গাফফার নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে ছিল। বেটা আক্মল এসে বলল, বাপু- তুমাকে ছোটচাচা ডাকছে।
গাফফার জিগ্যেস করল, কেনে?
কুরবানির গোস্তের ভাগা দিবা কিনা জানতে চাহিছে।
গাফফার বিছানায় শুয়েই দেওয়াল ঘড়ি দেখে। সকাল সাড়ে ন’টা বাজছে। আর একটু পরে সে বেরোবে তার স্কুলে। স্কুল বলতে মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র। সংক্ষেপে এম. এস. কে.। সেটা অবস্থিত পিপলাসরাই গ্রামে। সেখানকার শিক্ষা সম্প্রসারক সে। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা পড়ানো তার কাজ। তাহলে ঘর ছেড়ে একবারে বেরোলে ক্ষতি কী! ভায়ের সঙ্গে কথা বলে স্কুল রওনা দেবে। এমনটা চিন্তা করে সে জামাকাপড় পরতে শুরু করে।
ওই সময় বউ সালেহা ঘরে প্রয়োজনীয় কিছু নিতে এসে স্বামীকে জামাকাপড় পরতে দেখে জিগ্যেস করে, এত জলদি আবার কুন্ঠে চললা তুমি?
ইস্কুলে।
খাবা না?
না।
কেনে?
এমনি।
কেঁচো খুঁড়তে অভাবের সাপ বেরিয়ে না পড়ে সেই ভয়ে বউয়ের সঙ্গে এর থেকে বেশি কথা বাড়ায় না গাফফার, ঘর ছেড়ে নিজেই সটান বেরিয়ে যায় বাড়ির বাইরে।
বাইরে বাড়ির পাশেই ছোটভায়ের সাবিরের বিশাল মুদির দোকান। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই ভাই তাকে জিগ্যেস করে, কুরবানির কী করলি?
গাফফার বলল, কিছুই না।
কুরবানি দিবি না নাকি?
না।
কেনে?
টাকা নাই।
সাবির আর কিছু জানতে চায় না। কে জানে শেষপর্যন্ত আবার যদি বড়ভায়ের কুরবানির গোস্তের ভাগের টাকাও তাকেই দিতে হয়! গেল ঈদে ফেতরার টাকা দিতে হয়েছিল। জনপিছু পঞ্চাশ টাকা হিসাবে বড়ভাই, ভাবী আর ভাতিজার দেড়শো টাকা। সঙ্গে মোলবির মাহিনা বাবদ আরও সাড়ে তিনশো। মোট পাঁচশো টাকা। একেবারে নগদ।
খরিদ্দারের ভিড়ে কে একজন হঠাৎ বলে উঠল, কী বুলছো হে গাফফার? মাস্টারি করছো তাও বুলছো টাকা নাই! কেহু বিশ্বাস করবে তুমার কথা?
গাফফার দেখে, পাশের গাঁয়ের আরিফকে। মজ্জাতপুর প্রাইমারী ও লস্করপুর হাইস্কুলে একসঙ্গে পড়াশুনা করেছিল। প্রথম শ্রেণী থেকে একেবারে মাধ্যমিক পর্যন্ত। তারপর নিজে জঙ্গিপুর কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হলেও আরিফ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করে আর পড়াশুনা করেনি। বাজারে বিশ্বনাথ ডাক্তারের কাছে কিছুদিন কম্পাউন্ডগিরি শিখে গ্রামে এখন নিজেই ডাক্তার সেজে বসেছে। সঙ্গে এল. আই. সি-র এজেন্টগিরিও চলছে। তার ওপর বউ আবার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। আর সে নিজে গ্রাজুয়েট হলেও কপাল জোরে বয়স পেরিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক হয়েছে। তাও পিপলা গ্রামের মানুষের দয়ায়।
যদিও আরিফকে কোনও উত্তর করতে পারে না গাফফার। সত্যিই যে সে মাস্টারি করে। লোকে তাকে মাস্টার বলেই জানে। সকাল দশটায় বেরিয়ে বাড়ি ফেরে সেই বিকেল সাড়ে তিনটায়।
যদিও লোকে মাস্টার বলতে যা বোঝে, আসলে কিন্তু সে তেমনটা নয়। কাগজে কলমে সে হচ্ছে শিক্ষা সম্প্রসারক। তার বেতন, না বেতন নয়- সাম্মানিক, মাসে আট হাজার পাঁচশো পাঁচ টাকা। তার মধ্যে সরকার আবার নব্বই টাকা বৃত্তি কর কেটে নেয়। মুখলেশুরচাচা কি আর সাধেই বলে, ‘অনারেরিয়াম লয় বাপ- বুলবা অনাহারিয়াম। নিজে না বাঁচলেও সম্মান বাঁচবে।’
আরিফকে কিছু বলে না গাফফার। বললেও তার অবস্থানটা ঠিক বুঝবে না আরিফ।
কিন্তু আরিফ তাকে ছাড়বে কেন? চোখের সামনে সে দেখছে গাঁ-ঘরের মাস্টারদের। চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতে বিয়ে, গাড়ি, বাড়ি। তাহলে গাফফারমাস্টারের অবস্থা এরকম হবে কেন? তাই সে আবার জিগ্যেস করে, কী হইল- কিছু বুলছো না যে গাফফার?
