যাই হোক জানলা দিয়ে গোয়ালের দিকে একবার তাকিয়ে, লাল মেঝের পুরানো দালান বারান্দায় বদনার (লোটা) জলে দাঁত মেজে বসলাম টিভির সামনে।
দূরদর্শনে মহালয়া দেখা হবে, সাল ইং ১৯৯৮, ক্লাস ফাইভে পড়ি। তার আগে রেডিও তে শুনতাম, সেই দরাজ গলা, বাঙালির মহালয়া, পাঠ করতেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু এবারে ভোরে একটু বেশি উত্তেজনা, কারণ প্রথম বার টিভি এসেছে আমাদের বাড়িতে, সেটও রঙিন। চলচ্চিত্র জগতের এক বিখ্যাত অভিনেত্রী দুর্গা হয়েছেন। আমার আম্মুর পছন্দ তালিকায় সে নায়িকা রয়েছেন। বর্ধমানের অখ্যাত এক গায়ের বউ ও তার একমাত্র কন্যা সেদিন ভোরে উৎসবে মেতেছিল। হঠাৎ পাড়ার মসজিদের মাইকে আমাদের হাফেস সাহেবের (হাফিজ) কন্ঠে সুরেলা আজান ভেসে উঠলো। আম্মু বললেন ‘টিভি বন্ধ কর। আজান দিলো, নামাজটা পড়ে নি’। ফারাকটা কোথায়, এই ২০২৩ এ আজো বুঝে উঠতে পারলাম না!
আব্বুকে কোনোদিন দেখিনি ভোর ভোর উঠে মহালয়া শুনতে বা দেখতে দেখিনি, উনি পাশ ফিরে ঘুমাতেন। আমার দাদা (ঠাকুরদা) এবং দাদি (ঠাকুমা) কেউ দেখেছে ব’লে তো মনে পরেনা। তবে রোজ সকালে আমার দাদির চা’য়ের মজলিশ বসতো পাড়ার কয়েকজন দাদিদের নিয়ে, সকালে ইশকুলের পড়ার এক ফাঁকে সেখানে গিয়ে ভোরের মহালয়ার গল্প তাদের শোনাতুম। মনোযোগী ছাত্রীর মত তারা শুনতেন, দু একটা প্রশ্ন ও আসতো সেই প্রবীণ ছাত্রীদের থেকে। প্রশ্ন শুনে মনে হত, তাঁরা এই পৌরাণিক কাহিনীটি জানেন, কেবল আমাকে যাচাই করে দেখছেন আর কি! পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি আমার দাদা বা দাদি কেউ কোনদিন আমাকে মনে করিয়ে দেন নি, আমি মুসলমান। ভোর উঠে মহালয়া দেখার অতো বাই কিসের, ওকি আমাদের পরব নাকি! এমন কথাও তাদের বলতে শুনিনি।
গ্রামটাতে কয়েকঘর জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ, বাকি সবকটা ঘর মুসলমান। তদের ভাষা বাংলা। গ্রামে বারোয়ারি পূজা হয় না, তাই দুর্গা পূজার সময়টাতে গ্রামের ভিতরে থাকলে বোঝার উপায় ছিলো না ‘দুগ্গা এলো’। কেবল শিউলি ফুল আর কাশ জানান দিতো এই গ্রামের বাইরে হৈহৈ-রই রই চলছে নিশ্চয়।
ইশকুল ছুটি, তাই নিয়ম করে সপ্তমীটা আমার আম্মু আমাকে নিয়ে বাপের বাড়ি বর্ধমান সদরে নিয়ে যেতেন। সেখানে আমার মেলা কাজ। অষ্টমীতে আমার নানির (দিদা) করা লুচি, কুমড়োর ছেঁচকি নাকি রাজেন মামার বৌয়ের করা লুচি ছোলার ডালের তরকারি, সেটা চেখে নাম্বার দেবার ডিউটিটাও আমার কাঁধেই পড়তো। তারপর কাছের মন্ডপ, রাত বাড়লে মামার বাড়ির সকলে মিলে দূরের বড় মন্ডপ দেখতে যাওয়া এবং পেটপুরে হোটেলে খেয়ে ফেরা। নবমিতে সন্ধ্যা মাসির বাড়িতে নেমন্তন্ন, ফী বছর বাঁধা। ঘরের করা গুড়ের নারকেল নাডু, নিমকি, তারপরেই মাংস, ভাত, চাটনি, রসগোল্লা। দশমীতে আর একবার বড়মামার গাড়ি চড়ে মন্ডপ গুলো ঝালিয়ে নিতাম, কারন গ্রামের বাড়িতে ফিরে আমার চাচার মেয়দের দুর্গা পূজার গল্প শোনাতে হবে। ওদের কারোর মামার বাড়ি শহরে নয়, তাই ইয়াব্বড়ো দুর্গা পুজার মন্ডপ ওদের তখনো দেখা হয়ে ওঠেনি। অগত্যা আমার বলা বিবরণী ওদের কাছে ছিল পুজোর ছুটির মজা। গুরু দায়িত্ব আমার কাঁধে তখন।
দুর্গা বনম হুদুদ দুর্গা (মহিষাশুর) এর যে নানা ধারণা আজ আমি জেনেছি, সেই মেয়েবেলায় আমার কাছে ওসব অজানা ছিলো। তাই মুলধারার সম্প্রচারিত এবং প্রকাশিত তথ্যই আমার কাছে একমাত্র সম্বল তখন। অনৈচ্ছিক ভাবেই কেবল একটি ধারণাই সেই মেয়েবেলাতে প্রচার করার জন্য, আজ আমি বড়ই দুঃখিত এবং লজ্জিতও।
সাইফুদ্দিন কাকা, ছেলে বেলা থেকে আমাদের বাড়িতে থাকতেন, গরু, খামার, চাষের জমি এসব দেখতেন। তখন আমি ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। পাশের পাড়ার এক কাকা বিয়ে করেছেন। পাড়া গাঁয়ে লোকজন নতুন বউ দেখার জন্য ভীড় জমাতো তখন। সাইফুদ্দিন কাকা বউ দেখে এসে, আমার দাদি কে খবর দিয়ে গেলেন ‘চাচি, ওদের বউ এককেবারে দুর্গা ঠাকুরের মত হয়ছি গো, দেখে আসেন গিয়ে।‘ বৃহস্পতিবার কে আমার দাদি বরাবর লক্ষ্মীবার বলে এসেছেন। সংক্রান্তিতে গাঁয়ের সব মুসলমান বাড়িতে দেখতাম পিঠে পরব হচ্ছে। নবান্নে দেখতাম নতুন চালের পদ তৈরি হচ্ছে।
ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে, তথাকথিত ‘নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছেন, বা বখতিয়ার খলজীর সময়ে মুসলমান ধর্ম এই ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তে বঙ্গ দেশে বিস্তার লাভ করেছিল, বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাসে এসব তথ্য পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর বাংলায় সেন রাজবংশের রাজত্বে, বঙ্গদেশে সংস্কৃতের চল ছিলো, বাংলা ভাষা তখন অবহেলিত। কারণ সাধারণ চাষি বা জেলের (ছোটো জাত) ভাষা ছিলো আমার বাংলা। ডক্টর মুহাম্মদ মোহর আলী, ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যাপক (সৌদি আরব), তার লেখা “History of the Muslims of Bengal” এ বর্ণিত আছে মুসলিম রাজা/সম্রাটরা আসার পরেই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি প্রাপ্তি হয়।
যাইহোক, মোদ্দা কথা বাংলায় মুসলমান, ‘হাজার বছর’ ধরে এই বাংলায় বসত করে, বাংলার মাঠে ফসল ফলায়, তাই বাঙ্গালী হিন্দু সংস্কৃতির ছাপ তার জীবন এবং যাপনের মধ্যেও সিঁধিয়েছে। বলা যেতে পারে এ হলো এক ধরনের ‘Imprinting of Culture’। সব বাঙালি মুসলমানের চোখে দুর্গাপূজা কি, তা জানার অবকাশ এবং ইচ্ছে কোনটাই আমার বিশেষ নেই। তবে এটুকু সাদা চোখে দেখতে পাই, বছর ১৫ আগেও, কোনো বিশেষ পুজোর দিনে ঈদ বা মহরমের সমাপতন হলে সতর্ক থাকতে হতো না, ভয়ে এ থাকতে হতো না, আতঙ্কে থাকতে হতো না। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ নিশ্চিন্তেই তাদের উৎসব কাটিয়ে এসেছেন এই বাংলাতেই।
তা বলে আবার এমনটাও নয়, ‘আহা কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। এমন ধারা কোন কালেই মাখমাখ সম্প্রীতি ছিল না, সে কথাও সত্যি। বাড়িতে ‘হিন্দু ধর্মের’ কোনো আত্মীয় এলে আমার ঠাকুমা যেমন একটু ইতসস্ত বোধ করতেন, চিন্তায় পরতেন, কোন বাসনে তাদের খেতে দিলে অতিথির মান রক্ষা করা হবে! আবার কোনো এক মুসলমান আত্মীয়া কে দেখছি, হিন্দু বাড়ির লোক এলে একটু বিরক্তই হতেন। তবে সে বিরক্তি তার পরবর্তী দুই প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালিত/সংক্রামিত হতে আমি দেখিনি। একই ভাবে মুসলমান হয়ে হিন্দু বাড়ির ঠাকুরের সিংহাসনের নকুল দানা খেলে, এক ঠাম্মী কে বলতে শুনেছি ‘আমার কেষ্ট ঠাকুরের খাবার, একটা নক্ষি খেয়ে নিলো গো।‘ মুসলমান বন্ধু হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে কাগজের প্লেটে খায় এমনটাও দেখেছি, কারণ তার ঠাকুমা পছন্দ করেন না ‘মোচোলমানদের’। এতো কিছুর মাঝেও আমার বান্ধবী দেবপ্রিয়া বা রোমানা, আমরা সকলে নিশ্চিন্তে ছিলুম তখনও। এটুকু বিশ্বাস ছিলো, ‘গেরুয়া’ বা ‘সবুজ’ পতাকা উড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আমাদের কল্লা গুলো ঘ্যাছাং ফু করে দেবে না। কার কি ধর্ম, কে কি খায়, কেন খায়, কতটা খায় এই সওয়াল জবাব প্রোপাগান্ডার মত চলত না তখনও।
তবে আজ বাঙালী মুসলমান হয়তো একটু বেশি সাবধানী, একটু বেশি সতর্ক, একটু বেশিই আতঙ্কিত। হয়তো আজ আর, এক গায়ের বাঙালী মুসলমান ছোট্ট মেয়ে এবং তার আম্মু ঘুম থেকে উঠে মহালয়া দেখে না। ধর্মবিশ্বাস এবং মানুষের উৎসবে মেতে ওঠার সঙ্গে ধর্ম খোয়ানোর কোন সোমমধো নেই, একথা আজ আর কোনো পক্ষকেই অতি সহজে বোঝানো যায় না। জটিল তক্কো, আর বিদ্বেষে মুখর হয় ওঠে, চেনা উৎসবের দিনগুলি। দেশের রাজনৈতিক চক্রান্ত ছাড়া আর কাকেই বা দুষবো আমার শৈশবের মহালয়া ছিনিয়ে নেবার জন্য?