শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত যে প্রশ্নগুলো আমাদের সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে তার মধ্যে প্রথমের দিকেই থাকবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ণ পদ্ধতি। কি ভাবে মূল্যায়ণ করলে একজন শিক্ষার্থীর সঠিক মার্কশিট বানানো সম্ভব, তা নিয়ে তর্ক বহু দিনের। শুধুমাত্র পার্বিক পেন অ্যান্ড পেপার টেস্ট এখন অতীত,নিত্য নতুন চেষ্টা চলছে কিভাবে এক বিজ্ঞান সন্মত ও যৌক্তিক মূল্যায়ণ পদ্ধতি চালু করা যায়। বেশ কিছু বছর হল, সারা দেশে মূল্যায়ণ পদ্ধতির মধ্যে দুটো উপাদান নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথমটি হল সমষ্টিগত মূল্যায়ণ (সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট) এবং দ্বিতীয়টি হল গঠনমূলক মূল্যায়ণ (ফর্মেটিভ অ্যাসেসমেন্ট)। এই প্রেক্ষাপটে নয়া শিক্ষানীতির অনুষঙ্গে দেশব্যাপী একই ধরণের মূল্যায়ণ পদ্ধতি চালু করতে চাইছে ন্যাশানাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)। এই বিষয়টি সম্পাদন করার জন্য একটি সংস্থা তৈরি করা হয়েছে যার নাম 'পরখ' (পারফরম্যান্স অ্যাসেসমেন্ট রিভিউ অ্যান্ড অ্যানালিসিস অফ নলেজ ফর হলিস্টিক ডেভলপমেন্ট)।
পরখের প্রথম রিপোর্টে দ্বাদশ শ্রেণির মার্কশিট তৈরির একটা মডেল উপস্থিত করা হয়েছে যা নিশ্চিত ভাবে বহু তর্কের জন্ম দেবে।প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে নয়া শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক পরীক্ষার কোন জায়গা নেই, বোর্ড পরীক্ষা বলতে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষাকেই বোঝানো হচ্ছে। পরখ সুপারিশ করেছে দ্বাদশ পাশ করার পর (চলতি অর্থে উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষার্থী যে মার্কশিট হাতে পাবে তাতে চারটি শ্রেণিতে প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর নম্বর যুক্ত হবে। ধরা যাক কোন বিষয়ের মোট নম্বর ১০০,তা হলে নবম শ্রেণির প্রাপ্ত নম্বরের ১৫ শতাংশ, দশম শ্রেণির ২০ শতাংশ, একাদশ শ্রেণিতে ২৫ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির প্রাপ্ত নম্বরের ৪০ শতাংশ মিলিয়ে সেই বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর নির্দিষ্ট হবে। এখানেই কিন্তু বিষয়টা শেষ হচ্ছে না। এই নাম্বারের ক্ষেত্রেও সামেটিভ ও ফরমেটিভ মূল্যায়ণ পদ্ধতির মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে হবে। পরখের মডেল অনুসারে নবম শ্রেণিতে ফরমেটিভ ও সামেটিভের প্রাপ্ত নম্বরের অনুপাত হবে ৭০:৩০, দশম শ্রেণিতে ৫০:৫০, একাদশ শ্রেণিতে ৪০:৬০ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০:৭০। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার যে ফর্মেটিভ (গঠনমূলক) মূল্যায়ণের জন্য শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থীর ধারাবাহিক মূল্যায়ণ, সার্বিক প্রগতি নিদর্শন পত্র (হলিস্টিক প্রগ্রেস রিপোর্ট কার্ড), গ্রুপ ডিসকাশন ও প্রজেক্টকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
এ কথা আজ আর কেউই অস্বীকার করেন না যে শুধুমাত্র একটা বা দুটো পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ণ করলে তা কখনোই সঠিক হতে পারে না। এই সমস্যা দূর করার জন্যই নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ণের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমস্যা হল ফর্মেটিভ মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে যে সূচক গুলো নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। একই বোর্ডের অধীনে অবস্থিত সমস্ত স্কুলের পরিকাঠামো এক নয়, শিক্ষার্থীরা একই ধরণের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসেন না, এমনকি বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে তাদের আচরণের প্রকাশও এক রকম নয়। এই অবস্থায় ফর্মেটিভ মূল্যায়ণের কাম্যমান এক রকম হবে না। সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট এখনো পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যে পেন অ্যান্ড পেপার টেস্ট। এখানে শহর ও গ্রাম ভেদে প্রশ্নপত্রের মান এবং শিক্ষকদের নাম্বার দেওয়ার পদ্ধতি এক নয়। দ্বাদশ শ্রেণিতে সমস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বোর্ডের তৈরি প্রশ্নপত্র আর নবম-দশম-একাদশ শ্রেণিতে স্কুলের নিজের প্রশ্নপত্র এই বিভিন্নতার মধ্যে চারটে শ্রেণির নাম্বার এক জায়গায় করে মার্কশিট তৈরি করলে সমতার ভিত্তিতে সেই মূল্যায়ণ কি সম্ভব!