শেষপর্যন্ত মুখ খুলতেই হয় গাফফারকে, কী আর বুলবো ভাই! তুমরা হামাকে যা ভাবো হামি তা লয় খো। মাস্টারদের মুতোন কাজ করি ঠিকই কিন্তু অরঘের মুতোন বেতন পাই না হামি।
বুল্লেই হল! লস্করপুরের সানাউল্লাও তো তুমার মুতোন মাস্টার! চুঁয়াপুকুর এম. এস. কে-তে পঢ়ায়। সে তাহলে গাড়ি-বাড়ি করছে কী করে?
গাফফার সানাউল্লাকে ভাল করে চেনে। হ্যাঁ, সানাউল্লা তার মতোই মাস্টার। কিন্তু চুঁয়াপুকুর এম. এস. কে-তে পড়ানোর পাশাপাশি মেলা রকম হান্দাফান্দা আছে সানাউল্লার। বইয়ের ব্যবসা করে। সঙ্গে এল. আই. সি-র এজেন্টগিরি। তার ওপর নিকা পড়ানো থেকে জলসায় বক্তব্য রাখার মতো ব্যাপারগুলো তো আছেই। দুয়া-তাবিজের কারবারও করে। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, আজকাল নাকি হেরোয়িনের কারবারে টাকাও খাটাচ্ছে!
কিন্তু এসব কথা গাফফার আরিফকে বলতে পারে না। তার বদলে বলে, হামার ভাই অত টাকাও নাই। কুরবানি-টুরবানিতেও বিশ্বাস রাখি না। হামার জান্নাত-নশীবের লেগে অবলা জীবের জান যাবে সেটা হামি চাহি না খো।
তাহলে তুমার সমুন্ধে যা শুনতে পাই তা দেখছি একেবারে ঠিক!
গাঁ-ঘরে তার সম্পর্কে কী আলোচনা হয়, গাফফার সেটা জানে। তবু জিগ্যেস করে, কী শুনতে পাও হামার সমুন্ধে?
এই জী, তুমি নামাজ পঢ়ো না! রমজানের রোজা রাখো না! আল্লা-রসুলকে মানো না!
ঠিকই শুনো। তবে যারা হামার সমুন্ধে এমন সব কথা বুলে তারা কি আল্লা-রসুলকে মানে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পঢ়ে? রমজানের রোজা রাখে?
মানবে না কেনে, খুব মানে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পঢ়ে। রমজানের রোজাও রাখে। এসব করে বুলেই তো এই দুনিয়া আজও টিকে আছে। এই তুমার ভাইকেই দেখো, আল্লা-রসুলকে মানে বুলেই তো তুমাকে ডেকে শুধাইছে কুরবানির কথা। তা বাদেও দেখো, তুমার ভায়ের কেমুন ঈমান যে আল্লার কালাম ফ্রেম বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখ্যাছে দোকানের দেওয়ালে দেওয়ালে। তাই তো তুমার ভায়ের ওপর আল্লার এত রহমত। তার কারবারেও এত বরকত।
গাফফার আরিফের কথার উত্তর দিতে পারে না। উত্তর দিবে কী, তার ভাই সাবিরকে তার থেকে বেশি আর কে জানে? মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে মাস্টারকে মেরে পালিয়ে এসে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে ব্যবসা খুলে বসেছিল। তার সেই ব্যবসা আজ রীতিমতো কারবারে পরিণত হয়েছে। খুচরা বিক্রির পাশাপাশি হোল সেল। কত রকম কোম্পানি, তাদের কত ধরণের প্রোডাক্ট! কোম্পানির গাড়ি এসে মাল পৌঁছে দেয়। সেই মাল এলাকার খুচরা বিক্রেতারা এসে কিনে নিয়ে যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায় তবু তার দোকানে খরিদ্দারের ভিড় কমে না।
