পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মরা থেকে রাম থেকে মরা কিংবা আমরা

  • 04 August, 2020
  • 1 Comment(s)
  • 2615 view(s)
  • লিখেছেন : ধীমান বসাক
মসজিদের ধ্বংসস্তূপে মন্দিরের ভিত গড়া হবে, উদ্বোধন করবেন এক 'সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ' রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। একুশ শতকের ভারতের এক রাষ্ট্রনেতা। বেশীর ভাগ রাজনৈতিক দল হয় সম্মতি জানিয়েছে নয় মৌন থেকেছে। গোটা বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির বিবাদের গল্পটাই দাঁড়িয়ে আছে এক প্রতীকী লড়াইয়ের ওপর। কারোর কাছে ঐ মসজিদ ভাঙাটা তাদের ওপর আক্রমণ ও লাঞ্ছনার প্রতীক, কারোর কাছে সেটা বিদেশী বিধর্মীদের চিহ্ন বিলোপ করে এক নতুন ভারত গড়ার প্রতীক।

ঠিক একবছর আগে যেদিন কাশ্মীরকে, তার কাশ্মীরিয়তকে, তার লজ্জার শেষ আবরণটুকু, ৩৭০ আর ৩৫এ, সরিয়ে দিয়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, ৫ আগস্ট সেই দিনটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে রামের মন্দিরের ভিতপুজোর জন্য। এই সমাপতন একেবারেই কাকতালীয় নয়। আমরা ভারতবাসীরা লক্ষণ বা চিহ্ন বা প্রতীককে ভীষণ গুরুত্ব দিই। সেটা মাথায় রেখেই এই দিনটাকে বাছা হয়েছে। যে ইঙ্গিতটা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ছড়িয়ে দিতে চাওয়া হচ্ছে, তা হল - দেখো কাশ্মীরকে টাইট দেওয়া আর দেশজুড়ে মুসলমানকে টাইট দেওয়া দুটোই একই নীতির এপিঠ ওপিঠ, কাশ্মীর সমস্যা আসলে শুধু মুসলমানের সমস্যা, এদেশে মুসলমানরা বিদেশী সংস্কৃতির ধারক, তাকে হটিয়ে দিয়েই নতুন ভারত তৈরী হবে, আচ্ছে দিন আসবে। আরেকটা উদ্দেশ্য - আর ঐদিনেই কাশ্মীর নিয়ে আন্তর্জাতিক যে হৈচৈ হবে, সেটাকে উপলক্ষ করে আরোও মেরুকরণও করা যাবে, আবার ভারত বিদেশী চাপের কাছে মাথা নোয়ায় না, এরকমও জাহির করা যাবে। আর এসবের মধ্যে দিয়ে লকডাউনের বয়ে আনা ধ্বংসলীলা, ব্যর্থতা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিপর্যয়কেও চাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে।

উদ্বোধন কীভাবে হবে সেটা নিয়েও এক রহস্য বোনা হচ্ছে, তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে নরেন্দ্র তার দাড়ি লম্বা করছেন ঐ প্রতীকী অর্থেই, এক সাধুসুলভ চেহারা ফুটিয়ে তোলার জন্য। এই প্রতীক আজ থেকে নয়, এরকম নানা প্রতীক যেমন খেটো ধুতি খালি গা একটা ট্যাঁকঘড়ি একটা লাঠির প্রতীক ভারতের রাজনীতিতে আগেও ব্যবহার হয়েছে আপামর ভারতবাসীর সাথে সংযোগ গড়ে তোলার জন্য।

গোটা বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির বিবাদের গল্পটাই দাঁড়িয়ে আছে এক প্রতীকী লড়াইয়ের ওপর। কারোর কাছে ঐ মসজিদ ভাঙাটা তাদের ওপর আক্রমণ ও লাঞ্ছনার প্রতীক, কারোর কাছে সেটা বিদেশী বিধর্মীদের চিহ্ন বিলোপ করে এক নতুন ভারত গড়ার প্রতীক।

