রাতের খাবারে শুকনো রুটি ঝোলা গুড়। আর দুধ। কলা রয়েছে দুটো। ভালো করে বুঝে নিলাম আজ এখন আর জল পাওয়া যাবে না। রেশনিং শুরু হয়েছে। সকালে, দুপুরে আর বিকেলে ঠিক আধঘন্টা জল থাকবে, তার মধ্যেই প্রয়োজন মিটিয়ে নেওয়া। বিকেলে ভুলে গেছি, দুপুরেও আজ কিছু মনে ছিল না। সকালে যতটা জল ভরে রেখেছিলাম, তার মধ্যে খাবার জলের সঞ্চয় ফুরিয়েছে। বাথরুমের ড্রামে ভর্তি জল নিয়েএকটা গোটা রাত কাটানো...। একটাই তো রাত।
লেখার টেবিলটাই আমার খাবার টেবিল।চারদিকে স্তূপাকৃতি বইপত্র। এক কোণে কোনওরকমে বসে খেয়ে নিই। উচ্ছিষ্ট পাত্র পড়ে থাকে সেখানেই। কিছু প্রাণী ঘুরেফিরে বেড়ায়। একটি আরশোলা আসে। কিছু পিঁপড়ে। কয়েকটি মাছি। ওদের আসা-যাওয়া আমি মন দিয়ে দেখি। ওরা নিঃশব্দে আসে। শুঁড় দিয়ে, অ্যান্টেনা দিয়ে, পা দিয়ে, সেনসরি কোষ দিয়ে বুঝে নেয় চারপাশ। ওরা শুঁকতে থাকে। তারপর ওরা চেটে নেয়। গুঁড়ো করে মুখে বয়ে নিয়ে যায়। ঘুরে বেড়ায় খাবারকণার ওপরেই। এক সময় পাত্র পরিষ্কার। কিছু নেই কোথাও। আরও একটু রাখলে ভালো হত কী? আমি ভাবি, কিন্তু রাখি না। নিজের ভাগগুছিয়ে চেটেপুটে সাবাড় করে উদবৃত্তটুকু থাকে ওদের জন্য।
ট্রান্সফর্মার বিকল হওয়ায় গোটা অঞ্চল জুড়ে লোডশেডিং চলে মাঝেমধ্যেই, সেই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে গলির মধ্যে বসে আছি আমার পৈতৃক বাড়িতে। আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর আলো কখনও ঢোকে না এখানে। যেদিন অনেকটা রোদ এসে পড়ে বাইরের চাতালে, যেদিন চারদিক ঝকঝকে, যেদিন চলে আসে ফিরিওলা, তাদের হাঁকডাক চলে, ‘যা নেবেন, তা-ই পনেরো টাকা’, সেদিন আমি জল ভরে রাখি ড্রামে বালতিতে। এমনকী মগেও। টেবিলের ওপরে জগ জলে টইটম্বুর, খাটের পাশ থেকে গড়িয়ে নিচে অন্ধকার আড়ালে চলে যাওয়া বোতলগুলোও হাতের নাগালে চলে আসে কেমন চটপট, সেদিন আর রোজকার মতো চাল-ডাল-আলু যেখানে যা আছে তা-ই দিয়ে প্রেশার কুকারে সেদ্ধ বসাই না কিছু। একটু গুছিয়ে রাঁধি। যেদিন আলো আসে।
আলো এলে আমার সহেলির কথা মনে পড়ে।
আলো প্রিয়। কিন্তু অন্ধকারও। এই যে চারিদিকে আলো জ্বলে, মঞ্চে, সভায়, সেমিনারে, বক্তৃতায়, মিটিঙে-- এইসব আলো জ্বলে থাকা তৃপ্তি দেয়। ফিরে এসে নিজস্ব পরিসরে অন্ধকার ঝুপসিতে ঝিম ধরে বসে থাকা আমার বেশি ভালো লাগে।
সহেলি চেঁচামেচি করত। পর্দা টেনে সরিয়ে দিত জানলার। গজগজ করত। উফ, কী করে এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে থাকো? ভূত না কি তুমি? আমাদের পুরনো আমলের বড় বড় জানলা। কোনও কোনও জানলা শুরু হয়েছে মেঝে থেকে। তাতে কাঠের পাল্লা। খড়খড়ি দেওয়া। তার ফাঁক দিয়ে তিরতির করে আলোর টুকরো এসে নেতিয়ে পড়ে ঘরের মেঝেতে, পাপোশে, ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটিতে। আমি আলোর ফালিগুলোকে দেখে চট করে চোখ বুজে ফেলতাম। ওরা নড়েচড়ে, কথা বলে। ওদের ফিসফাস শুনে ভালো লাগে না। সকাল হতে না হতেই এত আলো কেন খেলা করে বেড়াবে আমার শরীরের আশেপাশে, আমার চোখের নাগালে।
চেঁচিয়ে উঠি।
জানলাটা বন্ধ করো না।
সহেলি ঝাঁঝিয়ে ওঠে। এই সাতসকালে সব খুললাম। এত বদ্ধ গুমোট হয়ে থাকে... ঘরের মধ্যে একটুও হাওয়া চলাচল করে না। অসহ্য।
আমি এক ধাপ গলা নামিয়ে বলি, আচ্ছা তাহলে পর্দাগুলো সরিয়ে দাও। চোখে আলো লাগে।
সকালের আলোতে এত অ্যালার্জি কেন তোমার? এই বিদঘুটে ঘরবাড়িতে এমনিই আলো-হাওয়া ঢোকে না... সকাল থেকে শুরু হল তোমার যত বায়নাক্কা।
আমি বোঝাতে পারি না, আলো আমার ভাবনাগুলোকে ঝলসে দেয়। আমি কেমন ফাঁকা হয়ে যাই। কে যেন একটা স্ট্র দিয়ে চোঁ করে শুষে নিচ্ছে আমার মেধাকণিকা মিশে থাকা তরল মস্তিষ্করস। ছটফট করে উঠি আমি। ফুরিয়ে যাব, ফুরিয়ে যাবে সব, আরও কত কী দেওয়া বাকি। ফুরিয়ে গেলে আর ফেরত পাব কী করে?
