কাতারের লুসেইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম সেমিফাইনাল আসলে দুই কিংবদন্তী ‘ম’ নামধারীর লড়াই বা বলা যেতে পারে দুই এলএম১০-এর লড়াই। দুজনেই নিজেদের ফুটবলার কেরিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলছেন। একদিকে আর্জেন্টিনার লায়োনেল মেসি অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়ার লুকা মডরিচ। দুজনের নামের আদ্যক্ষর শুধু এলএমই নয় দুজনেই তাদের নিজ নিজ দলের অধিনায়ক ও ১০ নম্বর জার্সির অধিকারী। ক্রোয়েশিয়ার এলএম১০ অর্থাৎ লুকা মডরিচের বিশ্বকাপ অগ্রগমন থেমে গেল সেমিফাইনালে অন্যদিকে আর্জেন্টিনার বিশ্বখ্যাত এলএম১০ লায়োনেল মেসি দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ ফাইনালে জায়গা করে নিলেন এলবিসেলেস্তে জার্সিতে।
আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনালে প্রথমে কিন্তু আক্রমণের ঝাঁঝ বেশি ছিল ভারতের জাতীয় দলের কোচ ইগর স্টিম্যাকের দেশের খেলোয়াড়দেরই। কিন্তু ক্রমশ আস্তে আস্তে সেই মেসির পায়ের জাদুতেই ম্যাচের কর্তৃত্ব নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় আর্জেন্টিনা। যদিও ম্যাচের ৩৩ মিনিটে আলভারেজের দাক্ষিণ্যে যে পেনাল্টিটা পেল আর্জেন্টিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। ক্রোট গোলরক্ষক লিভাকোভিচ গোল ছোট করার লক্ষ্যে আগুয়ান আলভারেজের সামনে এগিয়ে এসেছিলেন, সেখানেই দুজনের সংঘর্ষ হয়। রেফারি আর্জেন্টিনার স্বপক্ষে পেনাল্টি দিলেও সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। তবে আবারও পেনাল্টিকে গোলে পরিণত করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিতে ভুল করেননি মেসি। আর্জেন্টিনার অগ্রগমন শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রথমার্ধের বাকি সময় একের পর এক আক্রমণ আছড়ে পড়ল ক্রোয়েশিয়ার বক্সে আর তা থেকেই জুলিয়ান আলভারেজের আর্জেন্টিনার হয়ে দ্বিতীয় গোল। এককথায় অসাধারণ এক গোলের সাক্ষী হতে হল। ক্রোয়েশিয়ার পুরো দলটাই তখন সমতা ফেরানোর তাগিদে তখন আর্জেন্টিনার পেনাল্টি বক্সে। একটা দ্রুত প্রতি-আক্রমণে প্রায় মাঝমাঠ থেকে বল ধরে দুরন্ত গতিতে আর প্রবল বিধ্বংসী শক্তিতে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গোল আলভারেজের। এই ম্যাচে মেসির সঙ্গে সঙ্গত দিয়ে দারুণ খেললেন আলভারেজ। দ্বিতীয়ার্ধে বলের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগ সময়েই থাকল ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের পায়ে কিন্তু গোলের রাস্তা তারা তৈরি করতে পারলেন না। ফিনিশিং-এর অভাব ডোবালো ক্রোটদের। লুকা মডরিচ সারা মাঠ জুড়ে খেলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দারুণ মুভও তৈরি করলেন কিন্তু ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপের মডরিচ আর ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের মডরিচের মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই ধরা পড়ল। ডেড-বল সিচুয়েশন থেকেও সেভাবে ফায়দা তুলতে পারলেন না মডরিচ। পেরিসিচসহ ক্রোয়েশিয়ার বাকিরাও সতত চেষ্টা করলেন বটে কিন্তু আর্জেন্টিনার রক্ষণে সেভাবে কাঁপুনি ধরাতে পারলেন না। গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজও সেরকম কোনও বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন না। উল্টোদিকে ম্যাচের ৬৯ মিনিটে ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি বক্সে ছোট জায়গার মধ্যে নিজের পায়ের জাদুতে ক্রোট ডিফেন্সকে ফালাফালা করে দিয়ে মেসি যে বলটা বাড়ালেন সেটাকে নিখুঁত শটে গোলের জালে জড়িয়ে দিয়ে কোপা চ্যাম্পিয়নদের বিশ্বকাপ ফাইনালে ষষ্ঠবারের জন্য পৌছানো নিশ্চিত করলেন জুলিয়ান আলভারেজ। আগের ম্যাচে কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে একাধিক হলুদ কার্ড দেখে কার্ড সমস্যায় অনেক ফুটবলারকেই সেমিফাইনালে পাননি আর্জেন্টিনার কোচ লায়োনেল স্কালোনি কিন্তু মেসির নেতৃত্বে তার দল বেশ কর্তৃত্ব নিয়েই ৩-০ গোলে জিতে ফাইনালে প্রবেশ করল। এই লুসেইল স্টেডিয়ামেই কাতার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে সৌদিক আরবের কাছে ১-২ গোলে হেরে প্রচুর প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছিল স্কালোনি-মেসি সহ গোটা আর্জেন্টিনা দলকে। সেই লুসেইল স্টেডিয়ামেই ৩-০ গোলে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে দ্বাবিংশ ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌছে গেল আর্জেন্টিনা।