এই প্রতীক হিসাবে কোন ঘটনাকে তৈরী করা, বাবরি মসজিদকে হিন্দুত্বের তথা 'ভারতীয়ত্বে'র লজ্জা অপমান পরাজয় হিসেবে দেখানো, তাকে ধ্বংস করে ঠিক ওখানেই (মন্দির ওঁহি...) রামের মন্দির গড়লে সেটা হবে ভারতীয়ত্বের জয়, এই ধারণা একদিনে তৈরী করা হয়নি। আজ কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ দলের ভাবমূর্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু ১৯৮৭ সালে রাজীবের জমানায় দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে সরকারী উদ্যোগে 'রামায়ণ' সিরিয়াল প্রচার করে, এই প্রতীক ও তার পটভূমি তৈরীর কাজ চলে। বিপুল সরকারী অর্থ খরচ করে, আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিংশ শতকের ভারতবাসীকে টেলিভিশন সেটের সামনে আঠার মতো বসিয়ে রাখার মতো উপযোগী করে এই সিরিয়াল বানানো হয়, সেদিন আমরা শাসকের উদ্দেশ্য ধরতে পারিনি। এই বিপুল জনপ্রিয়তাই ১৯৯০ সালে আদবানীর রথযাত্রা এবং ১৯৯২ সালে করসেবকদের হাতে বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পটভূমি গড়ে দেয়। 'বাচ্চা বাচ্চা রাম কা, জনমভূমি কে কাম কা", "আভি ভি যিস কা খুন নাহি খৌলা, ও খুন নাহি হ্যায় পানি হ্যায়" স্লোগানকে জনপ্রিয় করা হয়, আপাত নির্দোষ রামায়ণের গল্প থেকে প্রতীক, চিহ্নগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে, মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে, অন্য কোথাও নয়, কারণ ওটাই 'আমাদের' লজ্জার চিহ্ন।

ঠিক যেভাবে বোরখা-হিজাবকে গড়ে তোলা হয়েছে মুসলমান নারীত্বের অবদমন হিসেবে, ফলত মুসলমান তথা ইসলামকে হেয় করার জন্য, আর তার বিপরীতে ওটাই কারোর কারোর কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসলামের প্রতীক, মুসলমানত্বের প্রতীক।

এই প্রতীক বানানোর খেলা শুধু ভারতে খেলা হচ্ছে না, হচ্ছে গোটা বিশ্বজুড়েই। হলিউডি সংস্কৃতিতে একসময় বদমায়েশ শয়তান হত রুশরা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কিছুদিন চীনারা, তারপরই সে জায়গায় এল মুসলিমরা। স্মাগলার ড্রাগ পেডলার খুনী শয়তান সব মুসলিম।

মূল তথা আধিপত্যকারী এই প্রতীকের বিপরীতেও কিন্তু প্রতীক তৈরী হয়, প্রতীক বানানোও হয়। এরদোগানের আজকের তুরস্কে হাজিয়া সোফিয়া সেরকমই এক প্রতীক। একসময়কার পশ্চিমী তথা রোমান তথা খ্রিশ্চানধর্মী সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনোপল যখন এশীয় তথা তুর্ক তথা ইসলামধর্মী ওসমান (অটোমান) সাম্রাজ্যে এসে ইস্তানবুলে পরিণত হয়, হাজিয়া সোফিয়াও গীর্জা থেকে হয়ে ওঠে মসজিদ। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোতে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংস, তুর্কী জাতীয়তাবাদের উত্থান শেষপর্যন্ত গিয়ে হাজিয়া সোফিয়াকে করে দেয় মিউজিয়াম।

