দুটো পঞ্চাশ টাকার একটি পেয়েছে সাজ্জাদের বৌ এর কাছে। সাজ্জাদ প্রাইমারির মাস্টার, বৌটা পড়াশুনা জানা। আবি ফেতরার টাকা নেবার জন্য এসেছিলো সাজ্জাদের বাড়ি। কয়েক মাস হলো ঈদ গেছে। রোজার ঈদ, কুরবানির ঈদ, দুই ঈদের পরে কাজীপাড়া আসা হয়ে উঠেনি। কাজীপাড়ায় লতায় পাতায় যে কুটুমঘর গুলো আছে, তারা আবি বুড়ির জন্য ফেতরার টাকা রাখে, কুরবানির ছাগল গরুর চামড়া বিক্রির টাকা রাখে।
আবির তিন কুলে কেউ নেই। তিন কুলে বলা ভুল, নিজের কেউ নেই। দেওয়ের ছেলেপুলেরা আছে, তাদের নাতি নাতনি রা আছে।
সাজ্জাদের বৌ বলে - বিটি এতো দেরি করলা? ফেতরার পয়সা কি এত দিন থাকে। বছর ঘুরে রোজার সময় চলে এল্যো।
আবি হাসে। বলে - না থাকলে দিস না। থাকলে দে। আসব্য আসব্য করে আসা হল্যো না। সরকার বাস টেকার বন্ধ করি দিয়েছিলো সব। আসব্য ক্যামুন করে। কাশেমেরে বলেছিনু আমাকে ভ্যানে তুলে দে। কাশেম আসতি দিলো না। বল্যল, বাইরে যাতি হবেনা, পুলিশে ঠাঙানি দিবে।
- তা লকডাউনের সুমা কার কাছে ছিলা?
- বাড়িতেই ছিনু। কাশেম ছিলো। উর বিটি স্কুলে চাল আলু পেতো, আমাকে দিতো, রেশন থাকি পাতুক। আমার একলা পেট, কত টুকুন লাগে।
- কেন তুমার একাউন্টে টাকা ঢুকে নি?সরকার টাকা দিয়েছিলো যে সে সময়। সাজ্জাদের বৌ বলে।
- আমি অতো বুঝিরে মানিক। কাশেমই সব করে, সব জানে। কত কিছু বলে, কত কাগজ, কত কার্ড। আদার ভুটার বারধক। অতো শত বুঝিনা। যিখানে টিপ দিতে বলে দিয়ে দি। নাতি খান নিজির না হলিও খবরটুক লেয় । চাল ডাল এর খোঁজ নেয়।
আবিকে একটা আপেল খেতে দেয় সাজ্জাদের বৌ। হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বলে - বিটি রাখো। ফেতরা, চামড়ার টাকা তো শেষ। এটাই রাখো।
আপেলটা আবি না খেয়ে আঁচলের খুঁটে বাঁধে। তার সাথে টাকাটাও।
- কার বাড়িতে উঠেছো বিটি? ক দিন থাকবা?
- তশির বাড়ি উঠেছি। উর কোলে বিটা ছেলা। কদিন হুনে বিটাটার মুখ খান দ্যাখতি কলজে পুড়ে।
- বিটি এক দিন ভাত খায়ে যেও।
ব্যাগে নারকেল খান, শশা খান, টাকা গুলান এই ভাবেই কারু কারু কাছে থেকে পাওয়া। আবি সবটা যত্ন করে রাখে।
ব্যাগের এই টুকু সামগ্রী গোছাতে হিমসিম খায় বুড়ি। চোখে আবছা দেখে। কোনটা নিলো কোনটা নিলো না ভুলে যায় বার বার। এক বার পুঁটুলি করে, আবার খোলে, দেখে সব নেওয়া হয়েছে কিনা।
- ও দাদী সকাল সকাল কি হলো গো তুমার। সব যে পুঁটলায় লিয়ে লিলা। বাড়ি যাবা নাকি?
যে বৌ টি বলে তার নাম তসলিমা। সে আবি এর সম্পর্কে পুতিন হয়, আবার নাতবৌও হয়। দূর সম্পর্কের নাত বৌ।
আবি এর আসল নাম আবিদা। ভোটার কার্ডে লেখা আবিদা বেওয়া। কেউ তার আসল নাম জানে না। সামনে কেউ কেউ বলে আবি দাদি, কেউ বলে আবি বুবু কিন্তু পেছেনে সবাই বলে আবি পাগলি।
- ভুট দিতি হবে না? বাড়ি যাতি হবে।
আবিদা বলে।
- ভোট দিতি হবে মানে? ভোটে তো দিন বাকি আছে এখুনো।
- কাল যে শুননু ' ভুট দাও ভুট দাও' বুলি করত্যাছেলো। তো ভুট আসে নাই এখুনো?
