পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কর্ণাটক কি গণহত্যার আশঙ্কায় প্রহর গুনছে?

  • 25 April, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 2210 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
গুজরাত গণহত্যা ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে বাস্তবিক এক প্রহসন। গোধরা-কাণ্ডের আপতিক ফলাফল যে গুজরাতের এই দুঃসময় নয়, এটা হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমান বিরোধী অভিযানের চূড়ান্ত পরিণতি, তা অনেক অনেক হিন্দুর চিন্তা-চেতনে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। কারণ একটা সময় ধরে যখন মুসলমান বিরোধী প্রচার, ঘৃণা-বিদ্বেষের মহড়া চলছিল গুজরাত জুড়ে, তখন গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগুলো সজাগ হতে পারেনি, হিন্দুত্বের কর্মসূচির বিকল্প নিয়ে ভাবেনি। আজকে কি ভাবছে?


কর্ণাটকে ২০১৫-তে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ নিয়ে প্রচুর হৈচৈ হয়েছিল, যখন হুব্বালিতে হিন্দু ধর্ম সমাবেশে এক হিন্দুত্ব-ভাবাপন্ন সাধু মুসলিম বিরোধী জিগির তুলতে মুসলিম মেয়েদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার নিদান দিয়েছিল। তবে সে সময় হেট ক্রাইমের কেন্দ্র ছিল বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ। ইদানিং হেট ক্রাইমের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে কর্ণাটক। এখন তার বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয়েছে বলা যায়।
ধর্মীয় বা জাতপাতগত ঘৃণা-বিদ্বেষ বশে একদল মানুষ জড়ো হয়ে একজনকে লাঞ্ছিত করছে অথবা কঠিন সিদ্ধান্তে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করছে। কখনো মেরে ফেলছে। প্রকাশ্যে, দিনের আলোয়। অজুহাত কিছু একটা থাকে, যেমন গো-মাংস খাওয়া, নিজ ধর্মবিশ্বাসবশত জয় শ্রীরাম না বলতে চাওয়া, ইন্টার-কাস্ট বিবাহ, দলিত হয়েও মন্দির চত্বরে প্রবেশ করা, নিম্নবর্ণের হয়েও বর্ণহিন্দুর সঙ্গে বচসা করা। এরকম ঘৃণা-বিদ্বেষের তালিকা দীর্ঘ। যারা মব লিঞ্চিংয়ে হাত লাগায়, একরোখা তারা। তারা জান্তব উল্লাসে মেতে ওঠে।
২০১৪-র আগে মব লিঞ্চিংয়ের ছিল অনেকটা সামাজিক অবয়ব। জাতপাতকে কেন্দ্র করে ঘটনা ঘটত বেশি। ঘটনা ঘটত অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে, সাধারণত কোন ঘটনার বিষম প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০১৪-র পর থেকে অবস্থাটা বদলে যেতে থাকল। ধর্মীয় ভেদাভেদ ব্যাপারটা হেট ক্রাইমের তালিকায় এক নম্বরে চলে এল। মূল নিশানা করা হল মুসলমান সম্প্রদায়কে। তখন রাজনীতিতে ধর্মীয় ঘৃণার চাষ শুরু হয়েছে বাড়াবাড়ি রকম।
মব লিঞ্চিংয়ের পিঠোপিঠি থেকেছে হেট স্পীচ। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় মঞ্চ থেকেই ধর্মীয় ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারে করা হয়েছে। হিন্দুত্বের নির্মাণে এটা অপরিহার্য উপাদান। মূল নিশানা সেই মুসলিমরাই। মুসলমান শাসন আমলের অর্ধসত্য ও মিথ্যা ইতিহাস, হিন্দু-মুসলমানে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বৈসাদৃশ্য, সন্ত্রাসবাদ, এসবকে বিষয়বস্তু করে মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে হিন্দুমন বিষিয়ে তোলার কাজটা ধারাবাহিকভাবে চলেছে। ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষে পুষ্ট হয়েছে ধর্ম-পরিচয়ভিত্তিক মব লিঞ্চিং।
অতি সম্প্রতি কর্ণাটকে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে কলেজে যাওয়া নিয়ে গেরুয়াপন্থীদের উগ্র বিরোধিতা শুরু হয়েছিল। বিরোধিতা কলেজ পেরিয়ে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই নিয়ে বিতর্ক কর্ণাটক ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়েছিল। অবশেষে কর্ণাটক উচ্চ আদালত হিজাবের বিপক্ষেই রায় দিল। হিজাব নিয়ে গা-জোয়াড়ির অস্থির পরিস্থিতিতে এমনকি এটাও খতিয়ে দেখার ফুরসৎ হল না যে, ক’টা কলেজেই বা পোশাক বিধি চালু আছে। শেষমেশ এটা দাঁড় করানো গেল যে, মুসলিমরা পশ্চাৎপদ প্রথা আঁকড়ে থাকতে অভ্যস্ত এবং মুসলিম মেয়েরা উপহাসের পাত্রী।
