পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ফেসবুকের জন্য কি চিরতরে বন্ধ হলো হাচালু হান্দেসার গান ?

  • 16 September, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1952 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
ভারতেও আজকে যে কথা উঠেছে যে তারা তাদের ব্যবসার জন্য শাসকদলের কিছু নেতা মন্ত্রীর করা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক পোস্টকে সরায়নি তা আবারও দেখিয়ে দেয় যে তৃতীয় বিশ্বের দেশে তাদের কোনও নিয়ম নেই। আমেরিকাতে তারা যেমন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে প্রভাবিত করে, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশে তারা তাদের ব্যবসার জন্য গৃহযুদ্ধ কিংবা গণহত্যার মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে ফেসবুক

ইথিওপিয়ান গায়ক হাচালু হান্দেসার গান হয়তো অনেকেই শোনেননি। তিনি সারাজীবন ভালোবাসার কথা, ঐক্যের কথা তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে শুনিয়ে এসেছেন। ওরোমো প্রজাতির মানুষদের সুখ দুঃখের কথা তিনি দীর্ঘদিন বলে আসছেন তাঁর গান দিয়ে। তিনি চিরকাল চেষ্টা করে এসেছেন যাতে তাঁর শিল্প এবং রাজনীতিকে আলাদা থাকে। তিনি বলে এসেছেন যে শিল্প যেন কখনও রাজনীতির কাছে মাথা না নত করে। কিন্তু ইদানীং তাঁর খুব সমস্যা হয়েছিল, এই রাজনীতি এবং শিল্পসৃষ্টিকে আর আলাদা রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ফেসবুকে এমন কিছু ভুয়ো প্রচার করা হয়, এমন কিছু অর্ধসত্য খবর প্রচার করা হয় হান্দেসার সম্পর্কে যে তিনি বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিচলিত হয়ে পড়েন। হঠাৎ বিভিন্ন গ্রুপ এবং ভুয়ো ফেসবুক পেজ থেকে প্রচারিত হতে থাকে যে হান্দেসা নিজের ওরো্মো জনজাতির শিকড়কে অস্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী আহমেদ আবিইর সঙ্গ দিচ্ছেন। আহমেদ আবিই সেই দেশের প্রথম ওরোমো জনজাতির থেকে উঠে আসা প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে ওরোমো জাতীয়তাবাদী নেতাদের অভিযোগ যে তিনি নাকি অন্য জনজাতির মানুষদের তোষণ করেন।

হান্দেসার গানের একটি লিঙ্ক

https://www.youtube.com/watch?v=Wv3he6CGF3E

ফল হয় মারাত্মক। হান্দেসাকে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন হতে হয়, ইথিওপিয়ার রাজধানী, আদিস আবাবাতে ২৯শে জুন ২০২০। যে মানুষটিকে পুলিশ এই খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করে, তিনি একটি সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী ওরোমো লিবারেশন আর্মি দলের সদস্য। তিনি বলেন যে এই খুনের ফলে ওরোমো জনজাতির উপকার হবে বলেই তিনি এই খুনটি করেছেন এবং হান্দেসা ছাড়াও তাঁদের আরও বেশ কিছু মানুষকে খুন করার পরিকল্পনা আছে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সী হান্দেসার এই নৃশংস হত্যার পর সারা ইথিওপিয়া জুড়ে আরও বেশ কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে, পরিণামে ১০০র ওপর মানুষ যারা মুলত খ্রিস্টান ওরোমো, খ্রিস্টান আমহারাস এবং গুরাগে জনজাতির মানুষজন মারা যায়। পুরো এই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানো হয়, ফেসবুকে কিছু উস্কানিমূলক প্রচার এবং ভিডিওর মধ্যে দিয়ে। উন্মত্ত জনতা বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়, মানুষের মাথা কেটে নেয় এবং বহু সম্পত্তি নষ্ট করে। যদিও হান্দেসার মৃত্যুর পরবর্তীতে সরকারের তরফ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় কিছুক্ষণের মধ্যে, কিন্তু তা সত্ত্বেও যতক্ষণ ফেসবুক চলে, ততক্ষণ জ্বলন্ত বাড়ি, গাড়ি এবং মানুষকে মারার ছবি এবং ভিডিও প্রচার করা হয়, এবং প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইন্ধন দেওয়া হয়।

