যেয়ে দেখি সে এক মেলা। সকলেই আচেন। এদিকে বেশি ইংরেজি কম বাংলা জানা টুকটুকে ছেলেমেয়েরা ডিলান সায়েবের গান গাইচেন, ওদিকে বোরখা পরা মা জননীরা ইয়াব্বড় ফেস্টুন হাতে মিছিলে হাঁটতে তোয়ের হয়ে আচেন। এক বাবুকে দেখি বয়সে খানিক কুঁজো হয়ে পড়েচেন, এসেছেন জোয়ান মেয়ের হাত ধরে। মিছিলের ছবি হুতোমের চোখে।
বড্ড শীত পড়েচে। বিষধর সাপেরা এ সময় শীত ঘুম দেয় আর বিষধর বাবুরা অন্যের ঘুম কাড়েন।
শীত না পড়তেই নোটিশ দেয়া হয়েচে অন্য দেশ থেকে পড়ি কি মরি করে পালিয়ে আসা বাচ্চা বুড়ো ছোঁড়া ছুঁড়িদের সরকার বাহাদুর দয়াপরবশ হয়ে দেশের লোক করে নেবেন। আর কারা নাকি ভিনদেশী, তবু দিশি হয়ে বসে আচে। তাদের দেগে দেয়ারও বন্দোবস্ত হচ্চে। সে কাজ মিটলে কী করা হবে? কেউ বলচে যার যার দেশে ফেরত পাঠানো হবে, আবার কোন বাবু বলচেন মস্ত মস্ত জেলখানা তৈরি হচ্চে, সেথায় গুঁজে দেয়া হবে।
আমাদের সম্পাদক দেশের দুখখে কদিন বিস্তর চোখের জল ফেলেচে। কাগচে লিখেচে, কাগচ মালিকের চ্যানেলে নাহক চেঁচামেচি করেচে। কিন্তু সেদিন দেখি কেমন উল্টো গাইচে। তার ফাঁকা ফ্ল্যাটে বসে নূতন স্মার্ট টিভিতে তারই অনুষ্ঠান দেখচিলেম। শুনি সে বলচে “এই আইন দেশের সঙ্কট মেটানোর বদলে বাড়িয়ে তুলল। এ দেশবিরোধী আইন, সাম্প্রদায়িক আইন” ইত্যাদি। আপনাদের হুতোম তো শুনে তাজ্জব। অনুষ্ঠানটি শেষ হতে সম্পাদকের আপিসে গিয়ে হাজির হলেম।
ভায়া, এসব কী? কাল পয্যন্ত যে বল্লে সব ভাল হচ্চে!
সম্পাদক গোড়ায় থতমত খেলে, শেষে গলার টাইটি ঢিলে করে নিয়ে বল্লে “আপনি জানেন না হুতোমবাবু। আসামে আমার পৈতৃক বাড়ি আছে। সি এ এ র বিরোধিতা না করলে জ্যাঠার ছেলেরা আমায় একটি পয়সা দেবে না ভাগ করার সময়৷ বাড়ির ভ্যালুয়েশন এই বাজারে দশ পনেরো কোটি তো হবেই। আমার চারটি কাজিন। পাঁচ ভাগ হলে কত করে পাব ভেবে দেখুন। টু থ্রি ক্রোর। নট আ ম্যাটার অফ জোক।”
সম্পাদক মাস মাহিনা পায় দশ কোটি, কাগচে আবার কিসব শেয়ার টেয়ার আচে, তবু দু তিন কোটির মায়া কচ্ছে। শুনে করুণা হল। শুধোলেম, টিভির দর্শককে তো আর সেকথা বলা যায় না। কাগচেও লেখা চলবে না। তালে যুক্তিটি কী দেয়া হবে?
“ওই যে, যা বলেছি টিভিতে। দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। সাম্প্রদায়িক।”
সে তো টিভিতে বল্লে বাছাধন। সত্যি কথাটি আমায় বলো দিকি?
