পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শ্রমদাসত্বের শ্রমকোড

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 200 view(s)
  • লিখেছেন : নোটন কর
৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পরে, ‘ওয়েজ অন কোড-২০১৯ এই মজুরি বিলটি কার্যকর হয়েছে এই বিলটি প্রচলিত ৪ টি আইন যথা – (i) ন্যূনতম মজুরী আইন-১৯৪৮ (the Minimum Wages Act, 1948), (ii) মজুরী প্রদান আইন-১৯৩৬ (the Payment of Wages Act, 1936), (iii) বোনাস প্রদান আইন-১৯৬৫ (the Payment of Bonus Act, 1965), এবং (iv) সম মজুরী আইন-১৯৭৬ (the Equal Remuneration Act, 1976) একত্রিত করে একটি কোডে পরিণত করা হয়েছে।

ভারতে প্রচলিত ৩৯টি শ্রম আইন বাতিল করে নতুন ৪টি শ্রম কোড তৈরি করেছে মোদি সরকার। ওই আইন যেমন শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ বিরোধী, তেমনভাবে মালিকশ্রেণি ও কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থ রক্ষাকারী। প্রচলিত শ্রমআইনগুলি তৈরি হয়েছিল ভারতের শ্রমিকশ্রেণির দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ভারতের শ্রমিকশ্রেণি প্রচলিত ৩৯টি শ্রম আইনের মাধ্যমে যে অধিকার ও সুবিধাগুলি অর্জন করেছিল তার অনেক কিছু নেই নতুন আইনে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এবং ট্রেড ইউনিয়নসমূহের বিরোধিতা ও আপত্তি সত্ত্বেও জোরপূর্বক সংসদে ওই আইন পাশ করানো হয়েছে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই (কোড অন ওয়েজ)। ওই আইনে রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিয়েছে ২০১৯ সালর ৮ সেপ্টেম্বর। দেশজুড়ে শ্রমজীবী মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। রাজ্যে রাজ্যে শ্রমজীবী মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সভা, সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন। ট্রেড ইউনিয়নগুলি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, শ্রমকোড বাতিল করতে হবে। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে তীব্র শ্রমিক আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়েছিল অনেকগুলি শ্রমআইন তৈরি করে শ্রমিকদের জন্য সুযোগ-সুবিধ চালু করতে। ১৯২৩ সালে প্রথম তৈরি হয়েছিল The Workmens Compensation Act, ১৯২৬ সালে তৈরি হয়েছিল Trade Union Act, ১৯৩৬ সালে তৈরি হয়েছিল The Payment of Wages Act, ১৯৪২ সালে তৈরি হয়েছিল The Weekly Holydays Act, ১৯৪৬ সালে তৈরি হয়েছিল The Industrial Employment (Standing Orders) Act ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রান্তে প্রবল শ্রমিক আন্দোলনের ফলে ভারত সরকার বাধ্য হয়েছিল নতুন কয়েকটি আইন তৈরি করতে। যেমন, ১৯৪৭ সালে তৈরি হয়েছিল The Industrial Dispute Act, ১৯৪৮ সালে তৈরি হয়েছিল The Minimum Wage Act ওই বছরেই তৈরি হয়েছিল The Factories Act, এবং ১৯৫২ সালে তৈরি হয়েছিল The Employees Provident Fund And Miscellaneous Provisions Act আইনগুলিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার অনেকটাই সুরক্ষিত ছিল, তাছাড়া নানা ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এই ব্যবস্থা বাতিল করার সূচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালে ভারতে উদারবাদী আর্থিক নীতি প্রয়োগের সময়কালে। বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন তৎকালীন কংগ্রেস সরকার তৎপরতার সঙ্গে উদার আর্থিক নীতি প্রয়োগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রের বিজেপি পরিচালিত বাজপেয়ী সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে বৃহৎ পুঁজি ও কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থ চরিতার্থ করতে গঠন করেছিল দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশন। ২০০২ সালে ওই কমিশন তার রিপোর্টে শ্রম আইনগুলির পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল। ওই সুপারিশেই ছিল শ্রমিক স্বার্থবিরোধী আইন প্রণয়নের কথা। সেই সুপারিশ কার্যকর করার জন্য সময়ের অপেক্ষায় ছিল মোদি সরকার। ২০১৪ সালে বিজেপি দল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তথা কর্পোরেট সংস্থাগুলির উদ্দেশ্যে শ্রমআইন সংস্কারের কথা যোষণা করেন। সেই ঘোষণা অনুসারে বৃহৎ পুঁজি ও কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থরক্ষা করতে মোদি সরকার সংসদে পাশ করিয়েছে নতুন শ্রমকোড আইন। শ্রমকোডে যা বলা হয়েছে, তা প্রতিটি শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের জানা প্রয়োজন। সেইজন্য শ্রম কোডের বিপদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা এখানে উপস্থিত করা হয়েছে।

