তোমাদের একবারের জন্যও মনে হয় না, যে মানুষটা সারা সপ্তাহ সকাল ছটা পাঁচের লঞ্চ ধরতে হবে বলে, স্নান সেরে, জল বাতাসা মুখে ফেলে, ভোর সাড়ে পাঁচটার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, হাতে দু পাঁচ মিনিট সময় পেলে লঞ্চঘাটে বা ঘাট পেরিয়ে নৈহাটীতে চায়ের দোকানে এক ভাঁড় চা কিনে খায়, ছুটির দিনে সেই মানুষটা বাড়িতে বসে একটু আয়েস করে এক কাপ চা খাবে, এমনটা আশা করতে পারে না? ভোর হয়েছে কি আজ!
বিমল অমল দু ভায়ের কেউ এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি ডাকাডাকি করলে তুমি রেগে যাবে, ঘুমোচ্ছে ঘুমোক না। এত তাড়া কিসের ! ছুটির দিনে না হয় একটু বেলা করে উঠল। যেন সারা সপ্তাহ ওরা কাজের পেছনে দৌড়চ্ছে! দম ফেলার ফুরসত পায় না।
এসব স্রেফ তোমার আস্কারা। কুড়ি বছর বয়স পেরিয়ে গেছে যাদের, তারা তো সাবালক। রীতিমত বড় হয়ে গেছে। নিজেদের ভালমন্দ বুঝতে শিখেছে। কোথায় কী বলতে হবে, কখন কোন কাজটা করতে হবে, কোনটা দেখেও না দেখার ভান করতে হবে, এসব ব্যাপারে তো দিব্যি সচেতন। তাদের একবারও মনে হয় না, বুড়ো বাবাটার দুপাশে দুই ভাইয়ের খুঁটি হয়ে দাঁড়ানো উচিত!
আজ আটত্রিশ চল্লিশ বছর হয়ে গেল, মানুষটা একনাগাড়ে খেটেই চলেছে, খেটেই চলেছে। কোন বিশ্রাম নেই। শখ আহ্লাদ নেই। হাতে গোণা দুটো প্যান্ট আর দুটো জামা পরে একটা জীবন পার করে দিল। আমি যে আর পারছি না। আমার সামনে না হোক, আড়ালেও তো ওদের বোঝাতে পার, তোরা বড় হয়েছিস, সংসারের দায়দায়িত্ব বুঝতে শেখ। ওই মানুষটা দিনরাত এক করে খেটে, নিজের ভাল শিকেয় তুলে রেখে, যা কিছু করল, এখনও করছে, সে সব তো তোদেরই জন্য। তোরা মানুষটার কথা ভাববি না ! আমি জানি বেলা, আমি নিজে মুখে এসব কথা বললে, ধুন্দুমার কাণ্ড বেঁধে যাবে। তুমি ছেলেদের পক্ষ নিয়ে গলা ফাটাবে, কি এমন বয়স ওদের! একজন সবে বি.এ. পাশ করল, আর একজন এখনও কলেজে পড়ছে। পড়াশোনার চাপ সামলানো কি চাট্টিখানি কথা ! জানবে শরীরের চেয়েও মাথার পরিশ্রম অনেক বেশী। তার ভারও অনেক।
তুমি বেশ জান, এ কথার শোনার পর, আমি চুপ করে যাব।
স্কুলের গণ্ডী পেরোয়নি যে মানুষটা, সে কলেজের পড়ার চাপ বুঝবে কেমন করে?
বেলা, আবার বলছি, তুমি আমায় যতটা অবুঝ ভাব, আমি কিন্তু তেমন নই। হয়ত তোমার মতো করে সুন্দর করে মনের সব কথা গুছিয়ে বলতে পারি না, তার মানে এই নয়, কলেজে পড়িনি মানে আমার বিচার বিবেচনা বোধ বলে কিছু নেই।
আমি জানি আমাদের বাড়িতে তোমার বউ হয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। মানানসই হয়নি। তার মানে তো এই নয় যে দুবাড়ির অমতে আমাদের বিয়েটা হয়েছে। আমার সরকারি চাকরিটা দেখেই তো তোমার বাবা রাজি হয়েছিলেন। মানছি তোমার বাবাও ভুল করেছিলেন। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষাটা দেবার কয়েক মাস আগেই তোমার বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছিলেন। কাজটা ঠিক না বেঠিক সেটার হিসেব আমি করতে যাব কেন বলো?