সম্পাদক লাজুক হেসে বল্লে “সত্যি কথাই বলেছি। তবে কিনা শাস্ত্রে বলেছে অপ্রিয় সত্যি বলতে নেই। তাই অ্যাদ্দিন ওসব বলিনি। এখন ওসব শুনে রাগ করবে না এমন লোক তৈরি হয়েছে, তাই বলছি আর কি।”
এত সহজে ছেড়ে দেবেন, হুতোম সে বান্দা নন। সম্পাদককে চেপে ধত্তে হল। তকন লজ্জার মাথা খেয়ে বল্লে সে পয়লা দিনেই জানত সরকার বাহাদুরের আসলি প্রোজেক্ট হল মোছলমান খ্যাদাও। কিন্তু কলকেতায় বসে কিচ্চুটি বলেনি কারণ ভেবেচিল আসামে এন আর সি ব্যাপারটি বাঙাল খ্যাদাও হবে। বাবু নিজে বাঙাল, বাপ পিতেমো দেশভাগের কালে শ্রীহট্ট হতে খ্যাদানি খেয়ে এসেছিলেন। এ সওয়ায় সম্পাদকের জন্মদাতা আসামে বাণিজ্য করে পেল্লায় বাড়ি হাঁকালেন, তেনার দু ভাই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে বেজায় নাম কল্লেন, রূপার চামচে মুকে দিয়ে সম্পাদক ধরায় এলে। কিন্তু সেসব কোন জম্মের কথা। সম্পাদকের বক্তব্য সে যুগে যে বাঙালের দল আসামে আসেন তেনারা সব শিক্ষিত সাধুপুরুষ, এদেশের ইকোনমিতে কন্ট্রিবিউট করেচেন। একুনো যারা আসচে সব চাষাভুষোর দল। অসমিয়ারা যে বলচে তারা এসে অসমিয়া ভাষা, সংস্কৃতির গুষ্টি উদ্ধার কচ্ছে সে মিছে কথা নয়। ও ব্যাটাদের না ঝ্যাঁটালে আসাম বাঁচে কী উপায়?
হুতোমের সুবিধে এই যে তিনি অশরীরী। রেগে সম্পাদকের ঘাড়টি মটকে দিলেও সে টু শব্দটি কত্তে পারবে না। তেড়ে গাল দেয়াও চলে। বেহায়া ভণ্ডটিকে গায়ের ঝাল মিটিয়ে গাল পাড়লেম, পরে শুধোলেম, তালে বলচ আসামের বাইরের হিঁদুরা নিশ্চিন্দি? সি এ এ, এন আর সি কোথায় কী হল সে খবরে তেনাদের ঘন্টা?
সম্পাদক ঢোঁক গিলে বলে কি “আজ্ঞে তা কী করে বলি হুতোমবাবু? আসামের এন আর সি থেকে যে উনিশ লাখ বাদ পড়ল, তার বেশিরভাগ তো হিন্দু। সরকার বলছে বটে যারা বাদ পড়বে তাদের সি এ এ দিয়ে নাগরিক করে নেবে। কিন্তু তা করতে গেলে তো বাদ পড়া হিন্দুদের শরণার্থী হিসাবে আবেদন করতে হবে নাগরিকত্বের জন্যে।”
ভায়া, সরকার বাহাদুরের ব্যবস্থাটি তো জব্বর! ছিলেম নাগরিক, হলেম শরণার্থী! কার মাথা থেকে বের হল এমনটি?
“হুঁ হুঁ, এমনি এমনি কি আর ওনাকে চাণক্য বলা হয়?” সম্পাদক এমনি র্যালায় বল্লে যেন বাহবাটি ওরই পাওয়া উচিৎ হয়। হুতোম কটমটিয়ে তাকাতে জ্ঞান ফিরল।
বেচারি একেবারে ভেঙে পল্লে দিন কতক পরে। সম্পাদকের আদুরে কন্যাটি রাজধানীর নাম করা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো কচ্ছেন জানতেম। তা সে ইউনিভার্সিটিতে যারা পড়েন তারা যে এমন ঠ্যাঁটা সরকার বাহাদুর ঠাহর কত্তে পারেননি। তারা সি এ এ, এন আর সি নিয়ে বেজায় গোল কল্লেন। এদিকে সরকার বাহাদুরের আপিসে লেকাপড়া জানেন এমনি লোক বেজায় কম। তাই তেনারা নামে ইসলামিয়া দেকেই বুঝেচেন সেথায় ছেলে মেয়ে সব মোছলমান। তা মোছলমানের প্রতিবাদ আবার সহ্য করবে কে? তাই রাত বিরেতে খাকি পুলিশ আর জিনস পুলিশ ঢুকিয়ে দিলেন ইউনিভার্সিটি চত্বরে। সে যমের অরুচি নপুংসকের দল লাইব্রেরী পয্যন্ত রেয়াত কল্লে না। আমাদের সম্পাদকের মেয়েরও মাথা ফাটালে।
ঘটনা শুনে হুতোমের সাধ হল গোটা কতক বীরের ঘাড় মটকে আসেন। তবে অমনধারা হয়ে যে একরকম উপকার হল সে কথাও মানতে হয়। এমনটি না হলে সম্পাদক শেষ নিঃশ্বাস ফেলা অবধি গাঁটকাটা মন্ত্রী সান্ত্রীর গুণ গেয়ে চলত বলে পেত্যয় হয়। খবরটি পাবার পরে সে বড়ই ভয়ে ছিল। কিন্তু পরদিন দিল্লী হতে কন্যাকে বাড়ি এনে গিন্নীর হাতে তুলে দেয়ার পরেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার হতে চাইলে। বল্লে “হুতোমবাবু, কাল একটা মিছিল আছে। আমরা দুজনে যাই চলুন।”
এই সেদিনও বল্লে অকম্মার ধাড়ি ভিন্ন কেউ মিছিলে মিটিঙে যান না, গাঁয়ের যত আঁটকুড়ির ব্যাটা বেটি মিছিলের ছুতোয় কলকেতা আসেন ভিক্টোরিয়া আর আলিপুরের চিড়িয়াখানা দেখবেন বলে! একন নিজেই মিছিলে যাবে কিরকম?
