বাইরে উঠোনে বসে নরম মাটির সাথে ছাই মিশিয়ে এঁটো বাসন মাজছিল আরতি। কয়েকটা পাতিহাঁসের বাচ্চা তি তি করতে করতে এসে মুখ দিয়ে ঘেঁটে দিচ্ছিল জমানো বাসন-কুসনগুলো। মগের থেকে কিছুটা জল নিয়ে হুস্ করে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আরতি বলে, "ওই কুলঙ্গিতেই আছে, দ্যাখ ভাল করে।"
মেঘলা অন্ধকারে মাটির কুলুঙ্গিতে রাখা কুর্নিটা দেখতে পায়নি বিমল। আরতির কথা শুনে আন্দাজে হাতড়াতেই হাতে আসে জিনিসটা। পাওয়া মাত্রই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। চেনা হাতের স্পর্শে কুর্নিটা যেন হেসে উঠে হালকা আলোয়। বিমলও মৃদু হেসে মাথায় ঠেকিয়ে ভরে নেয় থলিতে। তারপর সাইকেল নিতে এগিয়ে যায় চালাঘরের দিকে।
খড়ের চাল ভেদ করে আসা গতরাতের বৃষ্টির দাগ এখনও লেগে আছে সাইকেলের সিটে। হাতের কাছে কাপড় ছেঁড়াটা নিয়ে সিটটা মুছে নেয় বিমল। হ্যান্ডেলে ব্যাগটা ঝুলিয়ে সাইকেলটা বের করে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। উপর দিকে তাকিয়ে দেখে কতখানি বৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে মেঘটা। এখনই কী ঝরে পড়বে আবার?
আরতি মিনমিন করে বলে উঠে, "তুমি কি বেইরাচ্ছ? কাল যে বললে বুবাইয়ের প্রাইভেট মাষ্টারের বেতনটা আজ দিবে। দিয়ে যাও তবে। সবার সামনে মাষ্টার যখন বারবার খুঁজে, ছেলাটারও ত খারাপ লাগে..."
থলির ভিতর কী যেন হাতড়াতে হাতড়াতে বিমল বলে, "দাঁড়া, দু'দিন সবুর কর। বুঝতেই ত পারছু, কত দিন ঘরে বসে আছি। এই ক'দিন হল কাজ চালু হয়েছে। তুই কি জানুস নাই ?"
না, আরতির অজানা কিছুই নয়। জানে বলেই চুপচাপ বিমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিমল কিছু বলছে না দেখে নিজের মতো করে বলতে শুরু করে, "কতবার বলেছি আমাকেও ঝন্নাকাকির সঙে মাঠে কামিন খাটতে যাতে দাও। বাপের ঘরে ত এই কাজ আমি করেছি। গেলে ত দুটা টাকা আসবেক। তার বেলায় তুমার প্রেস্টিজ যত।"
"আমি কি মরে গেছি গো — যে বউটাকে পরের দুয়ারে কামিন খাটতে পাঠাব?" সাইকেলের চেনটাতে নারকেল তেল লাগাতে লাগাতে টেনে টেনে কথাটা বলল বিমল।
আরতি বলে, "তবে ছেলাটার মনে কষ্ট দিচ্ছ কেনে? মাষ্টারের টাকাটা মিটাই দিলেই পার।"
"আচ্ছা লোক ত! গা ছাড়ে পালাই যাচ্ছি কি ? দিব যখন বলেছি তখন ঠিক দিব। অত চাড়ের কী আছে?" ঝনঝনিয়ে উঠে বিমল মিস্ত্রি। চমকে যায় আরতি। কাছাকাছি বাজ পড়লে যেভাবে চমকায়।
" সকাল বেলায় কাজে বেরাচ্ছি। এই সময় মাথাটা খারাপ করিস না।" বলেই রাগে গজগজ করতে করতে সাইকেলটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বিমল। নরম মাটিতে সাইকেলের চাকার লম্বা দুটো দাগ কালশিটের মতো স্পষ্ট ফুটে উঠে উঠোনে। ঠিক যেন খোলা পিঠে জোর করে চাবকে দিয়েছে কেউ। সেই দিকে ছল ছল চোখ নিয়ে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে থাকে আরতি।
(২)
মোড়ের মাথায় সাধনের লটারির দোকান। বিমল এসে দাঁড়াল সেখানে। প্যাকেট থেকে একটা একশো টাকার কড়কড়ে নোট বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল, "দে ভাই, দু'ঘর ভালো দ্যাখে দে দ্যাখি। কাল শালা নাম্বারটা লাগতে লাগতেও লাগল নাই। আজ দ্যাখি ভাগ্য টা কেমন। সকাল সকাল বউয়ের সঙে কথাকাটাকাটি করে ত আসেছি, দ্যাখি কেমন যাত্তা হয়!"
