশেরও অস্বস্তি হয়। খাবার ছেড়ে উঠে যায় না বটে, তবে, চুল-পড়া অংশটা ফেলে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফের খেতে বসে। দু-তিন মাস যাবৎ মিলির শেডিং বেড়ে গেছে। খাবার টেবিলে প্রায়ই লোম পড়ে থাকে। মিনুদি মুছে পরিস্কার ক’রে যাওয়ার পরেও ফের লোম পড়ে। সুমনা বা ভাস্কর খেতে বসার আগে টেবিল মুছে নেয়। ঋকের বিছানা ঝেড়ে দেয় দু’বার ক’রে। অফিস থেকে ফিরে খেতে কারই বা এত মোছামুছি ভাল লাগে? একদিন ভুলে গেছিল ভাস্কর খাবার টেবিল মুছতে। ব্যস, সুমনার খাওয়া পণ্ড। প্লেটের ধারে দু’গাছি লোম আটকে আছে। অম্বিকেশের প্লেটেও একদিন পড়েছিল। মুখটা কুঁচকে পরিস্কার ক’রে হাত ধুয়ে ফের খেতে বসেছিল অম্বিকেশ। চেনা ভেট আছে। বিকাশ দাম। মিলিকে নিয়ে গেছিল অম্বিকেশ আর সুমনা। ভেট বলেছিল- এজিং। অবশ্য একটা ছোট ইনফেকশন ধরা পড়েছিল। ওষুধ খেতে কয়েকদিন শেডিং বন্ধ ছিল। কিন্তু আবার বেড়েছিল এক মাস পর থেকে। এবার আর বিকাশ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় হয় নি। ফোনেই কথা হয়েছিল। এজিং আর হরমোনাল কিছু প্রবলেম। কোয়াইট কমন ফর দিস ব্রিড। তবে, ওর তো ভ্যাক্সিন-ট্যাক্সিন দেওয়া থাকে সব। ডোন্ট ওরি। ভয়ের কিছু নেই।
অন্য একটা ডগি আনো না। ঋষভের বাড়িতে কী দারুণ একটা ডোবারম্যান আছে। ব্ল্যাক আর রাস্ট কালারের কম্বো। শাইনি হেয়ার। কত দৌড়ায়। টল। ফিট। অসুখ করে না একদম। মিলির কত শেডিং হয়। আমনরা একটা বক্সার পেট করছে, জানো? ওনলি সেভেন মান্থস এজ। ওকে ট্রেনিং দিতে আসে ট্রেনার। কতকিছু পারে ও। গ্রিট করা। হ্যান্ডশেক। মিলি কিচ্ছু পারে না। শুধু ল্যাজ নাড়ে। র্যাম্বো পেপার মুখে ক’রে এক রুম থেকে অন্য রুমে পৌঁছে দিতে পারে। ট্রেনিং দিচ্ছে ওকে। প্লিজ একটা বক্সার আনো না! না, না, ডোবারম্যান। ওর’ম শাইনি হেয়ার। আমরা ওকে ট্রেন করব। প্লিজ! বার্থডে গিফট? টিম মিটিংয়ের প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে করতে শুনছিল ভাস্কর। একটানা বায়না ক’রে থামল ঋক। হুঁ হুঁ করতে করতে পিপিটিতে আরও কী পয়েন্ট ঢোকানো যায়, ভাবছিল ভাস্কর। কিন্তু এবার উত্তর না দিলেই নয়। হুম, ওক্কে, আস্ক দাদাই। মাম্মাম আর দাদাই রাজি হলেই নিয়ে আসব তোর বার্থডে গিফট। যা, ওদের জিজ্ঞেস কর। ক’দিন পরেই ঋক আবার এসেছিল। ওরা রাজি। তাই নাকি? তোর দাদাই রাজি? সত্যি। আজ সকালে পার্কে গেছিলাম। দাদাইকে তখন বললাম। মিলি ওয়জ অলসো দেয়ার। মিলি তোদের কথা বুঝতে পারলে কী হত> বাই দ্য ওয়ে, মিলি কিন্তু সব বোঝে। হাসল ভাস্কর। আজ ছুটি। বিছানায় আধশোয়া হয়ে জমে থাকা ওয়াটসঅ্যাপ মেসেজ চেক করছিল। অপ্রয়োজনীয় প্রচুর গ্রুপ, কিন্তু সোস্যালাইজেশনের খাতিরে থেকে যেতে হয়। মিউট ক’রে রাখে গ্রুপগুলো। ছুটির দিন মেসেজ সাফ করে। কলিগদের গোপন গ্রুপে দু’টো ভিডিও শেয়ার করেছে সিনহা। ধর্মপুর গ্রামে মুসলমানরা পাথর ছুঁড়ে মন্দিরের দরজা ভেঙে দিয়েছে আর পুলিশ হাততালি দিচ্ছে। পাঁঠা, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এটা এআই দিয়ে তৈরি, মুভমেন্টগুলো প্রম্পটেড, পাঁঠা সেটা বুঝতেও পারে নি। আরেকটা ভিডিও না দেখেই ডিলিট মেরে দিল। ইউনিভার্সিটির প্রাক্তনীদের গ্রুপে স্ট্রিটডগদের ওপরে মিউনিসিপ্যালিটির জুলুমের বিরুদ্ধে পিটিশন সাইন হচ্ছে। অনলাইন। তিনদিন আগের লিঙ্ক। নাম আর ইমেইল আইডি লিখে সম্মতি পাঠিয়ে দিয়ে ঋকের দিকে ফিরল ভাস্কর। ঋক সিরিয়াস মুখ ক’রে ওর পিঠে টোকা দিচ্ছিল। সব বোঝে? মিলি কি সব কথা বোঝে?