লকডাউনের পর্যায়ে আমার তরুণ মুসলিম ফেসবুক বন্ধুদের লেখাপত্রে প্রথম শুনি এর্তুগ্রুলের নাম, হালিমা, গোকচে, সুলেমান, গুরদুগলু, মার্কোজ এইসব। তারপর সেটা নিয়ে খোঁজ নিই, দেখিও। ২০১৪-র ডিসেম্বর মাস থেকে তুরস্কের টেলিভিশনে প্রচারিত হয় এই 'দিলিরিস এর্তুগ্রুল' সিরিয়াল। মোঙ্গলদের তাড়া খাওয়া একটা ছোট তুর্কীভাষী মুসলমান কায়ি জনজাতির গোষ্ঠীর নেতা সুলেমানের ছেলে এর্তুগ্রুল তার বীরত্ব নিষ্ঠা ইসলাম-অনুবর্তিতা ন্যায়পরায়ণতা, এক অপরিচিতা বংশপরিচয়হীন নারীর প্রতি তার প্রেম, একদিকে সেলেবী মঙ্গোল ও খ্রিশ্চান রাজত্বের ষড়যন্ত্রের পর্দাফাঁস করে, নিজের জনজাতির জন্য এক স্থায়ী বাসভূমি জিতে নেওয়া, এই নিয়ে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই কাহিনীর বুনোন। এই এর্তুগ্রুলই অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান তথা ওথমান তথা অটোমান-এর পিতা।

তুরস্কের সরকারের সরাসরি আর্থিক সাহায্যে বানানো এই সিরিয়াল তুরস্কের সমস্ত টিভি জনপ্রিয়তার রেকর্ড ভেঙে দেয়, সম্প্রচারের সময় গোটা তুরস্ক স্তব্ধ হয়ে যেত। যে কোন হলিউডি সিনেমা বা টিভি সিরিয়ালের সাথে টক্কর দেওয়ার মতো প্লট, প্রযুক্তি, বুনোট, মিউজিক, অভিনয়, অ্যাডভেঞ্চার, পরিবেশ, সেট, সাউণ্ড এবং ফেলে আসা গৌরবময় এক অতীতের বর্ণনা। ছত্রে ছত্রে ইসলামের বাণী, কিন্তু কোনটাই একঘেঁয়ে বা গতানুগতিক নয়। চারিদিকে শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলির হাতে আক্রান্ত, বিশ্বাসঘাতকতায় দীর্ণ, এক নিপীড়িত গোষ্ঠীর জন্য ইসলামকে হাতিয়ার করে এক নিজ বাসভূমির সন্ধান, ভ্রাম্যমাণ যাযাবর থেকে ক্রমশ থিতু হওয়া, আত্মপরিচয় পাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের ভিতটুকু গড়ে দেওয়ার কাজ করছেন এর্তুগ্রুল বা এর্তুরুল, এভাবেই সিরিয়ালটা তৈরী। শুধু সাদাকালো নয়, মুসলমান তথা ইসলামকে আধুনিক মুসলিম তথা তুরস্কবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলাটাই ছিল এর চ্যালেঞ্জ, আর তাতে সে সফল।

কিন্তু এই সিরিয়াল গোটা আরব দুনিয়ার বিরোধিতার মুখে পড়েছে। সেখানকার বিভিন্ন সরকার এই সিরিয়ালকে নিষিদ্ধ করে, কারণ তাদের কাছে এ হল আরবদের ওপর অত্যাচারকারী অটোমান সাম্রাজ্যের গুণকীর্তন, সে যতই মুসলিম আর ইসলামের কথা বলুক না কেন। এদিকে এই জনপ্রিয়তা ইমরান খানকে প্ররোচিত করে এই সিরিয়ালটির উর্দু ডাবিং-এ এবং রিলিজ করা মাত্রই পাকিস্তানে তা একধাক্কায় জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দেয়, পাকিস্তান ছাপিয়ে কাশ্মীরে, ভারতে, বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যেও বিপুল সাড়া পড়ে।

এ হল আরেক প্রতীক নির্মাণ। এই সিরিয়ালের জনপ্রিয়তাই অনেকটা ভিত্তি গড়ে দিয়েছে আজকের দিনে হাজিয়া সোফিয়াকে আবার মিউজিয়াম থেকে মসজিদ বানানোর পেছনে। এরদোগান ডুব দিয়েছেন অতীতচারিতায়, ইসলামকে আশ্রয় করে এক কল্প গৌরব নির্মাণে, তুর্ক কত মহান ছিল, আমরা কত ভালো ছিলাম, এই অভিমান উসকে দিয়েছেন এরদোগান।