- ভোট তো ভোটের মোতন আসিছে গো দাদী তাতে তুমার কি? তুমি বাড়ি যায়া কি করবা?
- ভুট দিবু না? কাশেম আজ না হলি কাল লিতে আসবে আমাকে। ভুট দিতি হবে।
ভোটার কার্ডে আবি এর বয়স লেখা সত্তর। আসল বয়স কত কে জানে! কেউ জিজ্ঞেস করলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে।
- কাশেম বুল্যতে পারবে। আমি বুল্যতে পারব না।
কাশেম তার দেওয়ের বড় ছেলের নাতি। আবি এর নিজের পেটের কেউ নাই। কোন কাল আগে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছিলো । কতো খোঁজ ! কেউ বলতে পারে না। তারপর শুরু হয় তার নৌকার জীবন। আত্মীয় কুটুমের বাড়ি ঘুরে ঘুরে দিন কাটায়। কারু বাড়িতে আঁতুর হলে তার ডাক পড়তো। বিছানায় শয্যাশায়ী হলে তার ডাক পড়তো। বিয়ে লাগলে, কেউ মারা যাবার পর খতমের অনুষ্ঠানে ডাক পড়তো। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো প্রবাদ কে সত্য করে আবি কারু ছেলেকে তেল কাজল পরাতো, কারুর হাগা মুতা পরিস্কার করতো, বিয়ে বাড়ি খতম বাড়ির বাসি তসলা মাজতো কোমর বেঁধে। এখন বয়স হয়ে আর পারেনা, আগের মতো। কিন্তু কাজের বাড়িতে আবিকে দেখলে সবাই একটু স্বস্তি পায়।
তসলিমাদের বাড়ি এসেছিলো আবি মাস খানেক আগে। ধান উঠলো, পাট উঠলো সেই সময়ই বাড়ি ধরলো খালেক। তসলিমা ছেলে কোলে নিয়ে বাড়ির কাজ আবাদের কাজ সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলো, তখনই আবি এসে পৌঁছালো তসলিমাদের বাড়ি।
- ক্যামুন আছিস বুবু, বলে তসলিমাদের বাড়িতে ঢুকতেই তসলিমা হাতে যেন স্বর্গ পেলো।
- দাদী ভুলেই গ্যাছো । বলে তসলিমা পাটী বিছিয়ে বসতে দিলো দাওয়ায়। তসলিমার কোলে আজিজ কাঁদছিলো। কোলের ঝুলে থাকা বাচ্চাটাকে আবি র কাছে বসিয়ে দিয়ে বলল - দাদী বসো তুমি। তুমার জন্য মুড়ি মেখে নিয়ে আসি।
এই ভাবে আবি থেকে যায় সবার কাছে। বিনা আমন্ত্রণে চলে আসে। বিনা আমন্ত্রণে থেকে যায়। কেউ কথা শোনায়, কেউ প্রথমে মিষ্টি কথা বলে পরে কাজ ফুরালে বলে - বাড়ি যাবা না।
ভোটের প্রচার শুরু হয়েছে। কাল ছিলো হসপিটাল মাঠে বিশাল জনসভা। আসে পাশের গ্রাম অব্দি মাইক বাঁধা হয়েছিলো। আবি এর বয়সের সাথে সাথে কানেও কম শোনে আজ কাল। তবু তার কানেও এসেছিলো -
'আমরা......
আমরা ক্ষমতাই এলে.....
বিরোধী পার্টির লোকেরা.......
তাই আমাদের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন'
আবি এতো রাজনীতি বুঝেনা। কাশেম বুঝে। কাশেম রাজনীতি করে। বড় বড় পার্টির লোকের সাথে উঠা বসা। মিটিং মিছিলে আগে থাকে। ভোট এলেই বাড়িতে তার টিকি পাওয়া মুসকিল। রাত জেগে মিটিং আর মিটিং। এই জন্য তার বৌ মুখে মুখে ঝগড়া করে - কি পাও এতো মিটিং করে! লোকে পার্টি করে দুতালা বাড়ি জমি করি নিলো, আর তুমি সেই কবে একখান জমি কিনলা, আর কিছু নেই! ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছ কেবল !
