পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আমার বন্ধু উমর খালিদ

  • 26 September, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2124 view(s)
  • লিখেছেন : বনজ্যোৎস্না লাহিড়ী
দেশ, বিদেশের নানান প্রান্ত থেকে সংহতি জানিয়ে মেইল আসছে। কে নেই? সালমান রুশদি, নোয়াম চমস্কি থেকে শুরু করে অরুন্ধুতি রায়, পি সাইনাথ, হর্ষ মান্দার সহ অন্যান্যরা পাশে দাঁড়াচ্ছেন। প্রায় ২০০ জন মানুষ উমরের মুক্তির দাবীতে সরব হয়েছেন এবং আগামীদিনে আরও মানুষ উমরের জন্য রাস্তায় হাঁটবেন এটা আমি বিশ্বাস করি। শুধু উমর নয়, ২৮ বছরের গুলফিশা, যিনি গত ৬ মাস ধরে জেলে আছেন , অত্যাচার সহ্য করছেন সবার মুক্তির দাবীতে একদিন রাস্তা মুখর হয়ে উঠবে সেই বিশ্বাস আমি করি, এবং আমি জানি আমার এই বিশ্বাস একদিন নিশ্চিত সত্যি হবে।

মার্চের মাঝামাঝি একদিন সকালে যখন আমার এবং উমর খালিদের ঘুম ভাঙল, বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যর টুইটে, যেখানে উমরের একটা অমরাবতী,মহারাষ্ট্রের ২০ মিনিটের বক্তব্যের থেকে একটা ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে উমরের নামে দোষ চাপানো হল, আমরা সেদিনই জানি সামনে ঝড় আসছে। এবং সেদিনই আমরা জানতাম এটা একটা বড় ঝড় হবে, যেখানে প্রতিটি মানুষ যারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধী, তাঁদের প্রত্যেককে দোষী সাব্যস্ত্ করা হবে। প্রত্যেকটি মানুষকে ওই দিল্লির দাঙ্গায় অভিযুক্ত করা হবে এটা আমরা নিশ্চিত করেই জানতাম। সেই অনুভুতির মধ্যে যেমন উদ্বেগ ছিল, তেমন রাগ ছিল, যেমন আতঙ্ক ছিল তেমন চিন্তাও ছিল যে এরপর কি আসতে চলেছে। তবে ২০১৬ সাল থেকে এই অনুভুতিগুলোর সম্পর্কে আমরা পরিচিত। আমরা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি যে প্রতিদিন আমাদের ঘুম ভাঙতে পারে নিত্যনতুন খবরে, যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করবো। এক একদিন সকালে ঘুম ভাঙবে নিজেদের নাম টুইটারে এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে ‘ট্রেন্ড’ হতে দেখবো, আর ভাববো আবার কি হল রে বাবা? আসলে একটা নিপীড়নকারী সরকারের ক্ষেত্রে এটাই হওয়ার কথা।

আমার এখন ঠিক মনেও নেই কবে থেকে এই অস্বাভাবিকতাটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠল ২০১৬ সাল থেকে। এটা অনেকটা ওই পায়ের পিছনের ফোস্কার মতো, যা সেরেও সারে না। কিছুদিন স্বাভাবিক থাকে তারপর প্রচণ্ড ব্যাথার অনুভুতি। কখনও পচন ধরে যাবে তার থেকে মৃত্যুও হতে পারে, আবার কখনও নিজে থেকে সেরেও যেতে পারে। হয়তো বা এই রোগের সঠিক ওষুধও একদিন আমরা খুঁজেও পাবো।

উমর খালিদের সমস্ত চড়াই উৎরাইতে পাশে থাকা।

উমরের কাছের বন্ধু হওয়ার সুবাদে ওর আঘাত আমাদেরও আঘাত। আমরা ওর ব্যাথাকে অনুভব করতে যেমন পারি, তেমন মাঝে মধ্যে যেমন কিঞ্চিৎ বিরাম পাওয়া যায় বা তারপরেই আবার যে আঘাত আসতে পারে সেটাও বুঝতে পারি। আমি ওর প্রতিটি চড়াই- উৎরাইতে ওর পাশে থেকেছি। আমি জানি কি করে উমর খালিদ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেছে। কিভাবে ওর বিরুদ্ধে চিৎকার করেছে টিভির উপস্থাপকেরা এবং টুইটারের ট্রোলেরা তা আমরা পুরোটা জানি। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডগোলের দিন, রামজস কলেজে যেদিন ছাত্রদের মারা হলো, কিংবা ভীমা কোরেগাওর আগে এলগার পরিষদের মিটিং এবং সম্প্রতি দিল্লির দাঙ্গা প্রত্যেকটিতে কিভাবে উমরের নাম জড়ানো হয়েছে তা আমরা জানি, কিভাবে প্রতিটি ষড়যন্ত্র থেকে ও বেরিয়ে এসেছে তাও আমাদের অজানা নয়। প্রতিবার আমরা যথেষ্ট চাপের সম্মুখীন হয়েছি এবং প্রতিবার আমরা বেরিয়ে এসেছি কিভাবে তা আমরাই জানি।