না, ভায়ের ওপর তার কোনও হিংসা নেই। খুব কষ্ট করে এই কারবার দাঁড় করিয়েছে ছোঁড়া। চোখের সামনেই দেখেছে। সে যখন দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে ভাত-ঘুম দিচ্ছে, ভাই তখন দোকানে ঠাই বসে আছে। খরিদ্দার থাকুক বা না থাকুক। যেন এবাদত করছে! তারপর সপ্তাহে একদিন সেই কোন ভোরের ট্রেন ধরে কলকাতা যাওয়া। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- কখনওই ছেদ পড়েনি কলকাতা মাল খরিদ করতে যাওয়ার।
শুধু কি কলকাতা, কখনও তেল কিনতে সাঁইথিয়া ছুটছে। আবার কখনও ডাল কিনতে ডালখোলা। এখন অবশ্য কোথাও ছুটে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ফোনেই কাজ সারে। অর্ডার থেকে পেমেন্ট সব ওই ফোনেই হয়। তবে এখন সঙ্গে দুজন কর্মচারী রেখেছে। একজন তার সঙ্গে দোকান সামলায়। আর একজন তাগাদা করে বেড়ায়।
আবার আরিফের কথাও মিথ্যা নয়। সত্যিই সাবিরের যেমন যেমন কারবার বেড়েছে, তেমন তেমন তার দোকানের দেওয়ালে দোয়া লেখা ফোটো ফ্রেমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে তার হাতে, কোমরে, গলায় নানা রকমের তাবিজের সংখ্যাও বেড়েছে। আর হাতের আঙ্গুলে পাথর বসানো আংটির তো শেষ নেই। লোকে এসব দেখেই হয়ত ভাবে ভাই সাবিরের ওপর আল্লার রহমত আছে, তার কারবারেও আল্লার বরকত আছে।
অথচ সেই তুলনায় তার অবস্থা একেবারে বলার মতো নয়। সাম্মানিক যা পায়, সংসার চালানো দায় হয়ে ওঠে। গাড়ি-বাড়ি দূরের কথা, একটু মাছ বা মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হলে হাজারবার ভাবতে হয়। না, এসব কথা গাফফার কাউকে বলে না। বলতে পারে না। সে জানে, বললেও লোকে তা মানবে না। তাই গাফফার আরিফের সঙ্গে তর্কে যায় না। এমনিতে তার স্কুল যাওয়ার সময় হয়ে আসছিল। তাই সে আর সেখানে দাঁড়ায়ও না, স্কুলের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করে।
তার স্কুল বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়, শ্রীমন্তপুর- পাহাড়পুর- শিকারপুর- মাড়োয়াবাদ পেরিয়ে সেই যে পিপলার ধীরেণ ডাক্তারের পুকুর- যে পুকুরে জিনের ইঁদারা আছে- তার পাড়ে। চারপাশে আমবাগান। তার মধ্যে একপাশে দরগাতলা, আর একপাশে পিপলা গ্রাম। বাকি দু’পাশে ঘন সবুজ তিন-ফসলি মাঠ। তার খুব পরিচিত এলাকা। ধীরেণ ডাক্তারের পুকুরে এক বছর মাছ চাষ করার সুবাদে সে যেমন ওই এলাকার সবাইকে চেনে, তাকেও চেনে সবাই। তাই রাস্তায় কেউ যখন তাকে জিগ্যেস করে, ‘কেমুন আছেন মাস্টার?’ চলতে চলতে সে তখন উত্তর করে, ‘ভাল আছি ভাই।’ আবার কেউ যখন বলে, ‘ইস্কুল চললেন মাস্টার?’ সে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ ভাই। আর যাবার জায়গা কুন্ঠে আছে যে যাবো? মোল্লার দৌড় যেমুন মহজিদ, মাস্টারের দৌড় তেমনি ইস্কুল।’
এভাবেই গাফফার হাঁটতে হাঁটতে তার স্কুলে পৌঁছে যায়। কিন্তু আজ রাস্তায় সেরকম মানুষের দেখা পেলেও কেউ তাকে কোনও প্রশ্ন করে না। যে যার কুরবানির গরু-খাসি নিয়ে ব্যস্ত। এরটা ও দেখছে, ওরটা এ দেখছে। জায়গা জায়গা আবার অনেকগুলি কুরবানির গরু-খাসিকে ঘিরে অনেক অনেক মানুষের ভিড়। সেই সঙ্গে জোর আলোচনা। কোন হাটে কেনা? কত দাম? কোনটার কত গোস্ত হবে? ঠকেছে না জিতেছে?
