১৯৮১ সালে ৩৪তম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যসেম্বলি-র অধিবেশন বসেছিল জেনেভা শহরে – ৪-২২ মে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সদস্য সমস্ত দেশ অংশ করেছে। সেখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর ভাষণে বিশ্ববাসীর সামনে বললেন – আমাদের অত্যুন্নত আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ঊচ্চমূল্যের আরও বেশি টেকনোলজি নির্ভর মেডিসিনের প্রলোভন সামলাতে হবে … প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, দূরত্ব এবং অর্থ উভয় দিক থেকেই, সমস্ত মানুষের নাগালের মধ্যে থাকতে হবে … আমরা চাইব, ভারতে মানুষের দরজায় স্বাস্থ্য পৌঁছক, কেন্দ্রীভূত বৃহৎ হাসপাতাল-মুখী হবার পরিবর্তে। স্বাস্থ্যসেবা শুরু হবে যেখানে মানুষ আছে সেখান থেকে এবং যেখানে সমস্যার শুরু সেখান থেকে।” বললেন – “স্বাস্থ্য ক্রয় করার যোগ্য কোন পণ্য নয়, কিংবা অর্থের মূল্যে কোন পরিষেবা নয়। এটা হল জানার, জীবনযাপনের, অংশগ্রহণের এবং মানুষ হয়ে ওঠার একটি প্রক্রিয়া।” খুবই মূল্যবান কিছু মতামত দিলেন স্বাস্থ্য, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ইত্যাদি নিয়ে। বিশেষ করে যখন বলেন স্বাস্থ্য কোন পণ্যও বা কোন পরিষেবা নয়, “it is a process of knowing, living, participating and being”। আজ প্রায় ৪৫ বছর পরে একবার খোঁজ নিতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সরণিতে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
শুরুতেই কয়েকটি মূল বিষয় আমাদের নজরে থাকলে ভালো –
(১) যেমন ১৯৮১ সালে ভারতের তরফে বলা হয়েছিল “Health is neither a commodity to be purchased nor a service to be given” অর্থাৎ আমাদের স্বাস্থ্যের প্রয়োজন, অতি মূল্যবান স্বাস্থ্য পরিষেবার নয় এবং স্বাস্থ্যকে কোন মূল্যেই স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। মনে রাখা দরকার, এ কথাগুলো বলা হয়েছিল ১৯৭৮-এর পৃথিবীতে সাড়া ফেলা “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা” নিয়ে আলমা-আটা সম্মেলনের অব্যবহিত পরে।
(২) ক্লিনিকাল হেলথ তথা ব্যক্তির স্বাস্থ্য এবং পাবলিক হেলথ তথা জনস্বাস্থ্য এ দুয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক – দুটি আলাদা দর্শনের জগৎ। আমরা আমাদের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ৫-৭ বা তার বেশি সময় ধরে যা শিখি তা হল একজন ব্যক্তি রোগীকে সবচেয়ে ভালোভাবে কি করে চিকিৎসা করা যায়। এখানে জনস্বাস্থ্য বা জনতার স্বাস্থ্য একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে পাস করে বেরনো চিকিৎসক সমাজের মানসিক অবস্থানে এবং সামাজিক দর্শনে রয়ে যায় ক্লিনিকাল হেলথের দুর্মর ছাপ। পাবলিক হেলথ এখানে দুয়োরাণী। একটা উদাহরণ হচ্ছে, এ মুহূর্তে ভারতে ৩০,০০,০০০-এর বেশি মানুষ মারাত্মক এবং মারণান্তক সিলিকোসিস রোগে ভুগছে। এ রোগ আমাদের প্রায় পড়ানো হয়না বললেই চলে। এ রোগ দরিদ্র হবার রোগ, দারিদ্র্যের অভিশাপের রোগ – পেটের দায়ে কৃষিতে সংকুলান না হবার খাদানে, বিভিন্ন ক্রাশার নিয়ে কাজ করার রোগ।
ক্লিনিকাল হেলথের শিক্ষা আমাদের কাছে এ রোগকে invisible, indiscernible করে রেখেছে। একে visibility এবং discernibility-র স্তরে তুলে আনার প্রচেষ্টা কি আমরা চালাবো? এরকম আরও অনেক রোগের কথা বলা যায়। প্রসঙ্গত, আমেরিকায় অ্যাসেবেস্টোসিস রোগে (সিলিকোসিস ধরনের একটি রোগ) বছরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ মারা যায়। এ নিয়ে নিউ ইংল্যান্ড জার্নালের (NEJM) মতো পত্রিকায় ১৫ আগস্ট, ২০১৯, সংখ্যায় বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হল “A Most Reckless Proposal – A Plan to Continue Asbestos Use in the United States”। আমরা কবে পারবো এরকম এক পদক্ষেপ নিতে?
