সলমন রুশদির ভাষ্য অনুযায়ী 'মধ্যরাতের সন্তান' যে ভারতবর্ষ সেই দেশ আজ উঠতে চাইছে ধর্মীয় রাষ্ট্র। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা ও বিভেদের মধ্যে ঐক্যের সঙ্গে অতিবাহিত করবার পর তার এই রূপ বদলের
আকাঙ্ক্ষা। এখানে অবশ্যই ইন্ধন আছে সঙ্ঘ পরিবারের; আছে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির প্রণয়ন পরবর্তী কালে ' সোশ্যালিস্ট ' আর্থকাঠামোটির নামমাত্র থেকে যাওয়া। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ডিসকোর্সটি পরিণত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সমঝোতার ঘোষণায় । পিউ ফোরাম নামক গবেষণাকেন্দ্রের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা আমাদের জানান দিচ্ছে 'আর্থ-সামাজিক' নয়; ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বয়ান ক্রমশ ঘুরে যাচ্ছে 'সামাজিক-ধার্মিক' অবয়বের দিকে। খুব বিশ্লেষণাত্মক না হয়েও বলাই যায়, এই 'ভারত'-এর নির্মাণ মিলিট্যান্ট হিন্দুত্বের জনমুখী আবেদন ও লিবারাল বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে যাওয়ার যুগপৎ ফলাফল । রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের যে মনোকামনা, রাজনীতিকে হিন্দুত্ব দ্বারা পরিচালিত করা তাতে তারা সম্পূর্ণভাবে সফল। সেটা আমরা দেখতেও পাচ্ছি শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর আচমকা শিবভক্তিতে ; 'পোস্ট আইডিওলজিক্যাল' রাজনৈতিক নেতৃত্ববর্গ যথা : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হনুমান চালিশা ও চন্ডীপাঠে। এই সমীক্ষাটির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল :ভারতবর্ষের জনতার মনস্তাত্ত্বিক গড়নে একইসঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণামিশ্রিত 'আদারনেস'-এর এক অদ্ভুত সমাহার । যা আসলে নেহরুভিয়ান এলিট ও মার্ক্সীয় ইতিহাসবীক্ষার চিরকালীন ধারার বিরুদ্ধে উগ্র দক্ষিণপন্থী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত সাধারণ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ । অতএব ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে রক্তাক্ত ইঁদুর মুখে নিয়ে রাষ্ট্রময় ঘুরে বেড়াবে । লিঞ্চিং-য়ের চুঁইয়ে আসা সেই রক্ত ধুয়ে দেবে সংবিধানের সাদা মার্বেল মেঝে । অলক্ষ্যে চোয়াল শক্ত হবে বাবাসাহেব আম্বেদকরের । ভিড় করে এই নতুন 'ভারতবর্ষ' -কে দেখবেন সদাযুবক গণেশ ঘোষ ও চট্টগ্রামের ছেলেরা। গান্ধীর চশমা বসিয়ে দেওয়া হবে সরকারী বিজ্ঞাপনে ।নকশালবাড়ি-ভোজপুর-বাথানিটোলার শহীদদের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে , হয়েই যাবে । এহেন ভূতের নাচ আমাদের দেখতে হবে। দেখতেই হবে ।
যাই হোক ; এই পরিসংখ্যানটি থেকে আমরা জানতে পারছি:
১. ভারতবর্ষের হিন্দু জনসংখ্যার ৬৫% থেকে ৬৭% এবং মুসলিম জনসংখ্যার ৭৬% থেকে ৮০% মানুষজন মনে করেন তাদের ছেলেমেয়েদের নিজেদের ধর্ম ছেড়ে ভিনধর্মে বিবাহ করা উচিত নয়।
( লাভ জিহাদের আইন তাই সহজেই ইতিমধ্যে কয়েকটি রাজ্যে আনা গিয়েছে)
২. হিন্দু জনসংখ্যার ৬৪% মনে করে ' প্রকৃত ' ভারতীয় হতে গেলে ধার্মিক হিন্দু হওয়া বাধ্যতামূলক । হিন্দু জনসংখ্যার ৫৯% মনে করে সুস্পষ্ট হিন্দি বলতে পারে যারা তারাই প্রকৃত ভারতীয়।
( হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান প্রোজেক্ট বেশ সফল !)
