পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কর্ণ

  • 05 February, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1142 view(s)
  • লিখেছেন : তৌফিক আলি
(১) স্টেশনের ওভারব্রিজে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকা একতাল কুয়াশার মাঝে একমুখ বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে সফিক। আজ কুয়াশাও পড়েছে তেমনি, চোখের পাতা ভিজে যায়। যেন স্বর্গে যত পাগলি বুড়ি আছে তারা সবাই তাদের ধূসর মলিন সাদা কাপড়গুলোকে একসাথে পৃথিবীর ছাদে মেলে দিয়েছে।

                           প্রায় আটটা বাজে, এখনও দশহাত দূরে থাকা ওভারব্রিজের লোহার রেলিঙগুলো স্পষ্ট নয়। যেন মনে হচ্ছে রেলের ইঞ্জিনিয়র টাকা না পেয়ে ওখানেই কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গেছে। "শালা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! নাহ্, আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে।" পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে সময় দেখে মাথা গরম হয়ে গেল সফিকের। সফিক ইসলাম, গ্রামের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, বছর আঠাশেক বয়স। কপাল ভালো এই হারাকিরির বাজারে মাসখানেক হল পোস্ট অফিসের চাকরিটা পেয়েছে। ও হল আধুনিক যুগের ডাক হরকরা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের সেই রানার। সফিকের কাজ হল ভোরে নতুনপাড়া স্টেশন থেকে পাঁচটা পোস্ট অফিসের চিঠিপত্র-পার্সেল নিয়ে কেদুলি পোস্ট অফিসে জমা করা আর দিনের শেষে ওই পাঁচটা অফিসে বুক হওয়া চিঠিপত্র-পার্সেল কেদুলি পোস্ট অফিস থেকে নিয়ে নিমতা হেড পোস্ট অফিসে জমা করা। কথাটা যত সহজে বলা গেল কাজটা মোটেই অতটা সহজ নয়, কারণ বহুবিধ। প্রথমত, এর জন্য সফিককে প্রতিদিন ভোর পাঁচটা চল্লিশের মধ্যে পনেরো কিমি পথ উজিয়ে নতুনপাড়া স্টেশনে আসতে হয়। সে প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত না থাকলে ওই পাঁচটা অফিসের কোনো চিঠিপত্র সেদিন ট্রেন থেকে নামানো হবে না, এটাই সরকারি নিয়ম। সুতরাং ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিকে সফিকের কাছে হার মানতেই হয়। দ্বিতীয়ত, ওই পাহাড়সদৃশ মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বরাদ্দ চারপাশ খোলা একটা মোটরভ্যান। তাই আবারও ঝড়-ঠান্ডা-বৃষ্টি পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। উপরন্তু ওই পাহাড় থেকে একটা পাথর, মানে একটা চিঠির ব্যাগ বা পার্সেল যদি বুক ঘষটে ঘষটে হাঁচর-পাঁচর করে এগিয়ে চলা ভ্যান থেকে পড়ে হারিয়ে যায় তাহলে ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। তাই ভ্যানে বসেও জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই, সারাটা পথ রাতজাগা কুকুরের মতো সজাগ থাকতে হয় ওকে। তৃতীয়ত, নতুনপাড়া স্টেশন থেকে কেদুলি পোস্ট অফিস ও সেখান থেকে নিমতা হেড পোস্ট অফিস--এই গোটা যাত্রাপথটা প্রায় পঁয়ত্রিশ কিমি দীর্ঘ। যার অমসৃণ ত্বকের চড়াই-উতরাই পার হতে প্রায় সবসময়ই মোটরভ্যানটার বুক থেকে দলা দলা কালো কফ বেরিয়ে আসে। সময়ের সাথে যুদ্ধে প্রায়শই যেটা বিকল হয়ে আত্মসমর্পণ করে। ফলে প্রতিদিন হেড অফিসে ফেরার সময় সফিককে চিন্তায় থাকতে হয় ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছে মালগুলো বুঝিয়ে দিতে পারবে কিনা।না পারলেই ওপরতলায় রিপোর্ট চলে যাবে। চতুর্থত, ভোর সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফেরে সে। তার আহ্নিক গতির সময়কাল প্রায় সূর্যের সমান হয়ে পড়ে। "আসি যাই মাইনে পাই"-- কথাটা তাই সফিকের ক্ষেত্রে অন্তত খাটে না। 

                         আজও সে নতুনপাড়া স্টেশনে এসে অফিসের মালপত্র বুঝে নিয়েছে। একগাদা চিঠির বস্তাগুলো এই কদিনে পরিচিত হয়ে ওঠা প্ল্যাটফর্মের এক চায়ের দোকানের সামনে রেখে দিয়ে সে নিজে ওভারব্রিজে উঠে অপেক্ষা করছে কখন তার বাহন-- মোটরভ্যানটা আসে।ওভারব্রিজে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, ওখান থেকে স্টেশনের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা অনেকদূর অব্দি দেখা যায়। তাই ওখানে দাঁড়ালে মোটরভ্যানের আগমন কিছুটা আগে থেকে নজরে আসে আরকি। তার অপেক্ষার দৈর্ঘ্য কিছুটা অন্তত কমে।

