পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভারত পাক যুদ্ধ : স্মৃতি হাতড়ে

  • 20 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 593 view(s)
  • লিখেছেন : মালবিকা মিত্র
ভারত পাকিস্তানের আগের যুদ্ধে কিছু গুজব ছড়িয়েছিল মুখে মুখে। কারণ গুজব ছড়ানোর মাধ্যম গুলো এত সক্রিয় ছিল না সেযুগে। অনেক বেশি ম্যানুয়াল। মুর্শিদাবাদে কোন পাকিস্তানী গুপ্তচর কে ধরা হয়েছে। কেউ বলবে, চন্দননগর উর্দি বাজারে, আবার কেউ বলবে হাওড়ার ঘুসুরিতে। এমনও শুনেছি, কে নাকি নৌকোয় উঠে গঙ্গা থেকে হাওড়া ব্রিজের ছবি ক্যামেরাবন্দি করছিল। ভাবটা যেন হাওড়ার ব্রিজের ছবিটা দুষ্প্রাপ্য এবং গোপন। এবারের যুদ্ধতে এই গুজব ছড়িয়েছে মূলত গণমাধ্যমগুলো। সেই নিয়েও গণমাধ্যমগুলো লজ্জা পেয়েছে বলে জানা নেই। সমস্ত বিদেশী গণমাধ্যমও এখন এই নিয়ে কথা বলছে, তাতেও কি লজ্জা হবে এঁদের?

এখন তো ২৪ ঘন্টা ব্যাপী লাইভ টেলিকাস্ট দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধের। বলা বাহুল্য বেশিটাই টেলিকাস্ট নয়। একটা কোন ছবি বা ভিডিও নিয়ে শকুনের উল্লাস, ডোমের পোস্টমর্টেম, লেট নাইট - হোল নাইট প্রোগ্রামে। কাজী নজরুলের ভাষায় - "আজকে প্রাণের গো ভাগাড়ে উড়ছে শুধুই চিল শকুনি" ...... অথবা বলতে হয় "ছুঁড়েছে পাথর, ছিঁটায় কাদা, কদর্যের এই হোরি খেলায়"। রাত বাড়লে সেই উল্লাস আরো বেড়েই চলে। ফ্যাক্ট চেকার রা যতই জানাক না কেন, কোনটা ফিলাডেলফিয়া, কোনটা গাজা, কোনটা ইসরাইল, কোনটা ইন্দোনেশিয়ার ছবি, ঠান্ডা স্টুডিওতে বসে তা নিয়ে লম্ফ ঝম্ফ করতে তো অসুবিধা নেই। ফ্যাক্ট চেকার সত্য প্রকাশ করবে তো পরে, তার আগে এই মন্থনে যতটা বিষ উথলে ওঠে সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু জাতীয়তাবাদী আবেগ, দেশপ্রেম এসব বিষয়ে তো আগেও ছিল, যখন টিভি আসেনি। তখন যুদ্ধ নিয়ে কেমন, কতটা জনমানসে প্রতিক্রিয়া হত জানার খুব ইচ্ছা হয়।

আসলে ১৯৬৫ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আমার বয়স হবে সাড়ে ছয় সাত বছর। ফলে সেই অভিজ্ঞতা খুবই অল্প, ঝাপসা। সিনিয়র অনেকের সাথে কথা বলে ছিলাম। আমি দেখেছিলাম রাস্তায় রাস্তায় লাইট পোস্টের আলো গুলোকে কালো টিনের কৌটার মত কিছু দিয়ে আড়াল করা। যাতে আলোটা নিচে রাস্তায় পড়ে। বিমান থেকে যেন আলোর উৎস দেখা না যায়। আমি দেখেছিলাম, কোন কোন বাড়িতে কাঁচের জানালায় চওড়া ফিতের মত খবরের কাগজ ক্রস করে করে আটকানো। যাতে কাঁচ ভেঙে গেলে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে বিপদ না ঘটতে পারে। কাঁচের জানালা আবৃত থাকলে আকাশ থেকে এরোপ্লেন আলো দেখতে পাবে না। তবে উদ্বাস্তু কলোনিতে সেই ১৯৬৫ সালে কাঁচের জানালার বাড়ি ছিল দুর্লভ। আমার কলোনিতেই পাকা ছাদের বাড়ি ছিল কড়ে গোনা। তথাপি গঙ্গা তীরবর্তী জিটি রোডের ধারে, পুরনো ধনী বণিকদের কিছু বাড়িতে কাঁচের জানালায় এমন দেখেছিলাম।

