আজ যে কি মনে হল ছেলে-বউয়ের ঘরে এসে ঢুকলেন। ঢুকেই চোখ পড়ল ড্রেসিংটেবিলটার দিকে। ইস্ কি করে রেখেছে সামনেটা। পারফিউমের ঢাকনা খোলা, ক্রিমের শিশিটা গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে, চিরুনিটা নোংরা। সময় পায় না মেয়েটা। অফিস করে, দুষ্টু ছেলেটাকে সামলাতেই হিমসিম খায় চন্দ্রিমা। মনে মনে মায়া হল নিশিতারার। নিজেই ঝাড়ন নিয়ে লেগে পড়লেন ড্রেসিংটেবিল গোছাতে। সবকিছু নামিয়ে মুছে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে গিয়েই তার চোখ পড়ল ওটার ওপর। পেন কেন ড্রেসিংটেবিলে? এ নিশ্চয় নাতিটার কাজ। আপন মনেই গজগজ করলেন নিশিতারা। আজ আসুক দাদুভাই, খুব বকবেন। কোনো জিনিস ঠিক জায়গায় রাখতে শিখছে না। ঢাকনা খুলে বাতিল পেন কিনা দেখতে গিয়ে চমকে উঠলেন নিশিতারা। এ যে কাজল! কাজল পেন্সিলটা হাতে ধরে বৃদ্ধার মন চলে গেল সেই কিশোরী বেলায়। ছুটছেন নিশিতারা, চোদ্দ বছরের কিশোরী। মাথায় লালফিতে বাঁধা বেনীদুটো দুলছে। সর্ষেক্ষেতের আল ধরে করিমচাচার বাগানের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে প্রজাপতির মতো এক মেয়ে। পেছনে পেছনে মকবুল চাচার ছেলে উজান। পাল্লা দিয়ে ছুটছে দুজনে। আর একটু হলেই ধরে ফেলবে। কিন্তু নিশাত যেন ছুটে নয় উড়ে চলেছে।" নিইইইশাআআআত, নিইইইশাআআআত "। নিশিতারাকে ওই নামেই ডাকতো উজান। ছুটতে ছুটতে দুজনে এসে পড়লো ফারুকদের আমবাগানটায়। সবচেয়ে মোটা আমগাছটার আড়ালে দাড়িয়ে আমগাছে ঠেস দিয়ে হাঁপাতে লাগল নিশিতারা। এখন নিশ্চিন্ত। খুব কষ্ট না করলে আর কেউ তাদের দেখতে পাবে না। যেন গোটা পৃথিবীটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। উজানও হাঁপাচ্ছিল। এগিয়ে এসে নিশিতারার দিকে গাঢ় চোখে তাকাল উজান। প্রতিদিনের মতই বলল," তর চোখদুটা এত্ত সুন্দর, চোখে কাজল লাগাস না ক্যান? কাজল লাগালে তরে পরী পরী লাগব। এত্ত সুন্দর্য কুত্থাও নাই রে।" কাজলহীন চোখমেলে উজানের দিকে তাকাল নিশিতারা। মা কাজল পরতে দেয় না। বলে, কাজল মুসলমানদের মেয়েরা পরে। নিশিতারা দেখে শবনম, জুলেখা, হাসিনারা চোখে কি সুন্দর গাঢ় করে কাজল দেয়। হাতে পরে কত রঙবেরঙের কাচের চুড়ি। তারও খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু মায়ের কড়া নির্দেশ, পরা চলবে না। আরো একটু এগিয়ে আসে উজান। বলে, " দয়ালচাচারা তো কাল চলে গেল, তরাও চললি নাকি?" নির্বাক তাকিয়ে থাকে নিশিতারা। আস্তে আস্তে পাড়া খালি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ চলে যাচ্ছে। সঠিক কারণটা এখনো বোঝে না সে। বাড়িতে দেখে বাবা মুখচুন করে পায়চারি করছে, মা আজকাল রান্নায় নুন দিতে প্রায়ই ভুলে যায়। দেশ নাকি ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অবাক মানে নিশিতারা। জল, মাটি তো ভাগ হচ্ছে, এই আকাশ, চাঁদ, সূর্য --- সব ভাগ হবে নাকি?? কে জানে! তার বাবাকে তো কেউ জিজ্ঞাসা করল না ভাগ করা ঠিক হবে কিনা। এতদিন নিশিতারা দেখেছে করিমচাচা, বিশুকাকা, পাড়ার সকলে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাবার কাছে পরামর্শ চাইতে এসেছে। কিন্তু আজ কেউ জানতে চাইল না। আশ্চর্য আশ্চর্য। উজানের প্রশ্নে তার বুকের মধ্যের শিরশিরানিটা বেড়ে যায়। উজান হঠাৎ তার হাতের মুঠোয় গুঁজে দেয় একটা কাজলের কৌটো আর একটা কাগজের বাক্স। বাক্স খুলে নিশিতারার চোখ চকচকে হয়ে ওঠে। একগাছা সবুজ কাচের চুড়ি। উজান বলে," তর লেগে আনলাম। যদি এর মইধ্যে চইল্যা যাস, আর দেখা না হয়, পরবি।" হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পায় না নিশিতারা। সেই দিন রাত্তিরেই তাদের চলে আসতে হয়। মা কিছু গোছানোর সময়টুকুও পায়নি। রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি পালিয়ে এসেছিল তারা। পুতুলের বাক্স, কাজলের কৌটো, কাচের চুড়ি----সব পড়ে রইল। আর পড়ে রইল উজান। ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে নিশিতারার ভালোবাসাটাও যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। তারপর এদেশ, স্টেশনে মুড়িগুড় খেয়ে কোনমতে টিকে থাকা। উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল জীবন। তারপর বিয়ে, সংসার, নীলের জন্ম, বড় হওয়া, চাকরি, নীলের বিয়ে, দাদুভাই ...। আয়নার দিকে তাকিয়ে এক লহমায় ফেলে আসা জীবন মনে পড়ে যায় নিশিতারার। মনের মধ্যে চাপা পড়ে যাওয়া কিশোরী মেয়েটি আদ্যন্ত গ্রাস করে বৃদ্ধা নিশিতারাকে। বউমার দামী কাজল পেন্সিলটি সযত্নে তুলে ধরেন। কাঁপা কাঁপা হাতে গাঢ় করে কাজল পরেন নিশিতারা। আায়নায় তাকিয়ে দেখেন। কে যেন তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে? কোন লোলচর্ম বৃদ্ধ? না তো? এ যে তার উজান! সদ্য কৈশোর পার হওয়া। তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে। কাজল, কান্নায় মাখামাখি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক হুরপরী।
[খোঁজ- জানুয়ারি ২০২২, সংখ্যায় প্রকাশিত।]