ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় গ্যাসের দামের ছ্যাঁকায় অগত্যা গৃহিণীরা ফের ধোঁয়ায় ভরা হেঁশেলে ফিরছেন। ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে পুরনো অস্বাস্থ্যকর রান্নাঘরের চেনা পরিবেশে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের মানবিক মুখ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বধূরা। গ্যাসের সিলিন্ডার, ওভেন দূরে সরিয়ে রেখে তাঁদের অনেকেই কাঠ বা শুকনো পাতা জোগাড় করছেন। কেউ কাঠের উনুনে, কেউ কয়লার গুঁড়ো দিয়ে গুল বানিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। খরচের ঠেলায় অনেকেরই ভরসা হয়ে উঠছে ঘুঁটে। গ্রামাঞ্চলে ঘুঁটে পেতে সমস্যা না হলেও শহরবাসীকে বেগ পেতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে তাঁরা কাঠ কয়লার উনুনেই রান্না করছেন। বর্তমানে মফস্সলেও অনেকে জ্বালানি হিসেবে কাঠ জোগাড় করে উনুনে রান্না শুরু করেছেন।
উত্তর পূর্ব ভারত এবং বেশ কিছু বিধানসভার উপনির্বাচন মিটতেই দাম বাড়ল রান্নার গ্যাসের। পকেটে আর আগুন নয়, এবার দাবানলই বলা চলে! সাধারণ মানুষের ওপর আরও ভয়ঙ্কর বোঝা চাপানো হল! ফের একবার, একলাফে ৫০ টাকা বাড়ানো হল ভর্তুকিহীন রান্নার গ্যাসের দাম! ভারতে ফের নতুন ইতিহাস গড়ল এলপিজি’র দাম! ৫০ টাকা বেড়ে কলকাতায় ভর্তুকিহীন ১৪.২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম হল ১১২৯ টাকা। দু'বছর আগে ১ জানুয়ারি ২০২১ সালে রান্নার গ্যাসের(এলপিজি) দাম ছিল ৭২০ টাকা। এদিকে পাল্লা দিয়ে কমেছে ভর্তুকির পরিমাণও। ‘আচ্ছে দিনে’ মধ্যবিত্ত থেকে দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে গ্যাস এখন নাগালের বাইরে। এই ভাবে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মাথায় হাত নিম্ন ও মধ্যবিত্তের।
কোভিডের অভিঘাতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ, কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন অথবা মজুরি পাচ্ছেন না, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সঙ্কটে, তারমধ্যেই অর্থনৈতিক সঙ্কটে ঘি ঢালছে গ্যাসের অগ্নিমূল্য। গোদের উপর বিষফোঁড়া। গত কয়েক মাস ধরে পেট্রোপণ্যের লাগাতার দাম বৃদ্ধিতে ঘুম ছুটেছে মধ্যবিত্তের৷ পেট্রোলের দাম লিটারে একশো টাকা ছাড়িয়েছে৷ পেট্রোলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে ছুটছে ডিজেলও৷ দেশের একাধিক রাজ্যে ডিজেলের দামও লিটারে ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। পেট্রোপণ্যের লাগাতার দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাজারদরে৷ করোনাকালে বাজারে গিয়ে পকেটে টান সাধারণ মানুষের৷ প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছে৷ পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ছে নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জেরে মাসিক বাজারে কাটছাঁট করে চালালেও রান্নার গ্যাসের দামে নাজেহাল আমজনতা। গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে বহু পরিবার সিলিন্ডার কিনতে না পেরে ফের কাঠের জ্বালে রান্নায় ফিরছেন। সর্বত্রই একই ছবি। গ্রামের দিকে মহিলারা অনেক আগে থেকেই কাঠের উনুনে রান্না শুরু করেছেন।
বেশিরভাগ ছোটখাট চা, চপ,রেঁস্তোরা, তেলেভাজার দোকানে রান্নার গ্যাসই ব্যবহার হয়। কিন্তু দাম বাড়ায় সমস্যায় পড়েছেন এই সব ছোট ব্যবসায়ী। অনেকেরই আয় কমেছে। খরচ সামলাতে না পেরে গ্যাস ছেড়ে কাঠের উনুনে রান্না করছেন অনেকে। করোনা ও লকডাউনের ফলে এমনিতেই বেশিরভাগ ব্যবসার হাল খারাপ। তার উপরে গ্যাসের দাম বাড়ায় ছোট ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগেরই অবস্থা সঙ্কটজনক। অনেকের আশঙ্কা, এ ভাবে চললে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। সুবিধাজনক অবস্থায় নেই সেই সব ছোট ব্যবসায়ী, যাঁরা ব্যবসায়িক গ্যাস ব্যবহার করেন।