 

মজুরি সংক্রান্ত কোড (The Code on Wages 2019) :

 

৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পরে, ‘ওয়েজ অন কোড-২০১৯ এই মজুরি বিলটি কার্যকর হয়েছে   এই বিলটি প্রচলিত ৪ টি আইন যথা – (i) ন্যূনতম মজুরী আইন-১৯৪৮ (the Minimum Wages Act, 1948),  (ii) মজুরী প্রদান আইন-১৯৩৬ (the Payment of Wages Act, 1936), (iii) বোনাস প্রদান আইন-১৯৬৫ (the Payment of Bonus Act, 1965), এবং (iv) সম মজুরী আইন-১৯৭৬ (the Equal Remuneration Act, 1976) একত্রিত করে একটি কোডে পরিণত করা হয়েছে।

নতুন আইনে ন্যূনতম মজুরির কথা বলা হলেও কত হবে ন্যূনতম মজুরি তা বলা হয়নি। ফলে সুযোগ নেবে মালিকশ্রেণি ও কর্তৃপক্ষ। এই আইনের মধ্য দিয়ে মজুরি নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতি এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

মোদী সরকার ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ (the floor wage) দৈনিক ১৭৮ টাকা ধার্য করেছে, যা কেন্দ্রীয় শ্রম  মন্ত্রকের নির্ধারণ করা দৈনিক ৩৭৫ টাকার থেকে অনেক  কম। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত ১ম  ভারতীয় জাতীয় শ্রম সম্মেলনে মজুরী নির্ধারণের ক্ষেত্রে যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেগুলি হল- রাষ্ট্রসংঘের তৎকালীন  ডিরেক্টর ডঃ ওয়ালেস একরোয়েডের ফর্মূলা অনুযায়ী (ক) প্রত্যেক  শ্রমিক পরিবার ধরা হবে শ্রমিক নিজে, তার স্ত্রী ও তাদের ২ সন্তান (খ) প্রতিদিন তাদের ২৭০০ ক্যালোরী ন্যূনতম খাদ্য জোগাতে হবে (গ) বছরে ৭২ গজ বা ৬৮.৮ মিটার বস্ত্র (ঘ) শিল্প শ্রমিকদের বসবাস করার জন্য সরকারী হাউজিং স্কীমে যেটুকু ঘর বা জায়গার ব্যবস্থা আছে সেই আয়তনের ঘর বা বাড়িভাড়া দিতে হবে (ঙ) জ্বালানী, আলো এবং অন্যান্য খরচ যেমন সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মিলিয়ে ন্যূনতম মজুরির ২০ শতাংশ দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য সরকার নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি (ডঃ অনুপ শতপথি  কমিটি) ন্যূনতম দৈনিক মজুরি মূল্য সূচকের ভিত্তিতে কমপক্ষে ৩৭৫ টাকা বা মাসিক ১১৬২২ টাকা হওয়ার সুপারিশ করেছিল জুলাই ২০১৭ সালে। যদিও ঐ রির্পোটে অনেক গোলমাল ছিল। ২৭০০ ক্যালোরীর জায়গায় ধরা হয়েছিল ২৪০০ ক্যালোরী ও ৩ জনের পরিবার এবং তার সাথে বাজারের দামে ব্যাপক কারচুপির হিসাব করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য ভারত সরকার ৭ তম বেতন কমিশনে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম বেতন ১৮,০০০ টাকা নির্ধারণ করেছে (চ) নতুন আইনে এই নির্দেশিকার কথা নেই। পরিবর্তে বলা হয়েছে, টাইম রেট, পিস রেট এর ওপর মজুরি নির্ধারণ করা হবে। (ছ) এই কোডে উল্লেখ নেই শ্রমিকদের ক্ষেত্রে দক্ষ, অর্ধদক্ষ ও অদক্ষ বিষয়টি। যা প্রচলিত আইনে ছিল। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করায় দক্ষ, অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ মজুরির ক্ষেত্রে শ্রমিক বঞ্চনার শিকার হবেন। (জ) প্রচলিত আইনে ৮ ঘণ্টা কাজ করার পর অতিরিক্ত সময় কাজ করলে শ্রমিকের ওভার টাইম পাওয়ার অধিকার ছিল। শ্রমকোডে ওই অধিকার বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন আইন চালু হলে অতিরিক্ত মজুরি ছাড়াই অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হবে। এখন কাজের সময় ওয়ার্কলোড অনুযায়ী ১২ঘন্টা বাড়ানো যাবে যাতে ওভারটাইম মালিককে দিতে না হয়। (ঝ) নতুন কোডে বোনাস পাওয়ার অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। শিল্প সংস্থার আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে কর্তৃপক্ষ বোনাস নির্দিষ্ট করবে। কোম্পানি মুনাফা না করলে বোনাস প্রদান বন্ধ। প্রচলিত আইনে ছিল কোম্পানিকে ন্যূনতম ৮.৩৩ শতাংশ হারে বোনাস দিতে হবে। তাছাড়া কর্তৃপক্ষ লাভ-ক্ষতির হিসাব (Balance Sheet) দেখাতে বাধ্য থাকবে না। (জ) ন্যূনতম মজুরি না দিলে মালিক ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সরকার কোনো রকম ব্যবস্থা নিতে পারবে না। সামান্য জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রচলিত আইনে "মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট" মালিককে মানতে হত। নাহলে শাস্তির বিধান ছিল।