চলতে চলতে এসব টুকরো টুকরো কথাও ভেসে আসে গাফফারের কানে, তবু কোথাও দাঁড়ায় না সে। আশ্চর্য কেউ তাকে ডেকে দাঁড়ও করায় না। সে কিছু ভাবতে ভাবতে কিংবা হয়ত কিছুই ভাবছে না, আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে একসময়ে স্কুলে গিয়ে পৌঁছায়।
কিন্তু এ কী! স্কুলের গেট যে বন্ধ! একজনও ছাত্র বা ছাত্রী আসেনি!
তাহলে কি আজ রাস্তায় কোথাও দাঁড়াতে হয়নি বলে সময়ের অনেক আগেই সে স্কুলে চলে এসেছে?
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে টাইম দেখে গাফফার। না, ঠিক সময়েই এসেছে। দশটা বেজে মাত্র ক’মিনিট হয়েছে। কিন্তু দশটা বাজার আগেই তো রাকিব এসে তালা খুলে ঝাড়ু-ঝাঁটা লাগিয়ে পরিষ্কার করে একেবারে তকতকে করে রাখে স্কুলটাকে। আজ তাহলে রাকিবের কী হল? তাছাড়া আজ সব ছাত্রছাত্রীরাই বা কোথায় গেল? অন্যদিন যারা সময়ের অনেকই আগেই স্কুলে চলে আসে! মেয়েরা বাগানে গাদ্দি খেলে। ছেলেরা খেলে ডাংগুলি। রাকিব কোনওদিন আসতে দেরী করলে সেইসব ছেলেমেয়েদের কাউকে পাঠিয়ে রাকিবের খোঁজ নেয়! কিংবা রাকিব কোনও কাজে আটকে থাকলে রাকিবের বাড়ি থেকে স্কুলের চাবি আনায়। আজ তাহলে কী করবে?
রাকিব স্থানীয় ছেলে। বেশি পড়াশুনা করতে পারেনি। তা নিয়ে তার খুব দুঃখ আছে। হয়ত সেই দুঃখ মেটাতেই স্কুল খোলা, বন্ধ করা, মিড-ডে-মিলের বাজার করার মতো কাজগুলি স্বেচ্ছায় করে দেয় সে। স্কুলের চাবি তার কাছেই থাকে।
তাহলে রাকিব যতক্ষণ না আসে সে কী অপেক্ষা করবে? অবশ্য ফোন করে তাকে ডাকতেই পারে!
এমন ভাবলেও রাকিবকে ফোন করে ডাকে না গাফফার। দরগাতলার দিক থেকে অনেক মানুষের কথা বলার আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে। আর সে কী যেন কী মনে করে স্কুলের গেট ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে সেই দরগাতলার দিকে হাঁটতে শুরু করে।
***
এই দরগাতলা এই অঞ্চলের খুব নামকরা জায়গা। এখানে যেমন মহরমের মেলা বসে, তেমনি মাহ্মুদ শাহ্ নামে কোনও এক ফকিরবাবার মাজার আছে। মাহ্মুদ শাহ্ কে ছিলেন কে জানে! তবে তাঁর নাকি অনেক ক্ষমতা! বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এখানে। তাঁর মাজারে মাথা ঠেকায়। টাকা-পয়সা থেকে ছাগল-মুরগি প্রণামী দেয়। চাদর চড়ায়। মাহ্মুদ শাহের কাছে মানত করে করে আপদ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য।
গাফফার দরগাতলায় পৌঁছে দেখতে পায় মাজারের কাছে সত্যিই বহু মানুষের ভিড়। কিন্তু মহরম আর বাৎসরিক জালসার দিন ছাড়া এত ভিড় তো এখানে থাকে না অন্যদিনে! আজ তাহলে কী এমন ব্যাপার ঘটল?
পাশেই আনসুরের লাউয়ের জমি। সেই জমিতে কীটনাশক স্প্রে করছিল আনসুর। এলাকায় ভাল চাষী হিসেবে তার খুব নাম আছে। কোন সময় জমিতে কী চাষ করলে ভাল মুনাফা হবে, সে জানে। অবশ্য লোকে বলে, তার ওপর নাকি খোদ মাহ্মুদ শাহের নেক্নজর আছে! সে যাইহোক, মাজারের ভিড়ে না গিয়ে গাফফার সেই আনসুরের কাছে যায়। জিগ্যেস করে, আনসুরভাই- কী ব্যাপার জী, মাজারে আজ এত ভিড় কেনে?
আনসুর নিজের কাজ না থামিয়ে বলে, মাস্টার- মাজারে ভিড় হবে না তো আপনার ইস্কুলে ভিড় হবে হবে নাকি?