আর মনে আছে সিভিল ডিফেন্স এবং এনসিসির সদস্যরা, পাড়ায় ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করে, কম বয়সী ছাত্র যুবদের নিয়ে কিছু ট্রেনিং ক্যাম্প করেছিল। কোথাও আগুন লাগলে কিভাবে ভেজা চট দিয়ে চাপা দিতে হয়। কোথাও আগুন লাগলে প্রাথমিকভাবে লাইন করে দাঁড়িয়ে বালতিতে জল ভরে হাতে হাতে কিভাবে আগুন নেভাতে হয়। কিভাবে বোমা বা গুলির আক্রমণের সময়ে হাঁটু গেঁড়ে, কানে চাপা দিয়ে, মাথাটা মাটির দিকে ঠেকিয়ে অর্থাৎ শরীরটাকে গুটিয়ে রাখতে হয়। শক্তপোক্ত আস্তানা খুঁজতে হয়, কনুইয়ে ভর দিয়ে শরীরটাকে সরীসৃপের মতো এগোতে হয়, এইসব।

কথা হল সিভিল ডিফেন্সের এই ট্রেনিং গুলি সাধারণ ভাবে সামাজিক কাজ কর্মের ক্ষেত্রে, ঝড় বাদল, ঘূর্ণিঝড়, কোন অগ্নিকাণ্ড, কোন আহতকে কিভাবে বহন করতে হয়, এগুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। সব মানুষেরই জানা উচিত। কথাটা হলো এই সাধারণ জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো যখন একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে, বিশেষ সময়ে, মানুষের সামনে হাজির করা হয়, তখন সেটা ভিন্নমাত্রা বহন করে। যুদ্ধের আগে আগে এই ট্রেনিং ও কসরত মানুষকে মানসিকভাবে সন্ত্রস্ত আতঙ্কিত ও দুর্বল করে। আত্ম নির্ভরতার বদলে অনেক বেশি রাষ্ট্র নির্ভরতা এনে দেয়।

এছাড়া ১৯৬৫ এর যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেটা স্মর্তব্য যে, তখন পশ্চিমবাংলার সীমান্তে ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ফলে পূর্ব সীমান্তেও কিছু সামরিক হানা ঘটেছিল। দু একটি বিমান হামলা হয়েছিল। কিছু বিমান ঢুকে পড়েছে, আর তার পেছনে ধাওয়া করেছে আরো কিছু বিমান। ভূমি থেকে অ্যান্টিএয়ার ক্রাফট কামান গুলো বিমান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছে। আর আমাদের হুগলি জেলার পাশেই গঙ্গার ওপারে ব্যারাকপুরের সামরিক ঘাঁটি। ফলে বিমানের কিছু আনাগোনা এবং অ্যান্টিএয়ার ক্রাফটের গোলাবর্ষণ দেখা দিয়েছিল। বড় হওয়ার পর বুঝেছি, ওগুলো ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মক ড্রিল।

এই নিয়েই কম বাড়াবাড়ি হয়নি। অতিকথন, তিলকে তাল কম হয়নি। ধরুন চারটে প্লেন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে প্রবল শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। আর চারটি প্লেন তাকে ধাওয়া করেছে। আকাশে তো আপনি বুঝছেন না কে কাকে ধাওয়া করেছে। কোনটা ভারত কোনটা পাকিস্তান, শুধুই এরোপ্লেন। এবার চারটে প্লেন মুখে মুখে হয়ে গেল এক ঝাঁক প্লেন। মানে ২০-২৫-৫০-৬০ যা কিছু। প্রচুর ধোঁয়া ছাড়লো মানে দাঁড়ালো, প্লেনকে গুলি করেছে। তাই ওটা ধোঁয়া ছাড়ছে। অ্যান্টি এয়ারক্রাফট থেকে শেল তো ছোঁড়া হলো, সে তো আর প্লেনে লাগছে না। লক্ষভ্রষ্ট হয়ে বেশিটাই এদিক ওদিক পড়ল। অত উঁচু থেকে পড়লে স্বাভাবিক ভাবেই মাটিতে অনেকটা গেঁথে যাবে। বাড়িঘরে পড়লে ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনা। সে কি করা যাবে, শত্রুকে আক্রমণ করতে গেলে, এগুলো কো লেটারাল ড্যামেজ হিসেবে মেনে নিতে হবে। কিন্তু সেই শেল কত বড়, কত তার ওজন, সেটা লাগলে একটা প্লেন কেমন হতে পারে, এসব কত না কাহিনী মুখে মুখে ছড়িয়েছে। এই গল্পগুলো একটা সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করতে, আমাদের বাহিনীর আত্মগর্ব প্রচার করতে সমর্থ। বারাসাত বনগাঁয় প্লেন পড়েছে, এখানে শুনবো। আবার বারাসাত বা বনগাঁয় নিশ্চয়ই শোনা গেছে চন্দননগরে বা শ্রীরামপুরে পড়েছে। কোনটাই নাগালের মধ্যে নয়, ফ্যাক্ট চেকিং এর সুযোগ নেই।