২০১৮ সালে যখন আহমেদ আবিই, প্রথম ওরোমো জনজাতির তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন ভাবা হয়েছিল এবার হয়তো ইথিওপিয়া একটু শান্ত হবে। হান্দেসার গান এই ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই পরিস্থিতি সম্পুর্ন বদলে যায়, সারা দেশজুড়ে টুকরো টুকরো হিংসামূলক ঘটনা ঘটে। সব ঘটনার পিছনেই দেখা গেছে যে ফেসবুকের প্রভাব আছে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ৮০ জন মানুষ মারা যান, তার পিছনেও ফেসবুকে প্রচারিত ভুয়ো খবর এবং প্রচার ছিল সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আফ্রিকার ফেসবুকের যিনি অন্যতম মাথা তিনি স্বীকার করেছেন যে ফেসবুককে জানানো সত্ত্বেও, তাঁরা যেহেতু কোনও রকম কোনও পদক্ষেপ নেননি, তাই এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে পুরো ইথিওপিয়া জুড়ে, কারণ দেখা গেছে যে ওই দেশে ফেসবুকই খবরের অন্যতম একটি মাধ্যম। মানুষ ফেসবুককে বিশ্বাস করে, এবং সেখান থেকেই খবর সংগ্রহ করে থাকেন। ইউনাইটেড নেশন্সের তরফেও এই নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, যে ফেসবুক যদি কোনও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে ইথিওপিয়াতে আরও বড় গণহত্যা সংগঠিত হতে পারে এই ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ বার্তা দিয়ে।

আফ্রিকাতে ফেসবুক তার শাখা খুলেছে মাত্র কিছু বছর আগে। তখন ফেসবুক বলেছিল যে তারা অন্তত ১০০ জন মানুষকে চাকরি দেবেন। বিভিন্ন আফ্রিকার ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে থেকে যদি কোনও ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক লেখা উঠে আসে, সেদিকে নজর রাখাটাই হবে তাঁদের কাজ। অথচ ফেসবুকের যে ‘সামাজিক নীতি’ মেনে চলা হয়, তা ইথিওপিয়ার অন্তত দুটো ভাষায় নেই, সারা দেশে কোনও স্থায়ী কর্মচারী অবধি নিয়োগ করেনি ফেসবুক। যেকোনো স্বেচ্ছাসেবক যারা ফেসবুকের হয়ে কাজ করতে চায়, তাঁদের ওপরেই ভরসা করে, তারা তাদের ব্যবসা চালিয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি কিন্তু দেখিয়ে দিচ্ছে যে ফেসবুক যথেষ্ট সাবধান হয়নি এবং তারা ৪ বছর আগের মায়ানমারের ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি। মায়ানমারে যেভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হয়েছিল, যেভাবে সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল, তখনও যেমন ফেসবুক নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে, ঠিক সেইরকম ইথিওপিয়ার ক্ষেত্রেও হয়েছে।

ইথিওপিয়ার সঙ্গে ভারতের যেন অনেকটা মিল রয়েছে, ভারতেও শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন, যেগুলো ফেসবুক চলতে দিয়েছে, বারংবার বলা সত্ত্বেও সরিয়ে নেয়নি, ইথিওপিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। প্রভাবশালী সাংবাদিক এবং সরকারী ভাষ্যে ভারতে যেমন মাঝে মধ্যেই শোনা যায় ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ বা ‘আজাদি গ্যাং’ তেমনি ইথিওপিয়াতেও একই রকমের শব্দবন্ধ শোনা যেত এই ফেসবুকে – ‘নেফটেগনা’, যার ফলে ইথিওপিয়ার আমহারাস জনজাতির মানুষদের ওপর আক্রমণ নেমে আসে। এই যেমন ভারতে বিভিন্ন সময়ে মুসলমান এবং দলিতদের লক্ষ্য বানিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মারা হচ্ছে, ফেসবুক এবং হোয়াটসআপের গুজব ছড়িয়ে ঠিক একইরকম ভাবে ওই দেশেও মারা হয়েছে আমহারাস জনজাতির মানুষদের। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যেমন এখানে দেখা যায় যে বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়রা ভারতের মুসলমানদের মারার জন্য ভিডিও এবং লেখা ফেসবুকে ছাড়ছেন, ইথিওপিয়াতেও তাই হয়েছিল। কিভাবে আত্মঘাতী বোমা মেরে হলেও আমহারাসদের মারতে হবে এমন অজস্র ভিডিও ফেসবুকে পাওয়া গেছে। একদিকে যেমন বিভিন্ন মানুষের ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে ছোটখাট দাঙ্গা হয়েছে এই গত দু- বছরে তেমনি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক লেখা এবং পোস্টও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।