দু'বেলা গরম ভাত-রুটি তরকারি খাওয়ার অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছেন মুর্শিদাবাদের ডোমকল বাজারের ছোট কাপড়ের দোকানদার সিরাজুল সেখ। সকালের জলখাবার রুটি-তরকারি, লুচি বেগুনভাজার জায়গায় এসেছে মুড়ি, চানাচুর। গ্যাস ছেড়ে উনুনেই আবার ভরসা। আগে মায়েরা ঘুঁটে ও কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেই অবস্থায় ফিরে আসছে। উনুনে এখন একবেলা রান্না করছেন। শহরে গোবর কম, তাই ঘুঁটে তেমন পাওয়া যায় না। তাই গৃহিণীরা অনেকই কাঠের উনুন বানিয়েছেন আবার। সেখানেই রান্না করছেন সকালে। একটা গ্যাস এক দেড় মাসের বেশি যাচ্ছে না। গ্যাসের দাম বেড়েই চলেছে। অত টাকা জোগানোর ক্ষমতা নেই। তাই কাঠ দিয়ে একবেলা রান্না চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
রাস্তার মোড়ে, বাসস্ট্যান্ডে লকডাউনের পর দোকান খুলেছেন ফড়িং, শেখর, মোমিনরা। তাঁরা চপ তৈরির জন্য গ্যাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু গ্যাসের দামের চোটে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। আলুর একটা চপের দাম পাঁচ টাকা। তেলের দাম বেড়েছে, গ্যাসের দাম বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় গ্যাসে চপ ভাজলে ১০ টাকা পিস বিক্রি করতে হবে, খরিদ্দার জুটবে না। অগত্যা কাঠেই ভরসা। ছোট ছোট হোটেল, রেঁস্তোরার মালিকদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ইস্যুতে গ্যাসের দাম কমানো নিয়ে তৎপরতা নেয়নি মোদী সরকার৷ স্যোসাল মিডিয়া থেকে সন্ধ্যায় টিভির পর্দা, চায়ের দোকান থেকে বৈঠকখানা সব জায়গায় একই আলোচনার বিষয়বস্তু – বাংলায় দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে। রাজনৈতিক নেতারা সেজেগুজে সান্ধ্যকালীন টিভি আড্ডায় কার কত গলার তেজ তা প্রদর্শন করতে ব্যস্ত। কিন্তু গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে আম আদমির নাজেহাল অবস্থা, কিন্তু ‘কালিঘাটের কাকু’ কি বলছেন, তা নিয়ে মাতামাতিতে সে খবর এখন ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। নাকি সুকৌশলে আম জনতার নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
২০১৯ সালের মে মাসে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে কেন্দ্র চালু করেছিল প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা। গরীব মানুষের কষ্ট লাঘব করতে মোদী সরকার চালু করেছিল উজ্জ্বলা যোজনা প্রকল্প। বিনা খরচে রান্নার গ্যাসের সংযোগ দিয়ে দেশের গরিব মানুষদের একাংশকে ধোঁয়া, দূষণ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু দু'বছর যেতে না যেতেই উজ্জ্বলা যোজনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। উজ্জ্বলার গ্রাহকরা আগে বছরে চারটি সিলিন্ডারও ব্যবহার করতেন। এখন বেশিরভাগই একটি বা দু'টি নিচ্ছেন। অনেকে আবার একেবারেই সিলিন্ডার নেওয়া বন্ধ করেছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির দাবি, বিশ্ব বাজারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও তার উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়াতেই এই মূল্যবৃদ্ধি। বিরোধীদের বক্তব্য– কখনও এত দামী ছিল না পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস। সরকার পক্ষের নেতা-মন্ত্রীরা অবশ্য বলার চেষ্টা করেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়া আর ডলারের শক্তিবৃদ্ধির ফলেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে –এখানে সরকারের খুব একটা কিছু করণীয় নেই। অথচ বিরোধী আসনে থাকাকালীন জ্বালানির দাম বাড়লে যে নরেন্দ্র মোদী সারা দেশ ঘুরে হইচই শুরু করে দিতেন, আজ তিনি মৌনব্রত ধারণ করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যখন কম ছিল, তখন ভারত সরকার জ্বালানির ওপর শুল্ক বা এক্সাইজ ডিউটি যে দশ-বারো দফা বাড়িয়েছিল, সেটা এখন কেন কমানো হচ্ছে না- সরকার এ প্রশ্নের কোনও জবাব দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের উজ্জ্বলা যোজনা প্রকল্প যে কতটা ফ্লপ, তা এই ছবিগুলোই প্রমাণ দিচ্ছে। উজ্জ্বলা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। দেশের মায়েদের চোখের কষ্টে আর চোখে জল আসে না, প্রধানমন্ত্রীর।