কেন মনে নেই আরও কিছু গুজব ছড়িয়েছিল মুখে মুখে। কারণ গুজব ছড়ানোর মাধ্যম গুলো এত সক্রিয় ছিল না সেযুগে। অনেক বেশি ম্যানুয়াল। মুর্শিদাবাদে কোন পাকিস্তানী গুপ্তচর কে ধরা হয়েছে। কেউ বলবে, চন্দননগর উর্দি বাজারে, আবার কেউ বলবে হাওড়ার ঘুসুরিতে। এমনও শুনেছি, কে নাকি নৌকোয় উঠে গঙ্গা থেকে হাওড়া ব্রিজের ছবি ক্যামেরাবন্দি করছিল। ভাবটা যেন হাওড়ার ব্রিজের ছবিটা দুষ্প্রাপ্য এবং গোপন। তাকে পাকিস্তানের গুপ্তচর  সন্দেহ করে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাওড়া ব্রিজের দুই প্রান্তে বসানো হয়েছিল বিমান বিধ্বংসী কামান। মুসলমান অধ্যুষিত জনবসতি গুলি খুব স্বাভাবিক ভাবেই গুজবের টার্গেট হয়ে থাকে। কোথায় নাকি পাকিস্তান রেডিও র খবর শুনছিল গোপনে একদল গুপ্তচর। সেটা চুঁচুড়ার মিঁয়ার বের হতে পারে অথবা মেটিয়াবুরুজও হতে পারে। বলা যায় গুজব তখনও রটান হত, কিন্তু সবটাই ম্যানুয়াল।
১৯৬৫ সেই যুদ্ধের দিনগুলোতে বামপন্থীদের বিশেষ পৃথক অবস্থান শুনতে পাইনি। আমার পক্ষে শোনা সম্ভবও না। আমি তো তখন ক্লাস টু। সিনিয়র যারা তাদের কাছেও শুনিনি। এই যুদ্ধের পরেই তো তাসখন্দ চুক্তি এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু। এটা বেশ মনে আছে, এই যুদ্ধের সময় "জয় জওয়ান, জয় কিষান" স্লোগানটা খুব পপুলার হয়েছিল। মনে আছে, পরে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান মন্ত্রিত্বের সময়, ওই স্লোগানকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে বামপন্থী নেতারা বক্তৃতায় আরও দুটি শব্দবন্ধ জুড়েছিলেন "জয় রেশন, জয় শ্মশান"। মনে রাখবেন যুদ্ধ পরবর্তী বছরটিই ছিল বাংলায় খাদ্য আন্দোলনের বছর। রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয় শহর ও শহরতলীতে। যুদ্ধ পরবর্তী ১৯৬৬ র খাদ্য আন্দোলন ও ১৯৬৭ তে অ কংগ্রেসি সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে এটা প্রমাণ হয় যে ১৯৬৫ ভারত পাক যুদ্ধ এই বাংলায় জাতীয়তাবাদী মেরুকরণ ঘটাতে পারে নি। শাসক কংগ্রেস দলকে তা বিশেষ সুবিধা এনে দেয়নি।