 

শিল্প সম্পর্কিত কোড (the Industrial Relations Code 2020):

 

ট্রেড ইউনিয়ন আইন ১৯২৬ (The Trade Union Act 1926), শিল্প কর্মসংস্থান সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ আইন ১৯৪৬ (The Industrial Employment (Standing Orders) Act 1946) এবং শিল্প বিরোধ আইন ১৯৪৮ (The Industrial Dispute Act, 1948) সহ বেশ কয়েকটি আইন একত্রিত করে এই ‘শিল্প সম্পর্কিত কোড’ তৈরি করা হয়েছে।

(১) ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন:- কর্মরত মোট শ্রমিকের ১০ শতাংশ বা ১০০ জন আবেদন করলে রেজিস্ট্রেশন হবে। প্রচলিত আইনে ৭ জন শ্রমিক আবেদন করলেই রেজিস্ট্রেশন হতো। সুতরাং নতুন আইনে সহজে নতুন ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না।

(২) ইউনিয়নের মান্যতা (Recognition):-দ্বিতীয়ত প্রচলিত আইনে কর্তৃপক্ষ (management) দ্বারা কোনো ইউনিয়নকে স্বীকৃতি (recognition) দেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত (registered) সকল ইউনিয়নের দর কষাকষির (negotiation) সমান অধিকার ছিল। তারা শ্রমিকদের দাবি দাওয়া, শিল্প বিরোধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করতে পারত এমনকি দাবি আদায়ের জন্য ধর্মঘটেও যেতে পারত।

এখন এই কোডের ১৪ নং ধারা অনুযায়ী শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত ইউনিয়নের আলোচনা করার অধিকার থাকবে। যদি কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানে মাত্র একটি রেজিস্টার্ড ইউনিয়ন থাকে তাহলে কেবলমাত্র তখনই এই ইউনিয়ন আলোচক (negotiator) হিসেবে স্বীকৃতি পাবে যদি এর সদস্যপদে অন্তত ৩০ শতাংশ শ্রমিক অন্তর্ভুক্ত থাকে। যদি কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানে একাধিক রেজিস্টার্ড ইউনিয়ন থাকে তাহলে যার ৫১ শতাংশ শ্রমিক সদস্যপদ থাকবে সেই ইউনিয়নকে একমাত্র আলোচক ইউনিয়ন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে । যদি কোনো ইউনিয়নের ৫১ শতাংশ সদস্যপদ না থাকে তাহলে ২০ শতাংশের বেশি সদস্যপদযুক্ত সকল ইউনিয়নকে একত্র করে একটি আলোচক কাউন্সিল (negotiating council) গঠন করা হবে। ইউনিয়নগুলির সদস্যপদ যাচাইয়ের জন্য গোপন ভোট গ্রহণ করা হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সরাসরি কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হবে এবং ভোটার তালিকা কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত করবেন। এই নতুন ধারায় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত ছাড়া অন্যসব রেজিস্টার্ড ইউনিয়নকে সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। প্রয়োজনীয় ১০ শতাংশ সদস্য সংখ্যা থাকা সত্বেও বাকি ইউনিয়নগুলির কোনো অধিকার থাকবে না। তারা কোনো ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারবে না। তারা কোনো দাবি পেশ, ধর্মঘট করা বা দর কষাকষি আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শ্রমআইন লঙ্ঘনের বিষয়ে শ্রম বিভাগের কাছে অভিযোগ করতে পারবে না।

(৩) ধর্মঘট করার অধিকার- নতুন আইনে ধর্মঘটের অধিকার প্রায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন ধর্মঘট করতে হলে ১৪ দিন আগে সব ক্ষেত্রের জন্য ধর্মঘটের নোটিশ দিতে হবে। প্রচলিত আইনে বলা ছিল, অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ধর্মঘটের ১৪ দিন আগে নোটিশ দিতে হবে।