৩. প্রত্যেক পাঁচজন মুসলমানের মধ্যে একজন ব্যক্তির ধর্মের ভিত্তিতে লাঞ্ছনা ও অপমানের অভিজ্ঞতা হয়ে চলেছে ।
( এবং 'মুসলমান যাও পাকিস্তান' শ্লোগানটিও প্রভাব বিস্তার করেছে )
৪. হিন্দু জনসংখ্যার ৪৩% মনে করে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশভাগ হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের জন্য ভাল পদক্ষেপ ছিল. মুসলমান জনসংখ্যার ৪৮% মনে করে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশভাগ হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের জন্য খারাপ পদক্ষেপ ছিল।
৫. ভারতবর্ষের সামগ্রিক জনসংখ্যার মধ্যে ৬২% পুরুষ ও ৬৪% মহিলারা মনে করেন অপর কাস্টে বা বর্ণে ছেলেমেয়েদের বিবাহ আটকানো উচিত ।
( হিটলারের জার্মানিতে আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা ও বর্ণসংকরের ভয়ে অসবর্ণ
বিবাহজনিত ট্যাবু স্মরণীয় )
৬. ভারতবর্ষের ৯৭% জনগণ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন নিরক্ষরদের মধ্যে ৯৬% ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ৯৬ % ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন
( নাস্তিকরা মোটামুটি সিলেবাসের মার্জিনে দাঁড়িয়ে আছেন )
৭. ভারতবর্ষের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৯৯% নিজেদের ধর্মের মধ্যেই বিয়ে করে থাকেন
৮. প্রত্যেক দশজন ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে সাতজনেরই নিকটজন অথবা
বন্ধুবান্ধবেরা তাদের নিজেদের কাস্টের অথবা জাতির ।
৯. ৯০% হিন্দু ও ৯০% মুসলমান বিশ্বাস করেন বয়সে বড়দের সম্মান না করলে
ভারতবর্ষকে অসম্মান করা হয় ।
১০. ৭২% হিন্দু গোমাংস খাওয়াকে ও ৭৭% মুসলমান শুয়োরের মাংস খাওয়াকে গর্হিত ধর্মীয় অপরাধ মনে করেন ।
এখন আমার একটি সহজ প্রশ্ন ভারতবর্ষের সমাজ পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে যারা ভাবছেন শুধুমাত্র তাদের প্রতি; বিজেপিকে হারানোটা নিঃসন্দেহে বড় প্রশ্ন কিন্তু একইসঙ্গে এই কথাও যাচাই করা দরকার যে আমরা নিজেরাই নিজেদের কাছে হেরে বসে নেই তো ?
৫৩% ভারতীয় যদিও মনে করেন বিভিন্নতা আমাদের দেশের জন্য লাভদায়ক ; একথা বেশ আশাব্যঞ্জক । আবার এটাও উল্লেখযোগ্য যে , ৮৪% ভারতীয় বিশ্বাস করেন সাচ্চা ভারতীয় হতে গেলে অপরের ধর্মকে সম্মান করা আবশ্যিক । আবার সাচ্চা ধার্মিক হওয়ার গুণাবলীর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় হল অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা
এমন মনে করেন ৮০% ভারতীয় । অথচ প্রত্যেক তিনজন ভারতবাসীর মধ্যে দুজন অন্যধর্মে ও অন্যজাতে বিবাহে নারাজ ।
প্রতিবেশী চয়নের প্রশ্নে ৩৬%হিন্দু নিজের প্রতিবেশী হিসাবে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে চাইছেন না । অবশ্য হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মীয় গোষ্ঠীই ধার্মিক আচার-আচরণকেই নিজস্ব আত্মপরিচয়ের চিহ্ন হিসাবে মনে করছেন । ৬৭% মুসলমান নামাজ পড়া ও ৬১%মুসলমান মসজিদে যাওয়াকে প্রকৃত মুসলমানের গুণাবলী মনে করেন । এবিষয়ে ৪৮%হিন্দুরা মনে করেন মন্দিরে না গেলে বা নিয়মিত প্রার্থনা না করলে কেউ প্রকৃত-হিন্দু হতে পারেনা ।
এই সমীক্ষাটি করা হয়েছে নভেম্বর ১৭, ২০১৯ এবং মার্চ ২৩ , ২০২০ -এর মধ্যে এবং এই সমীক্ষার মূল উপাদান হলেন ২৯,৯৯৯ জন প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়। যাদের মধ্যে ২২,৯৭৫ জন হিন্দু ও ৩,৩৩৬ জন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ ।
উল্লেখযোগ্য ভাবে , দেশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) -বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন এই সমীক্ষাটি করা হয়েছিল ।
প্রসঙ্গত, এই সমীক্ষায় দেখা গেছে জনমানসে জন্মান্তর সম্পর্কে বিশ্বাস কমছে । কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান উভয় জনসমাজেই কর্মফল সম্পর্কে বিশ্বাস ও ধর্মীয় বোঝাপড়া প্রখর । সমীক্ষায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নটি জাতপাত-বর্ণব্যবস্থার প্রশ্নে বেশ বোঝা যাচ্ছে । যদিও সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কলেজ স্তরের শিক্ষিতদের মধ্যে অন্য ধর্মের বিবাহের থেকে অন্য জাতে বিবাহে বেশি সম্মতি রয়েছে ।
খুবই অদ্ভুত সমাপতন হল যে ভারতবর্ষের মাত্র ২০% জনগণ মনে করেন জাতপাতভিত্তিক বৈষম্য রয়েছে । যদিও দক্ষিণ ভারতে দায়ের করা বৈষম্যের কথা বলেছেন সর্বাধিক ৩০% দলিত । আরো অদ্ভুতভাবে এই সমীক্ষায় উঠে এসেছে ধর্মীয় বৈষম্যের প্রশ্ন । ২৪% মুসলমান মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য করা হয় । ১৭% হিন্দুর মত হল মুসলমানরা ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার । এই সমীক্ষাটির ইঙ্গিত আসলে বৈষম্যের প্রকারভেদকে নির্দেশ করছে ;যা আমাদের বুঝে নিতে হবে । আসলে কোনো একটি জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে যখন মূলস্রোতের সামাজিক ডিসকোর্স থেকে সুচারুভাবে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেটাকে অভ্যাসে পরিণত করা হয়; তখন সমাজের বহিরঙ্গে গোদাভাবে বৈষম্যের দেখা মেলেনা । বৈষম্য তখনই সম্ভবপর ; যখন দুটি যুযুধান জনগোষ্ঠী একই সামাজিক
স্থান পায় , একই প্রাপ্যের জন্য প্রতিযোগিতা করে , একই সমাজবিশ্ব ভাগ করে নেয় । এটাই তো স্বাভাবিক যে সমাজের অভ্যাস কোন একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রতি শুচিবায়ুগ্রস্ত আচরণ ; সেই সমাজে বৈষম্য আদপেও চিহ্নিত হবেনা । সাম্প্রতিক ফেনোমেনা অনুসারে, আমরা রাজনৈতিক পরিমন্ডলের সঙ্গে যে ধর্মীয় আচার ও জাতীয়তাবাদের ককটেল পান করছি তাও আসলে জনগণ দ্বারা স্বীকৃত ; জানাচ্ছে এই সমীক্ষা । সকল সম্প্রদায়ের দুই - তৃতীয়াংশ মানুষের মতে রাজনীতিবিদদের ধর্মীয় সংসর্গ সমস্যাজনক নয় ।
এই সমীক্ষায় উঠে আসা ভারতবর্ষের যে সামগ্রিক চিত্র ; তা একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রেরই রূপরেখা । আদর্শগত ভাবে ভারতবর্ষের জনগণ ধর্মীয় বিভিন্নতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতা-র ভাষ্যে নির্ধারণ করছে
সহিষ্ণুতার মাত্রা ও সংখ্যালঘুর ধর্মাচরণের সীমা-পরিসীমা , জনমানসে ব্যাক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্নে সমর্থন উধাও এবং স্বৈরাচারী হিন্দু-একনায়কতন্ত্রকেই জাতীয় পরিচিতির দিকচিহ্ন হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করানো হচ্ছে । মহামহিম বলতে কেবলই দুজন : স্বর্গে ঈশ্বর ও মর্ত্যলোকে রাষ্ট্র ।
ভারতবর্ষের জাতীয় উন্মাদনা ক্রিকেটের বিষয়ে গবেষকরা এই সমীক্ষায় একটি প্রশ্ন রেখেছিলেন: 'আপনার মতে ভারতবর্ষের ক্রিকেট দলকে সমর্থন করা সত্যিকারের ভারতীয় হওয়ার জন্য কতটা জরুরি?’। এর উত্তরে সায় দিয়ে হ্যাঁ বলেছেন ৭৯% হিন্দু, ৭৫% মুসলমান ও ৬৫% শিখ। কাজেই ভারত ম্যাচ হারলেমুসলমান মহল্লায় পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হয় এমন হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড বিভ্রান্তিজনক মনে হয় । যদিও এই প্রশ্নের উত্থাপন বোঝায় যে আজকের ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ সম্পূর্ণভাবে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । এই লেখাটি শেষ করার আগে একটাই কথা বলার; আমাদের প্রতিপাদ্য কখনোই এই গবেষণামূলক সমীক্ষাটি থেকে ভারতবর্ষের স্বরূপ চেনা নয়। অথবা এর বিপ্রতীপে ২০১৪-র ভারতবর্ষকে অসাম্প্রদায়িক অথবা বহুত্ববাদী জন্নত প্রতিপন্ন করাও নয় । আসলে আমাদের ম্যাপে অথবা অ্যাটলাসে কাশী বিশ্বনাথ চিনে আর কাজ নেই । এখন আমাদের সশরীরে কাশী গিয়ে বিশ্বনাথ দর্শনের সময় । বন্ধুগণ ; খেয়াল করবেন জনপ্রিয় উদ্ধৃতিযোগ্য কথা বলবো বলে আমিও 'হিন্দু ' দৃশ্যকল্প ব্যবহার করলাম।
তথ্যঋণ:
১.https://indianexpress.com/article/opinion/columns/the-religious-life-of-indians-according-to-a-recent-survey-7385080/
২.https://indianexpress.com/article/explained/explained-religions-in-india-living-together-separately-7394060/
৩.https://www.telegraphindia.com/amp/opinion/faith-and-the-absence-of-fraternity/cid/1821088?__twitter_impression=true&s=08
৪.https://www.pewforum.org/2021/06/29/religion-in-india-tolerance-and-segregation/