ফাইনাল পরীক্ষাটা পাশ করে গেলে, আরও বড় কোন ঘরে, লেখাপড়া জানা কারোর সঙ্গে তোমার বিয়েটা হতে পারত। এ জীবনে তোমার আমার দেখাই হতো না।
কিন্তু তারপরেও বলছি, আমাকে মানিয়ে নিতে তোমার যেমন অসুবিধে হয়নি, ঠিক তেমনি তুমি আমার চেয়ে কয়েক ক্লাস বেশি পড়েছ, গান গাইতে জান, বই বড়তে ভালবাস, লাইব্রেরী থেকে বই এনে হ্যারিকেনের আলোয় রাত জেগে বই পড়, এই ব্যাপারগুলো ভেবে আমার বেশ গর্ব হোত। এখনও হয়। আমি জানি তোমার কড়া শাসন না থাকলে বিমল অমলের লেখাপড়া স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজ অব্দি পৌঁছত না।
তোমার জ্যাঠতুতো দাদা, স্কুলে পড়ায় কী যেন নাম, তোমরা কী বলে ডাকতে যেন, বলো না, হ্যাঁ মনে পড়েছে, 'মাস্টারদা' তাই না? কার কাছে যেন আমার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিল, মেজকাকার মেয়ের বর, কলে মিলে কোথাও একটা কাজ করে। সেটা পাড়ার এক কাকিমার মুখ থেকে শুনে, তুমি কেমন রেগে গেছিলে !
মনে করে দেখ, আমি কিন্তু তখন তোমায় বুঝিয়েছিলাম, মাথা গরম কোর না। গঙ্গা পেরিয়ে যাই বলে তোমার দাদা ভেবেছে আমি ওপারে কোন পেপার কল বা জুট মিলে কাজ করি। চেপে যাও। যেদিন জানতে পারবে, আমি ইছাপুর রাইফেল ফ্যাকটরিতে গমমেন্টের চাকরি করি, সেদিন তোমার দাদা নিজেই লজ্জা পাবে।
মনে পড়ে বেলা, তুমি কেমন চোখ বড় বড় করে আমার মুখের দিকে চেয়ে বলেছিলে, ঠিক বলেছ। এর জবাব অন্যভাবে দিতে হবে।বিমল অমলকে অনেক লেখাপড়া শিখিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে 'কোলো মিলো'-র ছেলেরাও লেখাপড়া শিখে স্কুলের মাস্টার হতে পারে। আমাদের বাড়িটাকেও একদিন লোকে 'গ্রাজুয়েট বাড়ি' বলবে। দেখে নিও। এটা আমি করেই ছাড়ব।
সে সব কত বছর হয়ে গেল।
এখনও কিন্তু চা-টা পেলাম না। কাকলি, হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি ছোট বৌমা, অন্যদিন না হয় তোমার মর্নিং স্কুলে যাওয়ার তাড়া থাকে, আজ তো ছুটির দিন। বুড়ো মানুষটার জন্য এক কাপ চা তৈরী করে দিতে পারো না ?
তোমাদের শাশুড়ি মাকে যেমন দুই ছেলের লেখাপড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় দেখভাল করতে হোত, তোমাকে তো তেমনটা করতে হয় না। আমি যেমন ছেলেদের দিকে নজর দিতে পারতাম না, অমল তো ঠিক তার বিপরীত। বুবুনকে জলখাবার খাইয়ে, স্কুলের ড্রেস পরিয়ে, ব্যাগে টিফিন ভরে দিয়ে, বড় রাস্তায় গিয়ে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আসা, সবটা তো অমল একাই করে।
তোমার নিজেকে গুছিয়ে বেরোতেই তো কত সময় পেরিয়ে যায়। তারপরেও প্রায়ই শুনতে পাই অমলকে বকাঝকা করছ। আর অমল মুখ বুজে সেসব সহ্য করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এক ধমকে তোমায় থামিয়ে দিই। আবার ভাবি অমল যদি ভুল বুঝে তোমার পক্ষ নিয়ে আমাকে দুচার কথা শুনিয়ে দেয় ! আজ তো তোমার শাশুড়ি-মা নেই যে রুখে দাঁড়িয়ে বলবে, অমল, গলা নামিয়ে কথা বল। তোর কি বুদ্ধিসুধ্যি লোপ পেয়েছে? কী বলছিস, কাকে বলছিস, সব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিস?