(৩) প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিকল্প কোন Health and Wellness Centre (HWC) হতে পারেনা। জনস্বাস্থ্যের আতুর ঘর হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয়, চিকিৎসা মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীর এবং আরও অনেক অবহেলিত রোগের। Do We Care গ্রন্থের সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ লেখিকা সুজাতা রাও বলেন – “একটি হার্ট সার্জারি, কানের একেবারে অন্তর্ভাগে “ইমপ্ল্যান্ট” বসানো কিংবা সিজারিয়ান সেকশনের জন্য অর্থ পাওয়া সহজলভ্য, কিন্তু সহজলভ্য নয় প্রয়োজনীয় এবং একেবারে প্রাথমিক ডায়াগ্নোসিসের জন্য, কিভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যায় এ শিক্ষার জন্য, রোগ থেকে সেরে ওঠার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য, বৃদ্ধদের দেখাশোনা এবং যত্নের জন্য, স্কুলে স্বাস্থ্যরক্ষা এবং বয়ঃসন্ধির যত্নের জন্য, অথবা communicable (যেমন ডায়ারিয়া, টিবি, শ্বাসকষ্টের রোগ) কিংবা non-communicable (যেমন ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক) রোগগুলোর যে সরাসরি কারণ (যেমন দূষিত পানীয় জল, দূষিত পরিবেশ বা বায়ু) সেগুলোকে আয়ত্তে আনার জন্য, কিংবা অর্থের জোগান নেই অ্যাক্সিডেন্টের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সামান্য জ্বরের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সাপে কাটা রোগীর জন্য – যে বিষয়গুলো দরিদ্র মানুষের জন্য নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ”। (পৃঃ ২৪-২৫) HWC এখানে নিরুত্তর। আমরা HWC চাইনা, চাই উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যা ১৯৪৮-এ “ভোর কমিটি”-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক কালে শ্রীনাথ রেড্ডির সুপারিশে যা জোর দিয়ে বলা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রাক্তন মহাসচিব (১৯৯৮-২০০৪ সময়কালের) গ্রো হারলেম ব্রান্টল্যান্ড এবং রাষ্ট্র সংঘের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুন (২০০৭-২০১৬ সময়কালের) ২০১৮ সালে ভারতে আসেন স্বাস্থ্যের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য। পরে ল্যান্সেট-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন “India’s health reforms: the need for balance” (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, পৃঃ ১-২) শিরোনামে। ব্রান্টল্যান্ডের উপলব্ধি ছিল – “ভারতের নতুন স্বাস্থ্যসংস্কারের যে সব প্রোগ্রাম সেক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি রয়েছে যে, এই প্রোগ্রামগুলো যে অর্থ খরচ হবে সেটাকে টার্শিয়ারি কেয়ারমুখী করে তুলতে পারে। এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের অন্তত ২/৩ অংশ ব্যয়ের ঘোষিত নীতিকে গুরুত্বহীন করে তুলতে পারে।” ব্রান্টল্যান্ড এক্ষেত্রে আমেরিকার উদাহরণ দিয়েছেন – যেখানে জিডিপির ১৮%-এর বেশি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হলেও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নেই।
(৪) ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC) এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্য - এই দুটি ধারণার মাঝে ফারাক আছে। UHC-তে ধরে নেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো যে পরিষেবা দেবে মানুষকে তার জন্য মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য ইন্সিউরেন্স থেকে টাকা পাবে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভিত্তিই ছিলো “equitable access to basic health services” এবং এর জন্য ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র, রোগীকে কোন ব্যয় বহন করতে হবেনা। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য কি সরকারি বা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের আওতায় আসবে? হাঙ্গরের মতো হাঁ করে রয়েছে বহুজাতিক ইন্সিউরেন্স কোম্পানিগুলো। একবার যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কবচ সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সরকারের তরফে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি ইন্সিউরেন্সের কথা বলা হলেও শেষ অব্দি তা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের হাতেই চলে যাবে। ল্যান্সেট পত্রিকায় ২৪ আগস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ জানাচ্ছে – ২০১৮-তে সবচেয়ে বেশি রেভেন্যু দেয় এরকম ১০০টি সংস্থার ৬৯টি কর্পোরেট সংস্থা, ৩১টি সরকারি সংস্থা। (“From primary health care to universal health coverage – one step forward and two steps back”, Lancet, August 24, 2019, pp. 619-621) পূর্বোক্ত প্রবন্ধে দুটি মনোযোগ দেবার মতো পর্যবেক্ষণ আছে – “UHC, unlike PHC, is silent on social determinants of health and community participation.” এবং “the term coverage rather than care either suggests a limited scope of care or is being used to suggest enrolment in an insurance scheme…Insurance-based models of UHC risk being promoted at the expense of funding PHC and other public health programmes.”
(৫) ১৯৭৮-এর আলমা-আটার ঘোষণাপত্রে স্পষ্টত “New International Economic Order (NIEO)”-এর ধারণা উচ্চারিত হয়েছিলো। যুদ্ধের পরিবর্তে স্বাস্থ্যের জন্য দেশের সম্পদ বিতরণের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে মেডিক্যাল সিলেবাসও তৈরি হচ্ছিলো। পরিস্থিতি বদলের সাথে সাথে মেডিক্যাল সিলেবাস এবং শিক্ষার ধরণও বদলে যাবে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে স্বাস্থ্যের মুক্ত বাজার – পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়
মুক্ত বাজারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন, বিশেষ করে এর উপজাত সামাজিক মানসিকতা, স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যপরিষেবার মধ্যেকার প্রভেদ মুছে দিতে চায়। কিন্তু খোদ আমেরিকার বুকেই চিকিৎসকদের একাংশও ভিন্নতর উপলব্ধিতে পৌঁছন। ২০১৩ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত “ডেড ম্যান ওয়াকিং” প্রবন্ধে দু’জন আমেরিকান চিকিৎসক জানান – “আমাদের কাছে এটা ভয়ঙ্করভাবে অমানুষিক এবং ট্র্যাজিক যে মি. ডেভিসের মতো হাজারে হাজারে আমেরিকান নাগরিকের এই ধনী দেশে ইন্সিউরেন্স না থাকার জন্য এরকম করুণভাবে মৃত্যু হবে।”
এখানে উল্লেখযোগ্য ইংল্যান্ডের সুবিদিত ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) কথা। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের প্রতিটি বাড়িতে একটি লিফলেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। লিফলেটে বলা হয়েছিল – “আপনাদের নতুন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস শুরু হচ্ছে ৫ জুলাই থেকে। এটা আসলে কী? কীভাবে আপনি এটা পাবেন? এই সার্ভিস আপনাকে সমস্ত ধরনের মেডিক্যাল, ডেন্টাল এবং নার্সিং কেয়ারের সুযোগ সুবিধে দেবে। প্রতিটি মানুষ – ধনী অথবা দরিদ্র, নারী এবং শিশুরা – একে ব্যবহার করতে পারবে, হয় সম্পূর্ণত কিংবা আংশিকভাবে। এর জন্য কোন চার্জ লাগবেনা, কেবলমাত্র বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া। এর জন্য আপনাদের কোনরকম ইন্সিউরেন্স কোয়ালিফিকেশনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা কোন “দাতব্য”ও নয়। কারণ আপনারা সবাই এর জন্য প্রধানত ট্যাক্স প্রদানকারী হিসেবে অর্থ দিচ্ছেন, এবং, পরিণতিতে, আপনার অসুস্থতার সময়ে এই সার্ভিস আপনাদের উদ্বেগ লাঘব করবে।”
জনস্বাস্থ্যের দর্শন একটি ভিন্ন অবস্থান। এখানে সবকিছুই অবারিত এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ। নিজের নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন-চর্যা এবং সর্বোপরি পড়শি-চেতনা ধরে আছে ভারতের মতো আরো বহু দেশের অসমসত্ত্ব বিপুল জনসমষ্টিকে। এই বিশেষ অবস্থান বুঝতে না পারলে মেডিক্যাল কলেজের প্রশিক্ষণ শেষ করা মাত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী চিকিৎসক হয়ে ওঠা যায় না। মুক্ত বাজারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন এর দার্শনিক ভিত্তিকে মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর।