সুমনা আর অম্বিকেশের সঙ্গে আলগা কথা হয়েছিল ভাস্করের। প্রথমে ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয় নি। ঋকের বায়না দু’দিনেই থেমে যাবে। আর, মিলিকে ঋক খুবই ভালবাসে। সুমনা আর অম্বিকেশেরও মিলির প্রতি টান আছে। মিলির তো আছে বটেই। মা মারা যাওয়ার দিনটা ভাস্করের এখনও মনে আছে। মানে, রাতটা। বাড়িতেই। অসুস্থ হয়ে পড়েছিল হঠাৎ। পাঁচদিনের জ্বর। ডাক্তার ঠিকঠাক রোগ ডিটেক্ট করার আগেই মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছিল। ভাস্করের নাথায় হঠাৎ আলোর মতো ঝলসে ওঠে রাতটা। ঋক তখনও হয় নি। সুমনা, অম্বিকেশ পালা ক’রে সেবা করছে মায়ের। ভাস্কর দু’দিন ছুটি নিল পরপর। বাবা বুঝতে পেরেছিল বোধহয় যে, মা আর বেশিদিন বাঁচবে না। গম্ভীর হয়ে গেছিল। খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। মায়ের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসছে। শ্বাস বাড়ছে। রাতের দিকে ওদের সবারই চোখ লেগে গেছিল। মিলির কুঁইকুঁই ডাকে তন্দ্রা ভেঙ্গেছিল ভাস্করের। মিলির স্বাভাবিক ডাক না। অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ। সুমনাকে ঠেলে তুলতে তুলতে ভাস্কর দেখল মিলি একবার মায়ের ঘরের দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছে, আবার ওদের কাছে এসে ওর’ম কান্নার সুরে ডাকছে। অম্বিকেশও উঠে পড়েছিলেন। ভাস্করের দিকে বললেন, আর নেই। ভাস্করের মনে পড়ছে মিলির ওই উদভ্রান্ত ছুটোছুটি আর কান্না, অম্বিকেশের রুদ্ধ স্বর। আর নেই। সত্যিই আর ছিল না মা। মিলি যে কী ক’রে বুঝেছিল, কে জানে। তিন দিন কিচ্ছু খায় নি মিলি। খাবার দিত সুমনা, অম্বিকেশ হাতে ক’রে খাইয়ে দিতে যেত, ভাস্কর মাথায় কত হাত বুলোত। কিন্তু মিলি মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকত। ভাস্কর দেখেছে মিলির ছলছল চোখ। করুণ দৃষ্টি। আঃ, সেই রাতের অথা মনে পড়লে এত অস্বস্তি হয় এখনও। সুমনা নাইটল্যাম্পের স্যুইচ দিল। আচ্ছা, নতুন ডগি এলে মিলি মানিয়ে নিতে পারবে? কেন? সমস্যা হবে বলছ? না, মানে, বাবাও বলছিল যে, নতুন কেউ এলে মিলির রিয়াকশন প্রেডিক্ট করা মুশকিল। ও হয়ত ভায়োলেন্ট হয়ে গেল। নতুনটা তো বাচ্চা। মিলি হয়ত রাগের মাথায় অ্যাটাক ক’রে বসল ওকে। সাপ্রেসড অ্যাঙ্গার। ওরা সেনসিটিভ তো খুব এসব ব্যাপারে। ভাস্কর একটু চিন্তিত। তোমারও কি তাই মনে হয়? মিলি এমনিতে বেশ শান্ত। সুমনা উঠে বসল। আই রেড অ্যান আর্টিকল। ইউকেতে এরকমই একটা কুকুর ভায়োলেন্ট হয়ে গেছিল নতুন পেট আসার পরে। হঠাৎ তাকে ভায়োলেন্ট হয়ে অ্যাটাক ক’রে ছিঁড়ে শেষ ক’রে দিয়েছিল। অথচ কুকুরটার কেস হিস্ট্রিতে এরকম ভায়োলেন্সের ট্রেস নেই কোনও। ইন্ডিয়াতেও তো সেদিন এরকমই একটা ঘটনা… ভাস্কর ভাবছে, তাহলে কী করা যায়। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে একবার। নতুন পেটকে মিলি যদি টলারেট না করতে পারে, জেলাসি থেকে কিছু ক’রে বসে, তার চেয়ে বেটার মিলিকে নিয়ে কিছু একটা ভাবা।