জানো ছোট বৌমা, জানিস অমল, তোদের মা কিন্তু তোরা বড় হওয়ার পর আমূল পাল্টে গেছিল। যতদিন তোরা লেখাপড়া করেছিস, চাকরিবাকরি পাসনি, ততদিন মা-পাখি যেমন ডানা দিয়ে ছানা পোনাদের আগলে রাখে, সেইভাবে তোদের মা তোদের আগলে রেখেছে। আমি ন্যায্য কথা বলছি বুঝেও তোদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে।
আমি বারবার বলতাম, আমি আর পারছি না। সেই আঠারো উনিশ বছর বয়স থেকে হাড়ভাঙ্গা খাটনি খাটতে খাটতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার শরীর আর নিচ্ছে না। তোরা কিছু একটা কর। গতর খাটিয়ে দুপয়সা রোজগার করে আমার পাশে দাঁড়া। এখন মনে হয়, তোদের মা আমার কষ্টটা বুঝত, তারপরেও তোদের হয়েই কথা বলত।ওরা তো চাকরির পরীক্ষার পড়াশুনো করছে। হুট বললেই তো আর চাকরি পাওয়া যায় না। একটু তো সময় লাগবে। যদ্দিন না পাচ্ছে, কী করবে তোমার দাদার ছেলেদের মতো কাপড় জামার দোকানে কাজ করবে? নাকি সাইকেল গ্যারেজে গাড়ি আগলাবে?
আমি তো বলছি, তোর মা যখন তোদের হয়ে এইসব কথা বলত, আমি কেমন কুঁকড়ে যেতাম। মনে হতো সত্যি তো তোর মায়ের যদি তোদের লেখাপড়া শেখানোর জেদটা না থাকত, গ্রাজুয়েট বাড়ির ভাবনাটা না থাকত, আমিও হয়ত আমার দাদার মতোই তোদের দুই ভাইকে যেখানে সেখানে কাজে লাগিয়ে দিতাম।
জানো কাকলি, বুকে হাত রেখে বলছি, আজ এই যে তোমরা মাথা উঁচু করে হাঁটছ, লেখাপড়া জানা বড় মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসা করছ, এর ভিতটা কিন্তু তোমার শাশুড়ি-মা তৈরী করেছে। মানছি তোমরা নিজেদের যোগ্যতায় চাকরিবাকরি করছ। কিন্তু চারাগাছে বেড়া দেওয়ার কাজটা কিন্তু ওই মহিলা করে গেছে।
কী হল? তোমরা কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছ না ? গরমজলে চা পাতা ভিজতে দিয়েছ ?
ঝুমার আসার সময় হয়ে গেল। কী বলছ? ঝুমা এসে চা ছাঁকবে ! তারপর .....!