                         আরো প্রায় মিনিট কুড়ি পরে সফিকের মনস্কামনা পূর্ণ হল। সে দেখল মোটরভ্যানের কালো ধোঁয়া সাদা কুয়াশার সতীত্ব হরণ করতে করতে এগিয়ে আসছে। শীত পড়ার পর থেকে ওর প্রাত্যহিক জীবনে এখন দুটি ইচ্ছা খুব প্রবল হয়ে উঠেছে। যার একটা জাগতিক আর একটা মহাজাগতিক। একটা গাছের যেমন জল-আলো পাওয়ার তীব্র আকুতি, ঠিক তেমনি ওর ক্ষেত্রে কখন মোটরভ্যান আসবে ও কখন একটু সোনার বরণ রোদ উঠবে-- এই দুটো চাহিদাই এখন অগ্রাধিকার পেয়েছে জীবনের অন্য সবকিছুর তুলনায়।আজ এইমাত্র মোটরভ্যানের কালো ধোঁয়ার চাদরটা দেখামাত্র তার জাগতিক ইচ্ছাটা পূরণ হল। টকটকে লাল সূর্যটা না ওঠা পর্যন্ত মহাজাগতিক ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে যাবে। 

                          সফিক অত্যন্ত দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে প্ল্যাটফর্মে নেমে এল। প্রায় সাড়ে আটটা বাজতে চলল, সেই সাড়ে পাঁচটা থেকে অপেক্ষা করছে সে। এর আগে খুব দেরি হলেও মোটামুটি সাড়ে সাতটার মধ্যে মোটরভ্যানটা চলে আসত। আজকের মতো দেরি কোনোদিন হয়নি।বিরক্তিতে, রাগে ওর নিঃশ্বাস গরম হয়ে গেল। মোটরভ্যানের চালক গোপালদা কাছে আসতেই সফিক ঝাঁঝিয়ে উঠল, "আপনার কোনো ধারণা আছে এই ঠাণ্ডায় এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হলে কেমন লাগে? খালি বয়সটাই হয়েছে, আক্কেল কবে হবে বলুন তো? এমন চলতে থাকলে আমি কিন্তু কমপ্লেন করতে বাধ্য হব।" স্টেশনের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গ্যালপিং ট্রেনের মতোই একতোড়ে কথাগুলো সফিকের মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

                          যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে ততক্ষ্ণণে ধীরেসুস্থে একটা বিড়ি ধরিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে চিঠির বস্তাগুলো নিয়ে ভ্যানে তুলতে শুরু করেছে। গোপালদার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। গায়ের রঙ মিশমিশে কালো, ছোটখাটো একটা গরিলার মতো চেহারা। মাথায় ভারি মাল বয়ে বয়ে গলাটা যেন বেমালুম উবে গেছে, ধড়ের পরই শুরু হয়েছে মাথা। হাত-পাগুলো মোটা মোটা, থপথপিয়ে হাঁটে। আঙুল, ঠোঁট, নাক আর হ্যাঁ বুদ্ধিও অস্বাভাবিক রকমের ভোঁতা। সফিক কোথায় যেন পড়েছিল যাদের আঙুল, নাক ভোঁতা হয়, ঠোঁট পুরু হয়-- তারা বুদ্ধিতে একটু খাটো হয়। গোপালদাকে চেনার পর থেকে এই কথাটা নিয়ে সফিকের মনে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। লোকটা অসুরের মতো খাটতে পারে। প্রায় কুড়ি বছর পোস্ট অফিসের চিঠি-পার্সেলের বস্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছেন, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে। না, তিনি পোস্ট অফিসের স্থায়ী কর্মচারী নন। সফিক শুনেছে মোটরভ্যানটা মাত্র তিন-চার বছর আগে কেনা। তার আগে প্রায় পনেরো-ষোলো বছর গোপালদা প্যাডেল ভ্যান নিয়েই এই দীর্ঘ পথের বুকের গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগোতেন। লোকটা তাঁর নামের চেয়েও সরল। সর্বদা মুখে একটা হাসি ঝুলেই রয়েছে যা দেখলে যে কোনো আধুনিক জটিল মনই হিংসায় জ্বলে যেতে পারে। এত অভাব-পরিশ্রম-না পাওয়া নিয়েও এইলোকগুলো কি করে যে বুকের গোপন কুঠুরি অব্দি দেখা যায়-- এমন হাসি হাসতে পারে, সেটা নিয়েই গবেষণা হওয়া উচিত, মঙ্গলে যান পাঠানোর আগে।

-- নাও গো, একটা বিড়ি ধরাও। ঠান্ডায় আজ হাড়ের ভেতর যেন সুঁই ফুটে গেল। ভ্যানে মাল তুলতে তুলতে মাঙ্কি ক্যাপের ভিতর থেকে শামুকের মতো করে মুখটা বার করে হাসতে হাসতে বললেন গোপালদা। 

