খুব সহজ এই খেলাটা, মানুষকে একলা করে দেওয়ার খেলা। সেই নোটবন্দীর সময় থেকে শুরু হয়েছে। প্রতিটি মানুষকে প্রমাণ করতে হবে সে কালোটাকার মালিক নয়, তাই প্রতিটি মানুষ ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের কষ্টার্জিত টাকা বদলিয়েছেন। সেটা করতে গিয়ে প্রায় ১০০ মানুষ মারা গিয়েছেন। তাও পাশের লোকটি বলতে পারেননি সরকারকে আমি কালো টাকার মালিক না। মাঝখান থেকে অমিত শাহের ছেলের সম্পত্তি বেড়ে গেছে।
এরপর এসেছে আধার। প্রতিটি নাগরিক ছুটেছেন এটা প্রমাণ করতে যে তিনি সন্ত্রাসবাদী নন, মোবাইলের সঙ্গে, ব্যাঙ্কের সঙ্গে আধার সংযোগ করতে দিনের পর দিন দৌড়েছেন। কিন্তু সরকারকে এই প্রশ্ন করতে পারেননি যে কেন তাঁকে প্রমাণ দিতে হবে এই বিষয়ে।
তারপর নাগরিকপঞ্জী। আসামের মানুষজন বাসে করে, ট্রেনে করে দূরদূরান্তে দৌড়েছেন নিজেকে নাগরিক প্রমাণ করতে। এতো সব করেও প্রায় ২০লক্ষ মানুষ কিন্তু বাদ পড়েছেন, কিন্তু তাও তাঁরা একজোট হয়ে আসামের সরকারের বিরুদ্ধে গলা তুলে চিৎকার করতে পারেননি যে কেন একজনকে প্রমাণ দিতে হবে সে এই দেশের নাগরিক? কেন একজনকে তাঁর পিতৃপুরুষের দলিল পেশ করতে হবে তা প্রমাণ করার জন্য? যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে ১৯৪৭ সালে যারা বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছেন তাঁরা মূলত হিন্দু এবং তাঁদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা শরণার্থী এবং অমিত শাহ সহ অন্যান্যরা যতই বলুন যে কোনও হিন্দুর নাম নাগরিকপঞ্জীর তালিকা থেকে বাদ যাবে না তা সত্ত্বেও সত্যিটা কি ? আসামে যারা নাগরিকপঞ্জীর তালিকা থেকে বাদ গেছেন তার বেশিরভাগটাই হিন্দু নয় কি? নাগরিকপঞ্জীতে নাম তোলার জন্য তো প্যান কার্ড, অর্থাৎ একজন নাগরিক সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করেন কিনা, বা ভোটার কার্ডই যথেষ্ট ছিল তাহলে এর সঙ্গে কেন জমির দলিল চাওয়া হয়েছে? সরকারের কাছে যেন জমির মালিকানার সমস্ত হদিশ থাকে। আরও একটু খুটিয়ে দেখলে পাওয়া যাবে যে মূলত মহিলারা বাদ গেছেন এই তালিকা থেকে। সরকার কিংবা কর্পোরেট কিন্তু চায় আরও সস্তার শ্রম যার জন্য সরকারের কোনও খরচ থাকবে না ফলে সেই রকম মানুষদেরই অঙ্ক কষে বাদ দেওয়া হয়েছে যেখান থেকে সরকার শ্রমিক পাবে। সেই শ্রমিকদের দিয়েই আপাতত আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প বানানোর প্রক্রিয়া চলছে আর সেখানেও যে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে তিনিও কিন্তু হিন্দু, নাম দুলাল পাল। দুলালবাবু ৫০ বছরের কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তাই তাঁর নাম বাদ গেছে তালিকা থেকে।
এই মুহূর্তে ভোটার তালিকা মেলানোর কাজ চলছে, তাও বেশীর ভাগ মানুষ জানেন না, কিভাবে করতে হবে?, কেন করতে হবে? সব কিছু ভাসা ভাসা। কেউই পরিষ্কার করে কিছু জানেন না, না কাগজে বড় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে না টিভিতে এসেছে। এখানেও নাগরিকেরা একা একাই করছেন সমস্ত কাজ।
সবাইকে একলা করে দেওয়ার খেলা। হয়তো বাংলায় নাগরিকপঞ্জী হবে , হয়তো বা হবে না, কিন্তু মানুষ যাতে ঐক্যমত্যে না পৌঁছতে পারে সেটাকে সুন্দর করে নামাচ্ছে এই বিজেপি সরকার। চারিদিকে কাজ হারাচ্ছেন বহু মানুষ কিন্তু তাও একজোট হতে পারছেন না। নাগরিকপঞ্জী বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আসলে মানুষের জমিজায়গা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত ছাড়া কিছু নয়। মানুষকে একলা করে তাঁকেই প্রমাণ করতে বলা যে ‘ আপনি ভারতের নাগরিক কিনা তার প্রমাণ আপনাকেই করতে হবে না হলে আপনার স্থান হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে’ এর মধ্যে যে ভীতি প্রদর্শন তাতেও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ গরীব মানুষ। আর কেন্দ্রের অধুনা সরকার এটা খুব ভালো বোঝে যে বেশিরভাগ হিন্দু মানুষের মধ্যে একটা মুসলিম বিদ্বেষ কাজ করে সেটাকে কাজে লাগাতে পারলেই ক্ষমতায় থাকাটা তাঁদের জন্য সুবিধাজনক। আর প্রতিটি মানুষ শেষ বিচারে একা এবং সে নিজের কথা বা তার একমাত্র কাছের মানুষের বাইরে ভাবতে রাজি নয়। তাই সে নোটবন্দীর বিরোধ করেনি, আধারের বিরোধ করেনি, নাগরিকপঞ্জীরও বিরোধ করবে না।
কারণ বিজেপি এই মূল মন্ত্রটা সবার মধ্যে যে আছে সেটা বোঝে।
আপনি বাঁচলে বাপের নাম।