অতঃপর কর্ণাটকে আরএসএস, বজরং দল সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো একের পর এক মুসলিম বিরোধী ঘৃণা-বিদ্বেষ-হেনস্থার কর্মকাণ্ড হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । ‘হালাল মাংসের’ নামে মুসলিমদের ব্যবসা বয়কটের ডাক দিচ্ছে। ‘হালাল মাংস’ বিক্রির অভিযোগে মুসলিম ব্যবসায়ীদের মারধোর বা হেনস্থা করছে। মুসলিমদের মালিকানাধীন যানবাহনে অমুসলিমদের চড়া বন্ধ করে দিচ্ছে। মন্দির চত্বরে ও ধর্মীয় মেলায় মুসলিমদের দোকান খুলতে দেওয়া হচ্ছে না। অন্যত্রও মুসলিম ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করা হচ্ছে বা দোকান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এমন দিন নেই, যেদিন মুসলিম নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে না। কোন ঘটনায় থানায় গেলে পুলিশ অভিযোগ নিচ্ছে না।
কর্ণাটকে গত এক বছরে দেখা গিয়েছিল, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো হিন্দু ছাত্র-যুবদের অ-হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে প্ররোচিত করত, লাভ জিহাদের নামে ইন্টার-কাস্ট বিবাহিতদের হুমকি দিত বা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করত, বিভিন্ন সময়ে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে মুসলিম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বয়কটের ডাক দিয়েছিল, বিভিন্ন স্থানে গো-রক্ষার নামে মুসলিমদের উপর হামলা করেছিল, সুযোগ মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করত ও নিয়ম করে তাদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচার করত। আর প্রশাসনের প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল প্রায় সব ক্ষেত্রেই।
দিল্লিতে শাহীনবাগে সিএএ ও এনআরসি-র বিরোধিতায় ধর্ণা চলাকালীন হেট ক্রাইমের খুল্লামখুলা প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল। প্রকাশ্য নির্বাচনী জনসভায় বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর “দেশকো গদ্দারোঁকো গোলি মারো শালোকো” স্লোগান, বিজেপি সাংসদের শাহীনবাগের প্রতিবাদী পুরুষদের হিন্দু নারীদের সামনে সম্ভাব্য ধর্ষণকারী ও হত্যাকারী হিসেবে দেখানো, একটা মসজিদও আস্ত না রাখার হুমকি দেওয়া, ১৭ বছরের কিশোরের ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজ তুলে জামিয়া মিলিয়ার আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর গুলি চালানো, কপিল গুজ্জর নামে এক ব্যক্তির শাহীনবাগ ধর্ণাস্থলে গুলি চালানো ও মুসলমান বিরোধী স্লোগান দেওয়া, এরকম মুসলমান বিরোধী প্রচার-প্ররোচনার ঘটনা ঘটেছিল হামেশা। সবশেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে মুসলিমদের উপর নেমে এল গণহত্যা। এটা ছিল হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমান বিরোধী সংক্ষিপ্ত কর্মকাণ্ড। উত্তর-পূর্ব দিল্লির গণহত্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘মিনি গুজরাত’।
এই শতাব্দীর শুরুতে গুজরাতে ধাপে ধাপে মুসলমান বিরোধী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। দফায় দফায় মুসলমান বিরোধী বয়ানে লক্ষ লক্ষ লিফলেট ছড়ানো হয়েছিল। খবরের কাগজ, সাময়িক পত্রিকা, ইন্টারনেট, এসব মাধ্যম ব্যবহার করে ধারাবাহিকভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষ ছড়ানো হয়েছিল। ২০০০ সালে আরএসএস সংকল্প শিবিরে ৩০ হাজার লোককে সমাবেশিত করে, যেখানে মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার ডাক দেওয়া হয়েছিল। ২০০১-এ ভিএইচপি ও বজরং দল মিলে আহমেদাবাদে এক কর্মসূচিতে ১ লক্ষ লোকের সমাবেশ করেছিল, যেখানে স্লোগান তোলা হয়েছিল, “মুসলিম কো নষ্ট করো”। তখন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির কাজই ছিল মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচার করা। মুসলমান বিদ্বেষ বাড়িয়ে তোলার কাজে প্রশাসন যথেষ্ট মদত দিয়েছিল। এসবের পরিণামে রাজ্যে ২০০২-এর ফেব্রুয়ারিতে মুসলিমদের উপর ব্যাপক, বীভৎস গণহত্যা ঘটানো হল ।
আশঙ্কার মেঘ ঘন হতে থাকে, তা হলে কি কর্ণাটক মুসলমান বিরোধী গণহত্যার বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে ?