-- আপনার এখনও হাসি পাছে? গোপালদার হাসি দেখে আরো চড়বড়িয়ে উঠল সফিক।

-- জ্যাকেট-ম্যাকেট এট্টা কিছু আর না কিনলি হবেনা মনে হচ্চে। এই যেটা পরে আছি এটা সাত বছর আগে দিয়েল অনির্বাণবাবু। তুমার আগের আগে এখানে যে কাজ করত। এতে আর জাড় ভাঙছে না। তাই ভাবলাম এট্টু দেরিতি বেরোই ততক্ষণে রোদ উঠলি ঠান্ডাটা এট্টু কমবেখুনি। তা সুমুন্দির রোদ তো উঠলই না, খামোখা দেরি হয়ে গেল। 

                             এতক্ষণে খেয়াল হল সফিকের। তাকিয়ে দেখল গোপালদা শীত তাড়ানোর জন্য যেটা পরেছেন সেটাকে এককালে উইন্ডচিটার বলা গেলেও এখন সেটা একটা পাতলা প্লাস্টিক ছাড়া কিছুই না। তার আবার কত জায়গা দিয়ে যে গোপালদার ভিতরের জামা দেখা যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সামনের চেনটা কোনোরকমে সেফটিপিন দিয়ে জোড়াতালি দেওয়া। ভীষণ খারাপ লাগল সফিকের। অনুশোচনা হল তার বাবার বয়সী একটা লোককে এত কড়া কড়া কথা বলার জন্য। সে নিজে জ্যাকেট-সোয়েটার-টুপি-মাফলার-জুতো পরেও এতক্ষণ ঠকঠক করে কাঁপছিল। অথচ গোপালদাকে একটা ফিনফিনে উইন্ডচিটার পরে প্রবল ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে মোটরভ্যান চালিয়ে আসতে হয়েছে। কষ্টটা অনুভব করে অনুশোচনায় আরো কুঁকড়ে গেল সে। যদিও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তার এই অনুশোচনা যুক্তিহীন।কারণ এরপর অফিসে লেট হলে তার নামের পাশেই লালকালি পড়বে, গোপালদার নয়। কিন্তু সফিকের মনটা গ্রামের মাটি দিয়ে তৈরী, তাতে এখনও পদোন্নতির ইঁদুর দৌড়ের ইঁদুরগুলো গর্ত খুঁড়তে পারেনি। সে মনে মনে ঠিক করল গোপালদাকে একটা উইন্ডচিটার কিনে দেবে।

-- কই গো নাও। বিড়িটা ধরিয়ে চটপট ভ্যানে বসো। এরপর তো আরো দেরি হয়ে যাবে।

-- হ্যাঁ হ্যাঁ কই দিন দেখি, একটু গরম হয়ে নিই। গোপালদার কথায় সম্বিৎ ফিরল সফিকের। মোটরভ্যান স্টার্ট করার সময় এবং মাঝে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চা-বিস্কুট খাওয়ার পর-- এই দুবার দুজনে একটা করে বিড়ি খাবে এটাই নিয়ম হয়ে গেছে।সফিক আগে বিড়ি খেত না। এই দুমাসে গোপালদার সাথে থেকে বদঅভ্যাসটা তৈরী হয়েছে ওর। "চলুন একটু টেনে চলুন। আজ দেখি আপনার ভ্যানের দৌড় কতদূর।" বিড়িতে একটা টান দিয়ে ভ্যানের সামনে উঠতে উঠতে বলল সফিক।

                 প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর কুয়াশাটা একটু কমল, হালকা রোদও উঠেছে। ভ্যানের সামনে জবুথবু হয়ে বসে আছে সফিক, আর মাঝে মাঝেই পিছনে তাকিয়ে গুনে নিচ্ছে সবকটা বস্তা আছে কিনা। নাহ্ এর মধ্যেও মাঝে-মাঝেই চোখ জড়িয়ে আসছে ওর। এইভাবে চলাটা বিপজ্জনক, যখন-তখন ভ্যান থেকে পড়ে যেতে পারে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটা ফাঁকা জায়গায় চায়ের দোকান দেখে ভ্যানটা দাঁড় করালেন গোপালদা। এখনও প্রায় মিনিট কুড়ির রাস্তা।

-- কই নামো, একটু চা খেয়ে নিই চলো।

-- উফ্ আপনি একদম মনের কথা পড়ে ফেলেন কি করে বলতে পারেন? একটু চা না পেলে চাঙ্গা হতে পারছি না। ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে নামল সফিক। মাফলার-টুপি-গ্লাভস খুলে সূর্যের দিকে চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে কিছুক্ষণ সেঁকে নিল নিজেকে।

                 দুজনেই রোদে বসে চা-বিস্কুট খেল। এই চায়ের দামটা বরাবর গোপালদাই দেন। সফিক প্রথম প্রথম খুব বাধা দিত, এখন দেয় না। ও খেয়াল করেছে আয়েশ করে বসে চা খাওয়ার পর  গোপালদার মেজাজটা কেমন শরিফ হয়ে যায়। এই দু'কাপ চায়ের দাম দোকানিকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এমন একটা মনোভাব কাজ করে যেন টাকা-পয়সাটা একটা অচ্ছুৎ ব্যাপার ওঁর কাছে। ওসব কাছে থাকা মানে আপদ। গোপালদা ওই দুটো চায়ের দাম এমনভাবে দেন যেন ধনতান্ত্রিক সমাজের মুখে টাকাটা ছুঁড়ে মেরে বলেন-- এই নে তোদের টাকা। আরো বড়ো প্রাসাদ বানা, আরো বড়ো গাড়ি চড় শালারা। আমার তাতে কিস্যু আসে যায় না।

