পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

দুয়ারে অপচয় উপদ্রব

  • 14 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 3278 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
প্রতি বছর এই যে নিয়ম করে মা আসেন, তার সঙ্গে আরও কি কি আসে, এবছর আর নতুন কি আসবে? তাহলে কি এবার মা এসে প্রমাণ করে ছেড়েছে, করোনা নিয়ে সরকারি বিধিফিধি যা কিছু দিল্লীশ্বর এবং রাজ্যেশ্বরী জারি করে চলেছেন—মাস্ক, দূরী, সব একেবারে ফালতু। না মানলে সামান্য তমও ক্ষতি নেই। আধাবাংলা মায়ের এই-ই একমাত্র সদর্থক অবদান!

মা এসে গেছে। আমার মা নয়, তিনি এখন এক সঙ্গে দুজায়গায় থাকেন—স্মৃতি এবং ছবিতে। আমি বহুকথিত জগজ্জননীর কথা বলছি। আসলে বড় জোর অর্ধবঙ্গজননী। মা দুর্গা। দশভুজাদি আরও খান এগারোটা নাম আছে। তবে দুর্গাই বেশি লোকপ্রিয়। তার কথাই বলছি।

প্রত্যেক বছর বর্ষান্তে এই মা আসে। সুখের কথা, আসার দিনটা শাস্ত্রকারদের দেশজ মাস-বছর খাঁটিগণিতের ঠেলায় এক থাকে না। আশ্বিন বা কার্তিকের চন্দ্রময় পক্ষে সপ্তম তিথিতে সে আসে। তিন রকম বাহনে। হাতি ঘোড়া অথবা নৌকায়।

পঞ্চাশ বছর বা তার আগে কী হত বলতে পারব না, কেন না, তখনও আমার বোধ চক্ষু ফোটেনি। ফুটল যখন, সেই থেকে যা দেখে আসছি, সেই অভিজ্ঞতাই বলতে পারি মাত্র।

চামড়ার চোখে দেখি, মা আসে সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে। পাঁচটি প্রাণীও আসার সুযোগ পায় বাহন হিসাবে: সিংহ, ইঁদুর, ময়ূর, রাজহাঁস ও প্যাঁচা। মহিষাসুরও থাকে মহিষ-নির্গত অস্ত্রবদ্ধ অবস্থায়। এই মূর্তিচিত্রের পশ্চাতে থাকে তিনটি অসংবদ্ধ উপকাহিনি: ১) স্বর্গে অসুর বধের পালা, ২) রামচন্দ্রের রাবণ বধের প্রাক্কালে অকাল বোধন, আর ৩) উমার পিতৃগৃহে আগমন। তিনটিই মিথ, তবে তৃতীয়টি একটু অর্বাচীন কালের বলেই মনে হয়। প্রথম দুটির মধ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের ছাপ স্পষ্ট। তিন নং-এ কিঞ্চিত লোকজ ভাব আছে বলে বুদ্ধিমানদের কাছে বেশ আদরণীয়। স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেখানে এই নিয়ে কা—

কথা তা নয়। শুধু এই সব সঙ্গে করে নিয়ে এলে মায়ের এই বাৎসরিক আসায় ক্ষতি ছিল না। আমারও তেমন আপত্তি করার কিছু ছিল না। হাজার হোক, বাঙালি হিঁদুদের কটা দিন ফূর্তি করার সুযোগ দিলে মন্দ কী! নতুন জামা কাপড় পড়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা, নাড়ু মুড়কি বাতাসা আপেল খণ্ড কলা কুচি খাওয়া আর “আসছে বছর আবার হবে” বলে ধ্বনি দেওয়া।