ধর্মঘট করা শ্রমিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার যা চূড়ান্ত অস্ত্র হিসেবে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। নতুন আইআর কোড প্রায় প্রতিটি শ্রমিক ধর্মঘটকে অসম্ভব করে তুলেছে। বর্তমান শ্রম আইনে ধারা ২২ অনুযায়ী শুধুমাত্র জরুরি পরিষেবা ক্ষেত্রে ১৪ দিন আগে ধর্মঘট নোটিশ দেওয়ার প্রয়োজন আছে এবং ধারা ২৩ অনুযায়ী অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের জন্য এই নোটিশের প্রয়োজন নেই। নতুন কোডে পুরনো ধারা ২২ ও ২৩ একত্রিত করে একটি নতুন ধারা ৬২(১) তৈরি করা হয়েছে এবং এখন সব ক্ষেত্রের জন্য আগাম ধর্মঘটের নোটিস দিতে হবে। ১৪ দিনের ধর্মঘটের নোটিশ প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ধর্মঘটের নোটিশ পাওয়ার পর যদি শ্রমকর্তা আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু করেন তাহলে আলোচনা চলাকালীন কোনো ধর্মঘট করা যাবে না। যদি আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে শ্রমকর্তা একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে দেবেন তারপর এটি একটি সালিশি সভার (tribunal board) কাছে যাবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি সালিশি সভার অধীন থাকবে তৎক্ষণ ধর্মঘট করা যাবে না। অপরদিকে সালিশি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে নতুন কোড অনুযায়ী কারখানা কর্তৃপক্ষ সরাসরি বিষয়টি নিয়ে আদালতে যেতে পারবে [ধারা ৫৩ (৬)] তাই কোনো ধর্মঘট করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

(৪) কোড মারফত মালিকপক্ষকে যখন তখন ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করার ক্ষমতা প্রদান হয়েছে।

(৫) তদুপরি, গণ নৈমিত্তিক ছুটিকেও ( mass casual leave) ধর্মঘটের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

(৬) নতুন আইনে বলা হয়েছে, ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হলে শ্রমিকদের জরিমানা হবে, জেলও হতে পারে। বলা হয়েছে, যারা বেআইনি ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানাবে তাদেরও জরিমানা ও জেল হতে পারে।

(৭) প্রচলিত শিল্প বিরোধ আইন ১৯৪৮ এর ৫বি ধারায় বলা ছিল, ১০০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করে এমন শিল্প সংস্থার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ লে-অফ, ছাঁটাই, ক্লোজার করার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এখন নতুন আইনে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ৩০০ শ্রমিক এবং তার অধিক কাজ করে এমন সংস্থার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। তাছাড়া, সরকার যে কোনো সময় এই সীমা বৃদ্ধি করতে পারবে; এ বিষয়ে ধারা ৭৭(১) তে উল্লেখ আছে। ফলে লে-অফ, ছাঁটাই, ক্লোজার করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষকে সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে।

(৮) এর দ্বারা বড় সংস্থাগুলি নিজেদের সংস্থাগুলিতে ছোট ছোট ইউনিট তৈরি করে ৩০০ শ্রমিক কর্মচারী রাখবে। ফলত শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা চলে যাবে।  তারা আরও কঠিন শর্তে কাজ করতে বাধ্য হবে।

(৯) ভারতবর্ষে ছোট ও মাঝারি ৭০ শতাংশ শিল্পে ১০০-৩০০ শ্রমিক কর্মচারী কর্মরত আছে। ফলতঃ এইসব কর্মী কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকির মুখে থাকবেন।

(১০) প্রচলিত আইনে বলা আছে, কর্তৃপক্ষ ক্লোজার করলে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নতুন আইনে ক্ষতিপূরণের কথা নেই।

(১১) নতুন আইনে মালিকের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে স্টান্ডিং অর্ডার চূড়ান্ত করার। এতদিন রাজ্য সরকার ও ট্রেড ইউনিয়নসমূহের অনুমোদনের ভিত্তিতেই স্ট্যান্ডিং অর্ডার চূড়ান্ত হতো।

(১২) এখন মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী  স্থায়ী কর্মীকে অস্থায়ী কর্মীতে পরিণত করা যাবে। এই আইনের মাধ্যমে বেসরকারী সংস্থাগুলি যে কোনও সময় যে কোনও স্থায়ী কর্মচারীকে অপসারণ বা চুক্তি শ্রমিক হিসাবে বদলে দেওয়ার অধিকার রাখে।

(১৩) Fixed Term Employment (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চাকরি)। এই ধারায় মালিককে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ।  “হায়ার এন্ড ফায়ার” ভিত্তিতে শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ এবং ছাঁটাই চলবে এখন থেকে।