                 সফিক আরো একটা বিষয় খেয়াল করেছে। গোপালদা যেখানে থাকেন সেই গ্রামের ওপর দিয়েই কেদুলি পোস্ট অফিসে যেতে হয়। তো যখনই ওদের ভ্যান গোপালদার গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়ে, গোপালদার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়। সেইসাথে ভ্যানের গতিও যায় বেড়ে। যেন সবাইকে বলতে চান, তিনি ও তাঁর ভ্যানের কর্মক্ষমতা নিয়ে যেন কেউ প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা না দেখায়। ওই অঞ্চলের অন্যান্য ভ্যানচালকদের তাকানো দেখলেই বোঝা যায় যে তারা গোপালদাকে ঈর্ষা করে। আর সেটা গোপালদা চেটেপুটে উপভোগ করেন। অন্য ভ্যানচালকরা হয়ত গোপালদার চেয়ে বেশি উপার্জন করে, কিন্তু গোপালদার যে একটা বাঁধা আয় রয়েছে, তিনি যে সরকারি বাবুদের মতো রোজ টাইমে অফিস যান-আসেন-- এই ব্যাপারটা অন্যদের কাছে যথেষ্ট ঈর্ষণীয় ছিল। একদিন এনিয়ে সফিক তাঁকে বলেছিল, "আপনি তো সকালে পোস্ট অফিসের মাল নামিয়ে তারপর অন্যদের মতো প্যাসেঞ্জার বইতে পারেন। এরপর তো আপনাকে আবার সেই বিকেলে অফিসে আসতে হবে। এতক্ষণ বসে না থাকলে দুটো পয়সা বেশি আয় হয় তো?" 

-- আরে ধুর ধুর। প্যাসেঞ্জারের জন্যি হা করে পথ চেয়ে বসে থাকতি পারব না। তারপর ওই ভাড়া নিয়ে খ্যাচর-ম্যাচর, ওসব আমার একদম পুষায় না। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দিয়েছিলেন গোপালদা। বোধহয় এতদিন সরকারি বাবুদের সাথে থেকে, তাদের নিঃশ্বাসের ঝাপটায় গোপালদার চামড়াতেও আলসেমির পুরু স্তর জমে গেছে।

                       পকেট থেকে মোবাইল বার করে সময় দেখে আঁতকে উঠল সফিক, "সর্বনাশ! আরে উঠুন উঠুন। আজ আর পোস্ট মাস্টারের ধাতানি থেকে রেহাই পাব না মনে হচ্ছে।"

-- অত উতলা হয়ো নাকো। সবই তো পরের খাতায় জমা হয়ে গেল। নিজের পকেট থেকে যদি পাঁচটা মিনিট বেশি খরচ করতি না পারলাম তায়লে আর এত খাটাখাটনি কোন সুমুন্দির জন্যি? স্বপক্ষে অকাট্য যুক্তি সাজিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসলেন গোপালদা। হাসিটা আচমকা থেমে গেল। রাস্তার পাশে একটা মাঝারি উচ্চতার কুলগাছ, তার ঠিক পাশ দিয়েই রাস্তার সমান্তরালে দশ-বারো ফুট গভীর একটা খাদ চলে গেছে। বর্ষায় খোলস পালটিয়ে যেটা নয়ানজুলির রূপ নেয়। কুলগাছটা অন্ধের মতো হামা দিতে দিতে ওই খাদের দিকেই এগিয়েছে। ফলে এখন সেটা খাদের উপর প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে।গাছটার কচি ডালগুলোতে একটা সিমগাছ পরম নিশ্চিন্তে সংসার পেতেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সিম হয়েছে, যা টুনি বাল্বের মতো কুলগাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি মারছে। সিমগুলোর ভরন্ত শরীর দেখে গোপালদার চোখ চকচক করে উঠল। সিমগুলো পাড়তে এগিয়ে গেলেন তিনি। 

-- আরে করছেন কী? গাছের সিম তো আর পালাবে না, কাল পেড়ে নেবেন। আজ আর দেরি করা ঠিক হবে না। প্রায় অনুনয়ের সুর সফিকের গলায়। 

-- হাতের লক্ষ্মী যেমন পায়ে ঠেলতি নেই, তেমনি অন্নকেও অবহেলা করতি নেই ভায়া। বলেই শিকারি বিড়ালের মতো গোপালদা নিজের ভারি শরীরটা নিয়ে হাঁচোর-পাঁচোর করে গাছে উঠতে লাগলেন। 

