পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সাধ্যের রথে টান

  • 27 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 443 view(s)
  • লিখেছেন : কৌশিক সেন
ছোটবেলার রথ বলতে সন্ধেবেলায় রথ সাজিয়ে, কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে দোরে দোরে যাওয়া ও পাড়া ঘোরা। পাঠ্যসূচির বাইরে, টিউশন জগতের ঘেরাটোপে জানা - শেখা নয়। আবেগ অত্যন্ত ঘন, উদ্দামতায় এক চিলতে যেন ঘাটতি নেই। ঝটপট রথ কিনে, বিকেলের মধ্যে সমাদরে সাজানো আর পথসাথী জোগাড় করে পথে নেমে পড়া। রথ গেছে কিছুদিন হলো, ছোটবেলার রথের সেই স্মৃতি নিয়ে আখ্যান লিখলেন কৌশিক সেন।

বাঙালি মধ্যবিত্তকে স্বপ্নও দেখতে হয় হিসেব করে কারণ তাকে বার বার ভাবতে হয় নিজের  দেখা স্বপ্নের স্বার্থটুকু রক্ষা করার সামর্থ্য তার আছে কিনা।  যদি খোপের ইচ্ছের সাথে পকেটের খাপ মিলে যায় তাহলে বাঙালি মানুষটিকে দেখে কে! তখন বুক ঠুকে নেচে ওঠা মনে প্রাণে গদগদ বাঙালির-  যেমন ভাবা তেমন কাজ।  গেটেড কমিউনিটির অনেক উপর তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে প্রাতঃকালীন চা পান করতে করতে ছোট স্বপ্ন-ইচ্ছা ধাক্কা মারলো। আজ রথের  সকাল, একটা রথ কিনলে বেশ হয়।  সাজালে হয়, টানলে হয়।  অতঃপর বাজারমুখী।

ছোটবেলায় পড়েছিলাম, নৈহাটির কাঁটাল পাড়ার রথে হারিয়ে যাওয়া বালিকাটি-ই , মাহেশের রথে হারিয়ে যাওয়া রাধারানী। রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তবে বঙ্কিমবাবু হারিয়ে গেলেন। প্রতি বছর রথের মেলার ভিড়ে কোন না কোন মেয়ে  তো হারিয়েই যায় ! তবে রাধারানির হারিয়ে যাওয়া কে বঙ্কিমচন্দ্র অমর করে তোলেন তাঁর  উপন্যাসের মাধ্যমে। শ্রীরামপুরে মাহেশ এর রথকে নিয়ে নানা কিংবদন্তি আছে। হুগলির মাহেশকে "নব নীলাচল" আখ্যা দিয়েছিলেন মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ শ্রী চৈতন্যদেব।

রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। তিনি জানতে পারেন, ছোটোজাত সাঁওতাল বা শবরদের দ্বারা নীলমাধব রূপে বিষ্ণুপুজো হচ্ছে। রাজা ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতিকে সন্ধান করতে বলেন। বিদ্যাপতির উদ্দেশ্য ছিল নীলমাধব কে পুরী তে নিয়ে যাওয়া। ভগবান বিষ্ণুর স্বপ্নাদেশ অনুসারে সমুদ্র থেকে দারুব্রহ্ম প্রাপ্তি হয়, যা কিনা জগন্নাথের রূপ। বিশ্বকর্মা ছুতোর অনন্ত মহারানার ছদ্মবেশে মূর্তি গড়তে আসেন। রানী গুন্ডিচা ২১ দিন অপেক্ষার ধৈর্য্য রাখতে না পেরে, বারণ সত্ত্বেও মূর্তি গড়ার ঘরে উঁকি মারলেন এবং অসম্পূর্ণ মূর্তি দেখে চমকে যান। শর্ত ভাঙার কারণে এরপর থেকে অসমাপ্ত বিগ্রহেরই পূজা করা চলতে থাকে। স্বপ্নে এও আদেশ আসে, যে পরম ভক্ত শবররাজ  বিশ্বাবসুর বংশধরেরাই যেন যুগ যুগ ধরে নীলমাধব এর সেবা করে।  এইভাবেই ব্রাহ্মণ ও শূদ্র জাতির একত্র মেলবদ্ধন ঘটে পুরীতে। তাই জগতের নাথ জগন্নাথ সবার।