এরকম অজস্র প্রতীক তৈরী হচ্ছে, তৈরী করা হচ্ছে আমাদের চারপাশে। নরেন্দ্র যখন বলেন, জামাকাপড় দেখেই বোঝা যায় ওরা কারা, তিনি সচেতনভাবেই ওই কাজটা করেন। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর যখন শিখদের ঝুঁটি কেটে রাস্তার মোড়ে মোড়ে গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছিল, তখনও ঐ একই প্রতীক তৈরীর কাজ চলে। আর একাজটা সহজও বটে, কারণ পরিচয় আর তার প্রতীক ছাড়া মানুষ বাঁচে না। কারোর গায়ের রঙ কালো বলে, কারোর জন্মপরিচয় শূদ্র বলে, কারোর ধর্মপরিচয় ইসলাম বলে, কারোর ভাষাপরিচয় বাঙালি বলে, কারোর নাক চ্যাপ্টা বলে, কারোর পদবী সোরেন মাণ্ডি সর্দার বলে যখন তার পরিচয়টাকেই হাতিয়ার করা হয় তাকে দাবিয়ে রাখবার জন্য, তখন ঐ পরিচয়ই হয়ে দাঁড়ায় তার আত্মপরিচয় সম্মান আত্মমর্যাদার, উঠে দাঁড়ানোর অবলম্বন।

কিন্তু এত পরিচয় আর তার নিপীড়ন, আর বিরুদ্ধে নিপীড়িতের নিজ পরিচয় নিয়ে সমানাধিকারের দাবীতে উত্থান এক জটিল বিন্যাস তৈরী করে। এক নিপীড়িত মুসলমান কি নিপীড়িত বাঙালিও হতে পারেন, কিংবা নিপীড়িত কাশ্মীরী? এক নিপীড়িত কালো মানুষ কি নিপীড়িত মুসলমান বা নিপীড়িত আফ্রিকানও হতে পারেন? হতে তো পারেনই, চোখের সামনেই এই পরিচয়গুলোর সমাপতন আমরা দেখছি, প্রশ্ন হল কোন পরিচয়ে তিনি উঠে দাঁড়াবেন? এক নারী হিসেবে নিজের সমানাধিকার দাবী করতে হিজাব-বোরখা তিনি কি সরিয়ে দেবেন, নাকি ইসলামের ওপর, বা আসলে মুসলমানদের ওপর বিশ্বজোড়া পশ্চিমী পুঁজির হাতধরা পশ্চিমী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হিজাব-বোরখাই হবে তার আত্মপরিচয়? আরও গভীর প্রশ্ন হল একজন শূদ্র কিংবা সাঁওতাল রমণী যিনি মাথায় ঘোমটা দেওয়া সংস্কৃতির বাইরে আছেন, তিনি কোন প্রশ্নে হিজাব-বোরখা পরেই আত্মমর্যাদার লড়াই লড়তে থাকা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রীটির সাথে একাত্ম হবেন? আরও একটা প্রশ্ন হল, এক গরীব হিন্দু চাষী একজন গরীব মুসলিম চাষীর ওপর চলা মুসলিমবিরোধী নিপীড়নের প্রশ্নে কী ভূমিকা রাখবেন?

যারা শ্রেণীশোষণের কথা বলেন, তাদের কাছে এর এক ধরনের উত্তর আছে, এরা সবাই 'শ্রেণী' প্রশ্নে এক হবেন। এই সরল উত্তর ভারতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে ধরে নেওয়া হয় যেন 'শ্রেণী'শোষণে ঐ পরিচয়গত নিপীড়নগুলো কোন ভূমিকা রাখে না। ঐ পরিচয়গত নিপীড়নগুলোকেই যে অধিকতর শোষণ, অতি-মুনাফা পাওয়ার কাজে, সস্তা শ্রমিক তৈরী কাজে, সস্তায় শ্রমশক্তি কেনার কাজে ব্যবহৃত হয়, তারা তা দেখতে পান না, ফলে অসম্পূর্ণ স্লোগান ওঠে - জাত নয়, ভাতের লড়াই করুন। আর এভাবেই তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে নিপীড়িত জাতের আত্মমর্যাদার লড়াই, সমানাধিকারের লড়াই।