অমল, আমি একবারও বলছি না, আমাকে দেখে শেখ। আমার থেকে তোদের শেখার আছেটাই বা কী? ছোট বৌমা, লক্ষ্মী মা, অন্যভাবে কথাটা নিয়ো না, আমার ছেলেরা, বিশেষ করে অমল, হ্যাঁ অমলের কথাই বলছি, বিমল তো বিয়েথাওয়া করল না, ঝাড়া হাত পা হয়ে নিজের মতো থাকে।সাতেও নেই। পাঁচেও নেই। যেহেতু অমল সংসারী, ছেলের বাবা, ছেলেকে বড় করতে হবে, মানুষ করতে হবে, ওর উচিত ছিল মায়ের ভাল দিকগুলোর কিছুটা আয়ত্ত করা। তুমি বিশ্বাস করবে না ছোট বৌমা, তোমার শাশুড়ি-মা, যেন চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই নিজেকে আমূল বদলে নিতে পেরেছিল। দুই ছেলে যখন চাকরি পেয়ে থিতু হয়ে গেল, তোমাদের বিয়ে হল, আমি টেনে হিঁচড়ে কোনরকমে চাকরিটা শেষ করলাম, যৎসামান্য পেনসন, তাতেই ওই মহিলার খুশি আর ধরে না। গর্ব করে এর ওর তার কাছে বলত, আমাদের কত্তা রিটার করেছে। পেনসন পায়। আমরা বুড়োবুড়ি ছেলেদের হাত তোলা নোই। আর রাতারাতি তাঁবু পাল্টে তোমাদের দিক থেকে আমার দিকে চলে এল।
বয়সের ভারে খুটখুট করে এঘর ওঘর করত। আর ঘুরতে ফিরতে আমাকে বলত, ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে বসে বিশ্রাম নাও। সারাজীবন অনেক খেটেছ। আর নয়। দুবেলা সময় ধরে খাবে। বাথরুম চেপে বসে থাকবে না। আমাকে ডাকবে। দুম করে উঠতে যেও না।
এই যে নিজেকে বদলে ফেলা, যে সময়ে যেটা করা উচিত, মাকে দেখেও অমলের মধ্যে সেই বোধটুকু গড়ে উঠল না। সদরে আওয়াজ হল। তার মানে ঝুমা এল বোধ হয়। তুমি কাজে কথায় এক করে ছাড়লে ছোট বৌমা। বেশ বুঝতে পারছি চায়ের কাপ হাতে যে এসে দাঁড়াবে তার নাম ঝুমা। কাকলি নয়।
বিমল, তোর কথা ভাবলে কষ্ট হয়। বিয়েথাওয়া করলি না। কেন করলি না সে তুই জানিস। তোর মা কিন্তু বারবার বলত, মনে মনে কাউকে পছন্দ করে থাকলে বল। আমরা গিয়ে কথা বলছি। ছোট ভাইয়ের আগে বিয়ে হয়ে গেছে তাতে কি ! এমন তো হামেশাই হয়। হাইস্কুলের মাস্টারমশাই, আর আমার ছেলেরা খারাপ স্বভাবের, বদরাগী, কুসঙ্গে মেলামেশা করে, এমন অপবাদ হাজার শত্রুও দিতে পারবে না। এখন ঘুরছিস, বেড়াচ্ছিস, রাত জেগে টিভিতে খেলা দেখছিস, বুঝতে পারছিস না, সারাটা জীবন কিন্তু এইভাবে কাটবে না। আমিও তো আর চিরদিন থাকব না। শরীরের বল কমবে। মনের জোর কমবে। কী করবি তখন একা একা ? কথায় বলে মানুষ একা না বোকা। তোর মা বলত ঝগড়া করার জন্যও দ্বিতীয় একজন লোকের দরকার হয়। দেওয়ালের সঙ্গে ঝগড়া করা যায় না। ওই দেখ মুখ ভার হয়ে গেল। তোর মা তোকে বোঝাতে বোঝাতে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। আমাকে বলত ওর জন্য মরেও শান্তি পাব না। আর সত্যি সত্যি একদিন টুক করে চলেও গেল।
ছোট বৌমা, বুবুনকে একবার নিচে পাঠিয়ে দাও না। কেন? একা বসে আছি। দাদু নাতিতে গল্প করতাম। ও আমার গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। পড়াশুনো করছে। থাক তাহলে। পড়া শেষ হলে পাঠিও। তারপর ড্রইং স্যারের কাছে যাবে? ছুটির দিনেও এত চাপ দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। অমল কি ঘুম থেকে উঠেছে? কেন আবার, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। সারা সপ্তাহ ওকে তো খুব ভোরে উঠতে হয়। ও যদি ঘুমোয় তাহলে ওকে এখন ডেকো না।
ঝুমা তোকে যতই দেখি, ততই অবাক হয়ে যাই। পাঁচ ছ'বাড়ি কাজ করিস। তারপরেও সব সময় মুখে হাসিটি লেগে আছে। এই যে চায়ের কাপ হাতে 'দাদু' বলে ডেকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিস, ঠিক যেন সাক্ষাত মা জগদ্ধাত্রী। তোদের দিদা বলত বাড়ির বউ যদি আধপেটা খেয়ে, এক খিলি পান গালে দিয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁটটি নিয়ে কারোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, সে ধরতেই পারবে না বউটির সংসারে অভাব আছে। ভরপেট খাওয়া জোটে না। এটা বোধহয় কেবল মেয়েরাই পারে। ও ঝুমা, আজ তোর কী হয়েছে ? কথা বলছিস না কেন? শরীর খারাপ? বাড়িতে অশান্তি?