#
মিলি দেখেছিল দাদাকে আর রিককে। নাকের ওপরে এখনও দগদগে। পুঁজ হয়ে আছে। ঠাণ্ডা লেগেছে বেশ। কিন্তু ওসবে কি আর প্রিয় মানুষের গন্ধ আটকায়? আলো আটকায়? মিলির মনটা আলো হয়ে গেছিল। অনেক অনেকদিন পরে। মিলি ঠিক জানত, ওরা ফিরে আসবেই। মিলিকে খুঁজতে। মিলি যে ভাল নেই, দাদা বুঝবে না? সেবার যখন মিলির অসুখ করেছিল, পাঁচ বছর আগে, দিদি সারারাত জেগে ওষুধ খাইয়েছিল। বাবা মিলিকে নিয়ে দৌড়েছিল। এই ডাক্তার, ওই ডাক্তার। মিলির বাচ্চা হয়েছিল তার আগে। তিনটে। একটা জন্মের সময়েই মরে গেছিল। দু’টো বেঁচেছিল, কিন্তু দুর্বল। দেড় মাস পরে আরেকটা মরে গেল। বড়টা বেঁচে ছিল। সাড়ে পাঁচ মাস বয়সে অম্বিকেশের ভাস্করের পুরনো অফিসের এক সিনিয়র কলিগকে দিয়ে দেয় বাচ্চাটা। ওদের বিয়ে হয়েছে সাত বছর। বাচ্চা হচ্ছিল না। তাই সময় কাটাতে একটা কুকুর পুষতে চাইছিল। ভাস্করের প্রজেক্টে বেশ সাহায্য করেছিল ওই কলিগ। ভাস্কর হয়ত পেতই না প্রজেক্টটা, উনি না থাকলে। ভাস্কর জিমিকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পরপর মিলির শরীর খুব ভেঙে পড়েছিল। মিলি শুয়ে থাকত। বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে পারত না একটানা। কিচ্ছু ভাল লাগত না। পেছনের দিকে অসহ্য ব্যথা। মিলির জ্বর হয়েছিল। তিনদিন। বিস্কুট হেতে পারত না। মুরগি খেতে পারত না। সারারাত জেগে ছিল দিদি। বাবা। দাদা অফিস থেকে ফিরে ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকত। মিলি নাক ঘষে দিত দাদার কোলে। ঘুমিয়ে পড়ত। একটু একটু ক’রে সেরে উঠেছিল মিলি। দাদা-বাবা-দিদি সবাইকে আঁকড়ে ধরেছিল মিলি। মিলি অপেক্ষা করে। দাদার গাড়ি এলে টের পায় মিলি। দিদি বাইরের গেটে হাত রাখলেই টের পেয়ে যায় মিলি। দৌড়ে যায় দরজায়। ওদের ঘরে নিয়ে আসে। বাবার সঙ্গে সকালে পার্কে যায়। সবসময় পাশে পাশে থাকে। এমনি বিস্কুট শুঁকে মুখ ফিরিয়ে নেয় মিলি। কিন্তু সকালে বাবা যখন ওই দোকান থেকে কিনে দু’টো বিস্কুট দেয়, মিলি দারুণ খুশি হয়।
মিলির অভিমান জমে ছিল। রিক আর দাদা কাছে আসবে। মিলিকে ডাকবে। মিলি যাবে না। তারপর ওরা আরও কাছে এলে মিলি মুখ গুঁজে শুয়ে থাকবে। আরও ক’বার ডাকলে মিলি উঠে ওদের চারদিকে গোল গোল ঘুরবে। কিন্তু কিছুতেই ওদের হাতে ধরা দেবে না। বাবা এসে মাথায় হাত বুলোবে। মিলি, শান্ত হও। শান্ত হবে। মিলি, হামি দাও। মিলি দাদার গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবে। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়বে। জিভ বার করবে। তারপর দিদির গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবে। খুব খুশি। গলার নিচে হাত বোলাবে দিদি। বিলি কাটবে ঘন লোমে। মিলির গলায় খুশির শব্দ। কিন্তু, গলায় টান লাগছে কেন? ব্যথা লাগছে। আলোতে মন ভরে গেছিল, সেই আলো এখন দপদপ করছে। মিলির গলায় দড়ি পরিয়ে টানছে দু’জন। বছর দশ বয়েস। হঠাৎ কখন ফাঁস পরিয়ে দিয়েছে গলায়। টেরই পায় নি মিলি। দাদা আর রিককে দেখতেই ব্যস্ত ছিল। ছাড় ছাড়, ইশ ঘেয়ো কুত্তা। ভুতো চেঁচিয়ে উঠল। ন্যাঃ এ কোনও বড়জাতের কুকুর ছিল। অলোক সেন ছুটির-দিনের চায়ে আয়েশ ক’রে চুমুক দিচ্ছিল। কী ক’রে বুঝলে? গায়ে জায়গায় জায়গায় লোম উঠে গেছে। নাকের ওপরে পুঁজ। মাছি বসে গায়ে। আরেঃ, ল্যাজটা দেখছনা? এখনও কেমন মোটা। লোম পড়ে গেছে বটে, তবে যতটা আছে, কেমন গ্লেজ মারছে দ্যাখো না। মিলির গলায় লাগছিল। মিলি চেষ্টা করছে এইবার দাদা আর রিকের কাছে। এটা অন্য গাড়ি। রঙ অন্য। গন্ধ আলাদা। মিলির গলায় দড়ির টান দিতে দিতে বিল্টু আর টিনা হাসছিল। ওদের মজা লাগছে। কুকুরটা সামনের দিকে এগোতে চাইছে। বিল্টু টানছে। মোটা দড়ি, নাইলনের। টিনা ভুতোদার চায়ের দোকান থেকে একটা প্রজাপতি বিস্কুট কিনে রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়েছে। মিলি ওদিকে এগোতে চাইছে আর বিল্টু টানছে। টিনার পছন্দ ওর ল্যাজটা- কেমন লোমশ, নরম। ভুতো সাবধান করছে চেঁচিয়ে। ওরে, ঘেয়ো কুত্তা, কখন কামড়ে-ফামড়ে দেবে, টের পাবি। অলোক সেন বিরক্ত। কবে থেকে বলছি একটা কুকুর রেসকিউয়ারকে খবর দাও। বা, মিউনিসিপ্যালিটিতে। পাড়ার কুত্তাগুলো এমনিই ওকে ছিঁড়ে খেতে চায় আর এখন বাচ্চাগুলোও ওকে অ্যামন করছে। এই ছাড়, ছাড়। মিলি টিনার ছুঁড়ে দেওয়া বিস্কুটটার দিকে এগোতে চাইছে না। ওসবে মন নেই আর। দাদার দিকে ছুটতে চাইছে মিলি। গলায় খুব লাগছে, ছিঁড়ে যাবে যেন। কিন্তু, দাদা গাড়ি থেকে নামছে না। রিক নেমে ছুটে আসছে না কেন? মিলি তো ওদের গন্ধ পাচ্ছে। আলো টের পেয়েছিল মিলি। গাড়িটা দূরে নিশ্চল। বেশ খানিকটা দূরে। মিলি কি গাড়িটা অবধি পৌঁছতে পারবে না? অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে এবার। তবু বাচ্চাদু’টো দড়ি টেনে মিলিকে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মিলির নখ বড় হয়ে গেছে। নরম মাটি আঁচড়ে থিতু হতে চাইছে। পারছে না। দাঁত বের করছে মিলি। বাঁচতে হবে। যে করেই হোক ছুটে যেতে হবে রিক আর দাদার গাড়ির কাছে। রাগের চিৎকারটা আটকে যাচ্ছে গলায় এত জোর টান পড়ছে। কোনওমতে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল মিলি। শ্বদন্ত