আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পরে এক বছরের মধ্যেই আরও দুটি ঘটনায় উত্তাল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ। প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটল দক্ষিণ কলকাতার একটি আইন কলেজে ও জোকার আইআইএম-এ। ‘ল' কলেজে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তিন জনকে। তাঁদের মধ্যে একজন কলেজের প্রাক্তনী এবং বর্তমান কর্মী। অন্য দু'জন এখনও ওই কলেজের পড়ুয়া।
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সংবাদপত্রের শিরোনামে প্রায় প্রতিদিনই এরকম ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে সারা দেশ জুড়ে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষক পড়ুয়া। এছাড়া, লক্ষনীয় বিষয় এই যে, তারা সবাই ধর্ষিতারই সহপাঠী বা বন্ধু। আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল এই পড়ুয়া ছেলেদের কেউই সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে আসা কেউ নন। সকলেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, এবং তাদের বাবা-মায়েরাও তথাকথিত শিক্ষিত। তার মানে তাদের পারিবারিক শিক্ষার ও অভাব নেই বা ছিলনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মনে এই ধরনের বিকৃত লালসা প্রতিপালিত হয়েছে… হয়ত সবার অগোচরেই। এই বিষয়ে আরও একটু গভীরে দেখলে বোঝা যায় যে ধর্ষণ বা যৌন প্রতিহিংসা আজ কেবল আইনি সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক অসুখ এবং এর পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক, জৈবিক, সাংস্কৃতিক ও অবস্থানগত কারণ। নারীকে যে পুরুষ ধর্ষণ করে এর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান হল, ধর্ষক তাঁর প্রথম জীবনে কীভাবে বেড়ে উঠেছিল, সেই ইতিহাস– যে সময় যৌনতা, বিশেষ করে নারীপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মধ্যে জন্ম হয়েছে একটি বিকৃত ধারণা।
শৈশব থেকে সাবালকত্ব – অনুবর্তন
এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তার মা ও বাবা। পৃথিবীতে সন্তানের সবচেয়ে নিকটতম মানুষ মা। সন্তানের লালন-পালন ও চরিত্র গঠনে মায়ের ভূমিকা অগ্রগণ্য। মায়ের কাছেই সন্তান গ্রহণ করে জীবনের প্রথম পাঠ। মায়ের আচরণ থেকেই সে শেখে জীবন যাপনের নিয়ম। মা বাবা কিভাবে সন্তানকে সচেতন করবেন সন্তানের অবাধ্যতা ও অসৎ আচরণ থেকে? শৈশব-কৈশোরে সন্তানের মধ্যে যে স্বভাব-চরিত্র গড়ে উঠে, সেটাই তার জীবনের শেকড় ও ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এরপর যখন সে পরিণত বয়সে উপনীত হয়, তখন কৈশোরে গড়া সেই ভিত্তিই তার জীবন যাপনের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সব মা-ই চান "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে", কিন্তু আমরা বাবা-মায়েরা চিরাচরিত ভাবে সন্তানের সাময়িক সুখ বা নিরাপদ ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হবার ইঁদুর দৌড়ে ছেলেদের ঠেলে দিচ্ছি না তো? অথবা কোন বিভ্রান্তির আবর্তে বা চক্রে, যেখানে অজানা থেকে যাচ্ছে তাদের মনের গোপন অলিগলি বা উপেক্ষিত মন যা থেকে জন্ম নিচ্ছে আপাত সভ্য কিন্তু বিভ্রান্ত যৌন বর্বরতা? যে সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলি একজন তরুণের বিকাশের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং তাদের ভবিষ্যতের পরিণতি চিনতে ও বুঝতে শেখার সময় সে সময় অভিভাবক হওয়ার সাথে সাথে বন্ধু হয়ে উঠে তাদের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করার গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অবহেলিত রয়ে যাচ্ছেনা তো আমাদের মা বাবাদের মধ্যে?