(১৪) পুনঃনিযুক্তি - পূর্বে ছাঁটাইয়ের পর, ছাঁটাই করা শ্রমিক কর্মচারীদের কোনও সময়সীমা ছাড়াই পুনঃনিযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া যেত (পুরনো ধারা ২৫H)। কিন্তু নতুন কোডের ধারা ৭২ অনুযায়ী এই অধিকার, ছাঁটাইয়ের তারিখ থেকে মাত্র এক বছরের জন্য সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে তাই কোনো ব্যাপক ছাঁটাই/সংস্থা বন্ধের এক বছর পর, নিয়োগকর্তার ওপর পুনঃনিযুক্তির অগ্রাধিকার দেওয়া বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এর ফলে মালিকপক্ষ সহজেই সিনিয়র ও দক্ষ শ্রমিকদের ছাঁটাই করে নতুন কম মজুরি প্রদত্ত শ্রমিক কর্মচারী নিয়োগ করতে পারবে।

(১৫) শিল্প সংস্থার মালিকপক্ষ আইন মানছে কিনা তা দেখার জন্য ইন্সপেকশনের ব্যবস্থা ছিল প্রচলিত আইনে। নতুন আইনে এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। শ্রমআইন ভঙ্গকারী নিয়োগকর্তাদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রম পরিদর্শকরা (labour inspectors) নতুন শ্রমকোডে “সহায়ক” (facilitator) রূপে ভূমিকা পালন করবে অর্থাৎ, তারা নিয়োগকর্তাদের পরামর্শ (advise) দিয়ে আইন প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করবে। তদুপরি, শ্রমকোড অনুযায়ী, নিয়োগকর্তার অপরাধগুলো লঘু করা হয়েছে অর্থাৎ, যদি কোনো নিয়োগকর্তা আইন ভঙ্গ করেন তবে জরিমানা প্রদান করলেই কারাগারের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবেন। অপরদিকে, শ্রমিকরা অবৈধ ধর্মঘটের জন্য কারাবাসের মুখোমুখি হতে পারেন এবং তাদের জন্য জরিমানা ও দণ্ডের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে।

(১৬) সংস্থায় ক্লোজার হলে শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পাবে না। আগে শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পেত

(১৭) শ্রমিক মালিক বিরোধ হলে সেই বিষয়ে কোথায় নিষ্পত্তি হবে তা নতুন আইনে স্পষ্টভাবে বলা নেই।

(১৮) ট্রাইব্যুনালের রায় কোনো মালিক না মানলে শ্রমিক কোর্টে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। প্রচলিত আইনে এই সুবিধা ছিল।

(১৯) শিল্প বিরোধের আইনি বিচার প্রক্রিয়া (Legal adjudication process for industrial disputes)

শ্রমকোডের অধীনে আগের মতো কোনও শিল্প সম্পর্কিত সালিশি আদালত (tribunal) থাকবে না। শুধুমাত্র একটি অঞ্চল ভিত্তিক শিল্প ট্রাইব্যুনাল বা জাতীয় ট্রাইব্যুনাল থাকবে। পুরানো শ্রমআইনে সালিশি আদালত এবং শিল্প ট্রাইব্যুনাল বিচার বিভাগীয় আইনবিদদের দ্বারা পরিচালিত হত। এখন শ্রমকোড অনুযায়ী নতুন শিল্প ট্রাইব্যুনালে ২ জন সদস্য থাকবে। তাদের মধ্যে একজন হবে বিচার বিভাগীয় (judiciary) এবং আর একজন প্রশাসনিক (executive)। কিছু কিছু বিষয়ে তারা পৃথকভাবে শুনানি এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবে অর্থাৎ প্রশাসনিক সদস্য (কিছু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা) একাই শ্রমিকদের বিষয়গুলি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যার অর্থ কার্যকরীভাবে শ্রমিকদের পক্ষে রায় পাওয়া সম্ভাবনা আরও কমে যাবে।

 

সামাজিক সুরক্ষা কোড (the code on Social security 2020)

 