ছোটবেলার রথ বলতে সন্ধেবেলায় রথ সাজিয়ে, কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে দোরে দোরে যাওয়া ও পাড়া ঘোরা। পাঠ্যসূচির বাইরে, টিউশন জগতের ঘেরাটোপে জানা - শেখা নয়। আবেগ অত্যন্ত ঘন, উদ্দামতায় এক চিলতে যেন ঘাটতি নেই। ঝটপট রথ কিনে, বিকেলের মধ্যে সমাদরে সাজানো আর পথসাথী জোগাড় করে পথে নেমে পড়া। 'বিবিধ ' টুকিটাকি জিনিসপত্র দিয়ে সকলের ' মিলনে ' রথ সাজানো এক ' মহান ' উপলব্ধি। এ রথের রশিতে টান, যেন জীবনের জয়োগান। হাত ছোঁয়ানো প্রতিটি প্রাণ, নিজের খুশি প্রাপ্তিতে আর একটি পালকের জোগান ।

কাঁচা বাজার সেরে এবার রথ কেনার পালা। আসার পথেই বেশ কয়েক জায়গায় ভালোই পসার সাজানো দেখেছি। আজকাল দরদাম করার সাবেকি কায়দায় নিজের মনমতো দাম বলে রোয়াব দেখিয়ে কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে যদি ভাবতে বসি , দোকানদার ভায়া ঠিক ডেকে বলবে- আচ্ছা দাদা নিয়ে যান, সে দিন চলে গেছে। অনুরোধ এর সুরে দশ বিশ টাকা কমানোর কথা বললে ফল মিলতেও পারে।  দাম পকেট অনুসারে না হলে গুটিগুটি সরে আসাই ভালো।  তবে হাঁ, চাকচিক্য ও বহর কম হলেও , চেহারার মূল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন বজায় থাকে। অর্থাৎ পতাকা উড়ছে কিনা, ঘোড়া ছুটছে কিনা , চাকা কম হলেও রথ গড়াচ্ছে কিনা এইসব। রথ সমেত ত্রিমূর্তি দেবদেবী  কিনে রিকশা চেপে বসলাম , আর কত কি নিলো ফিরিস্তি দিতে দিতে ঘরে ঢুকে পড়লাম।

