মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণা কি সেটা জানা দরকার।তিনি যখন কর্মীদের উপদেশ দেন যে, কাউকে চাকরি দিতে হলে পার্টির লেটার হেডে লিখবেন না, মুখে বলুন। কিংবা কাউকে টাকার ব্যাপারে কথা বললে ফোনে নয়, সামনাসামনি বসে কথা বলুন, তখন ভয় হয় তবে কি মুখ্যমন্ত্রী ধরেই নিয়েছেন এই ভাবেই দুর্নীতি চলতে থাকবে,সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে। না কি ভোট ধরে রাখতে তিনি কর্মীদের দুর্নীতিতে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আসলে ভোট বড় বালাই।
দুর্নীতি কাহাকে বলে? দুর্নীতি কয় প্রকার ও কী কী? আমাদের জানা নেই অদূর ভবিষ্যতে এই প্রশ্নের উত্তর পড়ুয়াদের পরীক্ষার খাতায় লিখতে হবে কিনা, তবে দুর্নীতির দীর্ঘ ছায়া আমাদের চারপাশ ঢেকে ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। কোর্টের নির্দেশে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি উন্মোচনের পরতে পরতে আলমারি থেকে যে সব কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে, তা বাঙালি কতটা হজম করতে পেরেছে সেই নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। তৃণমূল দলের রাজ্যসভার সদস্য স্বীকার করেছেন দলে পচন ধরেছে। দলের আর এক তরুণ তুর্কি মুখপাত্র বলেছেন, শরীরে বিষ ফোঁড়া হলে তা কেটে ফেলাই বাঞ্ছনীয়। প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলা, গরু পাচার মামলায় নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে যা দেখে শুনে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। যে বিষয়টি গভীর চিন্তার তা হল এই দুর্নীতির বিস্তার। তৃণমূলের দুই হেভিওয়েট মন্ত্রী, নেতাই নন, তাঁদের সঙ্গে লতায় পাতায় রয়েছেন প্রচুর মানুষ। একদল নিয়েছেন, একদল দিয়েছেন। যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের সংখ্যা ঠিক কত তার হদিস এখনও পাওয়া সম্ভব হয়নি তবে তাঁরাও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাঁরা জানতেন যে তাঁরা অযোগ্য, তাই টাকার বিনিময়ে কেল্লা ফতে করতে চেয়েছেন। এই দুর্নীতির কালো ছায়া আমাদের রবীন্দ্রনাথের নাটকের অন্ধকারের রাজাকে মনে করাচ্ছে।
বাংলার ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাছে ঘটমান বর্তমান পরে পাওয়া চোদ্দ আনার মত। তাঁরা প্রতি সন্ধ্যায় উচ্চ ডেসিবেলে ঝগড়ার আসর বসিয়ে টিআরপি বাড়াতে ব্যস্ত। বাংলার প্রিন্ট মিডিয়া এই দুর্নীতির সাগরে স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত। একদল আছেন যাঁরা ২০১১-ইস্তক মমতাপন্থী, তাঁরা রেখে ঢেকে রিপোর্ট করছেন। আর একদল যাঁরা মমতার একদম ভিতরের লোক তাঁরা মমতাকে রক্ষা করার জন্য - প্রতিআক্রমনই প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ পথ - নীতি গ্রহণ করেছেন। তাঁরা নিত্য নতুন তত্ত্ব দিচ্ছেন যার মধ্যে 'নতুন তৃণমূল' একটি জোরদার তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল কান্ডারি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পাদক, যিনি নিজেই কয়লা পাচার মামলায় অভিযুক্ত। তিনি ইতিপূর্বে জানিয়েছেন যে, তিনি অন্য মেটিরিয়াল, এবং তাঁর পেছনে কেন্দ্রীয় সংস্থা লাগিয়ে লাভ হবে না। উল্টে তিনি তীব্র ভাষায় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আক্রমন করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন অভিষেক 'ডেয়ারডেভিল'। 'নতুন তৃণমূল' চাইছে যাঁরা পার্টি করবেন তাঁরা নিজেদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখবেন, এবং 'নতুন তৃণমূল' চায় যে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের যোগদানে যেন কোনও বাধা না দেওয়া হয়। স্পষ্টতই এই ছকে জেলে থাকা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং বীরভূমের অবিসংবাদিত নেতা, দুজনেই বাদ পড়বেন। স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূলের সাধারণ কর্মীদের মধ্যে দলের ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সম্ভবত সেটা আঁচ করেই মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এক সভায় ঘোষণা করেছেন যে দলে কোনও বিভাজন নেই। তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে একটা উপলব্ধি হয়েছে। সেটা যে শাসক দলের পক্ষে খুব একটা স্বস্তিদায়ক তা নয়।মুখ্যমন্ত্রীর অনুব্রত মন্ডলের পক্ষে জোরালো সওয়াল মানুষ যে ভালো চোখে নিচ্ছেন না, সেটা রাস্তাঘাটে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। ইতিপূর্বে সারদা, নারদা কান্ড সাধারণের মনে রেখাপাত করলেও ভোট বাক্সে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। এবারও এমনটাই হোক তেমনটাই চান মুখ্যমন্ত্রী। তাই তিনি সাধারণ মানুষের চোখ ঘোরাতে দুর্গা পূজোর ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছেন পুজোর একমাস আগেই। কিন্তু 'কমলি না ছোড়ি', প্রতিদিন উঠে আসছে নতুন নতুন দুর্নীতির চিত্র।এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থান নিতেই হবে তৃণমূল কংগ্রেসকে।
মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণা কি সেটা জানা দরকার।তিনি যখন কর্মীদের উপদেশ দেন যে, কাউকে চাকরি দিতে হলে পার্টির লেটার হেডে লিখবেন না, মুখে বলুন। কিংবা কাউকে টাকার ব্যাপারে কথা বললে ফোনে নয়, সামনাসামনি বসে কথা বলুন, তখন ভয় হয় তবে কি মুখ্যমন্ত্রী ধরেই নিয়েছেন এই ভাবেই দুর্নীতি চলতে থাকবে,সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে। না কি ভোট ধরে রাখতে তিনি কর্মীদের দুর্নীতিতে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আসলে ভোট বড় বালাই।
দিল্লির শাহেনশাহও ২০২৪-এর হিসেব করে চলেছেন অবিরাম। অবিজেপি সরকার আছে এমন তিনটি বড় ঘাঁটি মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লি। এই তিন রাজ্য মিলিয়ে লোকসভার আসনের সংখ্যা ৯৭, যেগুলির মধ্যে বিজেপি চাইবে নিজেদের যতটা পারবে এগিয়ে রাখতে। কারণ দক্ষিণ ভারতে বিজেপি'র আসন বাড়ার কোনও আশা নেই। তাই এই তিন রাজ্যে চলছে আইটি, ইডি ও সিবিআইয়ের জোর ধরপাকড়। স্পষ্টতই এই তিন রাজ্যের বিরোধীদের চাপে রাখাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। মহারাষ্ট্রে সঞ্জয় রাউত, দিল্লির মনীষ সিসোদিয়াদের পিছনে কেন্দ্রীয় সংস্থাদের কাজে লাগিয়ে আসলে বিজেপি চেষ্টা করছে বিরোধী ঐক্যকে ঘুরপথে ভেঙে দিতে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাটে সামনে এসেছে ২৩ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি। জাহাজ ব্যবসায়ী ঋষি আগরওয়াল ভারতের সবচেয়ে বড় জাহাজ ব্যবসায়ী। গুজরাটের একাধিক বন্দর জুড়ে তাঁর ব্যবসার সাম্রাজ্য বিস্তৃত। সরকারি, বেসরকারী দুই রকম ব্যাঙ্ক থেকেই তিনি ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করে এখন তাঁর কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করে পুলিশের খাতায় ফেরার। বিজয় মাল্য, নীরব মোদির মতোই ঋষি আগরওয়াল সম্ভবত দেশত্যাগ করেছেন। ২৩ হাজার কোটির পাশে পার্থ ঘনিষ্ঠর ফ্লাট থেকে উদ্ধার হওয়া ৮৪ কোটি নেহাতই ফিকে। অতি সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ চৌহানের সরকারের শিশু ও কন্যা খাদ্য নিরাপত্তা তহবিলে ধরা পড়েছে বিপুল অর্থের নয়ছয়। সিএজি'র গোপন রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত টোটো, বাইক সরকারি খাতায় হয়ে গেছে লরি। অস্তিত্বহীন লরির তেল খরচ বাবদ দেখান হয়েছে বিপুল পরিমান টাকা। উপভোক্তার সংখ্যা যেখানে কয়েক হাজার সরকারি খাতায় তা হয়ে গেছে কয়েক লক্ষ। মধ্যপ্রদেশ সরকারের এই বিশেষ দপ্তরের দায়িত্বে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান নিজে। অর্থ দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এই খাদ্য নিরাপত্তা দুর্নীতির মোট পরিমান প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দপ্তরে এত টাকার নয়ছয় প্রচারে আসতেই নড়ে চড়ে বসেছে প্রশাসন। গুজরাট কাণ্ডে যেমন দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন যে ঋষি আগরওয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে। তবে সে কাগজ তৈরি করতে কত সময় লাগবে সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেন নি। বোঝাই যাচ্ছে ২৩ হাজার কোটির মামলায় সরকারি সংস্থা 'ধীরে চলো' নীতি নিয়েছে।
প্রশ্ন হল কেন? উত্তর হলো, এরা হচ্ছেন সেই সব ব্যবসায়ী যাদের মোটা টাকার চাঁদায় বিজেপি-আরএসএস-এর মত দলগুলি চলে, ফলে এদের দুর্নীতি সহনশীল, সে যত বড় মাপের দুর্নীতিই হোক না কেন।এই একই কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'কেষ্ট' ভজনা করতে হয়। 'কেষ্ট' দলের একজন বড় টাকা তোলার নেতা।প্রশান্ত কিশোরের মত ভোট গুরু,ভোটের আগে হেলিকপ্টার, এ সব তো আর বিনে পয়সায় হয় না! মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান হয়ত একই ব্যাখ্যা দেবেন তাঁর পার্টিতে, অর্থাৎ যা করেছেন সবই পার্টির জন্য। তবে এ ব্যাপারে কোনও দ্বিধা নেই যে যেহেতু মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার তাই কেন্দ্র হাত, পা গুটিয়ে বসে রয়েছে, তা না হলে সঙ্গে সাংবাদিকদের নিয়ে এতক্ষনে বিজেপির তিন ভাই, আইটি, ইডি ও সিবিআই সেখানে গিয়ে হাজির হতেন। টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় রিপোর্টার আমাদের দুর্নীতি সম্পর্কে বিস্ফোরক রিপোর্ট শোনাতেন। আমরা শুনতাম।যেমনটা রোজ শুনছি, নিরুত্তাপ। সবটাই মেনে নিয়েছি, অনেকে হয়ত মনেও নিয়েছেন। কিন্তু, কেউ কি ভাবছেন এবার একবার এগিয়ে এসে প্রশ্ন তোলা দরকার, হে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, তবে কি এই দুর্নীতির উল্লাসমঞ্চই আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য।