সেদিনটা ছিল ১৩ই আগস্ট , দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে ‘ভয়ের থেকে মুক্তি’ অনুষ্ঠান। অন্যতম বক্তা উমর খালিদ। বেশ কিছু মাসের বিরতির পর (এর মধ্যে সে তাঁর পিএইচডির কাজ করছিল ) উমর আবার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেবে স্বভাবতই যথেষ্ট উন্মুখ ছিল ও। আমরা চা খেতে গেটের বাইরে এসেছি হঠাৎ একটা বড়সড় চেহারার মানুষ ওর দিকে এগিয়ে এল। আমি প্রথমে ভাবলাম লোকটি বোধহয় উমরের কোনও ভক্ত, এবং ওর সঙ্গে সেলফি নেওয়ার জন্য এগোচ্ছে। কিন্তু না, আমি দেখলাম ওর পকেট থেকে একটা ছোট বন্দুক বার করে উমরের দিকে তাক করেছে। ৬ ফুট লম্বা মানুষটির হাতে যেটা ছিল তা কিন্তু কোনও দেশী বন্দুক নয়, রীতিমত একটি রিভলবার। ট্রিগারে চাপ দিতে যাবে, আমরা কয়েকজন উমর আর লোকটির মাঝখানে ঢুকে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছি। এই ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে লোকটি বুঝতে পেরে গেল যে ও ধরা পড়ে যাবে তাই পালাতে চেস্টা করলো, আর পালানোর সময়ে এলোপাথারি শুন্যে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালালো। হয়তো সেই লোকটির বন্দুক্টি বিভিন্ন টিভির অনুষ্ঠান বা টুইটারে কি করে গাল দিতে হয় তা দেখে উঠলেও পুরোটা শিখতে পারেনি, তাই এবার গুলিটা বেরোয়নি কিন্তু ভবিষ্যতে যে লোকটি উমরকে মারবে না, তা কি বলা যায়?

দিল্লি পুলিশের অন্য চেহারা

যুগ্ম পুলিশ কমিশনার, ওই রিভলভার থেকে বাকি গুলিগুলো বার করতে করতে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি সত্যিই ভাগ্যবান, উমর’। যে দিল্লি পুলিশ আজকে উমরকে গ্রেপ্তার করেছে তাঁদেরও যে একটা মানবিক মুখ আছে সেটা আমরা ২০১৮ সালে দেখেছিলাম। তখন মনে হতো এটাই তো পুলিশের কাজ হওয়ার কথা। যে কোনও নাগরিককে ভরসা দেওয়াই তো পুলিশের কাজ। আমরা যে নিশ্চিন্ততা সেদিন দিল্লি পুলিশের কাছ থেকে পেয়েছিলাম তা আজও মনে আছে। এক পুলিশ অফিসার বোধহয় ছাত্র জীবনে এসএফআই করতেন, তিনি তো উমরকে কমরেড বলেও সমর্থন করতেন। এক একেকজন তো তাঁদের সন্তানদের পড়াশুনা দেখানোর জন্যেও উমরকে বলতেন। কোনও কোনও সময়ে তাঁরা এমনিই ফোন করতেন সাধারণ খোঁজ খবর নিতে। কারণ তাঁরা জানতেন উমর খালিদ একজন শিক্ষিত যুবক যার সঙ্গে কথা বলা যায়। সেদিন ২০১৮সালে যখন লোধী রোডের স্পেশাল সেলের অফিসে গেছিলাম, যেখানে এই মুহুর্তে উমর খালিদকে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে, সেদিন ওখানকার এক পুলিশ অফিসার বলেছিলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে ‘ উমর তোর ওপর যারা হামলা করেছিল, তাঁদেরকে হরিয়ানা, রাজস্থান কোথায় কোথায় না খুঁজেছি। কয়েক রাত আমাদের ঘুম হয়নি’। এখন যদিও পরিস্থিতি অন্যরকম, কিন্তু তাও কি শুধু খারাপ কথাগুলোই মনে রাখা উচিৎ, না কি দিল্লি পুলিশের যে মানবিক মুখ আমরা সেদিন দেখেছিলাম সেটাও বলা জরুরী?