রথ যাত্রা হলো আর্য জাতির প্রাচীন ধর্মোৎসব। এর অন্য নাম পতিতপাবন যাত্রা , নন্দীঘোষ যাত্রা , নব যাত্রা ইত্যাদি। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয় রথ যাত্রা।  এই সময় , জগন্নাথ - বলরাম - সুভদ্রা রথে চেপে রাজা ইন্দ্রদুম্নর পত্নী , তাঁদের মাসি গুন্ডিচার বাড়ি যান।  পুরী হোক বা শ্রীরামপুরের  মাহেশ বা পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল – সর্বত্র  রথকে ঘিরে উন্মাদনা । এই উপলক্ষে গ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় মেলার আয়োজন করা হয় । বেশির ভাগ মেলাই সোজা রথ থেকে উল্টো রথ পর্য্যন্ত থাকে। কথিত আছে  জব চার্নক  কলকাতা আসার  আগে থেকেই এখানে জাকিয়ে বসতো রথের মেলা, মূলত শিয়ালদহ অঞ্চলে। তৎকালীন অভিজাত পরিবার, শেঠদের সাত তলা রথ টানা হতো শিয়ালদহ থেকে বৈঠকখানা অব্দি আর তার ধারে ধারে নিত্যনতুন দোকান। এছাড়াও কলকাতার পোস্তায় রথের মেলা ছিল বিখ্যাত। এই মেলা গুলিতে  শহরের পুরাতন অধিবাসীরা তাদের গ্রামের সংস্কৃতি বহন করে এনেছিলেন। আদি ঔপনিবেশিক কলকাতায় কবিগান, তরজা, সং, পাঁচালি অনুষ্ঠিত হত। সেখানে  হাজারো লোক ভিড় করত। এই  মিলনে  ধর্ম, জাতি, শ্রেণি বিভাজন থেকে  খানিক মুক্তি। পরবর্তীতে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন ‘ শহরে রথ পার্বণে খুব একটা ঘটা নেই’ তবুও চিৎপুরে রথের মেলার বর্ণনায় তিনি বলছেন মাটির জগন্নাথ, কাঠাল, তালপাতার ভেপু আর শোলার পাখি বিক্রি হবার কথা। সাথে সখের সংকীর্তন ও নেড়া-নেড়িদের ভিড়। এ থেকে শহরের মেলার একটা ছবি পাওয়া যায়। আর গ্রামীণ রথের মেলা সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী  বিস্তারিত লিখে গেছেন। তিনি লিখেছেন রথের মেলায় পাপড়, ফুলুরি, গজা, জিলিপি, লুচি, মিহিদানার সাথে প্রচুর পাঁকা কাঠাল আর আনারস বিক্রি হতো। তাছাড়া মিলতো গাছের চারা, কিঞ্চিৎ বড়লোকদের জন্য গোলাপ, জুঁই, শিউলির চারা, কিংবা গোলাপজাম, পিচ, সবেদা, ফলসার চারা। বর্ষার মরশুমে গাছ ভালো বেড়ে উঠবে, তাই রথের মেলাতে চারার ছড়াছড়ি। রথের মেলায় গাছ বিক্রি হওয়ার রেওয়াজ আজও আছে, এ ব্যাপারে গ্রাম শহরে কোনোও তফাৎ নেই। তবে মেলায় কি বিকিকিনি হবে সেটা অনেকটাই নির্ভর করে প্রয়োজনের ওপর। তাই গ্রাম-শহর বিভেদে মেলার পণ্যের ধরন বদলে যেতে দেখি। কিন্তু রথের মেলার সাথে একাত্ম হয়ে গেছে পাঁপরভাজা আর জিলিপি। এক্ষেত্রে গ্রাম শহরে কোনও ভেদ নেই ।

রথ চলবে রশির টানে। ওড়িয়া ভাষায় বলে 'দৌড়ি' , তাই আমরা বলবো দড়ি। সেই দড়ি তে হাত ছোঁয়ানো কম ভাগ্যের কথা ! আগেকার মতো যদিও এখন অবশ্য প্রাণ বিসর্জন নয় , তবে পুনর্জন্ম না হলেই আর দুঃখ শোক নেই , এ সবার জানা। রথের দড়ি ছুঁয়ে দিতে পারলেই ইহজীবনের পাপমুক্তি ও জন্ম মৃত্যুর শৃঙ্খল মুক্তি অর্থাৎ মোক্ষলাভ। রাজতুল্য সুখ প্রাপ্তি। রোগ , ব্যাধি , দুর্দশা ,দুঃসপ্ন দূর।  কপিল সংহিতায় আছে - ''গুন্ডিচাখ্যাং মহাযাত্রা যে পশ্যন্তি  মুদনিতাঃ / সর্বপাপ বিনির্মুক্তা---ভুবন'।  রথের প্রতি অংশ পবিত্র। সবার আগে চলবে বলরামের রথ। লাল - সবুজ রং , রথের নাম তালধ্বজ  বা হলধ্বজ, পতাকার নাম 'উড়ানি' , দড়ির নাম 'শঙ্খচূড়া', চাকার সংখ্যা চোদ্দ। এরপর সুভদ্রার রথ। লাল - কালো রং , রথ এর নাম পদ্মধ্বজ বা দর্পদলান , পতাকার নাম 'নাদাম্বিকা', দড়ির নাম 'স্বর্ণচূড়া', চাকার সংখ্যা বারো। সবশেষে জগন্নাথের লাল - হলুদ রথ , নাম নন্দীঘোষ , পতাকার নাম 'ত্রৈলোক্যমোহিনী ', দড়ির নাম 'বাসুকি', চাকার সংখ্যা ষোলো। মহাউৎসবের মহা আয়োজন মাত্র।    