দেখাল মিলি। ভুতোদার দোকানে যারা চা খেতে বসেছিল, তাদের দু-একজন হল্লা ক’রে উঠল। টিনা আর বিল্টু দড়ি ফেলে দৌড়েছে। অলোক সেন জাগ থেকে জল ছুঁড়ে দিল। বেঁটে লোকটা একটা ঢিল ছুঁড়ে মারল। ভাগ ভাগ। শশাল্লা, এক্ষুনি কামড়ে দিত। মিলি যন্ত্রণায় শুয়ে পড়েছে ভিজে মাটিতে। নড়তে পারছে না। মিলি তো কামড়াত না। মিলি কাউকে কামড়ায় নি কখনও। বাবা আর দাদা ওকে শিখিয়েছে না কামড়াতে। মিলি আদর করতে জানে। ভালবাসতে চায়। ভালবাসা জানে। কিন্তু, প্রবল ব্যথায় গলা ছিঁড়ে আসা যন্ত্রণায় মিলির শ্বদন্ত বেরিয়ে গেছিল। মিলির গলায় দমচাপা অদ্ভুত হিংস্র স্বর। মিলি এখন মাটিতে শুয়ে হাঁপাচ্ছে। আহা রে, ভয় পেয়ে গেছে মালটা। বেঁটে লোকটা চ্চুক চ্চুক আওয়াজ করল টাগরায়। রতু বুড়ি এতক্ষণে দৌড়ে এল- বিল্টু হারামি হয়ে গেছে। মাদী কুকুরটাকে কীভাবে মারল অনামুখোটা। আয়, কালী ইদিকে আয়, চ্চু চ্চু। রতু বুড়ি সব কুকুরকেই কালু নয়ত কালী বলে ডাকে। অলোক সেন ভুতোকে ফিসফিসিয়ে বলল- রতু বুড়ির মুখখারাপ কমল না। ঘাটের দিকে এক পা বাড়িয়ে রেখেছে, কিন্তু মুখ যেন নর্দমা। মিলি কী ক’রে ওদের বোঝাবে যে, ও বাচ্চাদের কামড়াতে যায় নি। কাউকে কামড়ায় না মিলি। কিন্তু, গলার অমন যন্ত্রণা তার সঙ্গে পিঠের ঘা চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল। মিলি শ্বাস নিতে চাইছিল। মিলির চোখে জল নাকি? রতু বুড়ি দেখছে। কালী, কাঁদে না রে। বারোভাতারীর বাচ্চাগুলো অ্যামনই ত্যাঁদড়। দাঁড়া না, ওদের হচ্ছে। তুই চল। রগড় বুঝে ভুতোর চা-দোকানে দাঁড়ানো সবাই হাসছে। টিনা আবার ফিরে এসে ধাঁই ক’রে একটা ঢিল ছুঁড়ল। মিলি কুঁই ক’রে আওয়াজ করল। পায়ের ওপরের হাড়ে লেগেছে। মিলি শরীরটা টেনে টেনে ফিরে যাচ্ছে ঝাঁপ-বন্ধ দোকানের ভাঙা দরজার নিচে
#
ওই ত্তো, মিলি। বাপি, দেখো, দেখো! ভাস্কর দেখেছিল। স্টিল রঙের একটা ডিজায়ার ভাড়া নিয়ে এসেছে ভাস্কর আর ঋক। রঙ নিয়ে অবশ্য দ্বিধা ছিল। ভাস্কর কথায় কথায় বলেছিল কুকুরেরা কী কী রঙ চিনতে পারে না, কী কী চিনতে পারে। ওদের ঘ্রাণশক্তি যতটা প্রবল, আলোকিত বস্তুর ওপরে দৃষ্টিশক্তি ততটা না। ইনস্টিংক্ট কী, কীভাবে সক্রিয় হয়। ঋক ছোট থেকে এসব শুনেছে। বুঝেছে। গাড়ি ভাড়া নিয়ে মিলিকে দেখতে যাওয়ার কথা হয়েছে এওদিন ঋক উত্তেজিত হয়ে ঘরে এল। ঋকের মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত আইডিয়া এলে আর পেটে চেপে রাখতে পারে না, তখন এর’ম লাফাতে লাফাতে আসে। ভাস্কর আর সুমনা জানে। আমরা যে গাড়িটা নিয়ে যাব, সেটার কালার রেড হলে কেমন হবে? ওরা তো রেড আর গ্রিন চিনতে পারে না। তুমি বলেছিলে না, ওরা ব্লু-ইয়েলো-হোয়াইট এসব কালার চেনে। তা’লে শি উইল বি