পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মিডিয়া: খবরের আড়ালে

  • 11 January, 2025
  • 1 Comment(s)
  • 493 view(s)
  • লিখেছেন : আকাশ চ্যাটার্জ্জী
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এর আগে বহু ছোটবড় সাংবাদিক করেছেন। প্রাণও হারিয়েছেন। কিন্তু, মুকেশ চন্দ্রকারের মৃত্যু সম্ভবত এই সমস্ত সমীকরণের ঊর্ধ্বে। তাঁর মৃত্যুর পরে টুইটারে রানা আইয়ুব লিখলেন ‘আমরা সাংবাদিকদের মনে রাখি মৃত্যুর পরে। অথচ, বেঁচে থাকতে তাঁদের রক্ষা করার চেষ্টা করি না।’ মুকেশকে কি আদৌ রক্ষা করার কথা ছিল?

‘সমস্ত যুদ্ধ জেতার জন্যে হয় না, কিছু যুদ্ধ করতে হয়, এটা জানিয়ে দিতে, যে যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ একটা দাঁড়িয়ে ছিল।’

 

আমরা যারা মোদী জমানায়, সাংবাদিকতা নামক পেশাটায় ঘাড়-মুখ গুঁজে ঢুকে পড়েছি, কিছুটা চেয়ে অথবা না চেয়ে–এবং, প্রলোভন অথবা অভাবের ইঙ্গিত দূরে ঠেলে চেষ্টা করেছি রিপাবলিক টিভি না হয়ে ওঠার--তাঁদের অনেকের কাছেই বেদবাক্য হল রাভিশ কুমারের বলা এই কথাগুলি। ভারতীয় গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভের ভূমিকা প্রতিটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইতে সুস্পষ্ট। কিন্তু, অলিখিত চতুর্থ স্তম্ভটি? যা গণতন্ত্রকে উঁচু থামের আড়াল থেকে পৌঁছে দেয় গৃহস্থের চার দেওয়ালে, তার ক্ষমতার হদিশ রাখে কে? সেই, যে এই অতল সমুদ্রে অন্তত একবার ডুব দিয়েছে।

বাস্তবিকই, মিডিয়ার অনেক ক্ষমতা। মনে পড়ে যায় ২০১১-১২। স্কুলফেরতা আমির চোখ থেমে যাচ্ছে টিভির পর্দায়। পার্লামেন্টে টাকা উড়ছে। একের পর এক দুর্নীতিতে দিশেহারা কংগ্রেস। নীটশের উবারম্যানসের মতোই তখন ভারতের আশা-ভরসা একজনই। নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী। বুম এগিয়ে দিচ্ছে মিডিয়া। কথা বলছেন মোদী। কাট টু ২০২৪। এক নেতা অন্যায়, অত্যাচার, অবহেলা ল, বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা হাতে সারা দেশ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়া এই সামান্য ছাত্রের স্মরণে আসছে জয়প্রকাশ নারায়ণ। অথচ মিডিয়া নেই। নেই বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। বলা ভালো, সর্বশক্তি দিয়ে যাত্রা নিয়ে ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিচ্ছে পেটোয়া মিডিয়া। দশ বছর ধরে যা মোদী সরকারের সবথেকে বড় শক্তি।

কিন্তু, থাক, সেসব অন্য প্রসঙ্গ। পরে হবে কোনওদিন। আজ বরং কথা বলা যাক সাংবাদিকতার ভিতরের দুনিয়াটা নিয়ে। ব্রেকিং-বাইলাইন-বুলেটিন তৈরি হওয়ার দুনিয়া। আজ থেকে বছর আড়াই আগে, যখন বাংলা মিডিয়ার ‘দমবন্ধ’ পরিবেশ থেকে ‘ন্যাশনালের’ গর্বের দিকে এক পা বাড়িয়ে দিল্লির প্লেনে চাপলাম--তখনও কি জানতাম, জীবন বদলে যাবে এত তাড়াতাড়ি। ছোটবেলা থেকে শোনা কথা ‘সাংবাদিকতা পড়ে কেউ সাংবাদিক হয় না।’ এখানে এসে দেখলাম সম্পূর্ণ উলটো। দশজন কলিগ। আমি বাদে ন’জনই সাংবাদিকতার ছাত্র অথবা ছাত্রী। আটজন তার মধ্যে হয় এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজমের আর না হলে জেভিয়ার্স অথবা ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অফ মাস কমিউনিকেশনের। কোথাও পড়ার খরচ লাখ পাঁচেক কোথাও লাখ দশেক। আস্তে আস্তে বুঝতে শেখা ন্যাশনাল মিডিয়ায় ঢুকতে গেলে অ্যাফিলিয়েশন মাস্ট। ডিজিটাল সাংবাদিকতা আমূল বদলে দিয়েছে দুনিয়া। সেখানে পা ফেলতে গেলে কোর্স করে আসা আবশ্যিক। ডিজিটালের আগের দুনিয়াও অবশ্য বিশেষ সুবিধার নয়। সেখানে চলে রেফারেন্সিং। অমুকের দাদা, তমুকের ভাই, তমুকের বন্ধু--এই সব। মোদ্দা কথা খোলনলচে পালটে যাওয়া একটা পৃথিবীতে হয় টাকা নাহলে নেটওয়ার্ক এই দুই ছাড়া বিশেষ গতি নেই।