                         এরপরের দৃশ্যটা সফিক কোনোদিন ভুলতে পারবে না। বেঁটে-মোটা-কালো-আধবুড়ো একটা লোক দীর্ঘদিনের অনভ্যাস সত্ত্বেও গাছে উঠছে। যখন দুইহাত-দুইপা দিয়ে ডাল ধরে শরীরটা নীচে ভাসাচ্ছে তখন দেখতে প্রায় শিম্পাঞ্জীদের আত্মীয়দের মতোই লাগছে। সফিক কিছুক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা করেও আর পারল না, ওর পেট থেকে ভকভক করে প্রবল বেগে হাসি বেরিয়ে এল। তা দেখে গোপালদাও অমন ঝুলে থাকা অবস্থাতেই হাসতে লাগলেন। দুজনের হাসিতেই কোনো খাদ নেই। এইসময় গোপালদা আরো দূরের ডালে পা দিয়ে যেই সিম ধরতে গেছে অমনি মট্ করে কুলের ডাল ভেঙে নীচে পড়ে গেলেন। সফিক ত্রস্ত পায়ে খাদের ধারে গিয়ে নীচের দিকে দেখল। কিছুক্ষণ পর সারা গায়ে সিমের লতা জড়ানো অবস্থায় একমুখ হাসি নিয়ে গোপালদা যখন খাদ থেকে উঠে এলেন, তখন তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী পক্ষের কোনো এক ক্যাপ্টেন। শরীরের অনেক জায়গায় কুলকাঁটা ফুটে আছে, কোথাও ছড়ে গিয়ে রক্ত বার হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ওই সিমগুলো দিয়ে যে একবেলার তরকারির অভাব মিটবে এটাই তখন গোপালদার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। আসলে এই মানুষগুলোর মজ্জাতে একটা বিষয় ঢুকে গেছে যে, ওদের কিছু পেতে গেলে ঘাম বা রক্ত-- দুটোর একটা অন্তত ঝরাতেই হবে।

 

                                       (২) 

-- সফিক একটু এসো তো। একদিন পর পোস্ট মাস্টারের ঘরে ডাক পড়ল সফিকের। 

-- হ্যাঁ স্যার বলুন। পোস্ট মাস্টারের ঘরের পাশেই সফিকের টেবিল। ডাক শুনে দ্রুত তাঁর ঘরে উপস্থিত হল সে। 

-- এই নাও তোমার চিঠি। গত পরশু তোমার জন্য পাঁচটা অফিসের চিঠি-পার্সেল বিলিতে দেরি হয়েছে, তার শো-কজ করেছেন বড়ো সাহেব।

-- কিন্তু স্যার এর জন্য কি আমাকে দোষ দেওয়া যায়? আপনি তো সবই জানেন যে গোপালদা প্রায়ই সময় মতো স্টেশনে হাজির হন না বলেই এই সমস্যা। যার জন্য আমাকেও ভুগতে হয়।

-- সে আর আমাকে বলে কি হবে। আমার জানা বা না জানায় তো কিছু হবে না। সাহেবের চিঠির উত্তরটা অন্তত সময় মতো দিও নাহলে আমাকেও ফাঁসতে হবে। ফাইলে মুখ ডুবিয়েই কথাগুলো শেষ করলেন পোস্ট মাস্টার। 

                            সফিক বুঝতে পারল এবার জল তার নাকের উপর দিয়ে বইছে। সুরাহা না হলে শীঘ্রই হাবুডুবু খেতে হবে। সত্যিই সেদিন খুব দেরি হয়ে গেছিল। গোপালদার সিম পাড়া দেখে এমন ছেলেমানুষি চেপে বসেছিল যে ঘড়ির কাঁটার যান্ত্রিক অগ্রগমনও সফিককে সচেতন করতে পারেনি।

--তাহলে এখন কী করা যায় স্যার? 

পোস্ট মাস্টার খুশি হলেন, বললেন, "যাও ইউনিয়নের দাদাদের গিয়ে ধরো। এযাত্রায় তোমার বৈতরণী পারলে ওরাই পার করতে পারবে।" 

-- আচ্ছা স্যার, তাহলে তাই করি। বলে পোস্ট মাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সফিক।