এই কোডে ৯টি আইনকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এতদিন পৃথক পৃথক আইন ছিল। (১) ইএসআই আইন ১৯৪৮, (২) দ্য ইপিএফ আইন ১৯৫২, (৩) নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ সেস আইন ১৯৯৬, (৪) অসংগঠিত ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা আইন ২০০৮, (৫) মাতৃত্বকালীন সুবিধা প্রদান আইন ১৯৬১, (৬) গ্র্যাচুইটি প্রদান আইন ১৯৭২, (৭) ওয়ার্কমেন্স কমপেনশেসন আইন ১৯২৩, (৮) সিনে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড আইন ১৯৮১, (৯) এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ (কমপালসরি নোটিফিকেশন অফ ভ্যাকানসিস) আইন ১৯৫১। প্রচলিত আইনগুলিতে যে সুবিধা চালু ছিল তা অনেকাংশে ছাঁটাই করা হয়েছে। যেমন, (ক) ইপিএফ (EPF):- এতদিন ছিল শ্রমিকের বেতন থেকে ১২ শতাংশ কেটে ইপিএফ তহবিলে জমা হবে এবং মালিক সমপরিমাণ অর্থাৎ ১২ শতাংশ জমা দেবে। নতুন আইনে বলা হয়েছে ১০ শতাংশ কাটা হবে। ফলে মালিকের দেওয়া টাকা থেকে শ্রমিক ২ শতাংশ কম পাবে। শ্রমিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। (খ) ইএসআই (ESI): বর্তমানে শ্রমিকের বেতন থেকে কাটা হয় ০.৭৫ শতাংশ টাকা। মালিকপক্ষ দেয় ৩.২৫ শতাংশ। নতুন আইনে এই প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থার অনুপ্রবেশের দরজা খোলা রাখা হয়েছে। ইএসআই প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থা প্রবেশ করার সুযোগ পেলে ইএসআই এর সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। (গ) গ্র্যাচুইটি (gratuity):- নতুন আইনে বলা হয়েছে, গ্র্যাচুইটির পরিমাণ কত হবে তা কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করবে। অর্থাৎ সরকার যা ঘোষনা করবে শ্রমিক তাই পাবে। রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। প্রচলিত আইনে গ্রাচুইটি অ্যাক্ট অনুসারে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর আইনের নির্দেশিকা অনুসারে মালিকপক্ষ হিসাব করে শ্রমিকের গ্র্যাচুাইটি মিটিয়ে দিতে বাধ্য থাকত। নতুন আইন অনুসারে গ্র্যাচুইটি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। (ঘ) দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপুরণ:- প্রচলিত আইনে কর্মস্থলে শ্রমিক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলে মালিকপক্ষকেই ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হতো। সেই টাকার পরিমাণ ছিল ন্যূনতম ৪ লক্ষ টাকা, ঊর্ধ্বে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা। নতুন আইনে সুপারিশ করা হয়েছে ক্ষতিপূরণের টাকা কত হবে তা মালিকপক্ষ নির্দিষ্ট করবে। (ঙ) অসংগঠিত ক্ষেত্র:- অসংগঠিত ক্ষেত্রের স্পষ্ট সংজ্ঞা নতুন আইনে দেওয়া হয়নি। ফলে দেশের শ্রমশক্তির ৯৩ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি।

(১) অসংগঠিত ক্ষেত্র সহ অন্যান্য কর্মী যেমন গিগ কর্মী (যারা বাড়ী বাড়ী পরিষেবা পৌঁছে দেয়) এবং প্ল্যাটফর্ম কর্মী (যারা অনলাইনে কাজ করে) তাদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প এই কোডের মাধ্যমে ছাঁটাই করা হয়েছে। গিগ আর প্লাটফর্ম শ্রমিকদের জন্য কোন অধিকারের কথা নেই এই কোডে,  অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য অস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার এই সব শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য যোজনা তৈরি করবে। জীবনবীমা, স্বাস্থ্য, মাতৃত্ব, বৃদ্ধ বয়সের পেনশন, শিক্ষা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, দুর্ঘটনা, আবাস, ইত্যাদি বিষয়ে এই যোজনাগুলি তৈরি হবে। রাজ্য সরকারও এইসব বা অন্য বিষয়ে যোজনা তৈরি করতে পারে।

(২) আগে কাজের সময় কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে চিকিৎসা খরচের দায় নিয়োগকারীকে নিতে হতো। এখন সেই দায় কর্তৃপক্ষের নেই।

(৩) সংস্থায় ২০ জন কর্মী হলে পিএফ-এর সুযোগ। আগে সংখ্যাটা ছিল ১০জন।

(৪) কোন শ্রমিক কর্মচারী টানা ৫ বছর কাজ করলে গ্রাচুইটির সুযোগ পাবে। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা নির্দিষ্ট মেয়াদি চাকরির পর সেই মেয়াদি গ্রাচুইটি পাবে।

(৫) মহিলা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন (maternity leave) সুবিধা হ্রাস।

(৬) বিপজ্জনক কাজে মহিলা কর্মীদের রাতে কাজ করার অনুমতি।

(৭) কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত মজুরীর মধ্যে ১০ জন শ্রমিক কোন সংস্থায় কাজ করলে ইএসআই-এর সুযোগ পাবে।

 

পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কার্যনির্বাহী শর্তাবলী কোড (the occupational safety, health & working condition code 2020)

 

১) নতুন কোডে ফ্যাক্টরি বা কারখানার সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত সংস্থায় সর্বনিম্ন শ্রমিক সংখ্যা ১০ থেকে ২০ এবং বিদ্যুৎ ব্যবহৃত না হলে ২০ থেকে ৪০ এ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, অনেক ছোট শিল্প সংস্থাকে এখন কারখানা হিসেবে গণ্য করা হবে না এবং শ্রমিকরা ফ্যাক্টরি আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণমূলক সুরক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবেন। স্পষ্টতই, উদ্দেশ্য হলো আরও অনেক শ্রমিককে শ্রম আইনের সুরক্ষা ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে কর্তৃপক্ষের ব্যয়ভার কমিয়ে দেওয়া এবং নিয়োগকর্তাদের শ্রমিকদের উপর আরও কঠিন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

একইভাবে, ঘর ও নির্মাণ কাজের সংজ্ঞায় একটি বিধি যুক্ত করা হয়েছে, “…যেখানে নির্মাণ খরচ পঞ্চাশ লক্ষ বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ও সীমাবদ্ধ থাকবে সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের ঘর ও নির্মাণ শিল্পের মধ্যে গণ্য করা হবে না।” এর মাধ্যমে সরকার ঘর ও নির্মাণ কাজের শ্রমিকের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে শ্রমিকদের কল্যাণমূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারে।

২) আগের আইনে ন্যূনতম স্বাস্থ্য, সুস্থ পরিবেশ ও পেশাগত সুরক্ষার জন্য আলাদা আলাদা পেশা ভিত্তিক আইন তৈরি হয়েছিল। নতুন আইনে সব বাতিল করে একটি কোডে নিয়ে আসা হয়েছে। এতে সব পেশার শ্রমিক উপকৃত হবেনা। মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করতে হবে।

৩) ১৯৭০ সালের The Contract Labour (Regulation and Abolition) Act অনুযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মজুরীর দায়িত্ব নিয়োগকর্তার উপর ছিল। নতুন আইনে সেই দায়িত্ব মালিকের নেই। চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের দিয়ে কোনও স্থায়ী কাজ করা বেআইনী ছিল। এখন থেকে, ঠিকাদার কর্মীদের যেকোন স্থায়ী বা অস্থায়ী প্রকৃতির ধরণের কাজের জন্য নিযুক্ত করা যাবে এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য মালিকের কোনও দায়বদ্ধতা নেই।

প্রচলিত আইনে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগের ওপর নিয়ন্ত্রণের কথা বলা ছিল। প্রচলিত আইন কন্ট্রাক্ট লেবার (অবলুপ্তি ও বিধিমালা) ১৯৭০ (CLARA) অনুযায়ী সরকার আইনিভাবে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে পারত যদি নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ দেখা যেত যেমন—

(ক) চুক্তিভিত্তিক কাজ শিল্প, বাণিজ্য, ব্যবসা, উৎপাদন বা পেশার সাথে অন্তর্ভুক্ত বা তার জন্য অপরিহার্য কিনা;

(খ) এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির ধরণ কিনা অর্থাৎ শিল্প, বাণিজ্য, ব্যবসা, উৎপাদন বা পেশাগত বিবেচনায় পর্যাপ্ত সময়ের জন্য স্থায়ী কাজ কিনা;

(গ) এটি কি সাধারণত নিয়মিত কর্মচারীদের মাধ্যমে করা হয়;

(ঘ) এখানে কি যথেষ্ট পরিমাণে পূর্ণসময়ের কর্মচারী নিয়োগের প্রয়োজন হয়;

এই কোড এখন যা পূর্ণসময়ের শ্রমিক দ্বারা করা হয় বা যা দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির কাজ সেখানে স্বাধীনভাবে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের অনুমতি দিয়েছে ।

ঙ) আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কর্মক্ষেত্রের নিকটবর্তী শ্রমিক আবাসনের ব্যবস্থাপনা এই আইনে বাতিল করা হয়েছে।

আন্তঃরাষ্ট্রীয় অভিবাসী কর্মীদের (Inter-State Migrant Workmen act-1979) সংজ্ঞা এই কোডে এমনভাবে নির্ধারিত হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে একজন অভিবাসী কর্মী নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করেন এবং মাসে ১৮,০০০ টাকার নীচে আয় করেন। তারপরও কিছু শর্ত চাপানো হয়েছে। যেমন যেখানে কর্মী কাজ করতে গেছেন সেই কারখানার মালিক যদি ঘোষণা করে তার কারখানায় কুড়ি জনের বেশি কাজ করে আর কর্মীদের মজুরি আঠারো হাজার টাকার কম সাথে যে ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করতে কর্মী গেছেন সেই ঠিকাদার যদি সরকারের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে থাকেন তবেই অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। আইনকে কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে না দিলে কী হয়, তার উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের ইটভাটাগুলি। দূরের গ্রাম বা ভিন রাজ্য থেকে ঠিকাদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে হতদরিদ্র মানুষগুলো কাজ করতে আসেন। ভাটার ভিতরে ছ'ফুট বাই সাত ফুট ঘরে থাকেন, যার দেওয়াল মানে ইটের পাঁজা আর ছাদে ভাঙা টালি। প্রচণ্ড দাবদাহেও বেলা তিনটেয় কাঁচা ইট রোদে দেন। আজ অবধি কোনও ঠিকাদার সরকারি নথিতে নাম তোলেনি। পুরুষ মজুরদের নাম শুধু ঠিকাদারের খাতায় থাকে, মহিলা ও শিশু মজুরদের নাম কোথাও থাকে না। তাঁদের আইনি সুরক্ষা আরও দুঃসাধ্য হয়ে উঠে।

ক্যান্টিন, বিশ্রামকক্ষ, ক্রেশ: পুরনো শ্রমআইনগুলিতে সামাজিক সুরক্ষা বিধি ও সুবিধা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণমূলক বিষয় ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ ছিল। কিন্তু নতুন শ্রমকোডে বিষয়গুলি অস্পষ্ট রেখে সরকারের উপর বিধিমালা (rules & regulation) (যা মূলত আমলারা তৈরি করে) তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পুরনো ফ্যাক্টরি আইন অনুযায়ী, যন্ত্রপাতি বসানোর মধ্যে ব্যবধান, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুরক্ষা সরঞ্জাম, বায়ু চলাচল, এবং কল্যাণমূলক ব্যবস্থাপনা যেমন- শৌচাগার, ঠান্ডা পানীয়, ক্যান্টিন, বিশ্রামকক্ষ, ধোবার সুযোগ, ক্রেশ ইত্যাদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিল। খনির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম ছিল। কিন্তু এখন স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থাপনা সরকার কর্তৃক তৈরি হবে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাক্টরি আইনে যেখানে ক্রেশ, বিশ্রামকক্ষ ইত্যাদি বাধ্যতামূলক ছিল, নতুন ওএসএইচডব্লিউসি ২৪(৩) কোডে বিধি বলছে, “কেন্দ্রীয় সরকার ক্রেশের সুবিধার জন্য বিধি প্রণয়ন করতে পারে…।” এই আইনগুলি মূলত, যা আইনসভার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হওয়া উচিত ছিল তা এখন সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং সরকার ইচ্ছামত নিরাপত্তা ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন ও প্রত্যাহার করতে পারবে বা নিয়োগকর্তাদের জন্য ছাড় দিতে পারবে।

অনলাইনে অভিযোগ জমা: কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তরে শ্রমিকের অভিযোগ জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া (লিখিত বা মৌখিক) বন্ধ করে সবকিছু অনলাইন মাধ্যমে হচ্ছে – শ্রমিকের অভিযোগ, কাগজপত্র জমা, শিল্প বিরোধ সম্পর্কিত অভিযোগ জমা এমনকি সালিশি প্রক্রিয়াও অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। বিভাগীয় শ্রমকর্তারা এখন সরাসরি শ্রমিকদের সঙ্গে মুখোমুখি হন না। নিয়োগকর্তা কর্তৃক শ্রমআইন লঙ্ঘনের অভিযোগগুলি জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই শ্রম পরিদর্শকের মাধ্যমে তা পরীক্ষা করা হয়। এমনকি ইএসআই ও পিএফ অফিসগুলির নিয়োগকর্তাদের আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের উপর পদক্ষেপ গ্রহণে যথেষ্ট অনিচ্ছা দেখা যায়। উপরের কর্মকর্তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। সেজন্য এই ব্যবস্থাপনায় নিয়োগকর্তারা আইন ভাঙ্গার জন্য শাস্তির আশঙ্কায় থাকেন না।

 

শেষের কথা

অবাধ মুনাফার জন্য বৃহৎ শিল্পপতিদের লোলুপ দৃষ্টি এখন সস্তা শ্রম সম্পদের দিকে। ভারতের কর্পোরেট গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সহযোগিতায় সস্তা শ্রম করায়ত্ত করতে অতি দ্রুত সে কাজ সম্পন্ন করতে চায়। সেজন্য কর্পোরেট স্বার্থে শ্রমকোড। শ্রমিকবিরোধী শ্রমকোড ভারতবর্ষের শ্রমিকশ্রেণি তথা কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। কেন্দ্রের মোদি সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে আগামী ২০ মে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি ও সংগ্রামী ট্রেড ইউনিয়নসমূহ শ্রমকোড বাতিল সহ অন্যান্য দাবিতে দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সেদিন ধর্মঘট সফল করতে হবে। তবে একদিনের ধর্মঘট নয় এই আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে হবে।

0 Comments

Post Comment