গুজরাত গণহত্যা ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে বাস্তবিক এক প্রহসন। গোধরা-কাণ্ডের আপতিক ফলাফল যে গুজরাতের এই দুঃসময় নয়, এটা হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমান বিরোধী অভিযানের চূড়ান্ত পরিণতি, তা অনেক অনেক হিন্দুর চিন্তা-চেতনে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। কারণ একটা সময় ধরে যখন মুসলমান বিরোধী প্রচার, ঘৃণা-বিদ্বেষের মহড়া চলছিল গুজরাত জুড়ে, তখন গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগুলো সজাগ হতে পারেনি, হিন্দুত্বের কর্মসূচির বিকল্প নিয়ে ভাবেনি। সেটা করা হলে অন্তত গণতন্ত্রের সামনে আজকে এই জায়গাটা থাকত যে, ধর্ম-জাতপাতগত ঘৃণা-বিদ্বেষের বিপরীতে, বিপর্যয়কর হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে অবিচল একটা ভাষ্য রচনা সম্ভব হয়েছে, রচিত হয়ে চলেছে। একটা শক্ত জমি তৈরি হয়েছে, সেই জমির পরিসর বেড়ে চলেছে। এই প্রয়াস কোন মরশুমী ব্যাপার নয়। এটা মানুষের সমাজের ভিতরে, রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থান-পতনে লেগে থেকে প্রচেষ্টা চালানোর ব্যাপার। এই রকম অধ্যবসায়, সমাজ-সংস্কৃতির পরম্পরা ধরে মানুষের মননে পৌঁছনো, রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃত্তে গণতন্ত্রের বোঝাপড়া, কতটুকু করা গেছে? এখন যখন হরিদ্বারে গুজরাতের মতো ধর্মযুদ্ধের আওয়াজ উঠল, যখন কর্ণাটক ঘৃণার আগুনে পুড়ছে, তখন মনে সংশয় জাগে, খুব কি দেরি হয়ে গেছে?
এই কর্ণাটকই দীপশিখা মেলে ধরে অন্ধকারে পরস্পরকে চিনিয়ে দেবে বলে। কর্ণাটকের সেই রূপকথার মতো কথা-কাহিনির রেশ মনে নিয়ে এই পাঠ শেষ করা যাক।
কর্ণাটকের বেল্লুরের চেন্নাকেশব মন্দির। এক ঐতিহাসিক স্থাপনা। যুগ যুগ ধরে প্রতি বছর মন্দিরে দু’দিনের রথোৎসব পালিত হয়। উৎসবে ঐতিহ্যবাহী রীতি হল, একজন মৌলবির কোরাণ পাঠের মধ্য দিয়ে রথোৎসবের সূচনা করা হয়। অতি সম্প্রতি উৎসবের প্রাক্কালে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এই রীতি নিয়ে প্রবল আপত্তি তুলেছিল। এদিকে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিস্থিতির কথা ভেবে মন্দির কমিটি উৎসবের দু’দিন মন্দির চত্বরে মুসলিম ব্যবসায়ীরা ষ্টল করতে পারবে না বলে নোটিশ জারি করে ও আশপাশের মুসলিম ব্যবসায়ীদের এই দু’দিন ব্যবসা বন্ধ রাখতে বলে। এই নিয়ে মানুষের মধ্যে বিতর্ক শুরু হলে ও মন্দিরের ঐতিহ্য রক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিলে রাজ্য সরকার মন্দিরের পুরোহিতদের সঙ্গে আলোচনা করে মন্দিরের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে ঘোষণা করে এবং মন্দির চত্বরে মুসলিম ব্যবসায়ীদের ষ্টল করার অনুমতি দেয়। অবশেষে উপস্থিত হাজার হাজার ভক্তের খুশির আবহে চেন্নাকেশবের রথের সামনে কাজী সৈয়দ সাজেদ পাশার কোরাণ পাঠের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হল।

0 Comments

Post Comment