প্রায় এক যুগ আগে এই পশ্চিমবঙ্গে একটা শ্লোগান দেওয়ালে, পত্রিকায় দেখা যেত, মিছিলে শোনা যেত, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। সে দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। ভবিষ্যতের প্রতি অতি মনোযোগী হয়ে ভিত্তি স্থাপকদের অগ্রাহ্য করার বিষময় ফল তৎকালিন শাসক হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। রাজ্যের বর্তমান রাজ্ঞীও কৃষকদের নিয়ে তামাশা করতে ব্যস্ত। নাহলে মৃত কৃষকের পরিবারকে দু লক্ষ টাকা অনুদানের অনুকম্পা প্রদর্শন করা যায় না। একদিকে ৭ বছরের শাসনে কৃষকদের আয় তিন গুণ হয়েছে বলে ঘোষণা অন্যদিকে কৃষকদের দারিদ্র নিয়ে রঙ্গ তামাশা মেগালোম্যানিয়াক শাসকের পক্ষেই করা সম্ভব। যথা সময়ে মৃতকে অনুদানের প্রতিশ্রুতির উত্তরও দেবেন কৃষকেরা। একদিকে রাজ্যে কৃষকের আয় তিন গুণ হওয়ার গল্প অর্থ মন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বিধানসভার অভ্যন্তরে বলছেন, অন্যদিকে আমাদের চৌকিদার প্রধানমন্ত্রী ২০২২ সালের মধ্যে দেশের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার কথা বারম্বার জোর গলায় বলেছেন। আমরা এই পর্যায়ে স্বল্প পরিসরে মোদি সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা খুঁজে দেখব।
২০১৭-১৮ পর্যন্ত মোদি সরকারের চার বছরে ভারতের কৃষি উৎপাদন বা আয় গড়ে বাৎসরিক ২.৫% হারে বেড়েছে (২০১৪-১৫:-০.২২%, ২০১৫-১৬:০.৫৯%, ২০১৬-১৭:৬.২৯%, ২০১৭-১৮:৩.৩%)। ২০১৮-১৯ এর প্রথম তিন চতুর্মাসিকে ওই গড় বার্ষিক বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩.৯৫%। যদি উৎপাদন বা আয় বার্ষিক ৩% হারে বাড়তে থাকে তাহলে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর।যদি ২০১৪-১৫ থেকে শুরু করা যায় ২০৪০ সালে তা ঘটতে পারে। কৃষি ক্ষেত্রটি খালি কৃষকদের নিয়েই গঠিত নয়। সেখানে কৃসি বা গ্রামীণ মজুররাও রয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রামীণ প্রকৃত (অর্থাৎ স্থির মূল্যে) মজুরি বৃদ্ধির হার বার্ষিক ০.৫%। যদি এই বৃদ্ধির হার বজায় থাকে তাহলে ১৫০ বছর বাদে গ্রামীণ মজুরদের আয় দ্বিগুণ হবে। কৃষি পণ্যের দাম ২০১৭ র অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২০১৮র অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে ০.৬৩% হারে কমেছে। সমস্ত পণ্যের দাম যখন বাড়ছে তখন কৃষি পণ্যের দাম কমছে। দেশের কৃষকদের হাল এই সরকারের আমলে কোথায় পৌছচ্ছে তা অনুভব করা যাচ্ছে।২০১৭র এপ্রিল- জুন, ত্রৈমাসিকেও কৃষি পণ্যের দাম কমেছিল, বার্ষিক ১.৩৮% হারে। তবুও পরপর দুটি ত্রৈমাসিকে কৃষি পণ্যের দাম কমা ঘটেনি।
কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনকে টাকার অঙ্কে মাপা হয়, অর্থাৎ উৎপাদন বলতে কৃষিতে মূল্যযোগের পরিমাণকে বোঝায়, যে মূল্যযোগ, উৎপাদিত শস্যের মূল্য থেকে উৎপাদন ব্যয়কে বাদ দিয়ে পরিমাপ করা হয়। তাই কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে উৎপাদিত শস্যের মূল্যের সরারসরি যোগাযোগ আছে। অন্যদিকে, কৃষি পণ্যের মূল্যের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের সরারসরি যোগ আছে। সরকার ন্যুনতম সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি করে সেই সহায়ক মূল্যে শস্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করলে কৃষককে দুর্দশায় পড়তে হয় না ও কম দামে ফসল বিক্রি করতে হয় না। অন্যদিকে সরকার মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চাষীকে কম দাম দিতে চাইলে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য তেমন বাবে বাড়াবে না। ফলে কৃষি পণ্যের মুদ্রাস্ফীতি কম ঘটবে। তার ধারাবাহিকতায় সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি কম হবে। বর্তমান সরকার তেমনটাই নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই কৃষি পণ্যের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য যথোপযুক্ত বাড়ায় নি। চাষী দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। চাষীদের দুর্দশার উপরে ভর করে মুদ্রাস্ফীতিকে কম দেখিয়ে জনসমর্থন চেয়েছে এই সরকার। কেন্দ্রে বিজপি নেতৃত্বাধীন সরকার যখনই এসেছে কৃষি পণ্যের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য তখনই অত্যন্ত শ্লথ গতিতে বেড়েছে। উদাহরণ স্বরূপ ধানের কথাই ধরা যাক। বাজপেয়ি সরকারের ৫ বছরে (১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০৩-০৪)ধানের সংগ্রহ মূল্য বেড়েছে ২৫%, মনমোহন সিং সরকারের প্রথম ৫ বছরে (২০০৩০৪ থেকে ২০০৮-০৯) তা বেড়েছে ৬৪%, দ্বিতীয় ৫ বছরে (২০০৮-০৯ থেকে ২০১৩-১৪) ৪৬%। মোদি সরকারের ৫ বছরে (২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯) অনুরূপ বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ২৫%। যেহেতু, টাকার অঙ্কে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার তলানিতে ঠেকেছে, এবং কৃষি পণ্যের দাম কমছে তাই, কৃষি মজুরদের মজুরিও তেমন বাড়ছে না। তবে তা অন্যান্য গ্রামীণ কাজের মজুরির তুলনায় অধিক হারে বেড়েছে। একদিকে কৃষি পণ্যের দাম তেমন বাড়েনি, অপর দিকে কৃষি মজুরি পণ্যের দামের তুলনায় বেশী বেড়েছে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রটিই সমস্যা সঙ্কুল হয়ে পড়েছে।
0 Comments
Post Comment