পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বলদে 'নো-ভক্তি' : রাস্তায় ছাড়াগরু ৫০ লাখ, ৯০০ মানুষের মৃত্যু

  • 03 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1259 view(s)
  • লিখেছেন : সুমিত দাস
দুধ দিলে গোমাতা। না দিলে নো-ভক্তি! ভারতের রাস্তাঘাট ৫০ লাখ ছাড়াগরুর দখলে। সঙ্গে গোশালায় অনাহারে লাগাতার গরুর মৃত্যু। ওদিকে, জন্মহারে বলদের সংখ্যা বেশি। অতএব? ইসকন কি দেবে গাই আর বলদের পরিসংখ্যান? ছবি - কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত

দিনটা ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫। দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে খুন হলেন মহম্মদ আখলাক। গুজব ও অজুহাত - গোমাংস! পবিত্র গণপিটুনি শেষে পূণ্যকাতর গোরক্ষকরা চামড়ার জুতো-জ্যাকেট-বেল্ট ব্যবহার বন্ধ করলেন কি না- তা জানা নেই! তবে তথ্য বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৭-র জুন পর্যন্ত গোমাতার নামে গোরক্ষকদের শিকার হয়ে নিহত ২৮ জন। এর মধ্যে ২৪ জন মুসলমান। এই সাত বছরে মোট ৬৩টি ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ২০১৭-র প্রথম ৬ মাসে ২০টি ঘটনা ঘটে। ইন্ডিয়া স্পেন্ডের তথ্য অনুযায়ী গোরক্ষকদের হাতে ওই ৭ বছরে আহতের সংখ্যা ১২৪।  রিপোর্ট বলছে, শেষ ৩ বছরে, মানে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ৯৭% ঘটনা ঘটেছে। ৬৩টি ঘটনার মধ্যে ৩২টি ঘটনা বিজেপি শাসিত রাজ্যে ঘটেছে। এর মধ্যে, উত্তর প্রদেশে - ১০, হরিয়ানা -৯, গুজরাত - ৬, কর্ণাটক - ৬, মধ্যপ্রদেশ - ৪, দিল্লি - ৪, রাজস্থানে ৪ টি ঘটনা ঘটে। তালিকায় আছে আসাম, উড়িষ্যা ও বাংলা। ২৩ টি হামলায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ্গ দল, স্হানীয় গোরক্ষকদের নাম সরাসরি পাওয়া গেছে। আর ৬৩টি ঘটনার মধ্যে পুলিশি রিপোর্ট অনুযায়ী ৩৩-টিতে গুজবই ছিল 'সরল গোরক্ষক'-দের গণপিটুনিতে মাতামাতির কারণ!

আপাতত প্রবহমান গরু ও গো-রাজনীতিতে নয়া সংযোজন ইসকন। বিজেপি সাংসদ মানেকা গান্ধীর দাবি, বকনা বা বলদ, কসাইদের কাছে পৌঁছে দেয় ইসকন৷ গাই বা গোমাতা যত্নে থাকলেও, গো-পিতা, থুড়ি, বলদ সোজা পাচার হয় গো-মাংসের জন্য। ধর্মরাজ্যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ। আপাতত ইসকন ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করলেও, বলদের সংখ্যা জানালে ল্যাঠা চুকে যেত! কারণ, গাই গরু ও বলদের জন্মহার সাধারণত ৪৮ ও ৫২। জন্মহারে বলদের সংখ্যা বেশী।


কৃষিতে বলদের ব্যবহার সারা পৃথিবীতেই কমেছে। চাষে জমির গঠনে বদল ও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বলদের ঠিকানা কোথায় হবে? আর কৃষি কোনওকালেই সমস্ত বলদ কাজে লাগানোর জায়গা ছিল না। বকনা জন্মানোর পর একটু বড় হলেই কসাই নিয়ে যাবে, বা বিক্রি হবে। মাদি গরু বাড়িতে থাকবে দুধের জন্য। এটাই গো-সম্পদ ব্যবহারের রীতি। ওদিকে, সারা পৃথিবীতে মোট গরুর চামড়ার উৎপাদনের ১৩% ভারতের। আর গোমাংস রপ্তানিতে ভারত তৃতীয়। তবে, উৎপাদন, অর্থনীতি পিছনে সরিয়ে গোরক্ষক নামক উপাদানটি পৃথিবীতে অন্যত্র নেই!