১৯৭১ এর পাক ভারত যুদ্ধ অনেকাংশেই প্রতিবেশী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিশে যায়। বাংলা, বাঙালি, বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ, ভাষা আন্দোলন, এসব মিলে একটা বাঙালি সেন্টিমেন্ট তৈরি ছিল। ফলে এই যুদ্ধে পাকিস্তান বিরোধী একটা সাধারণ আবেগ কাজ করেছিল। তদুপরি বাংলাদেশের এই লড়াইয়ে, ভারত সরকারের সামরিক অবস্থানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর ফলে সরকারি বামেরা খুব স্বাভাবিকভাবেই এই যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিল। অর্থাৎ বাংলা বা বাঙালি সেন্টিমেন্ট বলি, ভারত-পাক আখ্যান বলি, অথবা সোভিয়েত - আমেরিকা আখ্যান বলি, সবদিক থেকেই এই যুদ্ধের পক্ষে ছিল ভারতের সাধারণ জনমত।

কিন্তু এটাই শেষ কথা না। এই সময় আরেকটি আখ্যান তৈরি হয়েছিল। প্রবল জনপ্রিয় না হলেও আমার মত নাবালকও সেদিন বুঝেছিলাম যে, সত্তরের দশক সারা বিশ্বে মুক্তির দশক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভারতে যেমন এ সময় নকশালপন্থী আন্দোলন সক্রিয় হয়েছে, ঠিক তেমনি নেপালে, পূর্ব পাকিস্তানেও নকশালবাড়ি আন্দোলন সক্রিয়। বাংলাদেশে এই আন্দোলন উত্তর-পূর্ব ভারত দিয়ে চীনের প্রত্যক্ষ সমর্থন লাভ করেছিল। এই অবস্থায় ভারতের প্রতিবেশী দেশের একটি কট্টর বামপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়া বা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়া, এগুলির কোনটি সরকারি বাম, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত সরকার, কারো কাছে কাম্য ছিল না। তাই তারা সরাসরি ভারতীয় সেনা দিয়ে তাদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে শুধু পাক আধিপত্য নয়, নকশালপন্থী ও চীনের আধিপত্যের সম্ভাবনা প্রতিহত করেছিল। ফলে ১৯৭১ এর পাক ভারত যুদ্ধেও নকশালপন্থী ব্যতীত, অন্য সকলেই মোটামুটি ভাবে ভারত সরকারের যুদ্ধ প্রয়াসকে সমর্থন জানায়। মনে আছে তখন সম্ভবত আমি ক্লাস এইট। ওই সময়েই নকশালপন্থী দাদাদের কাছে  সিরাজ শিকদারের নাম শুনেছিলাম।

সে যুগে প্রচারের ক্ষেত্রে প্রথমত বেশ কিছু গান সর্বক্ষণ রেডিওতে বাজানো হত। যেন থিম সঙ্।  উল্লেখযোগ্য ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি"..... "বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ! বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ!" এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের বেতার কেন্দ্র কলকাতায় স্থাপন করা হয়েছিল। সেখান থেকে মুজিবর রহমানের বক্তৃতা নিয়মিতভাবে প্রচার করা হতো। "এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশকে মুক্ত করবোই করবো। জয় বাংলা।" এমনই সব বক্তৃতা।

এ সময় পাকিস্তান বিরোধী গুজবের একটা বড় মাধ্যম ছিল বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু স্রোত। তারা সীমান্ত পার হবার নানা গল্প কাহিনী অভিজ্ঞতা বর্ণনা করত। এর মধ্যে অনেক করুণ, নির্মম, মর্মান্তিক কাহিনী ছিল। আবার বহু কাহিনী অতিরঞ্জিত থাকতো। সেই কাহিনী যত মুখে মুখে প্রচারিত হতো, তা বিকৃত হতো এবং তিলকে তাল করে পরিবেশন হতো। এপার বাংলা সেসব তাড়িয়ে তাড়িয়ে আস্বাদন করতো। পাক বিরোধী মগজ পুষ্ট হতো।