বাছাধন অসহায় মুখে বল্লে “বিপদে পড়েছি বলে এরকম হ্যাটা করছেন? নিজের চোখেই তো দেখলেন এরা নেহাত ছাত্রছাত্রীদের পর্যন্ত কি মার মেরেছে। এরপর কি আর ঘরে বসে থাকা উচিৎ?”
কথাটি ফেলে দেয়ার মতন নয়। তাই যাওয়াই ঠিক হল।
যেয়ে দেখি সে এক মেলা। সকলেই আচেন। এদিকে বেশি ইংরেজি কম বাংলা জানা টুকটুকে ছেলেমেয়েরা ডিলান সায়েবের গান গাইচেন, ওদিকে বোরখা পরা মা জননীরা ইয়াব্বড় ফেস্টুন হাতে মিছিলে হাঁটতে তোয়ের হয়ে আচেন। এক বাবুকে দেখি বয়সে খানিক কুঁজো হয়ে পড়েচেন, এসেছেন জোয়ান মেয়ের হাত ধরে। আরেক বাবু দুধের দাঁত না পড়া শিশুটিকে ঘাড়ে চড়িয়ে। বাবু সকলের সাথে স্লোগান দিচ্চেন, সন্তানটি গলা মেলাচ্চে। ধুতি পরা মাষ্টার দেখলেম, আবার এক মৌলবী দেখলেম এক কোণে নমাজ আদা কচ্ছেন, গুরু গোবিন্দ সিং এর এক ভক্তও পোস্টার বিলি করে বেড়াচ্চেন। সম্পাদককে ফিসফিসিয়ে শুধোলেম, এ চত্বরে তো অনেক দল। আমরা কার দলে? সে জবাব দেয়ার ফুরসত পেলে না। একটি দাড়িওলা তথাপি কচি ছেলে আমাদের মৃদু ধমকে দুটি হিজাব পরা বালিকার পেছনে দাঁড় করিয়ে দিলে। “লাইন দিন, লাইন দিন। মিছিল শুরু হচ্ছে।”
মেয়ে দুটি বেজায় লাজুক। তাদের স্লোগান পথের কুনো বেংটিও শুনতে পায় না এমনি দশা। আমি আর সম্পাদক কিনা ইন্টেলেকচুয়াল, আমরা স্লোগান দিলে ধোপা নাপিত বন্ধ হবার ভয়। কে বন্ধ করবেন সে কথা ভিন্ন। তবে আমাদের পিছনেই একজন শ্বেতশ্মশ্রু নিয়ে বিরাজ কচ্ছেন ও গলার শির ফুলিয়ে আমাদের ফাঁক ঢেকে দিচ্চেন। বোধ হল মেথর কি কুলি হবেন, বয়স হুতোমের অধিক হলেও আশ্চয্যি নয়।
চলতে চলতে কখন যে মিছিলের তাল বদলে যাচ্চে টের পাচ্ছি নে। কোথায় ঢোল বাজচে, কোথায় কেবল তালি ক্রমে ঠাহর করা অসাধ্য হল, দেখলেম সম্পাদকও দিব্য স্লোগান দিচ্চে। শেষে ধোপদুরস্ত চৌদ্দ পুরুষের নাক কেটে হুতোমও প্রতিবাদী হওয়াই সাব্যস্ত কল্লেন।
সহসা চোখে পল্ল একটি তাজা ছেলে টিভিতে শোনা সেই আজাদি স্লোগানটি দিচ্চে। মাজা রংটি আর গালে দাড়ি দেখে সম্পাদককে শুধোলেম, হ্যাঁ গা, এ সেই কানাই বলে ছেলেটি নাকি? সে ধুয়োই তো দিচ্চে দেকচি। সম্পাদক বল্লে “কানহাইয়া কি আজ একটা হুতোমবাবু? এখন ঘরে ঘরে কানহাইয়া। এত যে ছেলে দেখছেন, সবাই কানহাইয়া। এমনকি মেয়েরাও কানহাইয়া।”
ভাবলেম, সত্য বটে। কংস কানাইয়ের বাপ মাকে হাজতে ভল্লে, যতগুলি সন্তান হল ততগুলি কোতল কল্লে, তথাপি কানাইকে খতম কত্তে পাল্লে না। তুমি পুলিশ ডাকো, আজাদি। তুমি জেলে ভরো, আজাদি। তুমি ডান্ডা মারো, আজাদি। কানাইকে আটকায়, কার সাধ্যি?