প্রথম থেকে আমরা যা বলে আসছি, যা সত্যি তা তো একদিন সামনে আসবেই... করোনাভাইরাস নিয়ে প্রথম দিন থেকে যে-নীতিগুলো নেওয়া হয়েছিল তা যে অন্তঃসারশূন্য ছিল তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। পারদর্শীরা যেসব ধ্বংসের বাণী প্রচার করেছিল সেগুলো যখন একে-একে সবকটা মুখ থুবরে পড়বে, তখন তাদের মনে পড়বে, আমরা তাহলে ঠিকই বলেছিলাম।
একটা শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলে না, সেকথা বুঝতে আপনাদের দু’বছর লেগে গেছে। আপনারা যে গোহারা হেরেছেন সেকথা এবার স্বীকার করুন, কেননা দু’বছর ধরে তো শুনছি, আপনারা নাকি কোনও ভুলই করতে পারেন না। কিন্তু এখন তো আপনাদের সবকটা কুকাণ্ড এমনভাবে ধরাশায়ী হয়েছে যে, মিডিয়াও আপনাদের লজ্জা ঢেকে রাখতে পারছে না।
বহুকালের অভিজ্ঞতা আর বৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে আমরা জানতাম যে এই ধরনের ভাইরাস বারবার তরঙ্গের মতো ধেয়ে আসে, এটাই তার চরিত্র; অথচ আপনারা তা মানতে চাননি। বরং এক-একটা তরঙ্গ যখন নিজের নিয়মেই স্তিমিত হয়েছে, আপনারা তখন বলেছেন... একই মিথ্যে বারবার বলেছেন, তা নাকি আপনাদের যুদ্ধেরই সুফল; মিডিয়ায় প্রচার করেছেন, কী মার মারলেন ভাইরাসটাকে!
প্রতিটি লোকের শরীরে ভাইরাস খুঁজে বেড়ানোটা যে অর্থহীন সেকথা আপনাদেরই নথিপত্রে বলা ছিল (‘প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা হেলথ সিস্টেম প্রিপেয়ার্ডনেস প্ল্যান, ২০০৭’, পৃষ্ঠা ২৬), অথচ আপনারাই তা মানেননি।
ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠলে শরীরে যে-প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায় তা যে টিকার্জিত ক্ষমতার চেয়ে বেশি তা আপনারা স্বীকার করেননি। একথাও স্বীকার করেননি যে, টিকা পেয়েও যারা রোগমুক্ত হয়নি তাদের চেয়ে যারা এমনিতেই রোগমুক্ত হয়েছে তাদের নতুন করে সংক্রমিত হওয়ার আশংকা কম। অথচ এটাই ছিল আমাদের এতকালের অধীত বিদ্যা এবং অভিজ্ঞতা। টিকা-পাওয়া লোক যে রোগ ছড়াতে পারে একথাও মানতে চাননি। ভেবেছিলেন, শুধু টিকা দিয়েই গোষ্ঠীগত প্রতিরোধ ক্ষমতা (‘হার্ড ইমিউনিটি’) গড়ে তুলতে পারবেন। আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন।
চিন থেকে এই অতিমারীর প্রথম থেকেই খবর এসেছিল যে, এই ভাইরাসে সংক্রমণের আশংকা অন্যদের চেয়ে বৃদ্ধ আর নানান্ কারণে শারীরিকভাবে কাহিলদের মধ্যে অনেক গুণ বেশি। অথচ তাদের দিকে নজর দেওয়ার কথাটা আপনারা ভুলে গেলেন। পৃথিবীর ষাট হাজার বিজ্ঞানী আর ডাক্তাররা মিলে ‘গ্রেট ব্যারিংটন ডিক্লারেশন’-এর মতো একটা অতি মূল্যবান প্রচারপত্র তৈরি করেছিলেন। সেদিকেও নজর দিলেন না। বরং কাণ্ডজ্ঞান ভুলে গিয়ে আপনারা তাঁদেরকে গাল দিয়েছেন, বিদ্রূপ করেছেন, যা-নয়-তাই বলে অপমানও করেছেন। যা-করা উচিত ছিল তা না-করে এমন অবান্তর লোকজনের উপর আপনারা নির্ভর করেছেন যাদের মহামারী নিয়ে কোনও ধারণা বা অভিজ্ঞতাই নেই।
টিকা নেওয়ার পরে যেসব কুফল ঘটে থাকে তার নথি তৈরির কোনও বন্দোবস্ত আপনারা রাখেননি; এমনকী, ফেসবুকে যেসব কুফলের ঘটনা বিবৃত হয়েছে তাও মুছে দিয়েছেন যাতে লোকের চোখে না-পড়ে। আপনা্দের কুনজরে পড়তে পারেন, সেই ভয়ে ডাক্তাররাও টিকাকরণের কুফলগুলো জানাননি; আপনাদের কুনজরে পড়ে আমাদের কিছু সহকর্মী বিপদেও পড়েছেন। টিকা নেওয়ার পরে রজঃস্রাব সংক্রান্ত গোলমালের কথাগুলোকে আপনারা স্রেফ অগ্রাহ্য করেছেন। ঠিকমতো গবেষণা করতে গেলে যে-বাস্তব তথ্যগুলো লাগে আপনারা তা দেখতে দেননি। তার বদলে টিকার কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নিয়ে ফাইজার কোম্পানির বড়কর্তাদের দেওয়া অবাস্তব লেখাপত্রগুলোকেই দাম দিয়েছেন।