অথচ পাঁচ বছর আগে এই হাচালু হান্দেসার গানে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল ইথিওপিয়া। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবীতে তাঁর গানের মধ্যে দিয়েই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন আহমেদ আবিই। বিদেশে পলাতক বিরোধী দলনেতাদের ঘরে ফেরানোর কাজটিও করেন হান্দেসা। দেশের প্রথম মহিলা রাস্ট্রপতিও নির্বাচিত হয় এই সময়ে। ২০১৯ সালে মহিলা এবং পুরুষ উভয়ের যোগদানক্রমে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ মন্ত্রীসভাও গঠিত হয়। কিন্তু এই মধুচন্দ্রিমার স্থায়িত্ব বেশী দিনের হয়নি। আহমেদ আবিইর মন্ত্রীসভার আচরণের মধ্যেও ধীরে ধীরে তাঁর আগের অন্যান্য সময়ের প্রধানমন্ত্রীদের মতো দমন পীড়ন দেখা যেতে থাকে। ওখানকার মানুষদের মতে এই সমস্ত কিছুর পিছনে ফেসবুকের প্রভাব আছে। অথচ ফেসবুক এই বিষয়ে নির্বিকার। তাদের লক্ষ্য একমাত্র তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সেই জন্যেই হয়তো তারা যেকোনও সামাজিক সমস্যা বা জাতিগত বিদ্বেষ মূলক পোস্ট এসেছে, সেগুলো এড়িয়ে গিয়েছে, বা বলা ভালো সেগুলো বাড়ার ইন্ধন জুগিয়েছে। ওখানকার মানুষের বক্তব্য অনুযায়ী হয়তো প্রাথমিক ভাবে অনেক মানুষ আরও সোচ্চার হয়েছেন এই ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে কিন্তু আবিই আসার পর থেকে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়তে থাকে এবং যারা ফেসবুকের মধ্যে দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক কথা বলছিলেন, দেখা গেছে তাঁরাই গণতান্ত্রিক পরিসরকে ধবংস করার মুল কারিগর হিসেবে সামনে এসেছেন। ফেসবুক হয়তো নিজে হিংসা ছড়ায়নি, কিন্তু তারা যে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এই ঘৃণা ও বিদ্বেষকে বাড়তে দিয়েছেন এই বিষয়ে নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ভারতেও আজকে যে কথা উঠেছে যে তারা তাদের ব্যবসার জন্য শাসকদলের কিছু নেতা মন্ত্রীর করা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক পোস্টকে সরায়নি তা আবারও দেখিয়ে দেয় যে তৃতীয় বিশ্বের দেশে তাদের কোনও নিয়ম নেই। আমেরিকাতে তারা যেমন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে প্রভাবিত করে, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশে তারা তাদের ব্যবসার জন্য গৃহযুদ্ধ কিংবা গণহত্যার মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে। এই ফেসবুক আজ এতোটাই শক্তিশালী একটি সামাজিক মাধ্যম। এখনও যদি নাগরিকেরা সচেতন হয়ে এই ধরনের সামাজিক মাধ্যমগুলো থেকে না বেরিয়ে আসতে পারেন তাহলে আগামীতে ভারতেও যে গণতন্ত্র ধ্বংস হবে না, বা ভারতেও যে মায়ানমারের মতো গণহত্যা হবে না তা কি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়?

0 Comments

Post Comment