এই সমস্যাগুলো পরখের রিপোর্ট অস্বীকার করেনি বরং তারা তাদের মত করে সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশের মধ্যে রয়েছে হলিস্টিক প্রগ্রেস রিপোর্ট কার্ড তৈরির কথা। এই ধরনের রিপোর্ট কার্ডের সুবিধার দিক হল একটা কার্ডের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির ফরমেটিভ, সামেটিভ মূল্যায়ণের ফল নথিভুক্ত হয়, সঙ্গে থাকে শিক্ষার্থী সম্পর্কে হরেক রকম তথ্য, তার বৌদ্ধিক দক্ষতার ক্ষেত্রসমূহে তার মূল্যায়ণ। এই কার্ড তৈরির কাজ সব বোর্ডেই চালু হয়ে গেছে, আমাদের রাজ্যেও আগামী শিক্ষাবর্ষে এই কার্ড চালু হবার কথা। কিন্তু গোল বেঁধেছে পরখের পরবর্তী সুপারিশ সমূহে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগের হল বিভিন্ন বোর্ডের মধ্যে সমতা বিধানের নামে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা। সিবিএসই, আইসিএসই, এনআইওএস, বিভিন্ন রাজ্য বোর্ড নিয়ে দেশে উনসত্তরটি স্কুল বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ডগুলোর মধ্য দিয়ে ভারতের বৈচিত্র্যর মধ্যে ঐক্যের ধারণা স্পষ্ট হয়। এই কারণে সংবিধান প্রণেতারা শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকায় রেখেছিলেন। পরখ এই বৈচিত্র্যের বিষয়টাই অস্বীকার করতে চাইছে। তাদের সুপারিশে বলা হয়েছে মূল্যায়ণের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় ভাবে সারা দেশে প্রত্যেকটি শ্রেণির জন্য একটা করে কোশ্চেন ব্যাঙ্ক তৈরি করা হবে এবং প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে পেশাদার পেপারসেটার তৈরি করা হবে। এই ভাবে ঘুরিয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কুক্ষিগত করার চেষ্টা হবে। এ কথাটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কেন্দ্রীয় ভাবে কোশ্চেন ব্যাঙ্ক সফল করতে হলে সিলেবাসটাও কেন্দ্রীয় ভাবে করতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল তাদের ভাবাদর্শ সিলেবাস বানাবার চেষ্টা করবে। এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে পরখের পক্ষ থেকে দেশজুড়ে সার্ভে করা হবে বোর্ডগুলোর কাজের উপর। সম্ভবত এর ফলে কলেজে চালু ন্যাকের মত বোর্ডগুলোর ক্ষেত্রে গ্রেডেশন প্রথা চালু হবে।এই অবস্থায় বোর্ডগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হবে যা পরবর্তীতে বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত স্কুলের মধ্যেও লাগু হতে হবে।
মূল্যায়ণ পদ্ধতি কোন শালগ্রাম শিলা নয় বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, পরিস্থিতির চাহিদা মেনে যথাযথ পরিবর্তন কাম্য। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে সরকার সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে একমাত্রিক ও কেন্দ্রীভূত শিক্ষা পদ্ধতি চালু করতে চাইছে। এটা শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনার উপর আঘাতই নয়, প্রকৃত শিক্ষার অন্তরায়। পরখ নির্মিত মূল্যায়ণের মডেল সেই একমাত্রিক ভাবনার বাইরে বেরোতে পারল না ফলত নিরবচ্ছিন্ন ও সামগ্রিক মূল্যায়ণের ধারণা অপূর্ণই থেকে গেল।