কথাটা শুনে এক গাল হেসে উঠল সাধন। এই তো গত কালই লাখ টাকার দান হয়েছে তার দোকান থেকে। বাউরিপাড়ার মন্টু ড্রাইভার পেয়েছে। গাঁদা ফুলের বাসি মালা এখনও ঝুলে রয়েছে দোকানের সামনে। বড় দান লাগলেই এভাবেই গাঁদা ফুলের মালা ঝুলে। অন্যদের বুকে চিনচিনে ছটফটানি ধারায়। যেমনটা হয়েছে বিমলের। সাধনের রোজকার খদ্দের সে। ঝড় হোক, ঝাপটা হোক, দোকানে এলে একঘর টিকিট কাটবেই। কিন্তু আক্ষেপ একটাই, আজ পর্যন্ত একটাও বড়সড় দান লাগাতে পারেনি। তাবলে দমে যায়নি বিমল। মনের মধ্যে কোথাও যেন বিরাট একটা আশা, একদিন না একদিন বড় দান লাগবেই কপালে। সেদিন আর রোদে পুড়ে, জলে ভিজে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে হবে না তাকে। কুর্নি ধরে ধরে সিমেন্টে হাতের আঙ্গুলগুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রক্ত বেরিয়ে আসে। বড় দান লাগলে আবার নতুন চামড়া গজাবে সেখানে। আরতির পটপটানিও সইতে হবে না আর। ভাবতে ভাবতে কিছুটা সময় নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টিকিটের নম্বরগুলো দেখছিল বিমল। গমুটির সামনের পাটাতনে থরে থরে সাজানো লটারির বাণ্ডিল, কোনোটা আবার গাডার দিয়ে আটকানো। তার থেকেই একটা হাতে তুলে নিয়ে আবার নামিয়ে দিল সেখানেই।
সাধন বলে, "আজ অত কী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছু বল ত? লে ন একঘর যেটা খুশি। কপালের জিনিস, লাগার হলে এমনিতেই লাগবেক।"
"দাঁড়া দাঁড়া, সবুর কর।" মাথা দুলিয়ে বিমল বলে, "তোর দোকানে একদিন না একদিন গেঁদা ফুলের মালা টাঙাবোই রে সাধনা। কথাটা আমার মিলাই লিবি।"
সাধন কিছু না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে হাসতে থাকে। বিমল আর কথা না বাড়িয়ে নিজের পছন্দ মত দু'ঘর লটারি নিয়ে পকেটে ভরে এগিয়ে যায় মোড়ের চা-দোকানের দিকে। সাইকেলটা রেখে যেই না পিছন ফিরেছে, অমনি হঠাৎ মুখের সামনে কেউ যেন "জয় ভোলে শঙ্কর !" বলে চেঁচিয়ে উঠে। থমকে দাঁড়ায় বিমল। দেখে এক হিন্দুস্থানী সাধুবাবা হাসি হাসি মুখ করে সামনে দাঁড়িয়ে। গা জুড়ে গেরুয়া আলখাল্লা। মাথায় লাল পাগড়ি। কপালে হলুদ আর চন্দন লেপা। মাঝখানে সিঁদুরের টিপ। কাঁচাপাকা এক মুখ দাড়ি। চোখে পাওয়ার ওয়ালা চশমা। কাঁধে একটা হলুদ রঙের ছোট্ট ঝোলা। হাতে এসরাজ। বিমল কিছু বলার আগেই পান চিবানো মুখে মৃদু হেসে বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে বলতে শুরু করেন, "বেটা বহত চিন্তা মে হ্যায়! সব ঠিক হো যায়েগা। হামরা শিবজী সব ঠিক কর দেগা।"
কিছুটা যেন থতমত খেয়ে যায় বিমল। বহুদিন এরকম সাধুবাবা-টাধুবাবার দেখা মেলেনি এদিকে। ইনি আবার কোথা থেকে জুটলেন? সাধুবাবা অপেক্ষা না করে বলতে শুরু করলেন, "ঘরমে বিবির সাথে ঝগড়া হুয়া হ্যায় না?"