ভাল স্মৃতিকে মনে রাখা আর মানুষের সহায়তার কথাও মনে রাখা

এটাই আসল মন্ত্র। উমর এবং আমরা বারংবার যে আঘাত পেয়েছি এবং তার থেকে যে বেরিয়ে এসেছি তা শুধুমাত্র আমরা ভাল স্মৃতিকে মনে রেখেছি বলেই। আমরা চেষ্টা করেছি যাতে আমাদের প্রতি যাঁদের বিদ্বেষ আছে সেই কথাগুলো যাতে আমরা মনে না রাখি, বরঞ্চ সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের প্রতি নানান মানুষের যে সহমর্মিতা বর্ষিত হয়েছে আমরা সেগুলো মনে রাখার চেষ্টা করেছি। এমনিতে যে ঘৃণা উমরের প্রতি লোকের আছে ( কেন জানি না) সেগুলোর পরিমাণ এতোটাই বেশী যে তার থেকে বরং ছোটছোট ভালবাসার স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচাটাই আসল জীবন হওয়া উচিৎ। আমার কথা বিশ্বাস করুন, এটা কাজ করে। তাই আমি যেকোনো শান্তিকামী গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষজনকে এই কথাটাই বলি যে ভারতের সংবিধানের ওপর ভরসা রাখুন, ভালবাসার ওপর ভরসা রাখুন দেখবেন আপনি ভালো করে বাঁচা শিখে যাবেন। আপনাদের সকলের নিশ্চিত মনে আছে কিভাবে নাগরিকত্ব বিরোধী আন্দোলন রঙিন হয়ে উঠলো, কিভাবে বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষজন এই লড়াইতে যুক্ত হয়ে পড়লেন এবং কিভাবে বিভেদের মাঝে ঐক্যের যে ভারতের চেহারা আমাদের কল্পনায় ছিল তা চোখের সামনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। কিরকম প্রাণবন্ত ছিল ওই দিনগুলো, কিরকম কবিতা তৈরি হতো রোজ, কিরকম ছবি তৈরি হতো রোজ সেই ছবি কি সহজে ভোলা যায়? পুরো লকডাউনের সময়ে যখন একের পর এক নাগরিকত্ব আইন বিরোধী মানুষ গ্রেপ্তার হচ্ছেন তখন আমি আর উমর, আমরা এই কথাগুলোই বলতাম। আমরা জানতাম আমরা দেশ বাঁচানোর ডাক দিয়েছি আমাদের সঙ্গে নিশ্চিত প্রচুর মানুষ আছেন। উমর সারা দেশের নানান প্রান্তে গেছিল ওই আন্দোলনের সময়ে। কোনও ভাষা ওর অপরিচিত, কোথাকার মানুষদের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয় হচ্ছে, সেখানকার খাবার আগে কোনওদিন ও খায়নি, কিন্তু প্রতিটি কোণায় একটাই স্বপ্ন--- দেশটাকে বাঁচাতে হবে, আর সেটাই সবাইকে এই আন্দোলনে বেঁধে রেখেছিল। নতুন করে দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। প্রতি রাতে আমরা দেশের বিভিন্ন কোণায় বিভিন্ন বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছি আর একে অন্যকে ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা করেছি।

বিদায় জানানো

সেদিনটা ছিল ১৩ই সেপ্টেম্বর, আমি ওকে বিদায় জানালাম। ও নিজের আপনভোলা ভঙ্গীতে হেঁটে যেতে লাগল ওর বাড়ির দিকে। ও সবে রাজস্থান থেকে ফিরেছে সেদিন। ওকে সেই লোধী রোডের পুলিশের হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে। আমরা জানতাম আমাদের জন্য দিনের শেষে কি আসতে চলেছে। ওরা সেই সমস্ত কন্ঠস্বর যারা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে উঠেছিল, সেই সমস্ত কন্ঠ যারা নতুন ভারত গড়ার ডাক দিয়েছিল তাঁদের স্তব্ধ করে দিতে চায় তা আমরা জানতাম, উমরেরও তা জানা ছিল। তাহলে কি আমরা নিজে থেকেই চুপ হয়ে যাচ্ছিলাম. একদমই নয়.. নাকি চুপ হয়ে যাবো ভবিষ্যতে ? সেটার উত্তর সময় দেবে।

তাই হচ্ছে ঘটনাচক্রে। দেশ, বিদেশের নানান প্রান্ত থেকে সংহতি জানিয়ে মেইল আসছে। কে নেই? সালমান রুশদি, নোয়াম চমস্কি থেকে শুরু করে অরুন্ধুতি রায়, পি সাইনাথ, হর্ষ মান্দার সহ অন্যান্যরা পাশে দাঁড়াচ্ছেন। প্রায় ২০০ জন মানুষ উমরের মুক্তির দাবীতে সরব হয়েছেন এবং আগামীদিনে আরও মানুষ উমরের জন্য রাস্তায় হাঁটবেন এটা আমি বিশ্বাস করি। শুধু উমর নয়, ২৮ বছরের গুলফিশা, যিনি গত ৬ মাস ধরে জেলে আছেন , অত্যাচার সহ্য করছেন সবার মুক্তির দাবীতে একদিন রাস্তা মুখর হয়ে উঠবে সেই বিশ্বাস আমি করি, এবং আমি জানি আমার এই বিশ্বাস একদিন নিশ্চিত সত্যি হবে।

0 Comments

Post Comment