                            ব্যাপারটার সুরাহা হবে ভেবে আনন্দ পাওয়ার বদলে আরো বিমর্ষ হয়ে পড়ল সে। আসলে ও বরাবরই রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চায়, তা সে ছাত্র রাজনীতিই হোক বা কর্মক্ষেত্রে ইউনিয়নের রাজনীতি। এর ফল অবশ্য তাকে ভালোই ভুগতে হচ্ছে। চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর থেকেই ডান-বাম সবপক্ষ থেকেই তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল দলের সদস্যপদ গ্রহণ করার জন্য। সফিক রাজি হয়নি। বলা যায় সেই আক্রোশ থেকেই তাকে এমন একটা কঠিন জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনার পর সফিক বুঝতে পেরেছিল পৃথিবীতে এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে নিরপেক্ষতা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে প্রতিকূল স্রোতের মতো কাজ করে। কোনো একটা পক্ষ নিলে অন্তত একটা দিক থেকে শত্রুতা বন্ধ হবে -- এটা ভেবে একরকম বাধ্য হয়েই অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ইউনিয়নটির সদস্যপদ গ্রহণ করেছিল সে। যদিও তাতেও শান্তি নেই। ইউনিয়নের যে কোনো ধর্না-বিক্ষোভে চেয়ার-মাঠ ভরানোর জন্য তার মতো অসংখ্য সফিককে প্রয়োজন নেতাদের। অথচ সে প্রায় কোনো কর্মসূচীতেই অংশ নেয় না। তাই সে সহজে ইউনিয়নের দাদাদের মুখোমুখি হতে চায় না, কারণ দাদারা তার মতো বেয়াড়া ভাইদের 'সর্বদা সঠিক পথে' আনার জন্য নির্দিষ্ট অনুপানে বকাঝকা দিতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বড়ো সাহেবের বড়ো হাতের নাগাল এড়াতে নেতাদের লম্বা জিভের মুখোমুখি হওয়াই শ্রেয় বলে মনে করল সফিক। ঠিক করল সেইদিনই সন্ধ্যাবেলা ইউনিয়ন অফিসে যাবে।

 

-- কি হে ভায়া, মুখখানা অমন গম্ভীর কেন? বিকেলে মোটরভ্যানে মাল তুলতে তুলতে প্রশ্নটা করলেন গোপালদা। 

-- বড়ো সাহেব এত্তেলা পাঠিয়েছেন। এখন চাকরিটা থাকলে হয়। আপনার আর কি? গম্ভীর মুখে বলল সফিক।

-- অত ঘাবড়ালে হবে? নাও বিড়ি ধরাও একটা। অমন কত বড়ো সাহেব এল-গেল।

-- ইউনিয়নে যাব আজ। দাদারা কি বলে দেখি। বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল সফিক।

-- পেট দিয়েছে যে, পেট ভরাবে সে। আমার ভ্যান খুব পয়া গো। এখনও কারো ভাত কাড়েনি।চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে।

 

                                      (৩)

 

                             ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর সময় নষ্ট না করে পার্টির অফিস রুমের দিকে এগিয়ে গেল সফিক। সেখানে তখন নানা মাপের নেতাদের নিয়ে মিটিংয়ে ব্যস্ত ইউনিয়ন সেক্রেটারি গৌতম বিশ্বাস। যার দাপটে যে কোনোদিন জেলার যে কোনো ডিভিশনের সব পোস্ট অফিসে ধর্মঘটের তালা ঝুলে যায়। 

-- দাদা আসব?

-- সফিক? এসো এসো, বলো সব ঠিক আছে তো? ভুরু কুঁচকে মোলায়েম অথচ ঠান্ডা গলায় প্রশ্নটা ভেসে এল গৌতমদার কাছ থেকে। সবার কৌতূহলী দৃষ্টিতে অস্বস্তিতে পড়ে গেল সফিক।

-- দাদা বড়ো সাহেব শো-কজ করেছেন। আপনাকে তো আগেও বলেছি গোপালদার জন্য প্রায়ই লেট হয়ে যায়। গত পরশু একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছিল। এখন কি করব বুঝতে পারছি না।

-- ওহ্ এই ব্যাপার! হিমাংশু, সফিকের সমস্যাটা একটু দেখো তো। গলা উঁচিয়ে পার্টি সভাপতি হিমাংশু হালদারের দিকে সমস্যাটা ঠেলে দিলেন তিনি।

                              হিমাংশু হালদার তখন ঘরের এক কোণের দিকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইউনিয়নের অপর এক কর্মীর সাথে পরামর্শে মগ্ন। সফিক অত্যন্ত সঙ্কোচের সাথে তাঁর কাছে গেল, "দাদা একটু কথা বলা যাবে?" হিমাংশুবাবু ওর দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত না করে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে নিজেদের আলোচনাকেই প্রাধান্য দিলেন। সফিক ভাবল দাদা  বোধহয় শুনতে পাননি। তাই সে আবারও বলল, "দাদা একটু কথা ছিল।" এবার দাদার কৃপাদৃষ্টি মিলল, "এখন তো হাতে একদম সময় নেই সফিক। তুমি বরং এক কাজ করো রাতের দিকে ফোন কোরো।" 

                              পরদিন হিমাংশুবাবুর বলে দেওয়া বয়ান অনুযায়ী সফিক বড়ো সাহেবের দপ্তরে শো-কজের উত্তর পাঠিয়ে দিল। যে চিঠিতে গোপালদা ও তাঁর ভ্যানকে ঢাল করেই সফিকের দিকে ধেয়ে আসা যাবতীয় প্রশ্নবাণকে ভোঁতা করে দিয়েছেন হিমাংশুবাবু। যে চিঠির প্রতিটি ছত্রে উল্লেখ ছিল কিভাবে গোপালদা ও তাঁর ভ্যান পোস্ট অফিসের প্রাত্যহিক কাজকর্মে নিয়মিত ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

                              আগের দিন রাতে হিমাংশুবাবু যখন ফোনে চিঠির বয়ান বলে দিচ্ছিলেন তখন সফিক অনুচ্চ গলায় বলার চেষ্টা করেছিল যে, গোপালদার বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে অন্য কোনোভাবে বিষয়টা ম্যানেজ করা যায় কিনা। কারণ সে আঁচ করতে পারছিল এর ফল গোপালদার পক্ষে ভয়ংকর হবে। জবাবে ফোনের ওপ্রান্ত বলেছিল, "রথের চাকা বসে গেছে সফিক, কর্ণকে যে বলি দিতেই হবে!"   

