পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জেল যেখানে আইন, বেল যেখানে ব্যতিক্রম

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 206 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক চট্টোপাধ্যায়
প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ফ্রান্সিস বেকন বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন যে তাঁদের কর্তব্য হচ্ছে দেশের জনসাধারণের কল্যাণসাধন। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে বিচারব্যবস্থাটাই মোটের ওপর শাসকদলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে!—বেকন-এর এই ক্ষোভ যে কতটা সত্য তা আমরা তো আমাদের দেশে অহরহ প্রত্যক্ষ করে চলেছি। উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম সহ অন্যান্যদের বিনা বিচারে জেলে রাখা তার প্রকৃষ্ট ও সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।

কবি-সাংবাদিক-নকশাল নেতা সরোজ দত্ত ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের অগাস্ট মাসে রাষ্টীয় বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার অব্যবহিত পরে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন  তাঁর এক যন্ত্রণাবিধূর কবিতা। তার শিরোনাম ছিল ‘বিচার’। এই কবিতায় কবিহৃদয়ের যন্ত্রণা ছত্রে ছত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। প্রবল আক্ষেপে কবি এই কবিতার শেষে লিখেছিলেন : এ দেশে মানুষ কেউ আছে না কি? আমিও কি এখনো মানুষ?

কবির সেই আক্ষেপ আজও  রয়ে গিয়েছে। সরোজ দত্তের বিচার হয়নি। বিচারের দাবি এই রাষ্ট্রের পাথুরে দেওয়ালে বারবার ধাক্কা খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছে। এদেশে সেসময় মাথা উঁচু করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে মুখর হওয়ার মানুষকে কবি বীরেন্দ্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আজও আমরা আমাদের ঘিরে থাকা অজস্র মানুষের মধ্যেও কবি বীরেন্দ্র প্রার্থীত মানুষকে খুঁজে পাইনা। আমরাও ক্রমশই মানুষের আচ্ছাদনে থেকে অমানুষে রূপান্তরিত হয়ে চলেছি। প্রতিবাদে উৎসাহ পাই না, মার খেয়েও কাঁদতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের বিপ্রতীপে অধিকার হারানোর যন্ত্রণায় কাতর হয়েও উঠে দাঁড়াতে ভয় পাই। আমরা আমাদের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে বসে থাকি, আর এই পরিব্যবস্থায় বিচার, আইন, প্রশাসন তাদের চারিত্রিক স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে একটি ফ্যাসিস্ত সরকারের গোলামবৃত্তিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ক্রমশই। মগজ, মেধা, চিন্তা সবই আমরা বন্ধক দিয়ে বসে আছি।

প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ফ্রান্সিস বেকন বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন যে তাঁদের কর্তব্য হচ্ছে দেশের জনসাধারণের কল্যাণসাধন। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে বিচারব্যবস্থাটাই মোটের ওপর শাসকদলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে!—বেকন-এর এই ক্ষোভ যে কতটা সত্য তা আমরা তো আমাদের দেশে অহরহ প্রত্যক্ষ করে চলেছি। আদালত যখন জনস্বার্থ রক্ষার বিপ্রতীপে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন শাসকদলের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, তখন অনিবার্যভাবেই দেশে বিচারব্যবস্থার জনকল্যাণকারী ভূমিকা বিড়ম্বিত হয়। তবুও তো দেশের মানুষ ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশায় এই বিচারালয়ের কণ্টকাকীর্ণ পথে বিদ্ধ হতে হতেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে চান, চাতকের মতো অসীম তৃষ্ণা নিয়ে সুবিচারের বারিধারায়  সিক্ত হওয়ার জন্যেই।

১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে বিচারপতি কৃষ্ণ আইয়ার বলেছিলেন : ‘বেইল ইজ দ্য রুল, জেইল ইজ দ্য এক্সেপশান’। কিন্তু আমাদের দেশের বিচারকদের মুখেই এই উচ্চারণের পাঁচদশক পূর্তির দ্বারপ্রান্তে এসে আমরা দেখছি বিনাবিচারে মাসের পর মাস, বছরের পর জেল তথা কারাবন্দিত্ব একটা সাধারণ রাষ্ট্রিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের সাজানো অভিযোগের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় বিচারালয়ে। অভিযুক্তের বক্তব্য মান্যতা পায়না। তথ্য-প্রমাণ এখন এক নির্দিষ্ট নির্দেশ শাসন মেনে চলে!

গত ২ সেপ্টেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট দীর্ঘ পাঁচবছরেরও (২০২০-র বিভিন্ন সময় থেকে) অধিককাল তিহার জেলে কার্যত বিনাবিচারে কারাবন্দি থাকা সত্ত্বেও উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম, গুলফিসা ফতিমা, আথার খান, খলিদ সাইফি, মহ্মমদ সালিম খান, শিফা-উর-রহমান, মিরন হায়দার, সাদাব আহমেদ—এই নয়জন বন্দির জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করেছেন। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ‘দিল্লি দাঙ্গার’ পেছনে চক্রান্তকারী হিসেবে এঁদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। দীর্ঘ পাঁচবছর  অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও নির্দিষ্ট সজীব বিচারপ্রক্রিয়া ব্যতিরেকেই এঁদের সম্পর্কে বলে দেওয়া হয়েছে যে, দিল্লি-দাঙ্গা ছিলো আসলে এঁদের পূর্বপরিকল্পিত এক গভীর চক্রান্তের ফলশ্রুতি! এইসব অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে কুখ্যাত য়ুএপিএ আইনের ১৬ নম্বর ধারা,  যার ফলে বিচারে ‘সন্ত্রাসবাদী কাজে যুক্ত থাকার কারণে’ এঁদের প্রাণদণ্ডের আদেশ হতে পারে!

উমর খালিদ সহ এইসব অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে যে এঁরা নাকি তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের গোপন আলোচনার মাধ্যমে এই দাঙ্গা সংঘটিত করেছিলেন। প্রকৃত সত্য থেকে বহুযোজন দূরে গিয়ে এক পরিকল্পিত মিথ্যার জাল বুনে এই অভিযুক্তদের কারারুদ্ধ করে রাখার একটি রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত সাধিত হয়েছিল এবং সেই মামলায় দীর্ঘ পাঁচবছর পরেও এঁরা জামিন পাচ্ছেন না! গুলফিসার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে মহিলাদের প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। শার্জিল ইমাম নাকি এটাই প্রচার করেছিলেন যে সিএএ (সিটিজেন আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) মুসলিম স্বার্থবিরোধী, এবং এই আইনের মাধ্যমে এই দেশের মুসলিম জনসাধারণকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে!

দেখা যাচ্ছে, এখানে আবার এই ‘দিল্লি-দাঙ্গা’ সংঘটনের পশ্চাৎপটে সিএএ বিরোধী জনপ্রিয় জনআন্দোলনের সঙ্গে এইসব তথাকথিত অভিযুক্তদের সংযোগের তথ্য মিলছে। রাষ্ট্রীয় আইনে বলা হয়েছে যে যদি দেখা যায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে জারি করা অভিযোগ আপাত-সত্য বলে মনে হয়, তবে  সেই অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। আর এরই সূত্রে উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম, গুলফিসা ফতিমা সহ অভিযুক্ত আরও সাতজনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে তাঁদের জামিন অগ্রাহ্য করার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন বিচারকেরা! ফলে স্বাভাবিকভাবেই উমর খালিদ সহ অন্য দশজনের জামিনের আবেদন দিল্লি হাইকোর্ট অগ্রাহ্য করেছে!

একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের উত্তরসম্পাদকীয় স্তম্ভে যোগেন্দ্র যাদব লিখেছেন : আমি স্পষ্ট মনে করতে পারছি, ২০২০-র জানুআরি মাসের এক সন্ধ্যায় ভিয়ান্ডিতে লক্ষাধিক শ্রোতার উপস্থিতিতে সিএএ-র বিরুদ্ধে এক মনমাতানো বক্তৃতায় সবাইকে অভিভূত করে দিচ্ছেন উমর খালিদ। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে আবেগতপ্ত যুক্তির বিস্তার বাস্তবিক ছিল বিস্ময়কর। তাঁর বক্তৃতার শুরুতে তিনি উপস্থিত সবাইকে ‘বিপ্লবী অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন এবং স্মরণ করেছিলেন ভগৎ সিং, বি আর আম্বেদকর এবং স্বয়ং গান্ধিজিকে, আর সিএএ-র বিরুদ্ধে এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অহিংসার পথে পরিচালনার কথা বলেছিলেন। সিএএ-কে তিনি দেশের সংবিধানবিরোধী বলেও অভিহিত করেছিলেন, বলেছিলেন এই আইন দেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পর্যবসিত করার এক অপপ্রয়াসী স্বাক্ষর।