কাশেম বলে - মেয়েছেলে মানুষ, তুই কি করে বুঝবি রাজনীতির মর্ম। বাপ দাদা এর জমি। নিজের দাপে থাকতি হলে পার্টি করতি হয়। কুন বাপের ব্যাটার সাহস আছে আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতি? বলুক দেখি কলজে খুলি নিবো শালাদের।
- যত মুখে তড়পাও তত বাঘ তুমি না। আড়ালে আবডালে কত কথা বুল্যে। তুমার কানে যায় সেগুলা? শরিকরা শুনে তুমার কথা? দাপ ছিলো শ্বশুরের, তুমার লয়।
- তুই কি বুঝবি ঘরে হুনে। বাহিরে চ ধিনি, দেখবি। এম এল এ সাহেব করিমগঞ্জ বুল্যতে কাশেম শ্যাখ কেই চিনহে। আর কুনোঅ শালা তল পাবে না। এতো বড় গুষ্টির ভুট আমার হাতে। যারে দিবো সেই জিতবে।
- কত গুষ্টির নেতারে! জানিনা বুঝি। নুরনাহার বুবু বুল্যছিলো ওউর ব্যাট্যা টিকিট পাবে।
কাশেমও জানে সে কথা। বরকত শেখ দলের বাইরে হাত মেলাচ্ছে। এসব কাশেমের পিছনে লাগার জন্য। তার বাপের সাথে এক জমির মামলা চলেছিলো কুড়ি বৎসর। সেই জমির মামলা জিতেছে কাশেমরা। সেই রাগ হজম করতে পারছেনা বরকত শেখ। শোধটা রাজনৈতিক ভাবে উঠাতে চাইছে।
চোখ গুলো দপ করে জ্বলে উঠে কাশেমের। মনে মনে ফুঁসতে থাকে সে।
-দু দিনের বাচ্চা ওই বরকত। শালা হারামির বাচ্চা! পতাকা ধরতে পেতিস আমার হুকুমে। আর টিকিট পাচ্ছিস এখন! দেখে নেবো। জান কবুল, কিন্তু জিততে দেবো না।
তসলিমার স্বামী আনসারকে দেখে আবি বলে
- ভাই, কাশেম ফন কর্যছেলো? লিতে আসবি কি কিছু বুল্যছে?
- ও দাদী। ওতো তাড়া কিসের? যাবা বাড়ি, এইতো কদিন এলা। আনসার দাঁতন করতে করতে বলে।
- ভুট দিতি হবে না। আগে হুনে না গেলি ক্যামনে হবে।
- ক্যান দাদী তুমি ভুটে দাঁড়াবা নাকি? পোধানমন্তী হবা? হাসে আনসার।
- জ্বালাস না ভাই। একটা ফুন করনা কাশেম কে। কবে আসবে শুধা। না হলি আমিই বাসে টেকারে চলি যাবো।
- আচ্ছা দাদী ভুট যে দিবা তুমি জানো কুন কুন দল আছে।
- ভাই ওইর লেগে তো আগে হুনে যাওয়া লাগে। লুকমান যখন পচার করতো, রোজ সন্ধ্যা বেলায় আসি আমাকে শিখাতো। বুল্যতো ' এবার হাতে, দিবা। হাত ছাড়া কি খাতি পারবা? তাই হাতে দিবা'। আবার কাস্তে হাতুড়িতে দিতি হলি, বুলত্যো ' কাস্তে ছাড়া কি ধান কাটতি পারবা? তাই কাস্তের ছবি যিখানে দেখবা শিখানে দিবা। আবার কখুনো কখুনো আরো কুতো ছবির তে দিতি বুল্যতো। আমার কি অতো মুনে থাকেরে মানিক! আগে হুনে মুনে রাখতি হবে।
- তুমাদের উখানে তিন খান ছবি আছে ইবার। ঘাসফুল, পদ্মফুল আর খাম। তুমি কারে দিবা?
- আমি কি অতো জানিরে মানিক। কাশেম যারে বুল্যবে তাকেই দিব্যু।
ভোটার আবি বুড়ি এগিয়ে চলে।তার পোঁটলাতে বাঁধা থাকে ভারতীয় গাঁয়ের নাগরিক অধিকার।
* সহজিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত