নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা বলতে কী বোঝায় তা কয়েকটি শব্দ বা শব্দবন্ধ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। আসলে বিচার ব্যাবস্থার নিরপেক্ষতা তার পরিচালনার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিচালন পক্রিয়াই বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ নাগরিকের আস্থা রাখতে সাহায্য করে। তবে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল— আদালত যেমন কখনোই রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যান্য শাখা দ্বারা প্রভাবিত হবে না, তেমনই কোনো ব্যক্তি দ্বারাও প্রভাবিত হবে না। মানুষের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাই নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার সার্থকতা।নিরপেক্ষ বিচারক অথবা বিচার উভয় পক্ষের বিশ্বাসই দৃঢ় এবং সৎ সংকল্পের উপর নির্ভরশীল। মূলত কৌশলগত ভাবে এই সংকল্পের দায়বদ্ধতা পালনের দায়িত্ব নিতে হবে, তবে তা কখনই সংবিধানিক পরিকাঠামো অমান্য করে নয়। দেশের সাধারণ নাগরিককেও সজাগ থাকতে হবে,তাদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার্থে।
সাধারণ নাগরিকের অধিকার রক্ষার শেষ অবলম্বন বিচার ব্যবস্থা। নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ঔপনিবেশিক সরকারের সময় থেকেই ভারতবাসীর দাবী। Dr. B.R. Ambedkar বলেছিলেন- “ It has been the desire of this country from long past that there should be separation of the judiciary from the executive and the demand has been continued right from the time when the congress was founded. Unfortunately, the British Government did not give effect to the resolution of the Congress demanding this particular principal being introduced into the administration of the Country”.
ভারতবাসীর দাবী মেনে বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ রাখার স্বার্থে— সংবিধানের ৫০ নং ধারায়, এক্সিকিউটিভকে বিচার ব্যাবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। এতদসত্বেও, স্বাধীনতার ৭২ বছর পরও ঘুরে ফিরে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার দাবিতে যদি আজও ভারতবাসীকে সোচ্চার হতে হয়, তাহলে স্বাধীন দেশের নাগরিকরা আদৌ কতটা স্বাধীন হতে পেরেছেন সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আমরা জানি, সংবিধান স্বীকৃত গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ-
১. লেজিসলেচার
২. এক্সিকিউটিভ
৩. জুডিসিয়ারি।
লোকসভা বা বিধানসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্বাধীন ভাবে সংবিধানের পরিধির মধ্যে যেমন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখেন তেমনি, এক্সিকিউটিভেরা আইনের পরিধির মধ্যে থেকে স্বাধীন ভাবে সরকার পরিচালনা করতে পারে। লেজিসলেচার বা এক্সিকিউটিভ আইনের বাইরে গেলে জুডিসিয়ারি হস্তক্ষেপ করতে পারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য; মানুষ যাতে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তা মাথায় রেখেই, সংবিধান প্রণেতারা এই পরিকাঠামো তৈরি করেছিলেন।
দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর নিরিখে অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান ও সংবিধান প্রদত্ত অধিকার তথা ন্যায়, সাম্য এবং স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ আজও অধরা রয়ে গেছে। আজও দেশের অসংখ্য মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেI অর্থাভাব নিরপেক্ষ জনপ্রতিনিধির নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওই নাগরিকের। একটি সমীক্ষা ভিত্তিক বই “ Against the election by Devid Van Reybrouck” এর উপস্থাপন অনুষ্ঠানে উল্লেখ করা হয় যে আমাদের দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৮৬% দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। দেশের এক্সিকিউটিভরা যাতে এই দুর্নীতির দ্বারা প্রভাবিত না হয় সে জন্যই Public Service Commission এর মত নিরপেক্ষ নিয়োগ সংস্থা দ্বারা এদের নিয়োগ হয়। সংবিধানের ৩১৬ ধারা প্রণয়নের বিতর্ক সভায় Dr. Ambedkar , Jaspat Roy Kapoor, Pandit Hirday Nath Kunzru, H.v. Kamath প্রমুখেরা PSC কে রাজনৈতিক প্রভাব বর্হিভুত রাখতে চেয়েছেন। ওঁদের মতো যোগ্যতা অনুসারে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাতে গেলে এই কমিশনকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। তৎকালীন এবং সমকালীন অভিজ্ঞতায় এ দৃশ্যমান যে, এরপরও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিরপেক্ষ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, এক বৃহত্তর অংশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হয়েছে।।
আমাদের অভিজ্ঞতা PSC এর চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত I বিগত কয়েক বছরের সংবাদপত্রে প্রায়সই দেখতে পাওয়া যায়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির খবর।
W.B.C.S এর মতো গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও, অভিযোগ ওঠে নির্বাচনের সময় বিভিন্ন প্রতারণা যেমন- প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ন না হয়েও চাকরি পাওয়া অথবা রহস্যজনক ভাবে নম্বর বৃদ্ধির সুবাদে চাকরি পাওয়ার মতো ঘটনা লক্ষনীয়ই বটে।
পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে ৭০ দশকের শেষ দিক থেকে সরকারি স্কুলে গুলিতে বিনা পয়সায় লেখাপড়া করার সুযোগ পায় হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েরা। দক্ষ শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই আশায় বুক বাঁধে কোনও সরকারি চাকরির জন্য। তবে, এ বলাই বাহুল্য, কর্মক্ষেত্রে নিযুক্তি যদি যোগ্যতার বিচারে, শিক্ষার নিরিখে না হয়ে তা অর্থের বা রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন সহজাত ভাবেই সুযোগ্য শিক্ষর্থীদের বঞ্চিত হতে হয়। তখনই প্রশ্ন ওঠে এই সংস্থার নির্বাচনী নিরপেক্ষতা
আবার আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায় প্রশাসনের যে অংশে, তারা নিরপেক্ষ ভাবে পরিচালনা করতে না পারলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমাদের অভিজ্ঞতা রাজ্য পুলিশ বা কেন্দ্রিয় তদন্তকারী সংস্থা নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আদালতের নির্দেশ থাকা সত্বেও সারদা বা নারদার মতো দুর্নীতির তদন্ত শেষ হয়েনি আজও। অসংখ্য গরীবের স্বার্থ ভয়ানকভাবে বিঘ্নিত হলেও শুধুমাত্র প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের যুক্ত থাকার কারণে তদন্ত প্রক্রিয়া যেমন দীর্ঘায়িত হয়, তেমনই নিপীড়িত মানুষের স্বার্থ রক্ষার লড়াইয়ে সোচ্চার হলে, রাষ্ট্র যন্ত্রের এই অংশের অতি সক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ মানুষের কন্ঠরোধ করতে দেশদ্রোহিতার মতো আইন প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করেনি রাষ্ট্র ব্যবস্থা I
তাই একথা বলতে দ্বিধা নেই অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে এবং মানুষের মধ্যে সমভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটলে ও রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ না হলে, এই সংস্থাগুলিকে নিরপেক্ষ রাখা সম্ভবপর নয়।।
এমতাবস্থায় আদালতই পারে আইন সভার প্রতিনিধি অথবা কার্যনির্বাহকদের ত্রুটিপূর্ণ কাজকে বাতিল করে ত্রুটিমুক্ত শাসনে সাহায্য করতে। নিরপেক্ষ বিচার ব্যাবস্থার প্রয়োজনীয়তা সেখানেই।
উচ্চ অথবা সর্বোচ্চ আদালতের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যাতে, রাজনৈতিক কার্য নির্বাহক হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা আদালতের বরিষ্ঠ বিচারকদের, অর্থাৎ, কলেজিয়ামের হাতে ছাড়া হয়েছে; তেমনি নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া সংবিধান স্বীকৃত নিরপেক্ষ নিয়োগ সংস্থা PSC র হাতে ছাড়া হয়েছে । তা সত্ত্বেও বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের করা সাংবাদিক বৈঠকটি, যেখানে আদালতের প্রধান বিচারপতির সম্পর্কে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন বরিষ্ঠ বিচারপতিরা, যা ভোলবার নয়। সাম্প্রতিক অতীতে যেমন, সবরিমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার মতো প্রগতিশীল রায় সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়িয়েছে, তেমনি ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে দেওয়া রাম মন্দিরের রায়, বিচার ব্যাবস্থা ও মানুষের বিশ্বাসের উপর আঘাত হেনেছে। October, 4, 2018 সালে প্রকাশিত Job for justice(s); Corruption in the Supreme Court of India নামক গবেষণা পত্রে গবেষক মন্ডলী বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন- “ We also find that authoring judgements in the favour of the Government is positively associated with the likelihood of being appointed to a prestigious post-supreme Court job. These finding suggests the presence of corruption in the form of Government influence over judicial decisions that seriously undermines judicial independence”.
আগেই উল্লেখ করেছি গনতন্ত্রের প্রথম ও দ্বিতীয় স্তম্ভের ত্রুটি ও মুক্তির দায় একান্তই বিচার ব্যবস্থার। ফলে বিচারক যদি ত্রুটিকারকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রায় দান করেন, তবে অচিরেই তথাকথিত গণতন্ত্রের মোড়কের এই ব্যবস্থাপনা যে ভেঙে পড়বে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই। উল্লেখ্য এই যে- উচ্চ আদালতের আইনজীবীদের মধ্যে করা এক জরিপে ( A survey of Advocates before the High Court) আইনজীবিরা ন্যায্য শুনানি করতে পারেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে তারা নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন।
সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার দায় বিচার ব্যবস্থার। মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নিরপেক্ষ বিচারক I টাকার জোর না থাকলেও, মোটের ওপর সাধারণ মানুষ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখে। এই আস্থা টিকিয়ে রাখার দায় আইনি ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি মানুষের। ধনী-দরিদ্র, সর্বশক্তিমান-দুর্বল, রাষ্ট্র-নাগরিক এদের মধ্যে পার্থক্য না করে, ভয় না পেয়ে বা পক্ষপাতিত্ব না করে, এক দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ সাংবিধানিক পরিকাঠামোর অন্তর্নিহিত বিচারের ক্ষমতাকে, সম্পূর্ণ রূপে নিরপেক্ষ দায়বদ্ধতার আঙ্গিকে সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে বিচার ব্যাবস্থায় নাগরিক বর্গের আস্থা ফিরবে।
পরাধীন ভারতবর্ষ দেখেছে “Hand Picked Tribunal”. দেখেছে ভগৎ সিং-এর ফাঁসির রায়। স্বাধীন ভারতবর্ষ দেখতে চায় এক ন্যায় সঙ্গত সুবিচারক; যে বা যারা রাষ্ট্র শক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয়। শুধুমাত্র তথ্য প্রমাণ আইন ও তার ব্যাখ্যা দিয়ে নয়, একজন বিচারক সঠিক বিচার তখনই দিতে পারেন যখন দেশের অধিকাংশ মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকবে।
সংবিধানের মর্যাদা তখনই রক্ষা করা সম্ভব,যখন আদালত সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দায় নেবেI প্রতিবাদী বঞ্চিত মানুষের উপর রাষ্ট্রের নিপীড়নকে খারিজ করবে। তার কাছে হাজির তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত ঘটনার বিবৃতিকরন করলে তবেই সঠিক বিচার সম্ভব। অন্যথায় যে নৈরাশ্যবাদ গঠিত হবে তা নৈরাজ্যের সূচনা করবেI