এই নিয়ে ষষ্ঠবার ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌছালো আর্জেন্টিনা। আগের পাঁচবার ফাইনালের মধ্যে দুইবার (১৯৭৮, ১৯৮৬) তারা জিতেছে, আর বাকি তিনবার (১৯৩০, ১৯৯০, ২০১৪) ফাইনালে হেরে রানার্স হতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। মজার তথ্য যতবার ফাইনালের আগের ম্যাচে গোল না খেয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জিতে ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা ততবারই তারা জিতেছে। ১৯৭৮ সালে স্বদেশের মাটিতে ফাইনালের আগের ম্যাচে তারা পেরুকে হারিয়েছিল ৬-০ গোলে। এমনকি দ্বিতীয় গ্রুপ লীগে সেবার একটাও গোল খায়নি আর্জেন্টিনা। ১৯৮৬-র সেমিফাইনালে তারা মারাদোনার জোড়া গোলে বেলজিয়ামকে হারিয়েছিল ২-০ ব্যবধানে। এই দুইবারই তারা এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতেছে। অন্যদিকে ১৯৩০-এর প্রথম বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনালে তারা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে ৬ গোল দিলেও তাদের হজম করতে হয়েছিল ১টি গোল। আর ১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপে আর ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠেছিল বিপক্ষকে টাইব্রেকারে পেনাল্টি শুট-আউটে হারিয়ে। এই তিনবারই তারা রানার্স হয়েছে। এবারেও কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কোনও গোল না খেয়ে ৩-০ ব্যবধানে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে উঠল আর্জেন্টিনা। মেসির পূর্বসূরি মারাদোনাও দুটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন, ১৯৮৬-তে চ্যাম্পিয়ন আর ১৯৯০ সালে রানার্স। লায়োনেল মেসি ২০১৪ সালে ব্রাজিলে জার্মানির বিরুদ্ধে নিজের প্রথম ফিফা সিনিয়র বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন এবং রানার্স দলের অংশ হয়েছেন। ১৯৭৯ সালের যুব-বিশ্বকাপ যেমন জিতেছিলেন মারাদোনা তেমনি ২০০৫ সালে জুনিয়র বিশ্বকাপ জিতেছেন মেসি। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ রানার্স হওয়ার পর এবার দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবেন মেসি এবং নিজের ফুটবলার কেরিয়ারের শেষ বিশ্বকাপের ফাইনালে নিজেকে শ্রেষ্ঠ খেলাটাই তুলে ধরবেন তিনি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৮ ডিসেম্বরের ফলাফল যাইহোক না কেন নিজের কেরিয়ারের শেষ বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখলেন মেসি। এবার শুধু তিনি নন, গোটা আর্জেন্টিনা দল অবশ্যই ঝাঁপাবে তাদের এলএম১০-এর জন্য এলবিসেলেস্তে জার্সিতে বিশ্বকাপ জয়ের লক্ষ্যে।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের পর ২০২২-এও একরকম ট্র্যাজিক নায়ক হিসাবেই বিশ্বকাপ এবং নিজের আন্তর্জাতিক ফুটবল কেরিয়ার শেষ করতে চলেছেন ক্রোয়েশিয়ার বিহুযুদ্ধের নায়ক এলএম১০ লুকা মডরিচ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভগ্নপ্রায় যুগোশ্লাভিয়ার এক অখ্যাত গ্রামে ১৯৯১ সালের এক তথ্যচিত্রে ভেড়ার পাল চড়াতে দেখা যাওয়া সেই বছর দশেকের লুকা মডরিচ ২০১৮ আর ২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপে দেশকে অনন্য সম্মান এনে দিলেও চূড়ান্ত সাফল্য তার অধরাই রয়ে গেল। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে প্রথম আবির্ভূত হয় ডাভর সুকেরের ক্রোয়েশিয়া যে দলের সদস্য ছিলেন বর্তমান ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ ইগর স্টিম্যাক। সেযাত্রা আবির্ভাবেই ফুটবল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে তৃতীয় স্থান পেয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। তারপর ২০১৮ সালে রাশিয়াতে তারা এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপের মূলপর্বে তাদের সেরা পারফরম্যান্স করে লুকা মডরিচের নেতৃত্বে রানার্স হয়ে। এবারে আবার ১৭ ডিসেম্বর তারা নামবে তৃতীয় স্থান অধিকারের লড়াই যা লুকা মডরিচের ফাইনাল ফ্রনটিয়ার। ঠিক একদিন পরেই বিশ্বকাপ জয়ের লক্ষ্যে শেষ ফুটবল যুদ্ধে নামবেন লায়োনেল মেসি। এখন দুই এলএম১০ তাদের দলের নিজ নিজ লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ হিসাবে কোন দেশকে পাবেন তা নির্ধারিত হবে কাতার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে যেখানে যুযুধান লড়াইয়ে নামবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তকমা ধরে রাখার লড়াইয়ে থাকা ফ্রান্স এবং কাতার বিশ্বকাপে স্বপ্নের দৌড়ে এগিয়ে চলা মরক্কো। এখনও পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে ইতালি (১৯৩৪ এবং ১৯৩৮) ও ব্রাজিল (১৯৫৮ এবং ১৯৬২) পরপর দু’বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে। সেই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে মরক্কোর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হবে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স। তবে এসবের মধ্যে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে পেনাল্টিতে গোল করার সাথে সাথেই পাঁচটি বিশ্বকাপ মিলিয়ে মোট ১১টি গোল করে বাতিস্তুতার করা ১০ গোলের রেকর্ড ভেঙে আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড গড়ে ফেললেন লায়োনেল মেসি।