"আপনি কী করে জানলেন?" ভ্রু কুঁচকে গেল বিমলের।
হো হো করে হেসে উঠলেন সাধুবাবা। তারপর চোখ দুলিয়ে দুলিয়ে গুন গুন করে গান ধরলেন :
"আজাও ভোলে বাবা মেরে মকান পর,
তেরে ডম ডম ডমরু বাজে সারে জাঁহান পর..."
হঠাৎ গান থামিয়ে ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে একটা আংটি বের করে এনে বিমলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, " লে রাখলে। শিবজী কা বরদান হ্যায় ইয়ে।"
বিমল আংটিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, "ইটা পরলে লটারি লাগবেক?"
সাধুবাবা আবারো হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর শান্ত হয়ে বললেন, " দে, লটা দে। তেরা মনমে বিশওয়াস নেহি হ্যায়..."
" না না, বিশ্বাস আছে বইকি, বিশ্বাস আছে।" বলেই আবারো ভালোকরে দেখতে থাকে বিমল। তারপর সাধুবাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "কত লাগবেক বাবা?"
" বরদান খরিদনে কা চিজ হ্যায় কেয়া?" চোখদুটো পাকিয়ে সাধুবাবা বলতে লাগলেন, "ফিরভি আশ্রমকে লিয়ে কুছ লেনা পড়তা হ্যায়। আগর তু আমির আদমি হোতা তো পাঁচ হাজার রুপিয়া সে একভি কম নেহি লেতা। তু গরিব আদমি হ্যায়, ইসিলিয়ে তুঝসে শিবজীকে নাম পর পাঁচশ রুপিয়া লুঙ্গা।"
এই প্রথম নয়, এর আগেও কত কত বুজরুকি জ্যোতিষী, সাধুবাবার পাল্লায় পড়েছে বিমল। লাভের লাভ কিছুই হয়নি । এ আংটিও যে বিরাট কিছু নয়, তা সে ভালো করেই জানে। তবুও মনে হল অনেক তো ঠকেছি, আর একবার না হয় দেখাই যাক। যদি কিছু হয়। এই ভেবে পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার ময়লা নোট বের করে সাধুবাবার দিকে এগিয়ে দিল, "পকেট খালি। এই ছাড়া আমি আর পারব নাই বাবা। শিব ঠাকুরের নামে এতেই সন্তুষ্ট হোন।"
কথাটা শুনে সাধুবাবা কিছুক্ষণ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মুখে প্রসন্নতার হাসি এনে টাকাটা নিয়ে বললেন, " ঠিক হ্যায়, আজ এহিসে সন্তুষ্ট হুঁ। লেকিন বেটা, যব তেরা কাম হো জায়েগা, মে ফির আওঙ্গা। উস দিন জবরদস্ত দক্সিনা লুঙ্গা। যা আপনে কাম পে যা। শিবজী তেরা মনস্কামনা পুরা করে।" বলে টাকাটা ঝোলায় ভরে গুন গুন করে গান ধরে এসরাজ বাজাতে বাজাতে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
এক অজানা আনন্দের ঢেউ যেন আছড়ে পড়ল বিমল বুকের ভেতর। মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা বিশ্বাস যে এই সাধুবাবা নিশ্চিত ভন্ড নয়। আহা কী চেহারা ! যেমন দিব্য তেজ, তেমনি সুন্দর কথা। এ আংটি কাজ দেবেই দেবে।
