পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পারফেকশনিস্ট

  • 01 December, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 340 view(s)
  • লিখেছেন : আবেশ কুমার দাস
নিত্য ঘোষের বাড়িটাকেই এ সময় ল্যান্ডমার্ক ধরে জয়ন্ত। কাছাকাছি এসে চোখ রাখে মিটারে। সেই মতো নাকবরাবর এগোনো বা ডাইনের তস্যগলি ধরা। পাঁচশো মিটারের আশপাশে বাকি থাকলে ঢোকে গলিটায়। তারপর স্বরলিপি বাড়ি হয়ে ননী দাসের বাড়ির সামনে দিয়ে আদহাটা রোডে গিয়ে ওঠা দুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের লাগোয়া।

ঘুরিয়ে নাক দেখানো যাকে বলে আর কি।

 এমনিতে নাকবরাবর এগোলেই যেহেতু আদহাটা রোড। আড়াআড়ি পার করলেই বাড়ি তার।

 কিন্তু তালেগোলে পেরিয়ে গেল আজ ল্যান্ডমার্ক। তস্য গলিটাও। যত নষ্টের গোড়া সাদায় কালোয় ছিটছিট উদূখলটা। যাতায়াতের পথে আগেও চোখে পড়েছে দু’-একদিন এঁটোকাঁটা ঘাঁটতে ঘোষপাড়ার গলিতে। আলোর আওতায় ঢুকে আসতে দেখেই আজ ঘ্যাঁচ করে দিতে হল ডান কবজির একপাক। গরগর করে উঠেছিল দশ বছরের পুরনো ইঞ্জিন। অলিগলির ভেতর চালালে সেকেন্ড গিয়ারের উপর পারতপক্ষে ওঠে না ইদানীং জয়ন্ত।

এসবের চক্করেই পেরিয়ে এসেছে নিত্য ঘোষের বাড়ি।

এদিকে সিক্স পয়েন্ট ফোর কিলোমিটার দেখাচ্ছে এখন ট্রিপে।

ল্যান্ডমার্ক থেকে ঠিক দুশো মিটার জয়ন্তর বাড়ি। যাতায়াতের পথেই এই দশ বছরের ভেতর কবে যেন চোখে পড়েছিল দূরত্বটা।

আচ্ছা গেরোয় ফেলে দিয়ে গেল বেড়ালটা। দশমিকের ছোঁয়া ট্রিপের গায়ে লেপটে রেখে গাড়ি ঘরে তোলে না জয়ন্ত। বিগত দশ বছরে একটা রাতও তোলেনি। শেষ মুহূর্তে হয়তো ঘুরে নিয়েছে বাড়তি এক পাক। পুরিয়ে নিয়েছে কিলোমিটারের কোটা। আজ কি হবে নিয়মের অন্যথা? কভি নেহি। সমানে উশখুশ করে যাবে ভেতর ভেতর। ঝুমুর এক কথা জিজ্ঞাসা করলে দেবে আর-এক উত্তর। শেষে বেধে যাবে একচোট।

তার চাইতে যতই চিল্লাক ঝুমুর, বাড়ি ঢোকা যাবে না এক্ষুনি। সামনে থেকে মেরে আসতে হবে এক চক্কর। আড্ডা ভাঙতে দেরি না হলে চিন্তাই ছিল না। পৌঁনে এগারোটা বাজতে চলেছে। শীতের রাত। তবু...

নিজেকে তো চেনে জয়ন্ত।

ক্লাস সিক্স তখন। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় জীবন বিজ্ঞানের পুরো উত্তর না লিখতে পারায় বেদম মার জুটেছিল যাদব স্যারের হাতে। রাগের কারণ ছিল মানুষটার। এলাকায় হেন ছেলেমেয়ে বোধহয় ছিল না যে ক্লাস এইট অবধি পড়েনি স্যারের কাছে। এবং তার মধ্যে হেন কেউ বোধহয় ছিল না যে জয়ন্তর স্তুতি না শুনেছে স্যারের মুখে। জয়ন্তকে নিয়ে অনেক আশাই ছিল আসলে মানুষটার। সেসবের কতদূর পূরণ হয়েছে, সে যদিও অন্য কথা।

তা সেবার জীবন বিজ্ঞানের পুরো উত্তর না লিখতে পারার কথাটা কিন্তু আগেভাগেই জানা হয়ে গিয়েছিল স্যারের। মানে তাকে পরীক্ষার আগের দিন অঙ্ক দেখাতে আসার আগেই। সুমন বলেছিল। তার বাড়ি হয়েই জয়ন্তকে পড়াতে এসেছিলেন স্যার। আসলে পুরো উত্তর শেষ করতে না পারার দুঃখে পরীক্ষাহল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে সুমনকেই কথাটা প্রথম জানায় জয়ন্ত। পরবর্তী পরিণতির কথা না ভেবেই। সুমন তো নয়ই, এমনকি গীতাকাকিমাও ছাড়েননি সেই পড়ে পাওয়া সুযোগ।

যাদব স্যারের সেদিনের কথাগুলো আজও কানে বাজে। থাপ্পড় কষাতে কষাতে বলছিলেন কেটে কেটে, মাথা হেঁট হয়ে গেল আজ আমার। এই তোমার জন্য ছেলে। জুতো ছাড়তে না ছাড়তেই বলা শুরু করলেন গীতাদি। জানেন তো স্যার, জয়ন্ত না পুরো অ্যানসার করতে পারেনি। এত বড় মুখ করে চতুর্দিকে করে বেড়াই তোমার গুণগান...

মিষ্টি তো দূরের কথা, বইখাতার পাশে নামিয়ে দেওয়া চা-বিস্কুটের প্লেটও ছুঁয়ে দেখেননি মানুষটা সেদিন।

তালেগোলে অঙ্কই দেখানো হয়নি আর।

খাতা বেরোনোর পর যদিও নিজে মুখেই বলেছিলেন মাকে, খুব ভুল হয়ে গেছিল সেদিন আমার। আজ বলে বলছি ভাববেন না যেন। বাড়ি ফিরেই বলেছিলাম বউদিকে। অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন এটা করা ঠিক হল না আমার। জানেন, ভাল করে ভাত অবধি মুখে তুলতে পারিনি সেদিন দুপুরে...

একাশির উত্তর করে জীবন বিজ্ঞানে সাতাত্তর পেয়েছিল জয়ন্ত।

আরও সময় থাকলে পুরো একশোই করে আসতে পারত।

আসলে গোল বেধেছিল চোদ্দো মার্কসের প্রশ্নগুলোর জবাব লিখতে গিয়ে। বইয়ের পাতায় পড়া কোন কোন বাক্যটা ছাড়বে, আর কোন কোনটা লিখবে, সেই হিসেবটাই মেলাতে পারেনি। লম্বা লম্বা প্যারাগ্রাফগুলোর প্রতিটা শব্দকেই মনে হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিছুই বাদ দেওয়ার নয়। উপরন্তু ‘যাহা জানো লিখো’ কথাটার মধ্যেও ছিল তেমনই নির্দেশ। পরিণাম যা হওয়ার তাই হয়েছিল। ঘণ্টা পড়ে যাওয়ার পর দাগ মেলাতে গিয়ে দেখে উনিশ নম্বরই ছোঁয়া হল না বিলকুল।

সব জেনেশুনেও লিখতে না পারার দুঃখটা তারপর সুমনের কাছে খানিক হালকা করা বই আর কী-ই বা করণীয় ছিল!

নিমেষেই মনে পড়ে যাচ্ছিল পুরনো কথাগুলো।

আদহাটা রোডে উঠে পড়েছিল ইতিমধ্যে।

সেই যাদব স্যারও নেই। জয়ন্তকে ঘিরে তাঁর আশাভরসাদেরও আর কেউ মনে রাখেনি এই ছোট্ট মফস্‌সল শহরে। লোকজনের অভাবে ভূতুড়ে হয়ে পড়ে রয়েছে কৃষ্ণ সাধুখাঁ রোডের উপর স্যারের পারিবারিক একতলা বাড়িটাও। বিয়ে-থা করেননি মানুষটা। কিন্তু দায়িত্ব কম ছিল না যৌথ সংসারে। মর্নিং স্কুলের চাকরির পর দিনভর টো টো করে গোটা শহরটা চষে বেড়িয়ে বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়েই কেটে গিয়েছিল আস্ত একটা নিস্তরঙ্গ জীবন। তবে মানুষ হয়েছিল ভাইপো ভাইঝিরা। তারপর আর মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কোনও প্রয়োজনই ছিল না সেই পরবর্তী প্রজন্মের।

কৃষ্ণ সাধুখাঁ রোডে প্রায়দিনই যাওয়া হয়। চোখে পড়ে স্বামীজি সংঘ লাগোয়া পরিত্যক্ত বাড়িটাও। কিন্তু অডোমিটার থেকে দূরত্বটা দেখে নেওয়ার কথা মনেও পড়েনি কখনও। ভাবতে গিয়ে হঠাৎই টের পায় জয়ন্ত।

তখনই সিক্স পয়েন্ট ফাইভ কিলোমিটারে পৌঁছল ট্রিপ জার্নি।

সামনে থেকে একপাক মেরে দোরগোড়ায় ফিরে আসা অবধি পুরিয়ে নিতে হবে আরও পাঁচশো মিটার। আবার ততদূর যাওয়াও চলবে না যাতে ঘোরা হয়ে যায় বাড়তি পথ। নতুন করে দশমিকের গেরো লাগে ট্রিপের গায়ে। ফাঁকা রাস্তায় ঢিমেতালে মোটর সাইকেল ছোটাতে ছোটাতে দিনের শেষে দূরত্বের এসব অঙ্কই ঘোরে মগজে। বাড়ি থেকে কতদূর আছে। কোত্থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলে দোরগোড়ায় নামার মুহূর্তে দৈনিক ট্রিপ জার্নির গায়ে লেগে থাকবে না অবাঞ্ছিত দশমিকের গেরো। এই ছোট্ট মফস্‌সল শহরটার রাশি রাশি ঘরবাড়ি থেকে অগণিত দোকানপাট, কবেকার মহাকালী মন্দির থেকে সদ্য গজিয়ে ওঠা এটিএম কাউন্টার অবধি হাজারো হোল্ডিংদের পারস্পরিক দূরত্ব নিজের দু’ চাকার যানটায় চেপে ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে বিগত দশ বছরে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছে তার। মানিক সাধুখাঁ লেনের মাসির বাড়ি থেকেই যেমন মিত্রপাড়া ব্রাঞ্চ রোড হয়ে বেরিয়ে বরোদা ব্রিজ দিয়ে রেলের এপারে আসতে তার বাড়ি পড়ে ঠিক তেইশশো মিটারের ব্যবধানে। গোটা শহরের বর্গফলটাকে এভাবে মগজের কোষে কোষে গেঁথে নিয়ে বেড়াতে বেশ লাগে। যদিও হালে বদলে যেতে শুরু করেছে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের সাবেক খতিয়ানগুলো। মাঝেমধ্যে টের পায় জয়ন্ত। দশ বা পনেরো মিটারের ফারাকে অস্তিত্বশীল দুই, তিন বা চারটে দোকানঘরের ভিন্ন ভিন্ন হোল্ডিং যেন অচিরেই ভেঙেচুরে মিশে যাওয়ার প্রহর গুনছে বিরাট বিরাট সব বাজারবাড়িদের পেটে।

বাঁ হাতে পেরিয়ে গেল ওভারসিজ ব্যাংকের বাড়িটা। এখনই এসে পড়বে দেড় মানুষ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা পোড়ো পোড়ো চেহারার কুঞ্জ মোদকের দোতলা। বিরাট জায়গা ভেতরে। কিন্তু হলে কী হয়। রাস্তার দিকের খড়খড়িগুলোকে যে শেষ কবে খোলা দেখেছিল মনে পড়ে না। যদিও লোক থাকে বাড়িটায়। লাগোয়াই নান্টুর দোকান থেকে মাংস নিতে এসে সকালের দিকে সদর দরজা খোলা থাকতে দেখেছে দু’-একবার। ফেরার পথেই খেয়াল করেছিল একদিন। কুঞ্জ মোদকের সদর থেকে পাক্কা দুশো মিটার তার বাড়ি।

ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়েছিল জয়ন্ত। এককালে এলাকায় বিরাট ধানকল ছিল কুঞ্জ মোদকের। সেই জমিতেই অধুনা ওভারসিজ ব্যাংক। মনে পড়ে ছেলেবেলায় ঠিকানা লিখতে গিয়ে একদম তলায় জুড়তে হত একটা লাইন। ধানকলের নিকটে। সে তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর আগের কথা। তখনও পুরসভার এক্তিয়ারে আসেনি রেলের পূর্বপাড়ের এসব এলাকা। তা সেই ধানকলও কবে উঠে গিয়েছে। ঠিকানা থেকেও অজান্তেই খসে পড়েছে লাইনটা। একালের উঠতি ছেলেমেয়েরা ধানকলের নামও শুনেছে নাকি সন্দেহ। পরক্ষণেই মনে হল। ঠিকানার সঙ্গে ধানকলের নামটা লেপটে রাখা এলাকার শেষ মানুষটা বোধহয় সে-ই। মেঘে মেঘে অনেকটাই বেলা পেরিয়ে আসতে হল তাকেও। তাই তো। এদিকে ঝুমুরের খিচুনির ভয়ে তাড়াতাড়ি ফেরার তাড়াও রয়েছে মনে মনে। অথচ ফাঁকা রাস্তা পেয়েও এতক্ষণ মনেই পড়েনি গিয়ার তোলার কথা। দোতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ-ই মুচকি হাসি খেলে যায় ঠোঁটের কোনায়। আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেন অবিকল এমন একটা চেহারাই নজরে আসে ইদানীং।

রাত হয়ে যাচ্ছে।

চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মিটারের দিকে।

তখনই খেয়াল হল।

তাই তো!

এখান থেকেই ফিরলে কাঁটায় কাঁটায় সাত কিলোমিটারেই শেষ হয় বটে আজকের ট্রিপ। কিন্তু ওদিকে আর-একটা মাইলস্টোনও যে চলে এসেছে প্রায় দোরগোড়ায়। আরও এক কিলোমিটার বাড়তি ঘুরলেই এখন কমপ্লিট হয়ে যাবে মোট সাঁইতিরিশ হাজার পাঁচশো কিলোমিটার জার্নি। আজ রাতেই জিরো ফিগারটায় পৌঁছতে পারলে মন্দ কী?

কুঞ্জ মোদকের পাঁচিলের শেষ মাথায় পৌঁছে গিয়েছিল প্রায়।

ক্ষণিক দোনামনা করেও গিয়ারে গোড়ালির চাপ রাখে জয়ন্ত।

দেরি যখন হয়েইছে, নয় আরও পাঁচ মিনিট হোক।

এখন ফিরলেও যা যা কপালে নাচছে, পাঁচ মিনিট পর ফিরলেও তাই তাই-ই।

বরং ফাঁকতালে ছুঁয়ে ফেলা যায় আর-একটা মাইলস্টোন।

বিধান সংঘর সামনে থেকে এবার গতি তোলে জয়ন্ত। এবং নাকেমুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে শীত। রক্ষে যে কানমাথা ঢাকা আছে উলের টুপিতে। ছোটখাটো একটা বিপত্তি বাধিয়ে বসলে আর আস্ত রাখবে না ঝুমুর। রাতের আড্ডাটা নিয়ে একেই সারা শীত জুড়েই আপত্তি থাকে তার। ওদিকে ঘরের মধ্যে ঠান্ডাটা এবার তত মালুম না হলেও রাতবিরেতে পথেঘাটে বেশ টের পাওয়াই যাচ্ছে শিরশিরানি। এমন ওয়েদারেই আরও খারাপ হয় শরীর। দু’পাশ থেকে আদহাটা রোডের লাগোয়া বাড়িগুলো হুসহুসিয়ে ছুটে যাচ্ছিল পিছনপানে।

আরও হাফ কিলোমিটার এগোতে হবে সামনে। তাহলেই ফিরতি পথে পুরিয়ে যাবে বাড়তি এক কিলোমিটারের কোটা। সব মিলিয়ে নিজের বাড়ি থেকে ঠিক সাতশো মিটার দূরে গিয়ে পৌঁছতে হবে জয়ন্তকে। নাকবরাবর চালালে পাওয়ার হাউস মোড় পেরিয়ে তালপুকুর রোডের সেই তিনতলা বাড়িটা অবধি হয় দূরত্বটা। এই রাস্তা ধরে স্টেশন পাক্কা এক কিলোমিটার তার বাড়ি থেকে। মধ্যবর্তী প্রতি একশো মিটারের ল্যান্ডমার্কগুলো না চাইতেও মগজে গাঁথা হয়েই গিয়েছে বিগত দশ বছরে।

এই খুঁতখুঁতে স্বভাবটাকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হয় ঝুমুর।

চটে যায়।

আবার হেসেও ফেলে।

সেদিন যেমন বলেই ফেলল, শুধু এই খুঁতখুঁতেনিটা বাদ দিলেই জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারতে তুমি...

মটর ডালের কৌটোটা জায়গা মতো ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে পিছন ফিরে হেসেছিল জয়ন্ত, কেন? পারফেকশন জিনিসটা কি ভাল নয়?

সব জায়গায় অবশ্যই নয়...

বটে! তা কোথায় কোথায় ভাল আর কোথায় কোথায় খারাপ শুনি?

অমন রেডিমেড কোনও ফর্মুলা তো নেই। বুঝে নিতে হয়। পরিস্থিতি দেখে।

বিস্কুট নিতে গিয়ে ক’দিন থেকেই খেয়াল করছিল জয়ন্ত। প্লাস্টিকের একটা কৌটো যেন কম পড়ছে তাকে। দেয়ালের দুটো তাক জুড়ে সার দিয়ে কৌটোতে কৌটোতে রাখা থাকে সারা মাসের মুদির জিনিস। কিশমিশ থেকে আতপ চাল। চিনি থেকে সয়াবিন। কোথাও একটা গড়বড় লাগছিল তার মধ্যেই।

রান্নাঘরে যদিও বিশেষ ঢোকে না সে।

তবু ক’দিন ধরেই চোখে পড়ছিল গোলমালটা।

খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েই শেষে ধরতে পারল সেদিন।

মটর ডাল ফুরিয়ে যেতে কৌটোটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে রেখেছে ঝুমুর।

পরদিনই চুপি চুপি পাঁচশো ডাল কিনে এনে সাহস করে চাইতেই হল কৌটোটা।

প্রথমে তো রেগে টং ঝুমুর, মাসের মাঝখানে কে আনতে বলেছে তোমাকে এসব?

মাসের মাঝখানেই তো ফুরিয়ে গেছে দেখলাম...

ভগবান, কপালে ছদ্ম করাঘাত করে আবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝুমুর, রান্নাঘরে আর ঢুকবে না তো তুমি। এই বলে রাখছি। আর কত ডাল এনেছ? পাঁচশো! হায় রাম, কে খাবে এত? উফ, আমি তো আর পারি না...

আসলে, মানে, আমতা-আমতা করতে করতে অপ্রতিভ হাসে জয়ন্ত, কৌটোগুলো ভরা থাকলে, তা অসুবিধেটা কোথায়?

ডাল বেশিদিন রাখলে পোকা লেগে যায় জানো? কতদিন লাগবে জানো শেষ হতে? এমনিতেই কম খাওয়া হয় এই ডাল।

কেন? বেটে ভাতে দেবে। দারুণ লাগে খেতে।

কত ঝক্কি জানো? তাছাড়া ক’দিন খাবে মাসের মধ্যে? বেশি খেলে গ্যাস হয়...

সে ঠিক আছে, হাসে জয়ন্ত, যখন পারবে করবে। তাছাড়া দেখতেও ভাল লাগে। ভরা ভরা সব কৌটো। আর পরপর সাজানো মুসুর ডাল, মুগের ডাল, ছোলার ডাল, মটর ডাল, অড়হর ডাল, কলায়ের ডাল...

এই তো, রাগতে গিয়েও এরপর হেসে ফেলেছিল ঝুমুর, এই হচ্ছে আসল কথা। তাই ভাবছি, দু’দিন অন্তর মাংস না হলে রোচে না যার...

সেদিনই বলেছিল কথাটা।

শুধু এই খুঁতখুঁতেনিটা বাদ দিলেই জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারতে তুমি...

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই পেরিয়ে এসেছে বিরজা ফার্মেসি। চলেই এল প্রায়। ওই দেখা যায় তিনতলা বাড়িটা। চওড়া ফটকের সামনে থেকে ঘুরিয়ে নেবে গাড়ি।

গতি কমিয়ে সেকেন্ড গিয়ারে নামতে যাচ্ছিল জয়ন্ত।

তখনই চোখে পড়ে। চার-পাঁচটা অচেনা মুখের ছোটখাটো জটলা বাড়িটার সামনে। ক্ল্যাচ ধরে এগোতে এগোতেই ফট করে দু’-একটা কথা উড়ে আসে কানে।

পাঁচ কাঠার বেশিই আছে বে। পুরনো আমলের বাড়ি। পল্টনদা ছাড়বে না এ দাঁও।

সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে তো বেঁকাতেই হবে বস...

চমকে ডান হাতের ব্রেক চেপে ধরে জয়ন্ত।

ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে যায় দশ বছরের পুরনো মোটর সাইকেল।

ছেলেগুলোও চমকে সরে গিয়েছিল দু’ পা।

কী বে, চোখ আকাশে রেখে চালাচ্ছিস নাকি?