এবার, গোমাংসের নামে হত্যা হওয়া ভারতের গোশালাগুলির একটা খণ্ডচিত্র নেওয়া যাক। গোরক্ষার নামে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ শানানো হয় ২০১৭ সালে। সে বছর জুলাইয়ে হরিয়ানার মথানার সরকারী গোশালায়  দু'দিনে ৩৫ টি গরু মারা যায়। ওই মাসেই রাজস্হানের উদয়পুরের সরকারি গোশালায় ৬ মাসে ১৫০টি গরু মরার খবর ফাঁস হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস রিপোর্ট করে, - বিজেপি জমানায়, মানে বসুন্ধরা রাজে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ৫ বছরে রাজস্হানের হিঙ্গোনিয়ার সরকারি গোশালায় ৭৪ হাজার গরু মারা গেছে। পরে কংগ্রেস সরকার অভিযোগ করে, আগের বিজেপি সরকার জনস্বার্থে ব্যবহারের ফান্ড দিয়ে ভুল পরিকাঠামোয় গোশালা বানিয়েছিল, যার পরিণতিতে এত গরুর মৃত্যু! ২০১৯ থেকেই হিঙ্গোনিয়ার গোশালায় এত গরুর মৃত্যু আলোচনায় আসে। মাঝের তালিকাও দীর্ঘ। পটনা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র, মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর, রাজগড় সহ বহু জায়গার নানা গোশালায় শয়ে শয়ে গরুর মৃত্যুর খবর আসে ওই বছর। আর সর্বত্রই অনাহারে মরে গোরক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল অবলা পশু।  গোমাতা ও গোপিতার অংক আলাদা। গরুর জন্য খুন আর গরু বাঁচিয়ে যত্ন করার অংকটিও সরলমনা তরলমতিদের জন্য আলাদাই! আর হ্যাঁ, পবিত্র গোশালায় গরু মৃত্যুর কারণ সর্বত্রই অনাহার। না খেতে পাওয়া। স্মৃতিতে পিছনে ফিরলে দেখা যাবে, নানান কর্মসূচির নানা ফটোশেসনে হিন্দুত্ববাদীরা গরুর উপকারিতায় নতুন তথ্য জুড়ে ঘাস খাইয়ে পূণ্য অর্জন করছেন। এবং, মুসলমানদের সম্পর্কে যথাযথ কুকথা জুড়ে দিচ্ছেন বাইটে বা মাইকে। প্রসঙ্গত, গোরক্ষা, গোমাংসের অজুহাত দেখিয়ে গণপিটুনিতেও যেমন, তেমন গোশালা এবং সেখানে অনাহারে মৃত্যুতেও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি শীর্ষে।


গো-সংবাদ প্রবাহে আরেকটি খবরও সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। গোরক্ষকদের তান্ডবের পর সারা ভারতে গোয়ালহীন রাস্তার গরুর সংখ্যা ৫০ লক্ষ ছাড়িয়েছে। গরুর মাংসের ওপর নিষেধাজ্ঞা, হিন্দুত্বের প্রতীক হিসেবে গোমাতার নানান উপলক্ষ,  সর্বোপরি গণপিটুনির হঠাৎ কর্মসূচি চালানোর ফলাফল,-  রাস্তায় গরুর সংখ্যায় মারাত্মক বৃদ্ধি। অধিকাংশই বলদ। জাতীয় সড়ক, বাজারহাট, জঞ্জালের স্তুপ,  কৃষিজমি, নদীর পার, বড়গলি-ছোটগলি, - কোথায় নেই ছাড়াগরু? বাজারে মাঠেঘাটে কখনোসখনো ষাঁড় দেখা যেত বৈকি। তাই বলে এত এত গরু! যার সিংহভাগ গোবলয়ে। ২০১৮ থেকে ২০২২, রাস্তায় বেড়ে যাওয়া গরুর জন্য দূর্ঘটনায় ৯০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়।  সংখ্যাটা আদতে অনেক বেশি বলেই অনুমান। একই সঙ্গে অসুস্হ গরু থেকে বাড়ছে সংক্রমণ।

উত্তরভারতের বড় শহর, ছোট শহর, কোথাও স্বাভাবিক ট্রাফিক মেলা দুষ্কর। কোথাও কোথাও যানবাহন আর রাস্তার গরুর সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। ঘুরেফিরে সেই সোজা প্রশ্নটিই আসছে বারবার। রাস্তায় এত গরু এল কী করে? ইসকন বা অন্যত্র,- গোশালাগুলিতে পুরুষ গরু যথাযথ আছে তো? নাকি, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পার করে পাচার হয়ে গেল গরু! পশ্চিমবঙ্গে পাঠালেন কারা? কারা পকেট ভরলেন?  রক্ষকই ভক্ষক? নাকি, প্রয়োজনে রক্ষক, আর প্রয়োজন ফুরোলে - সরল মনের গোরক্ষকটি জাতীয় সড়কে গরুকে ধাক্কা দেবে বা গরুর ধাক্কায় মরবে? আদতে, গোরক্ষকদের তাণ্ডবে ভয় পেয়ে গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ নানা জায়গায় বলদ গরু বাড়িতে রাখতে সাহস পায়নি বহু মানুষ।  কেউকেউ সে সময় মাদি গরুও ছেড়ে দিয়েছেন। গোশালায় তাৎক্ষণিক হুজুগে নানান তহবিল এলেও দায়বদ্ধ-পরিকল্পনা ছিল না। অথচ, গোমাংস নিয়ে খুনের আগে ছিল নিখুঁত গুজব। ভোটের অংক। গোসম্পদ রক্ষা ও সম্পদ বাড়িয়ে তোলার বদলে আরএসএসের গরু-মিশনে বদলেই গেল গো-অর্থনীতি। আর, দুধ না দিলে গরু গোমাতা নয়। দুধেল কামধেনু আর দুধহীন নন্দী গরু হলেও মার্কেটভ্যালু আলাদা। ভক্তিভ্যালুও ভিন্ন।

0 Comments

Post Comment