এমন উত্তর শুনে গাফফার একটু হলেও চমকায়। আনসুর বলে কী! তাই আবার জিগ্যেস করে, কী বুল্লা ভাই?
কেনে শুনলেন না? বুল্লাম যে মাজারে ভিড় হবে না তো আপনার ইস্কুলে ভিড় হবে নাকি?
কেনে ভাই, এমুন কথা কেনে বুল্লা তুমি?
কেনে বুল্লাম তা লিজের চোখেই যেই দ্যাখেন গা!
কী এমন ব্যাপার যে গিয়ে নিজের চোখে দেখতে হবে? গাফফার কিছুই বুঝতে পারে না। তার কৌতূহল হয়। সে মাজারের সেই ভিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। আর দেখতে পায় পরিচিত অপরিচিত অনেক মুখ। তাদের মধ্যে তার ছাত্রছাত্রীরাও আছে। অষ্টম শ্রেণীর পিয়ারুলকে দেখতে পায় সে। পিঠে স্কুলব্যাগ নিয়ে ছোঁড়া ভিড়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আগ্রহ ভরে কী যেন দেখছে! গাফফার তার নাম ধরে ডাক দেয়, পিয়ারুল- ও পিয়ারুল!
পিয়ারুল হকচকিয়ে ঘুরে দেখে গাফফারমাস্টারকে। সে খুব ভয় পায়। গাফফারমাস্টার খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ। কোনও রকম অনিয়ম বরদাস্ত করেন না। তাহলে তার স্কুল ছেড়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বরদাস্ত করবেন কী করে? সেই ভয়ে কোথাও যে পালিয়ে বাঁচবে, তেমন কোনও উপায়ও দেখতে পায় না পিয়ারুল। অগত্যা ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে সরাসরি গাফফারমাস্টারের সামনে এসে দাঁড়ায়। জিগ্যেস করে, কী বুলছেন স্যার?
কী করছিস এখানে? গাফফার জিগ্যেস করে।
উট দেখছি স্যার।
উট! এখানে আবার উট এল কুন্ঠে থেক্যা?
আপনি যেই দ্যাখেন গা স্যার। কুন্ঠেকার একটা লোক কুরবানি দিবে বুলে উট কিনে লিয়ে এস্যাছে পাকুড়ের হাট থেক্যা।
কৌতূহল দমাতে পারে না গাফফার, পিয়ারুলকে ছেড়ে ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। আর সত্যিই দেখতে পায় মাজার ঘেঁষা রাস্তার ধারে বটগাছের নীচে একটা উটকে বসে থাকতে। পাশে দাঁড়িয়ে চুঁয়াপুকুরের সানাউল্লামাস্টার। তাকে কিছু বলতে হয় না, সানাউল্লামাস্টার তাকে দেখতে পেয়ে নিজেই বলে ওঠে, আরে গাফফারভাই যে! তা এদিকে কুন্ঠে?
গাফফার বলে, এখানেই তো আমার ইস্কুল ভাই। তা তুমি এখানে কী করছো?
আর বুলিও না ভাই। কুরবানির উট কিনতে গেলছিনু পাকুড়ের হাটে। এই দ্যাখো ভাই সেই উট। দাম পড়ল ষাট হাজার টাকা। সারারাত ধরে হাঁটিয়ে লিয়ে আসছি।
কুরবানি! ষাট হাজার টাকার উট! সানাউল্লামাস্টার! কোনও হিসেব মেলাতে পারছে না গাফফার। তাহলে লোকে যা বলছে তা কি সত্যি? আজকাল নাকি সানাউল্লামাস্টার হেরোয়িনের কারবারে টাকা খাটাচ্ছে!
কে জানে!
গাফফার সানাউল্লামাস্টারের কুরবানির উটটাকে দেখছে। উটটা বুঝি খিদের জ্বালায় জাবর কাটছে! তার দুই কষা বেয়ে সাদা সাদা ফ্যানা গড়িয়ে পড়ছে। যা দেখে গাফফারের মনে হচ্ছে, তার অবস্থাও ওই উটটার মতো। সেও জাবর কাটছে। তবে পার্থক্য যেটুকু- উটটার মতো তার কষা বেয়ে সাদা সাদা ফ্যানা গড়িয়ে পড়ছে না। পড়বে কী করে? আসলে সে তার মুখে জমা ফ্যানা গিলে গিলে খাচ্ছে, নিজের পেট ভরাচ্ছে।
কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও গাফফার নিজে অন্তত সেটা বুঝতে পারছে।