সেই কবে কার্ল মার্ক্স লিখে রেখে গেছেন, "হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ, ফার্স্ট এজ ট্রাজেডি, দেন এজ ফার্স।" সেই কথা আজও যে কতোটা সত্য তা আমাদের দেশের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে স্পষ্ট। আজ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি যা করে চলেছে তার ছকটা পুরোনো, ওই সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ১৯৭৫-৭৭- এর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আজকের নরেন্দ্র মোদীর খুব একটা ফারাক নেই। সেদিনের সেই "ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা" স্লোগানের প্রতিধ্বনি আজও শোনা যাচ্ছে, শুধু ভাষার একটু তারতম্য হয়েছে এই যা।
মোদী যে একাই একশ, একথা বিজেপির বড়,মেজ,ছোট সব নেতাই দিনে রাতে যখনই সুযোগ পান বলে থাকেন। কিন্তু ইন্দিরা আর মোদীর কর্মপদ্ধতির কিছু মৌলিক তফাৎ রয়েছে। ইন্দিরা ১৯৭৫- এর ইমারজেন্সি ঘোষণার পর এক এক করে সব বিরোধী নেতাদের এবং সেই সঙ্গে সংবাদ মাধ্যম সহ অন্যান্য মাধ্যমের সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বরকে অবরুদ্ধ করার জন্য সবাইকে গারদের পিছনে পাঠিয়েছিলেন। মোদী ইমারজেন্সি ঘোষণা করার মত ভুল পদ্ধতি নেওয়ার মত কাজ করে দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি তাঁর পোষ্য বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি, যেমন ইডি, সিবিআই, আইটি ইত্যাদিকে যথেচ্ছ ভাবে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করে চলেছেন। সামনেই পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতে নিয়ম করে আনা হচ্ছে বিরোধী নেতাদের নামে নিত্য নতুন করে দুর্নীতির অভিযোগ। এক একজনের নামে এত অভিযোগের পাহাড়, যে সাধারণ মানুষের কাছে এবার গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। বিরোধীদের তাক করে ছোঁড়া দুর্নীতির তীরের ফলার দিকে তাকিয়ে সাধারণ মানুষ এবার প্রশ্ন করছেন যে শুধু অ-বিজিপি রাজ্যেই কেন ? বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলোতেও যাক তদন্তকারি দল।
বিজেপি দলটি চিত্রনাট্য নির্ভর। চিত্রনাট্যের পাতা কেড়ে নিলে ওই দলে সবাই বোবা। তখন সবাই একটা কাজই করতে পারেন, তা হল 'রাম নাম কেবলম"। প্রধানমন্ত্রীও এই ব্যবস্থার বাইরে নন। নিজে না পেরে তাই তিনি এখন সেনা বাহিনীর ছুটিতে যাওয়া লোকজনদের বলছেন সরকারের হয়ে প্রচার করতে। বিজেপি যে ঠিক কতখানি ঘাবড়ে রয়েছে এই অদ্ভুত নিদান তার বড় প্রমাণ। তবে মহুয়া মৈত্রকে কেন্দ্র করে যে অলীক কুনাট্য বিজেপি রচনা করেছে তার জুড়ি মেলা ভার। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার কুখ্যাত বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে টিএমসির সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন আদানির প্রতিদ্বন্দ্বি এক কর্পোরেট গোষ্ঠির কাছ থেকে ঘুষ খাওয়ার, এবং ওই গোষ্ঠীর হয়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার। মহুয়া তাঁর ইমেল আইডি ও সেই আইডির পাসওয়ার্ড ওই গোষ্ঠীর প্রধানকে দিয়েছেন, এ কথা মহুয়া স্বীকার করেছেন। বহু সাংসদ আছেন যাঁরা অন্যদের তাঁদের ইমেল আইডি দিয়ে থাকেন, তবে তাঁদের সঙ্গে মহুয়ার পার্থক্য এই যে তাঁরা আদনি নামক সাপের গর্তে হাত ঢোকাননি।
সংসদে মোদী সরকারকে ও সংঘ-বিজেপি বাহিনীকে নানাভাবে উন্মোচিত করে শক্তিশালী ভাষণ দেওয়ার জন্য মহুয়া মৈত্র সুপরিচিত। অন্য দিকে দুবে সংসদে বারবার অবমাননাকর ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্যকারী স্বভাব-অপরাধী। দুবে অভিযোগটি স্পীকারের কাছে পাঠিয়েছেন এবং স্পীকার তা তৎক্ষণাৎ লোকসভার এথিক্স কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পরিহাসের বিষয় হল, এথিক্স কমিটিতে বিএসপির দানিশ আলিও আছেন যিনি নিজেই এখনও কোনও সুবিচার পাননি সংসদে তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি এমপি রমেশ বিদুরির ঘৃণাপূর্ণ হুমকির মামলায়। সে ক্ষেত্রে এথিক্স কমিটিতে যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে, যাকে এক কথায় বলে চূড়ান্ত নাটক।স্পষ্টতই মোদী সরকারের তরফে একটি সুসমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে যে কোন বিরোধী সাংসদ আদানি গোষ্ঠির দুর্নীতি ও মোদী-আদানি আঁতাত প্রশ্নে সোচ্চার হলেই তাঁকে নিশানা বানানোর।
রাহুল গান্ধীকে সংসদ থেকে খারিজ করা হল, সঞ্জয় সিংকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এখন মহুয়া মৈত্রকে নিশানা বানিয়ে চলছে চরিত্রহনন অভিযান এবং তাঁর সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। দুবাই কেন্দ্রীক হিরানন্দানি গোষ্ঠির সিইও দর্শন হিরানন্দানির সই করা একটা সন্দেহজনক 'এফিডেবিট'-এ স্বীকার করা হয়েছে যে তিনি টিএমসি সাংসদকে ওইসব সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন যেগুলি অভিযোগটিতে বলা আছে এবং তার বিনিময়ে সাংসদ তাঁকে লোকসভা লগ ইন আইডির নাগাল দিয়েছেন কিছু প্রশ্ন জমা করার জন্য। এটাই মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে চালানো অভিযানে এখন পর্যন্ত নিশিকান্ত দুবের শানানো সবচেয়ে বড় 'অস্ত্র' বলে মনে হচ্ছে। হিরানন্দানি গোষ্ঠি দুবের অভিযোগটি প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করার পর এই এফিডেবিটটি আসে। এফিডেবিটটিতে প্রখ্যাত আইনজীবী শার্দূল শ্রফ ও পল্লবী শ্রফ এবং বাণিজ্য বিষয়ক বিশিষ্ট তথ্যানুসন্ধানী সাংবাদিক সুচেতা দালালের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলা হয়েছে আদানি গোষ্ঠি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলায় মহুয়া মৈত্রকে সহযোগিতা করার। এই দুই আইনজীবী এবং সাংবাদিক অবশ্য এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
মহুয়া মৈত্রকে এভাবে টার্গেট করার বিষয়টিকে কর্পোরেট প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলশ্রুতি বা কতিপয় ব্যক্তির নিজস্ব প্রতিশোধস্পৃহা থেকে ঘটা বিষয় বলে দেখলে ভুল হবে। মোদী সরকার এই সাংসদদের আক্রমণের নিশানা বানাচ্ছে শুধুমাত্র কিছু বিরোধী কন্ঠকে দমন করতে বা সংসদে বিতর্ক থামিয়ে দিতে এমনটা নয়, বরং এটা করা হচ্ছে আদানির পর্বতপ্রমাণ কর্পোরেট কেলেঙ্কারি বা মোদী-আদানি আঁতাত সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাকেই কর্পোরেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রসূত ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করে বেআইনী বলে প্রতিপন্ন করতে। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন ও কর্পোরেট লুন্ঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তাই অবশ্যই সমস্ত নিগৃহীত সাংসদদের সংহতিতে দাঁড়াবে -- রাহুল গান্ধী বা সঞ্জয় সিং, দানিশ আলি বা মহুয়া মৈত্র -- তাঁদের রাজনৈতিক সংযুক্তি যে দলের সাথেই থাকুক না কেন। এই ব্যাপারটি নিয়ে বিজেপি ভাবছে কিনা জানা নেই, কারণ ইন্ডিয়া জোটের নামকরণের ধাক্কা সামলে দেশের নাম ইন্ডিয়া থেকে ভারত করতেই তাঁরা হাবুডুবু।
বিজেপি জানে যে তাদের উন্নয়নের ভাঁড়ে মা ভবানী। তাই বিজেপি ফিরে গেছে তাদের রাম মহিমায়, আর বিরোধীদের পিছনে ফেউ লাগিয়ে তাদের উৎখাত করে মারার চেষ্টায়। ইন্দিরার পথে হেঁটে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে মোদী ও তাঁর দল বিজেপি যা করে চলেছে তাকেই সম্ভবত মার্ক্স বলেছিলেন ফার্স, প্রহসন।