আমার আপত্তি অন্য জায়গায়।

মা আসে প্রথমত সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর শব্দ উৎপাত নিয়ে। দেশজ লোকজ শাস্ত্রজ জ্ঞানে যেহেতু মনুষ্য হৃদয় ও চিত্তের উপরে ভয়ানক শব্দের ক্ষতিকারক ক্ষমতার বিষয়ে বলা নেই কিছু, যা কিছু বলা হয় বলেছে পশ্চিমা উপনিবেশ নির্মাতা রক্ত চোষা দেশের পুঁজিপতিদের কৃপা ধন্য বিজ্ঞানের পুঁথি, অতএব যথার্থ দেশপ্রেমিক বোধি তা অগ্রাহ্য করতেই উৎসাহ যোগায়। বিশেষ করে দেশি জ্ঞানে যেখানে শ্মশান যাত্রার সময়ও চিৎকারের নিদান দেয়, শাস্ত্রেও যেহেতু বলে, শব্দই ব্রহ্ম, সেই সব জ্ঞানের আলোকে মা দুর্গার আগমন উপলক্ষে দিন আট দশেক (তৃতীয়া থেকে দ্বাদশী) উপনিবেশিওয়ালাদের থেকে পাওয়া মাইকের সাহায্যে স্বদেশি চিত্তে গান ও ঢোল নামক ১৩০ ডেসিবেল দেশি আওয়াজ বাজানো ও শোনানো পুরাই জায়েজ হয়ে বসে!

প্রতিবাদ?

যে করবে, তাকে দেশজ গালাগাল প্রদান থেকে শুরু করে গণ পিটাই হয়ে পাকিস্তান বা স্বর্গেও প্রেরণের প্রেরণা হতে পারে। কেউ ঝুঁকি নেবে না!

অন্য দিকে, এই হানিকারক শব্দ শোনার জন্য যাদের হানি তাদেরই টাকা দিতে হয়। চাঁদা। চাঁদাকে জুলুম বলে মনে মনে যে কেউ ভাবতে পারে। বাইরে প্রকাশ করলে ক্লাব বা পূজা কমিটির তরফে যে ইউএপিএ ধাঁচের শাস্তি নেমে আসতে পারে, সেও এক ভয়ানক কাণ্ড। খুব কম লোকের পক্ষেই মায়ের নামে সন্তানের উপর এই স্বঘাতী অর্থদানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব। জিরো ডেসিবেলের বেশি শব্দ উৎপাদন এই সময় বাঙালি আধ্যাত্মিক হিন্দুদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। শব্দ প্রদান তখন ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তির অজুহস্ত হয়ে উঠবার সম্ভাবনা প্রচুর। নির্বিলম্বে।

সেই সঙ্গেই এই মা আসে বিদ্যুতের বিশ-আল অপচয়ের এক ভাণ্ডার খুলে। শক্তির অপব্যবহার।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহারের কারণে কতগুলি প্রকৃতি বিরোধী ঘটনা ঘটে, যথা: ১) কয়লার ভাণ্ডার নিঃশেষিত হতে থাকে (পুনরুৎপাদন যোগ্য নয়); ২) বাতাসে কার্বন দুষণ হতে থাকে, যা একটা সীমার পরে প্রাকৃতিক ক্ষয় নিবারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে; ৩) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সামগ্রিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

যেহেতু আধুনিক সভ্যতায় বেঁচে থাকার অনেক আবশ্যিক উপকরণের মধ্যে বিদ্যুৎ একটি, তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু এমনভাবে তার ব্যবহার করা দরকার যাতে প্রাকৃতিক চক্রগুলির ন্যূনতম ক্ষতি হয়।

মা এসে সেই প্রক্রিয়াকে মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ করেন। আলোক সজ্জায় এবং মাইকের ব্যবহারে দশ দিনে তিন চার মাসের বিদ্যুৎ এক লপ্তে খরচ করিয়ে ছাড়েন। এ এক বিশাল অপচয়। মুশকিল হচ্ছে, এই অপচয় বোঝার লোক হিন্দু বাঙালি শিক্ষিত সংস্কৃতমনা বুদ্ধিমানদের মধ্যে সহস্রাংশের অঙ্কে নেমে গেছে। আমি এই মর্মে ফেসবুকে পোস্ট করলে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও – যারা এমনকি বিদ্যাসাগর প্রশ্নে আমার পক্ষে থাকেন – রে রে করে তেড়ে আসেন। কত বাণিজ্য হয়, কত বেকার ছেলের দুপাঁচ টাকা রোজগার হয়, ইত্যাদি বলতে থাকেন, যেগুলো আমার একেবারেই জানা নেই বলে তাঁদের দৃঢ়মূল ধারণা।

সেই সাথেই মা নিয়ে আসেন বাজি ফাটানো এবং পোড়ানোর এক মহাবিধ্বংসী অভ্যাস। যা একাধারে শব্দ দুষণ ও বায়ু দুষণ বৃদ্ধি এবং বুদ্ধিবৃত্তির হ্রাস ঘটাতে থাকে।