মাথার মধ্যে বুনতে থাকি একের পর এক শব্দ অক্ষর বর্ণমালা। একজন শ্রমিকের মতো কুড়িয়ে আনি যত জুড়ে রাখা আলগা হয়ে থাকা কথাসমূহ। এগুলো দিয়েই গাঁথা হবে এবার কোনও গাথাসপ্তশতী। লেখা হবে কোনও উদাসীন নিশিকাব্য, সপ্রতিভ পদাবলী। প্রশংসা ছাড়াও টুপটাপ খসে পড়বে স্বীকৃতি।
সহেলির চেঁচামেচিতে এক-একদিন হারিয়ে যেত সংলগ্ন অর্থবোধক পয়ার ছন্দ।
উফ, একটু চুপ করো না। শান্তিতে একটু লিখতেও দেবে না?
সহেলি দাঁতে দাঁত চেপে বলত, ওইসব ছাইপাঁশ লিখে কী হয় শুনি?
সে তুমি বুঝবে না। আমি বলি, মনে মনে।
আজকাল সহেলি থাকে না আমার সঙ্গে। ও একজন স্বাভাবিক স্বামী চায়। যে বাইরে খেতে নিয়ে যাবে, উইক এন্ড আউটিং, সিনেমা-থিয়েটার গান-গল্প শাড়ি-গয়না নিয়ে একটা চাওয়া-পাওয়া। আমার সঙ্গে ওর আর পোষাচ্ছে না। আমার চারদিকে খসখসে সাদা কাগজ, ছড়িয়ে থাকা অক্ষর, আর ওর মতে, আমার খুব নীরস শুকনো জীবন। ও যেদিন চলে যায়, তার পরের দিন থেকে অনেক জানলা আর খোলা হয় না। শুধু যেদিন দুপুরে অনেকটা রোদ দেখতে ইচ্ছে করে... এই যেমন আজকের মতো।
সহেলি চলে যাবার সময় ওর মুখটা আমি দেখিনি। রাগী না খুশিমুখ। কিন্তু এমনি চারদিকে আজকাল খুব খুশি খুশি থাকে সকলে। আমি লক্ষ্য করেছি। বারান্দার রেলিঙে বসে থাকে একটা কুচকুচে কালো কাক। ঠাকুমা দেখলে হুশ হুশ করে তাড়াত। অপয়া, অলক্ষুণে। আমার খারাপ লাগে না। ওকে বেশ খুশি লাগে। একটা বিস্কুট খেতে দিয়ে ওর চোখে আমি কৃতজ্ঞতা দেখেছি। অথচ কাল একটি তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রশংসা করলাম। তার চোখে স্পষ্ট অবজ্ঞা। সেই অবজ্ঞা দেখিয়ে সে দিব্যি খুশি হয়ে চলে গেল। এর আগেও দু’একজন প্রবীণ তাদের উদাসীনতা দিয়ে নিজেদের আনন্দ আড়াল করেননি। বেশ আনন্দিত মুখে বসেছিলেন। অথচ নিরাসক্ত। কিছু এসে যায় না অন্যের সাফল্যে। এরা আসলে হিংসুটে। নিজেদের প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির ভাঁড়ার ঘেঁটে আনন্দ পান। দুঃখবিলাসী এরা। অথচ খুশি খুশি ভাব। পিছনের উঠোনে পাঁচিলে বসে রোদ পোয়ানো বেড়ালটার মতো। উচ্ছিষ্ট মাছের কাঁটার লোভে চুপটি করে বসে থাকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার ইশারা করার অপেক্ষা। হালকা চালে লাফিয়ে পড়বে নির্ধারিত খাবারের লক্ষ্যে। শিকারী সত্তা তার জিনগত, কিন্তু সে অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখে চমৎকার। থাবার আড়ালে ধারালো নখ যেমন। যারা পুরস্কারের মঞ্চের আলো নিভে গেলে গুটি গুটি পায়ে পিছনদিকে সরে যায় অতর্কিতে দাঁত নখ দিয়ে আক্রমণ করবে বলে, কিংবা চটুল সুরে অশালীন অপভাষা বিনিময় করে, তাদের মুখেও আমি অমলিন হাসি দেখেছি। ওই বেড়ালটা যেমন গোঁফ চেটে নির্বিবাদে উঠে পড়ে পাঁচিলের ওপরে, দুলে দুলে হাঁটে, পিছন ফিরে কৃতজ্ঞতা ফেরত না দিয়ে ওই খাবারটুকু প্রাপ্য জেনে এগিয়ে যায়, আবার পরদিন আসে আর একইভাবে চেটে খায় ছড়িয়ে দেওয়া খাবার।
