সংখ্যাগুরুর ইচ্ছে অনুযায়ী দেশ চলবে, এটাই নাকি আইন হওয়া উচিৎ। বক্তা, আর কেউ নন, দেশের একটি রাজ্যের উচ্চ আদালতের এক বিচারপতি, শেখর কুমার যাদবের। যদিও কথাটা তিনি বিচারপতির আসনে বসে বলেননি, কথাটা তিনি বলেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে। আজকের ভারতবর্ষে যদিও এই সব প্রশ্ন করা এখন বাতুলতা, যে একজন বিচারপতি কী করে এমন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন, কিন্তু তাও আমাদের মতো কিছু মানুষকে এই কথাগুলো বলে যেতেই হবে, কারণ একজন বর্তমান বিচারপতির মুখে যখন সরাসরি সংখ্যাগুরুবাদের প্রচার শোনা যায়, তখন এখনো কিছু প্রশ্ন ওঠে।
বিশদে ব্যখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এদেশের নাম যেহেতু হিন্দুস্তান, এখানে সবাই হিন্দু। এখানে গোরু, গীতা, গঙ্গার পুজো হয়, এই দেশে প্রতিটি শিশুই নাকি রাম। হয়তো হিন্দু নাগরিকদের একটি বড় অংশের কাছে, এই কথাগুলোর কোনও যুক্তি নেই, কিন্তু যাঁরা হিন্দুত্বের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা তো যুক্তির ধার ধারেন না। তাই তাঁদের উদ্দেশ্য করেই এই কথা বলা, তা কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সেই হিন্দুত্বের রাজনীতিকে শুধু হিন্দুত্ববাদ বললে ভুল হবে, সেটাই আসলে সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতি, যার মূল মন্ত্র- হিন্দুদের দেশ তো হিন্দুদের ইচ্ছে অনুসারেই চলা উচিৎ। ২০১৯ সালে পিউ রিসার্চের একটি তথ্য দেখলেই বিষয়টা আরো পরিষ্কার বোঝা যাবে। ঐ সার্ভের সময়ে ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলা হয়েছিল। বেশীরভাগ অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, ভারতীয় হতে গেলে আগে নাকি হিন্দু হতে হবে। সুতরাং, যাঁরা ঐ কথা বলেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন, যে অহিন্দুরা ঠিক ভারতীয় নয়। এটাই সংখ্যাগুরুবাদ। বাস্তবিকই, যখন দেশের সংসদে সংবিধানের ৭৫ বছরের পূর্তি উপলক্ষে, বিতর্ক চলছে, তখন একজন বিচারপতির এই ধরনের বক্তব্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক। তাই প্রিয়ঙ্কা গান্ধী যখন সংসদে তাঁর প্রথম ভাষণে বলেন, নরেন্দ্র মোদী যে সংবিধানের শপথ নেন, তার বহিরঙ্গে সংবিধান থাকলেও, তা আসলে ‘সঙ্ঘ কা বিধান’, যার মধ্যে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের স্থান নেই, সেটাই যে আসলে সংখ্যাগুরুবাদ, তা আর নতুন করে তাই বলে দিতে হয়না।
তাঁর এই বক্তব্যের সমালোচনা যেমন শোনা গেছে, নানান মহল থেকে, তেমনই তাঁর বক্তব্যের সমর্থন করারও মানুষের অভাব পড়বে না এই দেশে তা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সঙ্ঘ পরিবারের একটি শাখা সংগঠন, আর আজকের সময়ে আমাদের দেশে সঙ্ঘ পরিবারই যে দেশের সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রক, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং, বিচারপতি শেখর কুমার যাদবের সমালোচনা সঙ্ঘ পরিবার কিংবা সরকারের তরফ থেকে করা হবে, তা আশা করাই অন্যায়। উল্টে দেশের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখর থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী খোলাখুলি, ঐ বিচারপতিকে সমর্থন করে বিরোধীদের আক্রমণ করেছেন। বলেছেন, এই দেশে নাকি এখন সত্যি কথা বললেই, বিরোধীরা সেই কন্ঠ স্তব্ধ করতে চায়, ঐ বিচারপতিকে নাকি সেই কারণেই ইম্পিচমেন্ট অর্থাৎ তাঁর প্রতি অবিশ্বাস প্রস্তাব আনতে চায়, তাঁকে বিচারপতি পদ থেকে অপসারিত করার দাবি জানায়।
অনেকেই সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতাকে এক করে দেখতে এবং দেখাতে চান, কিন্তু বিষয়টা কি এতোটাই সরল? যখন এই দেশে একজন মুসলমান মানুষকে নামাজ পড়ার জন্য, পুলিশের লাথি খেতে হয়, যখন এই দেশে প্রতিদিন একজন সংখ্যালঘু মুসলমানকে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয়, যখন তাঁর ফ্রিজে কী খাবার আছে, তাঁর টিফিনবাক্সতে কী খাবার আছে, তা খুঁজে দেখা হয়, তখন সেটাই আসলে সংখ্যাগুরুবাদের সাম্প্রদায়িকতা। একটা সময়ে বা বিশেষ করে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে নেহেরু থেকে আম্বেদকর, সকলেই এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। আম্বেদকরের কথা যদি উদ্ধৃত করতে হয়, তাহলে ১৯৪৬ সালে ‘পাকিস্তান অথবা ভারত ভাগ’ লেখায় তিনি নির্দিষ্ট করেই লিখেছিলেন। “If Hindu Raj does become a fact, it will, no doubt, be the greatest calamity for this country.… Hindu Raj must be prevented at any cost,” তিনি যে ঐ সময়েই সংখ্যাগুরুবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