কনফিউজড উইথ দ্য কালার। আমাদের স্মেল যদি পায়, কিন্তু গাড়ির কালার বুঝতে না পারে, দেন, শি উইল গেট কনফিউজড। কেমন হবে? ভাস্কর আর সুমনা হেসে উঠেছিল এমন অদ্ভুত আইডিয়া শুনে। সুমনা ওর চুলে বিলি কেটে বলেছিল, পাগল একটা! যাও, নাও গো টু বেড। ভাস্কর একবার ভেবেছিল ঋকের কথা শুনে রেডিশ কালারের গাড়ি ভাড়া করবে। তারপর মনে হল, নাঃ, সন্তানের সব কথা মানতে নেই। গুড প্যারেন্টিং মানে সন্তানের সব কথা মেনে নিয়ে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া না। স্টিল কালারের সুইফট ডিজায়ার। ইস্কুলবাড়ির পাশে চায়ের দোকান। সকালে বাজার বসে। দুপুর অবধি টুকটাক। সন্ধ্যে অবধি লোকজন। দোকানপাট কিছু। দু’তিনটের ঝাঁপ আর খোলে না। রাস্তার দু’পাশে দু’টো মাঝারি মাপের রাস্তা। সেই রাস্তাদু’টোর ভেতরে অনেক ঘর। রতু বুড়ির ঘরও ওখানেই। বিভিন্ন মাপের। জলের কল। গাড়িটা যখন থেমেছিল, তার বেশ কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। রোববারের সন্ধ্যে। ভিড় পাতলা। দোকানপাট অধিকাংশ বন্ধ। দু’টো খোলা। ভাস্কর আর রিক দেখছিল। তিনটে কুকুর দাঁড়িয়ে চায়ের দোকানের সামনে। দু’টো কুকুর বন্ধ ‘শ্রীহরি জুয়েলার্স’-এর সামনের চাতালে শুয়ে গা খুঁটছিল। একটার বোধহয় বাচ্চা হবে, মোটা পেট নিয়ে শুয়েছিল। চা-দোকানের পাশের রাস্তাটার মুখে মিলির পেছনে দু’টো বাচ্চা। মিলি খেলছে ওদের সাথে? হুম, আই গেস সো। কাচটা নামাচ্ছে ঋক। সো, শি ইজ কোয়াইট হ্যাপি হিয়ার। হুম, দে জেনারেলি লাইক টু সারভাইভ ইন প্যাকস। দলের বাইরের কাউকে ওরা শত্রু মনে করে। বাট মিলি হ্যাজ এ স্পেশাল এবিলিটি টু বিফ্রেন্ড অল। ঋক মনঃক্ষুণ্ণ হল। দেখেছ, শি ডাজন্ট রিমেম্বার আস। সো সেলফিশ। না, না। মিলি ইজ আ গুড গার্ল। এখানে বন্ধু পেয়ে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে যখন খেলিস, তখন আমরা ডাকলে তুই আসিস? হাসতে হাসতে বলল ভাস্কর। ঋক আবার জানলার কাচ নামাল। ডাকব ওকে, বাপি? এই ন্না নাআ। একদম না। গাড়িটা ঘুরিয়ে চলে আসার সময় ভাস্করের এক ঝলক চোখে পড়েছিল মিলির গলায় একটা দড়ি পরানো। দু’টো বাচ্চা টানছে। কিন্তু, তখন গাড়ি টার্ন নিয়ে নিয়েছে, ঝলক সরে যাচ্ছে। মিলি কি আসতে চাইছে দৌড়ে? ভাস্করের দিকে তাকাচ্ছে? ভাস্কর ভাবতে ভাবতে গাড়ি অনেকটা দূর পেরিয়ে এল। নাঃ, পেছন ফিরে আর দেখা যাচ্ছে না কিছু। চা-দোকানটা বিন্দুর মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। মিলির চোখে জল ছিল? ধুস্, এতটা দূর থেকে ফ্র্যাকশন অব সেকেন্ডে চোখ দেখা যায় নাকি? নিজের মনে হাসল ভাস্কর। মনের ভুল। ঋক কলকল ক’রে উঠল। আজ একবার পেট-স্টোরটায় যাবে, বাপি? সোফির জন্য ডগ-বোনের একটা নতুন প্যাকেট নিতে হবে।