 

                                        (৪) 

                               আজ সকাল থেকে সফিকের মনটা বেশ ফুরফুরে। বহুদিন পর, তা প্রায় বছর দশেক তো হবেই, সে কেদুলি পোস্ট অফিসে যাচ্ছে। না ঠিক ঘুরতে যাচ্ছে না, অফিসের কাজেই যেতে হচ্ছে। এখন সে সিস্টেম অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে কর্মরত। বিভিন্ন পোস্ট অফিসের কম্পিউটারে সফটওয়্যার-হার্ডওয়্যারে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধানে সফিকের ডাক পড়ে। আজ কেদুলি পোস্ট অফিসের কম্পিউটারের রোগ সারাতেই তার এই যাত্রা। প্রায় দশ বছর আগে কেদুলি পোস্ট অফিসে থাকাকালীন যে ইন্টার-ডিপার্টমেন্টাল প্রোমোশনের পরীক্ষাটা দিয়েছিল, তাতে পাশ করেই তার এই পদোন্নতি। সমাজে এখন তার স্থান বেশ উঁচুর দিকেই। পুরনো সহকর্মীদের দেখা পাওয়া ও নিজের উজ্জ্বল বর্তমানকে তাদের দেখানো-- এই দুই রাসায়নিকের সংমিশ্রণে তার মনের ল্যাবরেটরিতে সকাল থেকেই উত্তেজনার বুদবুদ ফুটে চলেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ যত না নিজে ভালো থাকার জন্য উপার্জন করে তার চেয়ে অন্যের চোখে নিজে ভালো আছি এটা দেখানোর জন্য উপার্জন করে বেশি।

                               বেলা প্রায় এগারোটা, কেদুলি পোস্ট অফিসের সামনে পৌঁছল সফিক। অফিসে ঢোকার আগে একটা সিগারেটের জন্য মনটা আনচান করে  উঠল ওর। পকেট-ব্যাগ হাতড়েও সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে পেল না ও। সকাল থেকে আনন্দে-উত্তেজনার বশে সিগারেটের প্যাকেটটাই বাড়িতে ভুলে রেখে এসেছে। সফিক নিজের ওপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে আশেপাশে চোখ বোলাতে লাগল সিগারেটের দোকানের সন্ধানে। পেয়েও গেল, রাস্তার ঠিক উলটো দিকেই 'গোপাল টি স্টল' লেখা সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল।সাইনবোর্ডটা দেখেই তার গোপালদার কথা মনে পড়ে গেল। মনে মনে হেসে ফেলল সে। গোপালদাই ছিলেন তার ধূমপানের শিক্ষাগুরু। গোপালদার তেতো বিড়ি থেকে আজ সিগারেটে উত্তরণের অনুভূতিটাকে সে মনে মনে একবার চেখে নিল। বহুদিন পর আজ গোপালদার সাথে দেখা হতে পারে ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছে ওর। সত্যি, একটা মানুষের জীবনের পলিতে যে কতজনের ছাপ পড়ে যায় তা বোধহয় কেউই জানতে পারে না। 

-- এক প্যাকেট সিগারেট দিন তো মাসি। দোকানে বসে থাকা ক্ষয়াটে বুড়ির উদ্দেশ্যে বলল সফিক।

-- এক কাপ চা দিই বাবু? বুড়িটা সফিককে জিগ্যেস করল।

-- চা? হ্যাঁ তা পেলে মন্দ হয় না। দিন দেখি, একেবারে চা খেয়েই ঢুকব তাহলে।

-- এই রোদি বাইরি না থেকে ভেতরে বেঞ্চিতে বসুন না, এক্ষুণি দিচ্ছি।

                                সফিক দেখল কথাটায় যুক্তি আছে। সে ভিতরে ঢুকে বসল। আর পাঁচজন খদ্দেরের ছাড়া বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে আছে। এঘরে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। সে ইতিউতি চেয়ে দেখতে লাগল।হঠাৎ দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবিতে তার চোখ আটকে গেল। "গোপালদা না?" নিজেকেই যেন জিগ্যেস করল সফিক। কয়লার উনুনের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে উত্তর ভেসে এল, "হ্যাঁ বাবু। আমার মালতীর বাবা। আপনি ওরে চিনতেন?" 

-- পোস্ট অফিসে কাজ করতেন না? সফিকের গলাটা কেমন ঠান্ডা হয়ে এসেছে।

-- হ্যাঁ বাবু। দশ বছর আগে কাজ থেকে ছাঁটাই হয়ে গেসল। তারপর থেকেই তো মানুষটা কেমন যেন হয়ে গেল। তা আপনি ওরে কি করে চিনতেন?