মনের ভেতর আছে যে মন , খবর রাখে কোন জনা!
একটা শিশু জন্মের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত জীবনের অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে। এর মধ্যে সর্বশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বা সময় হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল। শিশুকাল পেরিয়ে শিশুটি যখন কৈশোরে পা দেয়, তখন তার জীবনচক্রে যে আমূল পরিবর্তন হয়, সেই স্পর্শকাতর সময়টিতে একটি শিশুর ভেতর পূর্ণ মানবিক ও জৈবিক পরিবর্তনের প্রারম্ভিক প্রক্রিয়াগুলো শুরু হয়। শরীরে তৈরি হয় নতুন হরমোনও। প্রাকৃতিক এই রূপান্তরই তাকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত করার প্রাথমিক সোপান হিসেবে কাজ করে। কিশোর বা কিশোরীর কাছে সম্পর্কের জায়গা হল তার পরিবারের সদস্যরা, তবে মা-বাবার ভূমিকাই অন্যতম। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত বাবাদের চেয়ে মায়েরাই সাংসারিক ও পারিবারিক দিকগুলো বেশি সামলান। তাই তারা সন্তানদের সময় দেওয়া বা তাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার সাথে জড়িয়ে থাকেন বলে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের বেড়ে ওঠায় মায়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের সান্নিধ্য ও সহযোগিতা তাদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে কাজ করে। যেহেতু এই সময় প্রাথমিক যৌন বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব হয় সেই জন্য আচরণগত নানা অস্বাভাবিকতাই আমাদের চোখে পরে, যেমন স্বাধীন মতামত প্রকাশে প্রবল আগ্রহ, অভিভাবকের ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে চলা, নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ, বন্ধুমহলের প্রতি তীব্র আর্কষণ, মুড সুইং, ডিপ্রেশন, ফ্রাস্টেশন বা ডিপ্রেশন থেকে ধূমপান বা মাদক গ্রহণ, কিশোর অপরাধ, শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে উদ্বিগ্নতা, বহির্মুখিতা, আবেগকেন্দ্রিক সম্পর্ক তৈরির প্রবণতা, ভালো লাগা বা পছন্দের জায়গায় উপেক্ষাকে কেন্দ্র করে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ইত্যাদি। যার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা হলো এ সময় তাদের মস্তিষ্কের দ্বিগুণের বেশিসংখ্যক হারে স্নায়ুকোষের উৎপাদন। কৈশোরকালীন পুরো সময়ে মস্তিষ্কের সম্মুখ এলাকা, যাকে ফ্রন্টাল লবি বলে। তার কোষ ও কোষ সংযোগের অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি হয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা সাধারণত তাদের জ্ঞান ও যৌক্তিক বিষয়ে সম্মুখ মস্তিষ্ককে কাজে লাগান, কিন্তু কৈশোরে মস্তিষ্কের এ অংশ অপূর্ণ থাকে। তাই মস্তিষ্কের এমিগডালা নামক একধরনের নিউক্লিয়াস (যা মূলত মানুষের গন্ধ, অনুভূতি, প্রণোদনা এবং আবেগপ্রবণ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে) দ্বারা তারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ফলে তাদের সিদ্ধান্তগুলো হয় আবেগতাড়িত ও উচ্ছ্বাসপ্রবণ। বয়ঃসন্ধিকালে শরীরের প্রতি আকৃষ্টতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্যই কিশোর বা কিশোরীরা খুব সংগত কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে বা যে কোন অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে জড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে মায়ের দায়িত্ব তার সন্তানকে রাগারাগি, ঘরে বন্দী করে রাখা, স্কুল-কলেজ, বন্ধুবান্ধব বা পরিবার থেকে বিছিন্ন করে দেওয়া নয় বরং সঠিক ভাবে বিপরীত লিঙ্গের বিষয়ে অবহিত করা বা কাউন্সেলিং করা যাতে ছেলে মেয়ে উভয়ই একে অন্যের প্রতি সম্মান বা সহানুভুতি সুচক মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে। বিশ্বাস হল যেকোনো সম্পর্কের ভিত্তি। গুপ্তচরবৃত্তি, বন্ধুদের সাথে জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্ত বা সন্দেহ করে অকারনে সন্তানের আত্মসম্মানকে হেয় না করে তার মতামতকে যথাযথ যুক্তি পূর্বক বিচার না করতে পারলে মা বাবা ও সন্তানের বন্ধনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে মিথ্যা বলা, চুরি করা, লুকিয়ে থাকা এবং অসম্মানজনক আচরণের মতো অবাধ্য আচরণ দেখা দেয়। এবং নারীদের প্রতি তৈরি হয় তীব্র বিদ্বেষ, বাস্তবিকভাবে একটি ছেলে তার মায়ের প্রতি সম্মানের মনোভাব থেকেই সমগ্র নারীজাতির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, যেমন মেয়েরা হয় তাদের বাবাদের দেখে। তা ছাড়া, বাবা-মায়েদের তাদের ছেলে মেয়ের সাথে ডেটিং, যৌনতা, মাদক এবং অ্যালকোহলের মতো কিছু সাধারণ সমস্যা নিয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলাও আজ বিশেষ প্রয়োজন কারন বাড়িতে সে যতটা সময় কাটাচ্ছে, তার চেয়ে বাড়ির বাইরে সে এই ধরনের আলোচনা বা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতেই পারে কৈশোরে, বন্ধুবান্ধব বা সামাজিক পরিসরে। কিশোর বয়স যে শুধু পরিবর্তনের বয়স, তা-ই নয়, তার ব্যক্তিত্ব, সামনের পথচলা কেমন হবে, ক্যারিয়ার কোনো দিকে মোড় নেবে– সবই নির্ধারণ হয়ে যায় ১০-১৮ বয়সসীমার মধ্যে। তাই এ সময়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রারম্ভিক নির্ধারক হিসেবে অভিভাবকের গুরুত্ব অপরিসীম। বাচ্চাদের চাকরি সুলভ নিরাপত্তা, বা পারফর্ম করার চাহিদা, প্রতিযোগিতার চাপ ইত্যাদির আড়ালে তাদের মনে কোন অপরাধ প্রবণতা বা অনিরাপদ দৃষ্টি ভঙ্গী জন্ম নিছে কিনা সে বিষয়টি আমাদের মায়েদের নজর এড়িয়ে যাছে কিনা সেটি ও ভাববার বিষয়, একজন মা সবসময় বাচ্চাদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে স্কুল, কলেজ বা প্রাইভেট কোচিং এ সঙ্গ দিছেন, সুতরাং তাঁর ও লক্ষ্য রাখা উচিত এই দিকে। গত এক দশক ধরে শিশু ও কিশোর মনের বিকাশের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল মোবাইল আসক্তি যা সামাজিক মহামারির আকার নিয়েছে, কোভিডে ঘর বন্দী অবস্থায় নিরুপায় হয়ে যেসব শিশুদের পড়াশুনা বা অন্য সব রকম বিকাশের মাধ্যম ছিল মোবাইল বা কম্পিউটার, কোভিড পরবর্তী সময়ে তা আজ ভাত ডালের মত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে শিশু কিশোরদের কাছে, এবং সেটি তাদের মানসিক গঠন কে সম্পূর্ণ চালিত করছে, ভুল পথে প্ররোচিত হছে তারা। কিশোর-কিশোরীরা যে ইন্টারনেটের অতি ব্যবহারে বিভ্রান্ত হছে, তাতে ভালর চেয়ে খারাপ দিকটি অনেক বেশি, বিভিন্ন নিষিদ্ধ বিষয়ের অবাধ ব্যাবহারে, 'সাইবার বুলিং' ইত্যাদির জন্য কিশোর কিশোরীরা যে উদ্বেগের মুখোমুখি হচ্ছে সে সম্পর্কে বাবা-মা, শিক্ষক এবং অন্যান্য অভিভাবকদের ভালোভাবে সচেতন থাকা উচিত এবং সেইজন্যই সঠিকভাবে সেক্স এডুকেশন সন্বন্ধে তাদের জানানো, পর্নোগ্রাফির মত যৌন-অশিক্ষার দিকটি সম্পর্কে তাদের অবহিত করা, adolescent, teens’ health ইত্যাদি বিষয়ের মাধ্যমে নিজেকে জানার, নিজেকে সম্মান করার শিক্ষা দেওয়া যাতে অপরকে সম্মান করা শেখানো যায়। ভালো-মন্দ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে না পারার এই অক্ষমতাই কৌতূহলবশত তাদের ভুল পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে।
ধর্ষণ – একটি অযৌন অনুপ্রেরণা
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যে ধর্ষণ একটি অপরাধ যা অযৌন অনুপ্রেরণার উপর ভিত্তি করে তৈরি; যা শত্রুতা, রাগ এবং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনেই বেশি হয় কারন সেটি বলপূর্বক করা হয়, বেশিরভাগ ধর্ষকের আত্মসম্মান কম থাকে এবং ধর্ষণের একটা প্রধান কারণ হল, নারীকে ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পারার অক্ষমতা। অধিকাংশ পুরুষের কাছেই নারী ভোগ্যবস্তুই। বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্ব মতে একটা শিশু যে মন নিয়ে জন্মাল, সংস্কৃতিই সেই মনের গঠনটি তৈরি করে। সম্ভবত এর আলোকেই লেনিন এই মন্তব্যটি করেছিলেন: "প্রেম হলো যৌনতা ও সংস্কৃতির সমন্বিত রূপ"। যৌনতার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ না থাকলে সেটা সহিংসতা, যৌনসন্ত্রাস ও ধর্ষণের দিকে ধাবিত হয়। একটা শিশু কী শিক্ষা পেল ও কেমন সংস্কৃতির মধ্যে সে বড় হলো– সেটাই নির্ধারণ করে যৌনতা সম্পর্কে, নারী সম্পর্কে, প্রেম সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম হবে। ধর্ষণ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রেমের প্রসঙ্গ আসবেই। কারণ নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের একমাত্র মাধ্যম হলো প্রেম-ভালোবাসা, অন্য কোনো মাধ্যম নেই। এই শিক্ষা না পাওয়ার ফলই ধর্ষণের এই মহামারির প্রকোপ। পুরুষ এবং ছেলেরা স্বাভাবিকভাবেই হিংস্র নয়; পিতৃতান্ত্রিক নিয়মগুলি তাদের অসংবেদনশীল করে তোলে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ আমাদের শিখিয়েছে নারী দুর্বল। নারী অবলা। শিখিয়েছে যে, বুক ফাটলেও মুখ ফাটা নারীর শোভা পায় না। প্রশংসার ছলে বলা হয়েছে যে, নারীর সহ্য ক্ষমতা অসীম মানে নারীকে সবকিছু সহ্য করে যেতে হবে। এমনকি ধর্ষণও। অনেকের মনে এই ধারণা গেড়ে বসে আছে যে সমাজের সদস্য হলো শুধুই পুরুষ এবং নারী হলো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য অনেকগুলো উপকরণের একটা উপকরণ মাত্র। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নারীর মন ও শরীর সম্পর্কে পুরুষের জ্ঞানের অভাব। পুরুষ মনে করে, গায়ে হাত দিলেই তো তাঁর ভালো লাগার কথা। কিন্তু এটা একটা মারাত্মক ভুল ধারণা। এই ক্ষেত্রেও বাবা-মার মধ্যেকার সম্পর্ক ছেলেদের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। তাছাড়া অধিকাংশ পরিবার নিউক্লিয়ার হতে হতে এমন হয়েছে যে পড়াশোনার ক্ষতি না হয় এই ভেবে আমরা বাড়ির ছোট ছোট কাজগুলোতে সন্তানদের অংশগ্রহণ করতে দিই না ফলে 'এ কাজ শুধুই মেয়েদের', 'এ কাজ শুধুই ছেলেদের'– এই বৈষম্যের শিক্ষা ছেলেদের