সাইকেলে চড়ল বিমল। প্যাডেল করতে করতে কত সব অদ্ভুত ভাবনা এসে ঘুরঘুর করছে মাথায়। মরচে পড়া প্যাডেলও যেন ক্যাঁড়েচ ক্যাঁড়েচ শব্দ করে সায় দিয়ে যাচ্ছে সে ভাবনায়। মেঘ তখন ঘনিয়ে এসেছে সামনের রাস্তায়।
(৩)
দুপুর বেলায় এই সবে স্নান সেরে ঘরে ফিরল বিমল। বুবাই তখন খাতায় ছবি আঁকছে এক মনে। ভিজে গামছাটা ছাঁচাকোলের তারে শুকোতে দিয়ে জামা-প্যান্ট ছেড়ে একটা লুঙ্গি পরে বুবাই এর পাশে এসে বসল বিমল। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "আজ প্রাইভেট গেছলি?"
অস্ফুটে "না" বলে ঘাড় নাড়ল বুবাই। বিমল শান্ত স্বরে বলল, "ক'মাসের টাকা পাবেক রে মাষ্টার?"
"দু মাসের।"
"ঠিক আছে। কাল দিয়ে দিব।" বলল বিমল, "তুই উসব কিছু ভাবিস না। তোর মা কুথায় গেছে রে?"
"ঝন্না দিদার সঙ্গে কাজে বেরাইছে।"
কথাটা শুনেই কিছুটা যেন চমকে উঠল বিমল। চোখগুলো বড় বড় হয়ে স্থির গেল নিমিষেই। নাক উঁচিয়ে শ্বাস নিতে লাগল জোরে জোরে। এতক্ষণ ধরে যে হালকা বাতাসটা খড়খড় শব্দে ঘর-পিছনের পুকুর পাড়ে শুকনো তাল পাতায়, খেজুর পাতায় আপন খেয়ালে খেলা করছিল। সেই বাতাস যেন আচমকা ছোট্ট একটা ঘূর্ণি তুলে ধুলোবালি, খড়কুটো উড়িয়ে বিমলদের উঠোন হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বিমলও যেন ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে গেল সে হাওয়ায়। শেষে আর কিছু না বলে ঝড়ের পথ ধরেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ফিরল যখন, আরতিও তখন বাড়ি এসে এই সবে উনোনে হাঁড়ি চাপিয়েছে। দু'জনেই দু'জনের দিকে তাকাল আড়চোখে। লাজুক লাজুক দৃষ্টি নিয়ে মৃদু হাসল আরতি। বিমল কী বলে তা শোনার জন্য উৎসুক হয়ে কান খাড়া করে রইল। কিন্তু বিমল কোনো কথা বলল না। সে শুধু ঘরে ঢুকে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর রান্না হতেই আরতি ডাকতে গেল, " উঠ, ভাত বাড়েছি, খাবে চল।"
"আমার খিদা নাই।" রাগ দেখিয়ে বলল বিমল।
"কেনে, খিদা নাই কেনে? আমিও কাজে গেছি বলে জ্বলন লাগছে?"
"জ্বলন লাগবেক নাই? আমার আর মান-সন্মান বলে কিছু রাখলি?"
"আচ্ছা মরদ ত! ঘরে ভাত নাই। আর ছেলাটার মুখের দিকে ভালে কাজে গেলে পেসটিজে লাগছে। ঝাঁটা মারি অমন পেসটিজের মুখে।"
"বিকলাস না আমাকে। তুই কী বুঝবি ইসবের মর্ম? শালী ছোটলোকের বিটি..."
"মুখ সামলে কথা বল। বাপ টানছ কিসের লাগে?" গর্জে উঠল আরতি। "নিজের মা-টার পরের দুয়ারে কাজ করে করে জীবন গেল। আজ আবার বউটা বেরালে মান-সম্মান!"
আরতির এই এক রোগ। মাথায় একবার বকবকানির ভূত চাপলে সহজে আর থামতে চায় না। কথায় কথায় কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলে তার ঠিক থাকে না। বিমলও এতে কম যায় না কিছু।
দেখেশুনে অস্থির হয়ে উঠে বুবাই। বাবা মায়ের ঝগড়া শুরু হলে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এমন সময় কী করা উচিত খুঁজে না পেয়ে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
কথাকাটাকাটি হতে হতে কী যেন একটা কুরুচিকর কথা বেরিয়ে এলো আরতির মুখে। শুনা মাত্রই নিজেকে আর সামলাতে পারল না বিমল। হাতের কাছে কুর্নিটা ছিল। রাগের বশে সেটাই ছুড়ে দিল আরতির দিকে। পিছনে বসে ছিল বুবাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কুর্নিটা আরতির না লেগে সোজা এসে লাগল বুবাই এর কপালে। "আ... মা-গো..." বলে চিৎকার করে উঠল বুবাই। হাত দিয়ে চেপে ধরল কপালটা। হাত বেয়ে গল গল করে ঝরতে লাগল লাল টকটকে রক্ত। দেখতে দেখতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল বুবাই।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠল আরতি। নির্বাক বিমল।
চিৎকার শুনে ছুটে এলো পাড়া-প্রতিবেশীর লোকজন। ছুটে এসেছিল মন্টু। দেখেশুনে নিজে থেকেই তার ভাড়ায় খাটা ন্যানো গাড়িটা এনে দাঁড় করাল বিমলের দুয়ারে। ওটাতে চাপিয়ে ছুটল হাসপাতালের দিকে।
(৪)
সন্ধ্যা বেলার আকাশ ঠেলে একটি কি দুটি তারা ফুটে উঠছে সবে। এখানে সেখানে জোনাকিরা মেতে উঠছে আলোর খেলায়। ফুরফুরে বাতাস বইছে থেকে থেকে। হাসপাতালের বাইরে স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠছে একে একে। পাখিদের কিচিরমিচিরে ভরে উঠেছে সামনের গাছগুলো। বাড়ি ফেরার আনন্দে মাতোয়ারা ওরা। এত শব্দ যে পাশের জনের কথা অব্দি শোনা যায় না। ওরা হয়তো জানেই না এই যে গাছতলার চাতালগুলোর উপর যারা রোজ এসময় বসে থাকে তাদের কী উদ্বেগ। জানলে হয়তো কন্ঠস্বরে নিশ্চয় সমবেদনা ঝরে পড়ত। কিংবা হয়তো এভাবেই ওরা সমবেদনা জানায়, বোঝে না কেউ। এই যেমন বিমল এখন বুঝতে পারছে না। সে শুধু চাতালের উপর বসে নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রয়েছে দূরে। যেখানে হালকা মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে আকাশ। অস্পষ্ট হতে হতে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে তারাদের দল।
কখন থেকে পকেটে ফোন বাজছে খেয়ালেই নেই। বুক পকেটে হঠাৎ একটা আলোর জ্বলা-নেভা দেখে বুঝতে পারে ফোন এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে পরিচিত নম্বর দেখে রিসিভ করল বিমল, "হ্যালো....হঁ, ভালোই আছে। জ্ঞান ফিরেছে তখনই। ডাক্তাররা সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।....কী?.... হঁ, আরতি ভিতরে আছে। আমি বাইরে আছি।.... না, না, আজ ছাড়বেক নাই। রাতটা এখানেই রাখবেক। কাল সকালে দেখেশুনে ছুটি দিবেক।....কিছু শুনাচ্ছে নাই। ভীষণ কেলের-বেলের শব্দ। রাখ এখন। পরে ফোন করব।"
ফোনটা কেটে আবার পকেটে রাখতে গিয়ে হাত লাগে সকালের লটারিগুলো। বের করে আনে সেগুলো। পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে বিমল। এখনও রেজাল্ট মিলিয়ে দেখা হয়নি। নিজের উপর নিজেরই রাগ হয় খুব। সঙ্গে সঙ্গে মুঠি দিয়ে চেপে ধরে সবকটা। একবার চোখ তুলে রাস্তার দিকে তাকায়। দেখতে পায় একটা পাগল গোছের লোক এখানে সেখানে পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে আগুন জ্বেলে বসেছে। গুটি গুটি পায়ে সেই দিকেই হেঁটে যায় বিমল। হাতের মুঠোয় লটারিগুলো তখনও ধরা। আগুনের কাছে হাত রেখে মুঠি খুলে দিল সে। হুস্ করে পড়ে গেল লটারিগুলো। দাও দাও করে জ্বলে উঠলো নিমিষেই। ভালোবাসলে যেরকম সুন্দর করে হাসে আরতি, তেমনি সুন্দর আগুন। অপলক চোখে তাকিয়ে রইল বিমল। ফুলে ফেঁপে উঠলো কালো ছাই হতে থাকা লটারিগুলো। হো হো করে হেসে উঠলো পাগলটা। বিমলও হাসলো ইষৎ। হাসতে হাসতে মনে পড়ে গেল সাধুবাবার হাসিমাখা মুখ। সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতটা তুলে আনল চোখের কাছে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আংটিটার দিকে। একটা বিভৎস মুখ ভেসে উঠল আংটির মাঝে। কি কুৎসিত! তাকিয়ে থাকা যায় না আর। অথচ কত চেনা সেই মুখ। এই মুখটাই কি সে রোজ দেখে আয়নায়? শিউরে উঠল বিমল। দেখতে দেখতে খুলে ফেললো আংটিটা। কী যেন ভেবে পরে নিল আবার। তারপর আবার টেনে খুলতেই পিছলে গেল হাত থেকে। ছিটকে গিয়ে ঠং করে ঠোক্কর খেল সিমেন্টের প্লেটে ঢাকা ড্রেনটার উপর। শেষমেষ কিছুটা গড়িয়ে গিয়ে সরু ফাটল পথে ঢুকে গেল ড্রেনের ভিতর। দু'পা এগিয়ে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল বিমল। স্পষ্ট অনুভব করল কাঁধে যেন হাত রাখল কেউ। তুলতুলে নরম সে হাত। পিছন ফিরতেই দেখতে পেল সেই সাধুবাবা, হাসি হাসি মুখ করে ঘাড় নেড়ে আশ্বস্ত করেছেন তাকে। কেমন যেন চোখগুলো পিট পিট করে উঠল তার। সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত দিয়ে বার কয়েক কচলে নিল চোখ দুটো। তারপর চোখ খুলে তাকাতেই যেন চমকে উঠল বিমল। সামনে কেউ নেই। সাধুবাবা উধাও। অবাক হয়ে একদিক ওদিক তাকাতে লাগল বিমল। ঠিক তখনই কানের কাছে একটা চেনা কন্ঠস্বর যেন গেয়ে উঠলো গুনগুন করে,
"আজাও ভোলে বাবা মেরে মকান পর,
তেরে ডম ডম ডমরু বাজে সারে যাহান পর..."
একটা জোর নিঃশ্বাস ছেড়ে স্থির হয়ে গেল বিমল। আনমনে ভাসা ভাসা চোখ তুলে উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মেঘ কেটে গেছে কোন সময়। তারায় তারায় আবার ভরে উঠেছে আকাশ। গা টা আবার কেমন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল তার। মনে পড়ল, কাল সকালে ঢালাই আছে পাশের গ্রামে। শক্ত হাতে কুর্নি ধরতে হবে এবার...