অবশ্য গতি যে নেই সে তো মুকেশ চন্দ্রকারের পরিণতি দেখেই বোঝা যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এর আগে বহু ছোটবড় সাংবাদিক করেছেন। প্রাণও হারিয়েছেন। কিন্তু, মুকেশ চন্দ্রকারের মৃত্যু সম্ভবত এই সমস্ত সমীকরণের ঊর্ধ্বে। তাঁর মৃত্যুর পরে টুইটারে রানা আইয়ুব লিখলেন ‘আমরা সাংবাদিকদের মনে রাখি মৃত্যুর পরে। অথচ, বেঁচে থাকতে তাঁদের রক্ষা করার চেষ্টা করি না।’ মুকেশকে কি আদৌ রক্ষা করার কথা ছিল? রেফারেন্সিং, পয়েন্ট অফ কনট্যাক্ট, লাখ লাখ টাকার কোর্স, পোস্ট-অফিস হ্যাং-আউট, দামী মদ, ব্র‍্যান্ডেড আউটফিটের এই দুনিয়ায় মুকেশ ছিলেন একজন প্রকৃত অর্থে আউটসাইডার। অধুনা ছত্তিশগড়ের সমস্যা-জর্জরিত এক জেলায় জন্ম তাঁর। বাবা মারা যান অল্পবয়সে। পরে, মাওবাদী-সেনা সংঘাতে জর্জরিত গ্রামে তাঁর পরিবার উচ্ছেদ হয়ে চলে আসে সরকারি শেল্টার ক্যাম্পে। সেখানেই বড় হন মুকেশ। মা অঙ্গনওয়ারি কর্মী। ছেলেকে পড়াশোনা শেষ করার জন্যে দান্তেওয়াড়ার এক স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। টাকা রোজগারের জন্যে বাইকের মেকানিক হিসাবে কাজ করেছেন মুকেশ। পেটের দায়ে মহুয়া বেচেছেন। মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি জোগাড় করতে না পারায়, মা'কে মরতে দেখেছেন।

অথচ, সাংবাদিক হিসাবে এই মুকেশই ছিলেন দিল্লির সাংবাদিকদের গো-টু পার্সন। বস্তার নিয়ে যে বা যাঁরা স্টোরি করতেন, তাঁরা অনেকের কললিস্টেই থাকত মুকেশের নাম। সাংবাদিকেরা বলে থাকেন, তাঁরা খবর বেচে খান। প্রকৃত অর্থেই সেটা করতেন মুকেশ। টাকার বিনিময়ে খবর বিক্রি। ইংরেজি ভাষায় সেই খবর লিখে প্রোমোশন, ইনক্রিমেন্ট, অ্যাওয়ার্ড অথবা নেক্সট বিগ হাউজে চাকরি নিয়ে চলে যেতেন বাকিরা। মুকেশ পড়েছিলেন বস্তারে। রিস্ক নিয়ে। অজস্র ন্যাশনাল হাউজের হয়ে কাজ করার পরেও, 'বস্তার কোরেসপন্ডেন্টের' চাকরি জোটেনি। উলটে এডিটরের টেবিল থেকে রিজেক্টেড হয়েছে একের পর এক স্টোরি। এমনকি মাওবাদীদের হাত থেকে সেনা জওয়ানকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার পরেও নয়। বাধ্য হয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেল খোলেন। সেখানে সাফল্য আসছিল। আর্থিক সাফল্য। সঙ্গে সামান্য নাম। তারপরেই....

মুকেশ চন্দ্রকারকে নিয়ে আসলে আমাদের কথা বলা উচিৎ নয়। অথবা, আমাদের সমস্ত কথা আসলে মুকেশ চন্দ্রকারকে নিয়েই বলা উচিৎ। মুকেশের মৃত্যুর জন্যে কার দরজায় বিচার চাওয়া উচিৎ, তা আমার জানা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি আর্টিকেলে আশুতোষ ভরদ্বাজের লেখা কতগুলো কথা ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। একটি খবরে মুকেশ ছত্তিশগড়ের কয়েকজন বিজেপি নেতার দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকার খবর সামনে নিয়ে আসেন। বিষয়টি নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়। সামান্য ভয় পেয়েছিলেন মুকেশ। ভরদ্বাজকে একটি মেসেজ পাঠিয়ে লিখেছিলেন ‘কিছু হবে না তো?’ আর তার কয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু। এই ভয় আসলে সিস্টেমের উপহার। এই ভয় আসলে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারার অভিশাপ। এই ভয় আসলে যথেষ্ট নেটওয়ার্কিং তৈরি না করতে পারার ফল। কে না জানে, আজকের সংবাদমাধ্যম চলে এই তিনটি জিনিসের উপর। মুকেশ চন্দ্রকারদের উপর নয়।

 

 

1 Comments

Manisha Banerjee

13 January, 2025

জরুরী লেখা। গণতন্ত্রের স্তম্ভটি ধরে রাখার গুরুভার শেষ করে দিল মুকেশকে।‌লড়াইটা কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে।

Post Comment