ভারতীয় প্ররিপ্রেক্ষিতে সংখ্যাগুরুবাদ যে হিন্দুদের একচ্ছত্র শাসন, তা সেদিন পরিষ্কার আম্বেদকর এবং নেহেরুরা বুঝতে পেরেছিলেন। আশির দশকের শেষ থেকে আজ অবধি সঙ্ঘ পরিবারের বিজেপির মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা এবং এখন তাঁদের আগ্রাসী মনোভাব এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁদের আক্রমণ, সেই আম্বেদকর এবং নেহেরু সহ অন্যান্যদের সতর্কবাণীকেই আবার মনে করিয়ে দেয়। একদিকে নির্বাচনী গণতন্ত্রে, ‘হিন্দু’ সত্ত্বাকে একজোট করা এবং অন্যদিকে সামাজিকভাবে সেই সত্ত্বাকে আরো অসহিষ্ণু ও সংখ্যালঘুর প্রতি আগ্রাসী করে তোলা, এই দুইয়ের মেলবন্ধন আজ দেখতে পাচ্ছে আমাদের ভারতবর্ষ। সমস্ত স্বশাসিত সংস্থার মাথায়, ধীরে ধীরে সঙ্ঘ পরিবারের মানুষদের বসিয়ে, সেই সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার ফল আজকের এলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি শেখর কুমার যাদব। তিনি কিন্তু শুধু সংখ্যাগুরুর শাসনের কথা বলেননি, তিনি সংখ্যাধিক্যের পেশীর বা ক্ষমতার কথাই বলতে চেয়েছেন। হিন্দু ও মুসলমান শিশুদের তুলনা করতে গিয়ে, তাঁর বক্তব্য আরো ভয়ঙ্কর। হিন্দুরা দয়া ও সহিষ্ণুতা শিখলেও, মুসলমানরা নাকি তা ‘শেখে না’। এবার এই বিচারপতিকে যদি প্রশ্ন করা যায়, রামনবমীর মিছিল থেকে মসজিদের উদ্দেশ্যে, ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি দেওয়া কোন সহিষ্ণুতার লক্ষণ? কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একজন সংখ্যাগুরু যুবক, সংখ্যালঘুর উপাসনাস্থলকে আক্রমণ করেন, তখন কী উত্তর দেবেন তিনি? একজন সংখ্যালঘু মুসলমানকে জোর করে ‘জয় শ্রী রাম’ বলানো কি সহিষ্ণুতা?
এই বক্তব্যের আগেও এই বিচারপতির আরো বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্য ছিল। গরুই একমাত্র প্রাণী, যাঁরা অক্সিজেন ত্যাগ করে নিশ্বাসের সঙ্গে। তাঁর ধর্মান্তকরণ নিয়েও বিতর্কিত মন্তব্য ছিল। শীর্ষ আদালতের কলেজিয়াম, তাঁর সমস্ত বক্তব্যের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলতে চেয়ে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন, তার জন্য অবশ্যই তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য, কিন্তু বিষয়টা তো শুধু একজন ব্যক্তি বিচারকের ব্যক্তিগত মন্তব্য নয়। তাঁকে যাঁরা সমর্থন করছেন, সেই উপরাষ্ট্রপতি কিংবা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কী হবে? তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস দেখাবে শীর্ষ আদালত? সংখ্যাগুরুর মতামত, একটি গণতন্ত্রে নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্ম যাপনের স্বাধীনতা। সংখ্যালঘুর অধিকারকে সুনিশ্চিত না করতে পারলে, সেই দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিরণ রিজিজু, যতই সংসদে দাঁড়িয়ে বলুন, যে ভারতে সংখ্যালঘু মানুষজন ভালো আছেন এবং বিদেশমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী যতই চিৎকার করুন, প্রতিবেশী দেশে ‘হিন্দু’ সংখ্যালঘুদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে, তার কোনও মানে থাকে না। সেখানকার হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিপীড়িত হওয়ার বিরুদ্ধে এই দেশের নানা প্রতিবাদে সঙ্ঘ পরিবারের যে মানুষেরা রোজ সংগঠিত হচ্ছেন, তা দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে, ঐ পাশের দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের থেকেও তাঁরা বেশী উৎসাহী, এই দেশের সংখ্যাগুরুদের এক করতে। সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষাই যদি গণতন্ত্রের ধর্ম হয়, তাহলে ‘সংখ্যাগুরুর ইচ্ছে’র সেখানে কোনও ভাবেই স্থান পেতে পারে কি? সংখ্যাগুরুবাদ তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরস্পরবিরোধী অবস্থান। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, একজন সংখ্যালঘুর কোনও যাপনেরই অধিকার নেই, ইচ্ছেমতো খাওয়া, পরা, ধর্মপালনের অধিকার নেই, সেটাই আসলে সংখ্যাগুরুবাদ। বিচারপতি শেখর যাদব হয়তো কথাটা বলে ফেলেছেন, কিন্তু এই দেশে এখন যা চলছে, তাকে কি সংখ্যাগুরুবাদ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায়?