দুপুরবেলা ছুটির দিনের ভাতঘুম শিকেয় তুলে , কোলের কাছে রথ টেনে মাটিতেই সাজাতে বসা। ফুল , মালা, ফুলের দোকান থেকেই বিনয়ের পরাকাষ্ঠা সেজে রঙ্গিন ডালপালা জোগাড় , সেগুলো কে গুছিয়ে বেঁধে রথের বাইরের দিকে  সজীব প্রাণদান এর চেষ্টা, এরপর মূর্তি মুখ থুবড়ে পড়ে না যায় তার ব্যবস্থা করা। সন্ধ্যে হলে শাঁখ বাজিয়ে , উলুধ্বনি সহযোগে ধুপ- ধুনো - প্রসাদ দিয়ে মূর্তিপূজা সমাপন। ঘর থেকে রথ বেরোতেই লোকে কি বলবে বা ভাববে তার আড়ষ্ট লজ্জা আর তার সাথেই মধ্যবিত্তের ইচ্ছেপূরণ এর অনাবিল আনন্দ।  যুক্তি বললো কয়েক পা ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া  ভালো। তার আগে দেখে নেওয়া দরকার , দড়ি টানলেই রথ সোজা পথে হাঁটছে কিনা।   লিফটে করে নিচে নামতেই রথের কাছে হাতজোড় ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ালেন নিরাপত্তা কর্মী। এ রথ,  বহরে চমকে ছোট ,তাহলেও ওনার চোখের শ্রদ্ধায় তা লেশমাত্র ধরা পড়লো না।  প্রসাদ থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন না। বিকেল হতেই অনেক উপরতলার ঘর থেকে কচিকাঁচাদের দু চারটি রথ তাদের বাবা মা কে টানতে দেখা গেছিলো বটে। তবে তা খুব সামান্য সময়ের জন্য। আমাদের রথ সন্ধের আঁধারের চাদর মুড়িয়েই বেরোলো।  আরো কয়েক পা রথ টানা। অলৌকিকভাবে , আশাতীতভাবে আধ ঘন্টার পথ চলায় পুরুষ নারী নির্বিশেষে প্রায় সাত - আট জন  নানা বয়সের মানুষ রথ এর কাছে এলেন।  কেউ শুধু দর্শন করলেন , কেউ প্রসাদ খেলেন আর আশীর্বাদ  নিলেন , কেউ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে  প্রণামী দিলেন আর হাসিমুখে দড়ি টানার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিলেন। এক তৃপ্তির হাসি এলো ভেতর থেকে , ছোট্ট স্বপ্ন- ইচ্ছেটার এতো ডালপালা গজাবে , অন্যরকম ভালো লাগা আসবে  , এতটাও ভাবিনি।  

প্রবাসী পত্রিকায় প্রমথনাথ বিশীর 'রথযাত্রা' প্রবন্ধ থেকে   আমরা জেনেছিলাম শুধু গ্রামের মানুষের সাথে বিশ্বভারতীর ছাত্ররা হাত লাগিয়েও চালাঘর থেকে রথ নাড়াতে পারেনি , হাত লাগিয়েছিলেন  ধান-কল থেকে কাজ শেষ করে ঘরমুখী কিছু সাঁওতাল নারী - পুরুষ। দুলে উঠেছিল রথ।  বোঝা গেছিল দৈব বাণী - এ রথ সকলের। দড়ির টান চাই সকল হাতের, মনের বাসনার। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন - " চিরদিনই তো উঁচুর মান রেখেছে নিঁচু মাথা হেট্ করে , উঁচু - নিচুর সাঁকোর উপর দিয়েই তো রথ চলে"। 'কালের যাত্রা' সংকলনের সময়ে তিনি অনুজ শরৎচন্দ্র কে লেখেন , " মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ বন্ধন দেশে দেশে যুগে যুগে প্রসারিত , সেই বন্ধনই   এই রথ টানবার রশি "। রবীন্দ্রনাথ  আরও বলেন, “সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গিয়েছে, তাই চলছে না রথ। এই সম্বন্ধের অসত্য এতকাল যাদের পীড়িত করেছে, অবমানিত করেছে, মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আজ মহাকাল তাদেরই আহ্বান করেছেন তাদের রথের বাহনরূপে। তাদের অসম্মান ঘুচলে তবেই সম্বন্ধের অসাম্য দূর হয়ে রথ সম্মুখের দিকে চলবে।” এখন আমরা কঠিন সময়ের মধ্যে্ দিয়ে চলেছি, যখন ধর্মে ধর্মে হানাহানি, জাত পাতের বিভেদ সেই রকম একটা সময়ে   রথের  রশি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আজও  সমান প্রাসঙ্গিক। তিনি মনে করতেন, অসাম্যই আদতে দেশকে গতিহীন করে। গোটা দেশকে রথ হিসেবে যদি কল্পনা করা যায়, তবে তার যাত্রা রুখে দেয় সেই অসাম্য। আর সেই অসাম্যকে যদি দূর করা যায়, তবেই সুগম হয় রথের পথচলা। অসাম্য তো কেবল জাতের নয়, শ্রেণিরও বটে। ‘সুখদুঃখ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এই বৈষম্যকে খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন। রথের মেলায় একটা বাঁশি কেনার আনন্দকে কী সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করেছেন -  সবার চেয়ে আনন্দময়/ ওই মেয়েটির হাসি--/ এক পয়সায় কিনিছে ও/ তালপাতার এক বাঁশি । মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার আনন্দ যেমন অসীম না পাওয়ার যন্ত্রণা ঠিক ততটাই গভীর - সেটাও তিনি এই কবিতাতেই বলেছেন। রথের মেলায়  একটি ছেলে , যার কাছে মাত্র এক পয়সাও নেই বলে সে একটি রাঙা লাঠি কিনে উঠতে পারেনি ।  তার সেই দুঃখ বোঝাতে কবি লিখছেন - অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারায়/ ভেসে যায় রে দেশ।/ আজকে দিনের দুঃখ যত / নাই রে দুঃখ উহার মতো/। আর সেই একটিমাত্র ছেলের দুঃখেই হাজার লোকের মেলার সব আনন্দ করুণ হয়ে যায়। ‘লিপিকা’র ‘রথযাত্রা’-তেও রাজবাড়ির ঝাটার কাটি কুড়োনি দাসী - রাজার সঙ্গে রথ দেখতে যেতে অস্বীকার করেন। জোরের সঙ্গে রাজার অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে বলতে পারে রাজার পথ আমার পথ নয়। তাঁর বিশ্বাস ঠাকুর রথে করে তাঁর দুয়ারে এসেই তাঁকে দেখা দেবেন। তিনি আসবেন পুষ্পরথে। কবি মানস চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন, ভক্ত ভিড় ঠেলে রথের কাছে পৌঁছতে না পারলেও, রথে চড়ে স্বয়ং ঈশ্বর তার দুয়ারে আসেন। কারণ তাঁর কাছে তো সমাজের এসব বৈষম্যের ঠাঁই নেই। তাই জাত-শ্রেণির ভেদাভেদ তৈরি করে মানুষ যে রথের রশি থেকে অন্য মানুষকে দূরে রাখে, সেই রথের চাকাতেই সব অসাম্য গুঁড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত থাকে। রথের প্রতীকে সে কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের জাত পাতের বিভেদ ভুলে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তবেই থেমে যাওয়া দেশ নামক রথটা আবার চলতে শুরু করবে। সবার মুখে হাঁসি ফুটবে।

রাতে ভোজনোত্তর পর্বে আর একবার আকাশ এর নিচে দাঁড়িয়ে  সন্ধ্যের স্মৃতিচারণা।  হে জগন্নাথ প্রেমানন্দ , এ চমৎকার আনন্দ কি করে হলো !?

0 Comments

Post Comment