-- আ-আমি? হ্যাঁ-হ্যাঁ চিনতাম চিনতাম, খুব ভালো করে চিনতাম। তারপর কি হয়েছিল ওঁর? সিগারেটে দ্রুত কয়েকটা টান দিতে দিতে কোনোরকমে কথাগুলো শেষ করল সফিক। নিজের অজান্তেই ঘামতে শুরু করেছে সে। 

-- তারপর আর কি! মেয়েডারে বিয়ে দিতি অনেক ধারদেনা হয়ে গেল। আমি বললাম লাইনে ভ্যান নিয়ে দাঁড়াতি, যা দু-দশ ট্যাকা হয়। পেত্থমে তো কিছুতিই রাজি হচ্চেল না। তারপর যাও বা রাজি হল তা মুখপোড়াদের কথার ঠেলায় সেকাজ বেশিদিন করতি পারল না। 

-- মানে? 

-- মানুষটা অন্য ভ্যানওয়ালাদের টিটকিরি কিচুতিই সহ্যি করতি পারত না। ওরা মালতীর বাপরে দেখলিই 'অপিসির বড়োবাবু' বলে খোঁচা মারত। লোকটা চিরডাকাল অপিসির বাবুদের সাথে মাথা উঁচু করে কাজ করেচে। একন ওই হারামজাদাগুলোর অপমান সইবে কী করে? পতিদিন সন্দেবেলা যকন বাড়ি ফিরত দেকতাম দুচোখ লাল হয়ে আছে। তারপর থেকেই মানুষটা কেমন আলাভোলা হয়ে গেল। তা বাবু বললেন না তো আপনি ওরে কী করে চিনতেন? সফিকের পাশে চায়ের গ্লাস রেখে থামলেন গোপালদার স্ত্রী।

                               নিভন্ত উনুনের ছাইয়ে খোঁচা দিলে যেমন আগুনের ফুলকিগুলো তড়াক করে ছোবল মারতে চায় ঠিক তেমনি করে কিছু ধারালো স্মৃতি সফিকের মস্তিষ্ক চিরে বেরিয়ে আসতে চাইল। এক লহমায় দশ বছর আগের সেই শো-কজের চিঠি-তার বয়ান-কর্ণকে বলি দেওয়ার উপদেশ-- সব সব মনে পড়ল সফিকের। প্রোমোশন পেয়ে কেদুলি পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পর তারই চিঠির অভিঘাতে গোপালদার কাজ গেছে, এটা ভেবেই ওর কান-মাথা ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। ফাঁপা গলায় সে শুধু বলতে পারল, "আমি সফিক। বছর দশেক আগে গোপালদার সাথে পোস্ট অফিসের মাল নিয়ে আমিই যাতায়ত করতাম।"

                               নামটা শুনেই বুড়ির মুখে যেন হাজার প্রদীপের আলো খেলে গেল।

-- বাবা তুমিই সফিক? শেষদিকে উনার মুখে তো শুধু তুমার কথাই শুনতাম। খালি বলত, "সফিক খুব ভালো ছেলে, খুব ভালো।" যকন লোকটা আলাভোলা হয়ে গেল তকন সারাক্ষণ তুমার দুয়া জ্যাকেটটাই পরে থাকত। গরমে খুলে দিতি গেলিই দাঁত খিঁচিয়ে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসত। বলত, "সফিক আমার ভালো ছেলে। ওর দিকি হাত বাড়ালি হাত ভেঙে গুঁইড়ে দোব।" তুমি যেদিন যেদিন সবজি কিনে পাঠাতে সেদিন খেতি বসি চোখ বড়ো বড়ো করে বলত-- "সফিককে পেটে ধরোনি তো কি, দেকেচ ওপরআলা ঠিক এট্টা ছেলে পেইটেচে আমাদের।" খুব ইচ্চে ছেল তুমারে দেখার। ঠাকুর আজ আমার সেই সাধ পূরণ করে দিল।চোখের কোণের চকচকে জলে কথা শেষ হল গোপালদার স্ত্রীর।

                               হঠাৎ সফিকের মনে হল উনুনের-বিড়ি-সিগারেটের একরাশ নীলচে ধোঁয়ার মাঝে সে পথ হারিয়ে বসে আছে। কয়েকফুট দূরের দেওয়ালও ঠিকমতো চোখের নাগালে আসছে না। আচমকা ঘরের দেওয়ালগুলো যেন দুমড়ে-মুচড়ে মোটরভ্যানের রূপ নিল। ভ্যানের কালো ধোঁয়ায় সফিকের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফটোফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে গোপালদা ভ্যানের চালকের আসনে বসলেন, "আরে ভায়া ওঠো ওঠো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।" সফিক সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে সজাগ করে একলাফে ভ্যানে ওঠার চেষ্টা করল। পারল না, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। পড়ার আগে এক লহমায় শুধু দেখতে পেল ভ্যানটা তীরবেগে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গোপালদার জ্যাকেটটা রক্তে ভেসে গেছে। পিঠে একটা কলম ছুরির মতো আমূল গেঁথে রয়েছে। 

 

0 Comments

Post Comment