রুক্ষ গলায় কথাটা যে তাকেই বলা হল টের পেতে সময় লাগে সেকেন্ডখানেকের মতো। আসলে একটু আগেই শোনা কথাগুলো তখনও বাজছে কানে। চোখ ফিরিয়ে তাকায় জয়ন্ত। একটা কটূ গন্ধ ঝপ করে এসে লাগে নাকে। শিরশিরিয়ে ওঠে ত্বক। তিতকুটি হয়ে যায় জিভের ডগা।

কেমন চোয়াড়ের মতো চাহনি মধ্যতিরিশের ছেলেগুলোর চোখের তারায়। তালপুকুর রোডের আলোয় টের পায় জয়ন্ত। আমতা-আমতা করে বলে, আসলে, বেখেয়াল হয়ে গিয়েছিলাম। কথা শুনতে শুনতে...

মানে? কী কথা শুনছিস বে?

এই যে বলছিলে। বাড়িটাকে নিয়ে। তোমাদের কি সুন্দর-কুচ্ছিতের বোধও নেই? এমন বাড়ি আর হবে আজকের দিনে? দেখছ খিলানের কাজ, ওই জাফরির ঢং? উঁচু উঁচু দরজা? এ বাড়ি ভেঙে খুপরি খুপরি পায়রার খোপ বানাবে তোমরা?

যেন ঘি পড়ল আগুনে। ফুঁসে ওঠে ছেলেগুলো, তাতে তোমার কী চাঁদু? দাঁড়াও, তেল একটু ঝরিয়ে দিচ্ছি...

কলার ধরে জয়ন্তকে রাস্তায় নামাচ্ছিল ওরা। ময়লা সোয়েটার পরা একটা ছেলে আচমকাই চেঁচিয়ে ওঠে, দাঁড়া দাঁড়া। আগেও দেখেছি না মালকে? এই রাতের দিকেই বাইক পোঁদে গুঁজে চক্কর মারে না এধার-ওধার?

বটে! ফির তো গভীর জলের মাছ নিকলা চাঁদু...

দুম করে একটা ঘুসি এসে পড়ল চোয়ালে।

পরক্ষণেই ভোজবাজি হল।

নিমেষের অন্ধকারের পর চোখে আলো ফুটতেই জয়ন্ত দেখে হঠাৎ বদলে গিয়েছে ছেলেগুলোর মুখ। আর অচেনা লাগে না কাউকেই। বরং সব্বাই তার পরিচিত। কেউ কেউ বহুকালের। লাল জ্যাকেটে এই তো সুমন। ময়লা সোয়েটারে এ যে আগের অফিসের সেই সব্যসাচী মণ্ডল। ওই তো চাঁদমোহন সাহার মুদির দোকানের ফচকে ছেলেটা। কিন্তু এ কে? হায় রাম, যাদবস্যারের ভাইপো যে! কোন কলেজে প্রফেসারি করত না! সে-ও ভিড়েছে আজ এদের দলে!

এলোপাথাড়ি ঘুসি মারছিল সবাই মিলে।

জয়ন্তর কানে আসছিল ওদের গালিগালাজ।

এত রাগ পুষে রেখেছিল সকলে!

সুমনের গলায় ঝরে পড়ছিল তিক্ততা, অনেক তুলনা শুনতে হয়েছে রে স্যারের মুখে। খুব ঝাট জ্বলত জানিস...

সব্যসাচী মণ্ডলের কণ্ঠে বিদ্রুপ, নিজের এলেমে উঠছিলাম উঁচুতে। পারলেন ঠেকাতে? শেষে ছেড়ে যেতে হল আপনাকেই। তাও শিক্ষা হয়নি...

হাসছিল মুদির দোকানের ছেলেটা, বহুত মটর ডাল কিনেছিস দফায় দফায়। আয়, একেবারে হবিষ্যি চাটিয়ে দি...

অতল তন্দ্রায় তলিয়ে যাওয়ার আগে জয়ন্তর কানে শুধু বাজছিল ঝুমুরের বলা কথাগুলো, রেডিমেড কোনও ফর্মুলা নেই। বুঝে নিতে হয়। পরিস্থিতি দেখে। শুধু এই খুঁতখুঁতেনিটা বাদ দিলেই জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারতে...

0 Comments

Post Comment