মধ্যে অজান্তেই থেকে যায় এবং সংসারের কাজগুলোর প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরি হয়না, তাদের বোঝানো সব দায়িত্ব সমান এবং ছোট ছোট কাজে উৎসাহিত করলে তাদের মধ্যে মা শুধুই ঘরে থাকার এবং সব সহ্য করে নেবার মত একজন লোক এই ধারনার উদ্রেক হবেনা, এবং এর পাশাপাশি মা যে একজন ভাল বন্ধু এবং সংসারের প্রয়োজনে তিনি হাসিমুখে বাড়ির কাজ বা দায়িত্ব নিয়েছেন সেটা বোঝা সম্ভব হবে। এছাড়া বাড়ির গৃহকর্মী বা কাজের লোক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলা এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব গড়ে তোলার জন্য মায়েদের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার কারন ছোটবেলা থেকে একটি শিশু তার মায়ের আচার আচরণ অনুকরন ও অনুসরন করতে শেখে এবং সমাজের মহিলা বা প্রান্তিক মানুষ বা সামগ্রিক জগতের উপর তার একটি গ্রহনযোগ্যতার ধারনা তৈরি হয়ে যায়। তাই সন্তানের উষালগ্ন হতে যদি তাকে সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা ও নারীদের প্রতি সহানুভূতি হবার শিক্ষা দেয়া না হয়, তাহলে পরে আর কোনো পন্থাই কার্যকর হয় না।
আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে…
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও কিশোর বিকাশ মনস্তাত্ত্বিকদের কাছে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল না। ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও আর্নেস্ট হেকেলের পুনরাবৃত্তি তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ গ্রানভিল স্টেনলি হল প্রথম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে 'শিশুরা অতি শৈশবে চার পায়ে হাঁটে, কৈশোরে অসভ্য, বর্বর স্বভাবের চঞ্চল হয় এবং সর্বশেষে একজন সুস্থ–স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়।' তিনিই প্রথম কৈশোরকে 'ঝড়-ঝঞ্ঝার কাল' বলে অভিহিত করেছেন। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমরা বয়ঃসন্ধিকাল কী, এ সময় কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক বা নিরাপত্তাজনিত কী কী সমস্যা হয়, তা অনেকে জানি না! উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশ এই জেনারেশনের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ক্যারিয়ার অনুসন্ধানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেই সময়ে তাই এই বয়সী কিশোর-কিশোরীর শারীরিক ও মানসিক– সব ধরনের বিকাশকে ঘিরে অভিভাবকদের নিতে হয় বাস্তবিক পদক্ষেপ। এবং সেই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ই গড়ে তোলে একটি কিশোর মন… যা পরিপূর্ণতা পায় একজন দায়িত্বশীল পুরুষের মধ্যে।
আমরা সব সময় বলতে পছন্দ করি, সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক। কিন্তু, আদতে জন্মানোর পর থেকেই শুরু হয়ে যায়, তাকে শুধুই 'নারী' বা 'পুরুষ' বা 'ক্যারিয়ারভিত্তিক সফল মানুষ' করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। সন্তান আপনাকে তা-ই উপহার দেবে যা আপনি তাকে দিয়েছেন… তাই আমাদের সন্তানরা বড় হয়ে সমাজ কে কী উপহার দেবে তা ঠিক করে দেবার দায়িত্ব আমাদের মায়েদের এবং তা শুরু হওয়া উচিত শিশুর জন্মের সময় থেকেই মায়ের পরিপূর্ণ যত্ন নেওয়ার মাধ্যমেই।