আমি পুরস্কার নিয়ে ঘরে ফিরি। ওই বেড়ালটার মতো গর্বিত আমি। অনেক পাঁচিল টপকে এসব একের পর এক অর্জন আমাকে তৃপ্তি দেয়। আমাকে আরও অনেক উঁচুতে পৌঁছতে হবে। সিঁড়ির ধাপগুলো ধূসর, ওঠার পথটা অন্ধকার। ফোন করে জনে জনে বলতে ইচ্ছে হয়, এই দেখো, এটা আমার। ফোন খুলে দেখি তালিকা থেকে অজান্তে মুছে গেছে কত নাম। কত নাম আর খুঁজে পাই না। কত নাম মনে পড়ে না। যারা আছে, তাদের মধ্যে কেউ ফোন ধরে না, কেউ কেটে দেয়। কেউ নেটওয়ার্ক পরিষেবা সীমার বাইরে। পৃথিবীর সীমানার বাইরেও চলে গেছে কেউ কেউ। নামগুলো রয়ে গেছে একইভাবে। আঙুল বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, সত্যিই কি নেই! আদৌ ছিল কী কোথাও?
পর পর সাজানো রয়েছে স্মারক। ধুলো পড়েছে কয়েকটাতে। পুরনোগুলোতে বেশি ধুলো। একটা আলমারি ভর্তি হয়ে এখন আলমারির মাথায়। হাসিমুখ উজ্জ্বল ছবি কিছু টাঙানো, কিছু পড়ে আছে এদিক-সেদিক। নতুন লেখার পাশে শুয়ে থাকে অনেকদিনের পুরনো বই। যে বই খুলে শব্দ চিনতে পারি না আজকাল। আমারই লেখা? কবে লিখেছিলাম এইসব সরল আত্মকথন? এভাবে কেউ মেলে দেয় নিজেকে! ছিঃ। কী বোকা ছিলাম আমি।
জল নেই। রাতের খাওয়া শেষ। গলা শুকিয়ে এলে মীটসেফে রাখা হুইস্কির বোতল ভরসা।
ভরসা নিয়েই গ্লাস ভর্তি করে টেবিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাই। একদিকে খাওয়া। অন্যদিকে বসে লেখা।
কত কী বাকি। গুছিয়ে বসতে হবে এবার। অথচ বুকের পাশ থেকে একটা ব্যথা বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে বাঁ কাঁধে। বাঁদিকের হাতটা অবশ। এই ব্যথাটা আমি চিনি না। আমি স্বীকৃতি না পাওয়ার ব্যথা চিনি। প্রায়ই হয়। কেন যেন একটু বেশি অন্ধকার নেমে আসে চোখে। আমি হাতড়ে হাতড়ে দেখি সব ঠিকঠাক সাজানো আছে কী না। দেওয়ালে ঝোলানো, আলমারিতে জমানো সব কিছুঝাপসা হয়ে আসার আগেই গুছিয়ে ফেলতে হবে আরেকটা ধাপ বেয়ে ওপরে ওঠার পথ। মসৃণ কিছুই নয়। বড় অগোছালো, এলোমেলো।
কেউ আসবে না? কেউ খুলে দেবে না বন্ধ দরজাটা? নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলে ডাকতে পারব না কাউকে? জল খেতে ইচ্ছে করলে? ঝুপ করে একটা শব্দ হল কোথাও। পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নামার শব্দ। সেই বেড়ালটাই বোধহয়। একমাত্র ওই পারে দরজা খুলে দিতে। আলো আর হাওয়ার জন্য এগোতে গিয়ে দেখি একটা শরীর শুধু পড়ে আছে। চারদিক বন্ধ। বেশ জানি আরশোলারা পিঁপড়েগুলো উঁকি দিয়ে দেখছে সব।