বেশ মনে আছে, বহু বছর পর এমনই একটি উদ্বাস্তু পরিবারের সিডিউল কাস্ট সার্টিফিকেট যোগাড় করতে এসডিও অফিসে গিয়েছিলাম। ফার্স্ট জেনারেশনের সার্টিফিকেট। সেখানে একজন অফিসার আবেদনকারীর দিদিমাকে প্রশ্ন করে করে ভেরিফিকেশনের সুযোগে, সীমান্ত পার হবার করুণ কাহিনী তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলেন। সেই মহিলা তার নিজের মেয়ের উপর জওয়ানদের ধর্ষণের কথা বলছিল। মা হয়ে মেয়ের উপর যৌন নির্যাতন দেখতে হয়েছে। কার্যত মহিলা কাঁদছিলেন। তখন সেই অফিসার প্রশ্ন করে ছিলেন, নিশ্চয়ই ওই জওয়ানগুলো খানসেনা? জবাবে বৃদ্ধা জানায়, ভারতীয় সেনা আর খান সেনাকে আলাদা করে চেনা যায় না। সব সেনাই দেখতে এক রকম।

এরপরেও বলবো ১৯৭১ এর যুদ্ধ বাঙালি আবেগকে কিছুটা উৎসাহিত করলেও কখনই সেটা আজকের মত উগ্র হিন্দুত্বে বা উগ্র জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়নি। কারণ এর পরেও তো ১৯৭১ সালে সাধারণ নির্বাচনে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে মুজিবর রহমান কে এনে, একই মঞ্চে সভা করলেন। ব্রিগেডের  ইতিহাসে সেই জমায়েত সর্ববৃহৎ। কারো কারো মতে সর্বাধিক প্রায় ১০ লক্ষ। ওই জমায়েতের ধারাবিবরণী দেওয়া হয়েছিল আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে। কিন্তু তারপরেও ১৯৭১ এর নির্বাচনে কংগ্রেস দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সিপিএম সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বে একটা জোড়া তালি সরকার গড়া হলেও, মাস তিনেকের মাথায় সেই সরকার ভেঙে যায়। ফলে ১৯৭২ এ পুনরায় নির্বাচন আসন্ন হয়।

নির্দ্বিধায় বলতে পারি ১৯৬৫ ও ১৯৭১ এর যুদ্ধে কিছু মাত্রায় হলেও বাংলার সীমান্তে কিছুটা উত্তাপ লেগেছিল। কিন্তু ২০২৫ এর এই পাক ভারত বিরোধ পর্বে বাংলা সীমান্তে কোন উত্তাপই লাগেনি, লাগার কথাও না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এখানে সারা রাত্রি উন্মাদনা সহ যে হোল নাইট সার্কাস অনুষ্ঠিত হলো, কিছু মিথ্যা ছবি ও ভিডিও প্রদর্শন করে, সেটার জুড়ি মেলা ভার। একটা চালু কথা ছিল যুদ্ধ থেকে যে যত দূরে তার গলায় যুদ্ধোন্মাদনা সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। সরকার নিজে বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিদিনের প্রেস বিবৃতিতে কোথাও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন নজরে পড়েনা। সেই দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিয়েছে  সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন মেজর - কর্নেল - লেফটনেন্ট জেনারেল।

কিন্তু তাদের কপালেও একটা ভাঁজ কিন্তু থেকেই গেল। ১৯৬৫ এর যুদ্ধ, ১৯৭১ এর যুদ্ধ, ১৯৮৪ এর ইন্দিরা গান্ধী হত্যা, ২০১৯ এর পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ড, কোন ঘটনায় বাংলায় সরকারি প্রচার, উগ্র জাতীয়তা, তথাকথিত দেশপ্রেম, সাড়া জাগাতে পারেনি। মনে রাখবেন ১৯৮৪ তে কংগ্রেস কিন্তু এ রাজ্যে লোকসভায় মাত্র ১৬ টি আসন জয় করেছিল। আর ২০১৯ এ বিজেপি লোকসভায় যে ১৮ টি আসন লাভ করেছিল, সেটা পুলওয়ামার প্রভাব নয়। সেটা ছিল সরাসরি ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বামের ভোট রামে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত ও তার ফল। অর্থাৎ সবকিছুর পরেও এই বাংলার নাড়ীর স্পন্দন বুঝে ওঠা খুবই দুরূহ। ১৯৮০  সারাদেশে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের পর, বাংলায় শোচনীয় পরাজয় কে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, কংগ্রেসের অশ্বমেধের ঘোড়া বাংলা সীমান্তে এসে গাধায় পরিণত হয়েছে। অতএব ভাবনা কিন্তু দূর হইল না, শোনেন ও মুনশী গো।

0 Comments

Post Comment