এখানে কোনও উসকানিমূলক কথা বলা হয়নি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইন্ধন যোগানোও হয়নি। দেশের জনস্বার্থবিরোধী আইন সিএএ-র প্রতিপক্ষতাকে দিল্লি-দাঙ্গার অনুঘটক হিসেবে চিহ্নিত করে আসলে দেশের ফ্যাসিস্ত সরকার এই আন্দোলনের সংঘটকদের দাঙ্গার ইন্ধনকারী এবং দেশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করে মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত করে কুখ্যাত য়ুএপিএ আইনে গ্রেপ্তার করে বছরের পর বছর কারান্তরালে রেখে দিয়ে বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে তাকে ন্যায্যতা দিয়ে চলেছে।

২০১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে অহরহ পুলিশ এবং মিডিয়ার নজরবন্দি উমর খালিদ কীভাবে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে এই দাঙ্গার চক্রান্ত হাশিল করলেন তা কোনও যুক্তি-বুদ্ধির অগম্য। যোগেন্দ্র যাদব লিখেছেন যে উমর খালিদের হাড়েমজ্জায় সাম্প্রদায়িকতার নামগন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি ছিলেন সিএএ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় সংগঠক। তাঁর অন্যতম সহযোদ্ধা খলিদ সাইফিও হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান জনপ্রিয় এবং এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। যাদব আরও লিখেছেন : সিএএ মুসলিম স্বার্থবিরোধী বলার কারণে যদি উমর খালিদ কারারুদ্ধ হয়ে থাকেন, তবে তিনি নিজেও ওই মত পোষণকারী। সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হওয়ার কারণে যদি উমর কারারুদ্ধ হয়ে থাকেন, তবে তিনি নিজেও ওই মত পোষণকারী। আসলে  দিল্লি পুলিশের ‘কনসপিরেসি থিয়োরি’কে কোর্ট ন্যায্যতা দিয়েছে।

দিল্লি পুলিশের ‘কনসপিরেসি থিয়োরি’কে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে কোর্ট এতথ্য বিস্মৃত হয়েছে যে দিল্লি-দাঙ্গার সময় রাগিনী তিওয়ারি, প্রদীপ সিং, যতি নরসিংহানন্দ এবং ‘মাননীয়’ মন্ত্রীদ্বয় কপিল মিশ্র এবং অনুরাগ ঠাকুর কী ধরনের ঘৃণা ভাষণ ছড়িয়েছিলেন! এই বিচারব্যবস্থায় উমর খালিদরা মিথ্যে অভিযোগে বছরের পর বছর বিনাবিচারে কারান্তরালে তাঁদের জীবনের মূল্যবান সময় কাটাতে বাধ্য হন, তাঁদের জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য হয়, আর অন্যদিকে ধর্ষণের অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত বিজেপিপ্রিয় গুরমিত রাম রহিম ইতিমধ্যে গত আটবছরে চোদ্দবার প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন!

সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সাংবিধানিক রক্ষাকবচের তোয়াক্কা না করেই বলেছেন যে, আপনি যদি দেশের স্বার্থবিরোধী বিন্দুমাত্র কিছু করে থাকেন, তবে, আপনি সাজাপ্রাপ্ত হোন বা না-ই হোন, আপনার যথাযথ আশ্রয় হচ্ছে কারাগার! আর এরই পরিসূত্রে বিচারালয়কে আমরা বলতে শুনি : বিচারের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করার অর্থই বিচারপ্রার্থী এবং রাষ্ট্র উভয়ের প্রতি অবিচার করা।—স্বভাবতই বিচারের নামে দীর্ঘকাল কাউকে মিথ্যে অভিযোগে কারান্তরালে রাখা ন্যায্যতা পেয়ে যায়! এর নির্যাস : উমর খালিদরা আরও অনেক অনেক বছর বিনাবিচারে কারান্তরালে থাকতেই পারেন, কারণ তাড়াহুড়ো করার অর্থই তো অবিচারের পোষকতা করা!

ফ্রান্সিস বেকন-এর কথা দিয়েই এই প্রতিবেদনের ইতি টানছি। বেকন তাঁর ‘অন জুডিকেচার’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন :  বিচারকদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়, নীতিনিষ্ঠতার সঙ্গে পালনীয় কাজকর্ম করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তার ওপর নজরদারি রাখা তাঁদের দায়বদ্ধতার অঙ্গ। আইন তখনই  ভালো হতে পারে  যখন এই আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়।

0 Comments

Post Comment