কিন্তু নিপীড়িত পরিচয় নিয়ে উঠে দাঁড়ানো গোষ্ঠীগুলোও কি একথা বোঝেন? বোঝেন যে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই পরিচয়গত নিপীড়ন শুধু তাকে হেয় করা নয়, তার কাছ থেকে, তার পরিচয়ের গোষ্ঠীর কাছ থেকে সস্তা শ্রম পাওয়ার উপায়ও বটে? একজন দলিত যুবক কি বোঝেন যে একজন মুসলমান চাষীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া পরিচয়গত নিপীড়ন আসলে তার ও ঐ চাষীর কাছ থেকে সস্তা শ্রম আদায়ের কায়দা, কিংবা মুসলমান চাষীও কি সেকথা বোঝেন? একজন হিন্দু উচ্চবর্ণের বেকার যুবকও কি একথা বোঝেন? নিপীড়িত একজন বাঙালি যুবক কি এক খোট্টা দলিত মজুরের পরিচয়ের সমস্যার কথা বোঝেন, বোঝেন একজন সাঁওতাল বা গোর্খা 'পরিযায়ী' শ্রমিকের সমস্যার কথা?

এই বোঝায় পৌঁছনো, এই বোধে পৌঁছনো যে এই পরিচয়গত নিপীড়নের আসল উদ্দেশ্য শুধু তাকে হেয় করা নয়, বরঞ্চ কর্পোরেটশাসিত এক ব্যবস্থার অধীন করে রাখা, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতজোড়া এক জনজাগরণের চাবিকাঠি। এই বোধ থেকেই বোঝা সম্ভব যে এই ব্যবস্থার অনুগামী প্রতিটি দল বা গোষ্ঠী কোন না কোন ভাবে এই বিচ্ছিন্নতা টিঁকিয়ে রাখার কাজ করে চলেছে, সে ভোট দিয়ে সরকার পালটেই ক্ষান্ত, সে গোটা নিপীড়ন তথা শোষণের কাঠামোকে কখনই মূলগতভাবে পালটানোর কথা বলবে না, আর তাই শেষ পর্যন্ত সে গোটা পরিকল্পনারই একটা অংশ, মানুষের বিক্ষোভকে কোন একটা গণ্ডীতে বেঁধে রাখার খেলায়, শুধু প্রতীক তৈরীর খেলায় ব্যস্ত, বাইরের চেহারাটা পালটানোর দিকেই তার নজর, ভেতর থেকে পালটানো সে চায় না। আর এই প্রতীক পেছনে তাকাতে বলে বেশি, সামনে কম।

নিপীড়িত পরিচয়ের লড়াই আর শোষিত শ্রেণীর লড়াইকে একসূত্রে গাঁথার কাজ তাই বলে থেমে নেই। সচেতনে অচেতনে এই কাজ চলছে, লকডাউনে কোটি কোটি দলিত আদিবাসী মুসলিম পরিচয়ের অভিবাসী শ্রমিকদের বিদ্রোহ এবং তার পাশে সমস্ত স্তরের সমস্ত পরিচয়ের গণতান্ত্রিক মানুষের দাঁড়ানোটা তার একটা উদাহরণ। দরকার এই ঐক্যকে সচেতনভাবে গড়ে তোলা। তবেই একবার এ'দল, একবার ও'দল বদলানোর শুধুমাত্র প্রতীকী বদল নয়, সত্যিকারের দিনবদলও নতুন সূর্যের মুখ দেখবে।

1 Comments

জয় মুখার্জি

04 August, 2020

দেশের রাজনীতি সবর্ণ হিন্দু দ্বারা পরিচালিত নিয়ন্ত্রিত। গতিকে যারা সায় দিচ্ছেন না তাঁরা রাজনৈতিক কারনেই দিচ্ছেন না, নাহলে আটখানা হতেন। ৬ই ডিসেম্বরে যে মসজিদ ভাঙা হয়েছিল তাও প্রতীকী। কমল নাথ যিনি তিরাশি সালে দিল্লিতে পুরোভাগে ছিলেন তিনি হনুমান চালিশা পাঠ করে চলেছেন। তার মধ্যে থেকেই এক নতুন ব্যবস্থা উঠে আসবে। আশাকরি।

Post Comment