এসবের ফলে আপনাদের উপর আস্থার জমিতে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়ে গেল
ঔদ্ধত্যের চূড়ায় বসে আপনারা ভুলেই গেলেন যে, যা সত্যি তা চেপে রাখা যাবে না, শেষপর্যন্ত তা সামনে আসবেই। এখন ঠিক তাই ঘটছে। সত্যি কথাটা এই যে, আপনারা জনমানুষের আস্থা এমনভাবে হারিয়েছেন যা এর আগে কখনও ঘটেনি; কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে নিজের মর্যাদা নিজেই নষ্ট করেছেন। দু’বছর ধরে অনবরত ভয় দেখিয়ে, অকার্যকর পরীক্ষা চালিয়ে, লকডাউন করে আর নাগরিকদের স্বচ্ছন্দ, সংহত জীবনযাত্রায় ভাঙন ঘটিয়ে আপনারা কোটি কোটি টাকা স্রেফ নয়ছয় করেছেন।
শিক্ষাঙ্গন বন্ধ করে দিয়ে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছেন। স্কুলের শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, তাঁদের ছাত্ররা এখন অসভ্যতা শিখেছে, নেশাগ্রস্ত হয়েছে, মানসিকভাবে ধ্বস্ত হয়ে গেছে; অনেকে লেখাপড়াই ছেড়ে দিয়েছে। আপনারা নাগরিকদের জীবিকার সুযোগ কেড়ে নিয়েছেন, তাদের উপর মানসিক আর শারীরিক নিপীড়ন চালিয়েছেন। মানবাধিকার এখন ধুলোয় লুণ্ঠিত।
যাঁরা আপনাদের নির্দেশ মানতে চাননি, আপনাদের কাছে নতিস্বীকার করেননি, সেইসব সহকর্মীদের বিরুদ্ধে আপনি কুৎসা ছড়িয়েছেন, দলাদলির আবহ তৈরি করেছেন, বিভাজন রচনা করেছেন। যাঁরা টিকা নিতে চাননি তাঁদেরকে আপনারা বলেছেন, সমাজের শত্রু, বলেছেন তাঁরাই নাকি সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন। ডাক্তারি পরিষেবা নিয়ে শিশু সমেত সকলেরই যে পছন্দের স্বাধীনতা ছিল তা আপনারা তুলে নিলেন, আর এইভাবে সমাজে যে বৈষম্যের কঠোর নীতি চালু করে দিলেন তা অভূতপূর্ব। জনস্বাস্থ্যের পাঠে এমন যুক্তি কোনওদিন ছিল না।
যে-ধ্বংসাত্মক নীতি আপনারা লাগু করে দিলেন তার সঙ্গে যদি অন্য দেশগুলোর তুলনা করেন, যারা এমন গর্হিত কাজ করেনি, তাহলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, যে-ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেল তা ভাইরাস-জনিত ক্ষতির তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি। ভাইরাস জনজীবনে ক্ষতিই করে; কিন্তু অর্থনীতি পঙ্গু করে দিয়ে, বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়ে, শিশুশিক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আপনারা সেই ক্ষতির পরিমাণ আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেন।
ডাক্তারি বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখলে, এখন কোনও ‘আপৎকাল’ নেই, কিন্তু গত দু’বছর ধরে আপনি এই আপৎকালের কথাই বারবার বলে গেছেন; তার কারণ ক্ষমতা, বাজেট আর নিয়ন্ত্রণের প্রতি আপনার অপরিসীম লোভ। আপৎকাল অবশ্য একটা আছে! আপনারা যে এখনও স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে নজর না-দিয়ে, হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট নিয়ে মিথ্যা প্রচার করে চলেছেন, আর জনমানুষকে কীভাবে মানসিকভাবে বলাৎকার করে যাওয়া যায় তারই জন্য নীতি আর কৌশল ফাঁদছেন, এটাই এই মুহূর্তের আপৎকাল।
এই আপৎকালের শেষ হোক!
(ভাষান্তর – স্থবির দাশগুপ্ত)