যাঁরা আমাকে প্রতি বছর এই সব ধুন্ধুমারালি সহ্য করে নেবার উপদেশ প্রদান করে একে বাঙালির সেরা উৎসব এবং এখন আর এটা ধর্মীয় নেই, সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, ইত্যাদি বলতে থাকেন, তাঁদের সাংস্কৃতিক বোধের দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হই। হিন্দু উৎসবকে বাঙালির উৎসব বলা একটা মারাত্মক তথ্যগত ও হিন্দু অহমিকাজাত ভুল। আর, মাইকের শব্দবাজি এবং বারুদের শব্দবাজি কী করে যে আধুনিক সভ্য মানুষের সংস্কৃতি হতে পারে, এবং তা কেউ দাবি করতে পারেন, তাও আমাকে চিন্তিত করে তোলে। আই কিউ পরীক্ষা নিলে এই বুদ্ধির মানাঙ্ক ৪২-এর এক বিন্দু বেশি হবে বলে বিশ্বাস হয় না।

হ্যাঁ, একে একটা বিকল্প সংস্কৃতি হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন। সিনেমা টিভির তারকারা নেতা মন্ত্রী এমএলএ এমপি-রা কাচি হাতে ফিতে কাটার জন্য তৃতীয়া থেকে সপ্তমী পর্যন্ত এক প্যান্ডেল থেকে অন্যগুলোতে দৌড়তে থাকে, তাদের দামী গাড়ির মসৃন চলার স্বার্থে সারা বছর ধরে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকা রাস্তায় মহালয়ার পরদিনই রাতারাতি মশলা পড়ে যায়, তাদের হাতেও নাকি গান্ধীর ছবিওয়ালা সরকারি ছাপা কাগজ দিস্তায় দিস্তায় জমা পড়তে থাকে, আয়কর বিভাগ যেদিকে ফিরেও তাকাবে না, এর মধ্য দিয়ে সরকার থেকে যা ক্লাবে বা পূজা কমিটিতে সরকারি অনুদান হিসাবে যায় তা আবার সরকারি শাসক দলের কেদারনাথদের হাতেই ব্যক্তিগত উপহার হয়ে ফিরে আসে {একে নাকি “হাম সে লো, হামে লাও” বীজমন্ত্র বলে!!}—একেও যদি সংস্কৃতির অংশ বলে মেনে নেন, তাহলে মা এসে অবশ্যই সংস্কৃতির চাষ করে যান!

এই আর্থিক লেনদেন কীরকম গতিবেগ পায় তার নমুনা স্বরূপ আমার এক ফেসবুক দোস্ত একখানা চেক-এর ছবি তুলে ধরেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ দপ্তরের ঠিকাদারদের এক সমিতি এক মন্ত্রী পোষিত পূজা কমিটির হাতে দশ লক্ষ টাকার দেক তুলে দিয়েছেন।

মা না এলে এই সংস্কৃতির বিকাশ যে হতে পারত না, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

এই পুরো দশ লক্ষ টাকাই একটা বিরাট অপচয়। এই অর্থে এই বছরে বন্যা কবলিত সমস্ত দুর্গত মানুষকে জামা কাপড় কিনে দেওয়া যেত। কিংবা খুলবার আগে রাজ্যের সমস্ত স্কুলগুলির ক্লাশরুম স্যানিটাইজ করে ফেলা যেত। সমস্ত টাকা চলে গেল কিছু মাটি, চট, থার্মোকোল, বাঁশ, পেরেক, বিদ্যুৎ আর মাইকের আওয়াজের পেছনে।

তবে আশার কথা এই যে এই মা একা নয়। এর পেছনেই আর এক মাও আসবে। সমস্ত দুষণ ও অপচয় আরও বেশি করে ঘটাতে।

তাকেও আমরা সংস্কৃতিই বলব।

হ্যাঁ, মৃত্যু মিছিল, ধ্বংস মিছিলকেও সংস্কৃতি বললেই বা কে ঠেকায়?

তবে এটা মানতেই হবে, মা এসে প্রমাণ করে ছেড়েছে, করোনা নিয়ে সরকারি বিধিফিধি যা কিছু দিল্লীশ্বর এবং রাজ্যেশ্বরী জারি করে চলেছেন—মাস্ক, দূরী, সব একেবারে ফালতু। না মানলে সামান্য তমও ক্ষতি নেই।

আধাবাংলা মায়ের এই-ই একমাত্র সদর্থক অবদান!

0 Comments

Post Comment