(দুই)
- এই যে শুনছো? একবার নিচে এসো না।
- কি বলছ ? ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারায় কী বলছ ? ও বুঝেছি।
- সময়ে বিয়ে থাওয়া না করলে এমনটাই হয়। বাবার মতো তোমার দাদার মাথাটাও বিগড়েছে। আচ্ছা এটা তোমাদের ফ্যামিলি হেরিডিটি নয় তো ?
- কি যা তা বলছ?
- যা তা নয়। আমি অনেকক্ষণ থেকে শুনছি। দাদা একা একা কথা বলছে। কী বলছে বুঝতে পারছিলাম না বলেই তো মনে হল, নিচের তলায় গিয়ে দেখি।
- কাকলি, দাদা চোখে হাত চাপা দিয়ে ঘাড় এলিয়ে শুয়ে আছে কেন বল তো? শরীর খারাপ? ইস্-স্-স্। শব্দ কোর না। গায়ের জামাটা লক্ষ করেছ? ওটা তো দাদার জামা নয়। বাবার এরকম একটা জামা ছিল। ডোরাকাটা হাফ হাতা শার্ট। জামাটা ছিল কোথায়? আর হঠাৎ করে বাবার জামা দাদার গায়ে ....! তোমায় কিছু বলতে হবে না। ব্যাপারটা আমি দেখছি। দাদা ? ও দাদা ? কী হল ? শরীর খারাপ ?
- কই না তো। সেই কোন ভোরে উঠেছি। গরম এক কাপ চায়ের কথা ভাবছি।
- এখনও এমন কিছু বেলা হয়নি। আর আধ ঘন্টা পরেই চা হবে। যেমন ছুটির দিনে হয়।
- তার মানে এখনও আধ ঘন্টা ….. !
- সে না হয় কাকলি তোমাকে এক কাপ চা করে দিচ্ছে। কিন্তু অবাক লাগছে, তুমি তো এই ইজিচেয়ারটায় কোনদিন বসো না। প্রাকটিক্যালি আমরা কেউ-ই বসি না। বাবা বসত। সেই অনারেই চেয়ারটাকে রাখা আছে। শুধু ইজিচেয়ারে বসা নয়, তুমি কি লক্ষ্য করোনি, বাবার পুরনো একটা জামা তুমি গায়ে দিয়েছ।
- হ্যাঁ, দাদা। আপনি সকাল থেকে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে শুনছি। কী বলছেন বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মনে হল, বাড়িতে কি কেউ এসেছে, নিচে গিয়ে দেখি। সিঁড়িতে কয়েক ধাপ নেমে, পরিস্কার শুনতে পেলাম, বাবা যেসব কথা যেমনভাবে বলতেন, অবিকল সেইরকমভাবে বাবার কথাগুলি আপনি বলে যাচ্ছেন। অথচ সামনে আশেপাশে কেউ নেই। বিশ্বাস করুন আমার কেমন ভয় করতে লাগল। তাই আপনার ভাইকে ডাকলাম।
- দূর পাগল মেয়ে। তোমরা যেমনটা ভাবছ তেমন কিছুই নয়। কাল রাতে স্বপ্নে বাবাকে দেখলাম। আরও বুড়ো হয়ে গেছে। আর ভীষণ রোগা। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। কথা বলছে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে। গত সপ্তাহে মঙ্গলবার ২রা মে বাবার জন্মদিন ছিল। বেঁচে থাকলে একশ বছরে পা দিত। আমরা কেউ-ই বাবার জন্মদিনটা মনে রাখিনি।
আমি লক্ষ্য করলাম অমল আর কাকলি অবাক বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। কোন ফাঁকে দোতলা থেকে বুবুন নীচে নেমে এসে বাবা-মা'র পিছনে দাঁড়িয়েছে।
বুকের গভীর থেকে একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এল। বললাম, ঘুম ভেঙ্গে উঠে কী মনে হল, আলমারিতে রাখা বাবার জামাটা গায়ে দিয়ে ইজিচেয়ারটায় এসে বসলাম। তারপর কী যে হল!
ওরা তিনজন আমার সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে। অপলক আমাকে দেখছে।