ইংল্যান্ডে যখন এনএইহএস-এর মতো “বৈপ্লবিক” মেডিক্যাল সার্ভিস চালু হচ্ছে তখন ১৯৭৪ সালে ইকনমিক্সে নোবেলজয়ী ফ্রেডেরিক হায়েক এর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ দ্য রোড টু সার্ফডম-এ জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেন। আরও পরে প্রকাশিত দ্য কনস্টিটিউশন অফ লিবার্টি (১৯৬০) গ্রন্থে তিনি খোলাখুলিভাবে স্বাস্থ্যকে মুক্ত বাজারের হাতে তুলে দেবার পক্ষে সওয়াল করেন এবং ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে অবাস্তবতা বলে অভিহিত করেন। ১৯৭২ সালের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র সুবিখ্যাত এবং সহস্রাধিকবারের বেশি উদ্ধৃত ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র “আনসার্টেনটি অ্যান্ড দ্য ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স অফ মেডিক্যাল কেয়ার” প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি জানান, তাঁর মূল আলোচ্য বিষয় মেডিক্যাল কেয়ার, স্বাস্থ্য নয়। এ প্রবন্ধে তিনি গাণিতিক যুক্তিতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন মেডিক্যাল কেয়ারকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। আরও বলেন – “এটা প্রায়শই দেখা যায় যে ব্যাপকহারে মেডিক্যাল ইন্সিউরেন্স মেডিক্যাল কেয়ারের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি করে।”
এরকম দুই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের তরফে দরাজ সমর্থন পাবার পরে মেডিক্যাল বাজার বৃদ্ধি এবং ইন্সিউরেন্স বিক্রি করার দরজা একেবারে উন্মুক্ত হয়ে যায়। শুরু হয় আমেরিকান মডেল অনুযায়ী ইন্সিউরেন্স-ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, এমনকি পৃথিবীর দূরতম দেশে এবং দুর্বলতম অর্থনীতিতেও।
এক অদ্ভুত যুক্তি জাল তৈরি হল – একদিকে, ইন্সিউরেন্সের ঢুকলো স্বাস্থ্য পরিষেবার জগতে; অন্যদিকে, ইন্সিউরেন্সের বহু বিস্তৃত ব্যবহার যে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়াবে এ ধারণা এলো। কিন্তু অ্যারোর দৃষ্টি এড়ায়নি যে, পণ্য দুনিয়ার অন্যক্ষেত্রের মতো এখানে শুধু কেনাবেচার-র সম্পর্ক নয় – একজন ব্যক্তি মানুষের অন্যের স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা ও ঊদ্বেগ থাকে যা পণ্য জগতের অন্যক্ষেত্রে দেখা যাবেনা। বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টর ইন-ডোর রোগীর ৮০% এবং আউটডোর রোগীর ৬০%-এর পরিষেবা দেয়। ফলে স্বাস্থ্যখাতে ৭০% ভাগ খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটাতে হয়, মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। এইমস-এর মতো সরকারী ভর্তুকী-পুষ্ট আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্রদের শতকরা ৫৪ জন পাড়ি দেয় বিদেশে।
হ্যাফডান ম্যালারের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে আলমা-আটা-য় গ্রহণ করা “Declaration of Alma-Ata – International Conference on Primary Health Care”-এর কথা যেখানে প্রথমবারের জন্য আক্ষরিক অর্থে একটি বিশাল আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হল বিশ্ববাসীর সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা (comprehensive primary health care) সুনিশ্চিত করার কথা এবং সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান গৃহীত হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণভাবে, আলমা-আটা সনদের ১০ নম্বর ধারায় যা বলা হয়েছিল তার মূল কথা ছিল – পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের স্বাস্থ্যের সুযোগহীন মানুষটির জন্যও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে হবে। এবং এজন্য যুদ্ধ ও যুদ্ধাস্ত্রের পরিবর্তে স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের সুষম বিকাশের জন্য আরো বেশি মানবসম্পদ সৃষ্টি হতে পারে।
“সকলের জন্য স্বাস্থ্য”, “স্বাস্থ্য আমার অধিকার” এবং “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা”-র ধারণা ১৯৭৮ থেকেই নিঃসাড়ে বদলাতে শুরু করে। প্রথমে আসে “সিলেক্টিভ প্রাইমারি হেলথ কেয়ার (বেছে-নেওয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা)”, তারপরে এলো GOBI (growth monitoring, promotion of oral rehydration, promotion of breast feeding, immunization) এবং পরবর্তীতে খুব খোলাখুলি ভার্টিকাল বা রোগ-কেন্দ্রিক প্রোগ্রাম। কমিউনিটির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি জীবন্ত ও সক্রিয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রোগ্রাম পরিত্যক্ত হল। এর বিষময় ফল আমরা এই অতিমারির সময়ে প্রত্যক্ষ করছি।
ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (এপ্রিল ৭, ২০১৮) “WHOse health agenda? 70 years of struggle over WHO’s mandate”-এ বলা হল – “The 1990s heralded a defanging (বিষ দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া) of WHO. The international health field was transmogrified into global health, whose “shared” agenda opened the floodgates to business.” আজকের ২১৫টি দেশ আক্রান্ত হবার পরেও জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে “opened floodgates to business” (ব্যবসার বাঁধ খুলে দেওয়া)-এর ফলে কে বেশি লাভ করবে।
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেমস গলব্রেথ তাঁর “A Perfect Crime: Inequality in the Age of Globalization” (Daedalus , Winter, 2002, Vol. 131, No. 1, pp. 11-25) প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, কিভাবে ১৯৮০-র দশকের পর থেকে নিওলিবারাল অর্থনীতি পৃথিবীতে বিপুল পরিমাণে অর্থনৈতিক অসাম্য এবং অসহায়তা বাড়িয়ে তুলেছে। সে প্রবন্ধে গলব্রেথ জানিয়েছিলেন – “It has been, it would appear, a perfect crime. And while statistical forensics can play a small role in pointing this out, no mechanism to reverse the policy exists, still less any that might repair the damage.”
আমেরিকান অর্থনৈতিক দর্শন তৈরি করে নেয় চিকিৎসা পণ্যের বাজার। সরকারী হাসপাতাল পড়ে থাকে হতদরিদ্রদের জন্য। ভারতবর্ষে আমরা আমেরিকান মডেলকে অনুসরণ করছি, ইউরোপের “ওয়েলফেয়ার স্টেট”-এর মডেল নয়। কিন্তু
২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির আমরিকায় ১৮% স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করার পরেও ওখানকার মানুষ স্বাস্থ্যের সবচেয়ে অসুখী দেশের একটি। মাত্র ৫.৪% বরাদ্দ প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য। সমগ্র চিকিৎসক সংখ্যার ৩০%-এরও কম নিযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে।
“বিশ্বগুরু” ভারতের প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এখনো ২%-এর কম। ফলে সহজেই অনুমেয়, কী সামান্য পরিমাণ অর্থবরাদ্দ পড়ে থাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য। বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্য খাতে খরচের চিত্রটিও অসমান – কোথাও কম, কোথাও তুলনায় বেশি।
ভারতেও কি এরকম এক মডেল অনুসৃত হবে অদূর ভবিষতে? ভারতে কর্পোরেট আধিপত্যের নতুন যুগে ইউরোপীয় নয়, আমেরিকান মডেল অনুসৃত হচ্ছে প্রায় সর্বক্ষেত্রে। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য (যারা Oxfam-এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী জিএসটির ৬৪% জোগান দেয়) কি পড়ে থাকবে? যে ৬ কোটির বেশি মানুষ নিজেদের পকেট থেকে স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করার দরুন “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ”-এর ফাঁদে পড়ে দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যায়, সে সংখ্যা কি আরও বৃদ্ধি পাবে? সর্বশেষ বিপদ সংকেত হল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও কর্পোরেটদের থাবা ঢূকে পড়েছে। এখনও অবধি অবহেলিত এ ক্ষেত্রটিও এদের কুটিল নজর পড়েছে।
১২ জানুয়ারি, ২০২৩-এ NEJM-এ প্রকাশিত হয়েছে – “Corporate Investors in Primary Care – Profits, Progress, and Pitfalls”। এখানে বলা হয়েছে – “On July 21, 2022, Amazon announced plans to acquire One Medical — a primary care practice with nearly 200 locations serving more than 700,000 patients — for $3.9 billion.” আরও বলা হয়েছে – “An overarching revenue strategy underlies investors’ appetite for primary care ... Between 2010 and 2021, the total capital raised for private investment in primary care in the United States increased by a factor of more than 1000 — from $15 million to $16 billion.”
অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্যও চলে যাচ্ছে দানবীয় কর্পোরেটদের হাতে। কর্পোরেটদের গ্রাস থেকে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রক্ষা করে আবার নতুন করে জীবন্ত করে তোলা আজ বড্ডো জরুরী। বলা যায়, স্বাস্থ্যের জগতে এটাই একমাত্র লক্ষ্য।
PLoS-এ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় “নিউক্লিয়ার ওয়েপনস অ্যান্ড নেগলেক্টেড ডিজিজেসঃ দ্য টেন থাউস্যান্ড-টু-ওয়ান গ্যাপ”-এ বলা হয়েছিল – “১১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা খরচ হয় তার ১/১০,০০০ ভাগেরও কম খরচে অবহেলিত রোগগুলোকে নির্মূল করা ও বিশ্বের উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি রক্ষা করা সম্ভব।”
আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে, ১৯৭৮ সালে অতিবৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি Merck-এর তদানীন্তন প্রধান কর্মকর্তা Henry Gadsden বিখ্যাত Fortune পত্রিকার প্রতিনিধি W. Robertson-কে জানিয়েছিলেন (Fortune, March, 1976) – “I want us to be like Wrigley’s and sell to everyone.” তুলনাটি বড়ো কৌতুকপ্রদ। Wrigley কোম্পানি, আমাদের অনেকেরই জানা, আমেরিকার একটি বিখ্যাত বাবল গাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি। Gadsden-এর আক্ষেপ হল যে বাবল গাম-এর মতো ওষুধকেও সবার কাছে বিক্রী করতে পারলেন না!
অতঃ কিম্? এরপরে শুরু হল সুকৌশলী এবং প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে রোগ বা অসুখ বিক্রী করার নিরন্তর, ধারাবাহিক ও হিংস্র একটি উপাখ্যান লেখার ইতিহাস। সে ইতিহাসের সানুপুঙ্খ বিবরণ ধরা আছে Ray Moynihan এবং Alan Cassels-এর লেখা Selling Sickness: How Drug Companies Are Turning Us All Into Patients (Allen Unwin, 2008) পুস্তকে।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে “সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অফ হেলথ”-এর প্রবক্তা মান্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাইকেল মারমট ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (“ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ অ্যান্ড সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অফ হেলথ”, অক্টোবর ১২, ২০০৩) বলেছিলেন – “ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ বা কোন ধরনের ইন্সিউরেন্স মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যের অভাব মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, এবং মানুষকে “মানুষ” হিসেবে দেখে তাকে মূল্য দেওয়া।”
এখানে কোথাও একটা আমাদের অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যপরিষেবাকে সুখ কেনার প্রধান উপায় হিসেবে দেখার চিন্তাকে আমাদের একবার পুনর্বিবেচনা করার বিশেষ প্রয়োজন আছে – বিশেষ করে আমরা যারা চিকিৎসক। সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তকে সমসত্ব medical consumer করে তোলার কর্পোরেট থাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের রোগীকে মানুষ হিসেবে দেখার অসমসত্ব অঞ্চল (heterogeneous space) গড়ে তোলার লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে।
নান্য পন্থা বিদ্যতে!