গাড়িটা খিদিরপুর থেকে ডান দিকে বেঁকতেই চেনা গন্ধ পেলাম। প্রায় দেড় দশক বাদে এইরাস্তায়।
আমার প্রথম চাকরি এই পাড়ায়, সেটা ১৯৯৯-২০০০ ।
আমার পোস্টিং ছিল খিদিরপুর দইঘাট রেডলাইট এরিয়ায়। আজ প্রায় ২০ বছর বাদে মুন্সিগঞ্জে গেলাম এক বন্ধুর সঙ্গে। মেয়েদের খবরাখবর নিতে। তারা কেমন আছে জানতে।
খিদিরপুর রেডলাইট এরিয়া গড়ে ওঠার একটা বড কারণ হল কলকাতা বন্দর। একটা সময় এই বন্দর গমগম করত, জাহাজের ভোঁ আর দেশি বিদেশী মানুষের আনাগোনা। তারপর আস্তে আস্তে কলকাতা বন্দর বিভিন্ন কারণে তার প্রতিপত্তি হারায়। তেমন জাহাজ আসে না, বড় মালবাহী জাহাজও খুব কম। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে দু পাশে সরে যায় ব্রীজটা দেখতে গিয়েছিলাম।জাহাজ নেই, মানে লোকজনও নেই, লালবাতি এলাকায় এমনিতেই খদ্দের কমতে থাকে। গতকাল গিয়ে আরও হতশ্রী অবস্থা দেখলাম। মুন্সীগঞ্জে ফ্রেন্ডস ক্লাবের উল্টোদিকের বাড়িগুলোতে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কেউ কেউ বাইরে বসেছিল, হাতপাখা দিয়ে বাতাস খাচ্ছিল, কেউ চুল আঁচড়াচ্ছে, কেউ মন গিয়ে মোবাইলে গেম খেলছে। অলস আষাঢ়ের দুপুর এই করোনা পরিস্থিতিতে আরও থমকে দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখে কেউ কেউ নড়ে চড়ে বসল। কথা বলব বললাম, বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আশ্চর্যজনক ভাবে একটি মেয়েকেও ওখানে মাস্ক পরতে দেখলাম না। জানতে চাইলাম মাস্ক কোথায়? বিপ্লবী ববিতা ( নাম পরিবর্তিত ) এসে বলল মাস্ক পরব না। এত ঘিঞ্জি জায়গায় একটা করোনা রুগীকে দেখান তো, তাহলে পরব। কটকট করে কথাগুলো বলল, ওর চোখেমুখে তেজ ঠিকরে বেরচ্ছে। অন্য মেয়েরাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল যে মাস্ক পরলে খদ্দের যা যতটুকু আসত, তাও আসবে না। প্রশ্ন করলাম, খদ্দের বসাচ্ছ? সবাই এ ওর দিকে তাকাল। মোদ্দা কথা যা বোঝা গেল খদ্দের যদি আসে, তাহলে বসাবে। কতদিন আর জমানো পয়সায় খাওয়া দাওয়া চলবে। স্যানিটাইজ করা নিয়েও তাদের পরিষ্কার মত । হাতটুকু স্যানিটাইজ করলেই কী হবে! সারা শরীর তো আর স্যানিটাইজ করা যাবে না।
বাকিদেরও বক্তব্য, অবস্থা খুব খারাপ। যারা লক ডাউনের আগে বাড়ি চলে গেছে, তাদের ওখানে রোজগার নেই , আর যারা এলাকায় আছে তাদের এখানে রোজগার নেই। বাড়িতে টাকাপয়সা পাঠাতে পারছেনা। একজন বলল আগে তো নিজে বাঁচি , তারপর বাড়ির কথা ভাবতে হবে। বেশির ভাগ মেয়েরই তো বাড়ির লোকরা জানে না তারা লাইন বাড়িতে আছে। তারা জানে কেউ চা গুদামে, ব্যাগ ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। লক ডাউন খুললেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মেয়েরা তা বলছে না। সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে তারা। খদ্দেরদের পয়সা কোথায় যে এই পাড়ায় আসবে। যে কজন আসছে, নাসিমা জানালো, আগে যদি ১০০০ টাকা দিত এক ঘন্টার জন্য, এখন তা ১৫০ কি ২০০। এইভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।রেশন পাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে খাবার দাবার দিচ্ছে। দুর্বার বা দীক্ষার মতো প্রতিষ্ঠান সাহায্য করছে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান কই ? ওরা নিজেরাই বলছে এইরকম বেশিদিন চললে না খেতে পেয়ে মরব। আবার খরখরে গলায় কবিতা বলে ওঠে বাঁচলে বাঁচব, মরলে মরব, এর বেশি ভাবতে পারছি না। ছিপছিপে চেহারার, কাটা কাটা চোখ মুখের এই মেয়েটি এপাড়ায় সবচেয়ে ভোকাল। এদের পাশে দাঁড়িয়েছে পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে সাহায্য করতে। কিন্তু নিজেরাও জানে না কতদিন এই অবস্থায় চালাতে পারবে। সঞ্চয় শেষ হচ্ছে ওদেরও। মুখ ফুটে না বললেও বোঝা যায় সাহায্য চাইছে ওরা।
এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও কারোর কারোর সঙ্গে কথা হল। রীতার ( নাম পরিবর্তিত) কাছে জানতে চাইলাম রুটিন কী সারাদিনের। বলল, রান্না করা খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, লুডো খেলা । ঘরের বদলে রাস্তায় বসে থাকে। কারণ লাইট পাখা চললে ইলেকট্রিকের বিল বেশি আসবে। যখন জানতে চাইলাম বাড়ির লোক চিন্তা করে না, বলল যদি চিন্তা করত তাহলে তো আজকে এখানে দেখতে পেতেন না আমাকে।
পরিস্থিতি সাময়িকভারে সামলানো গেলেও ভবিষ্যত কিন্তু বেশ নড়বড়ে।এদের জন্য বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা করতেই হবে। নাহলে অচিরেই শুধু তো এরাই নয়, বাচ্চাকাচ্চা সমেত পরিবারগুলো ডুবে যাবে। করোনা এদের হাতে না মারলেও ভাতে মারবে।
অনিশ্চয়তার বারুদে বসে এরা। বেলা পড়ে আসে, আমাদের ফিরতে হবে । লিখতেও হবে এদের নিয়ে, কিন্তু তাতে এদের কতটা কী হবে জানি না। তবে, ওরা কিন্তু ওদের মতো করে বেঁচে নিচ্ছে ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতেও। চোখের ইশারার ঠমকে যখন পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে ওঠে, বোঝা যায় জীবন তো এমনই একটা সিলভার লাইনের মাঝখানে দাঁডিয়ে ।
ফেরার সময়ে নিয়ে এলাম মুন্সিগঞ্জ ক্লাবের ব্যঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বর, এই আশা নিয়ে যে এই লেখা পড়ে কেউ কেউ নিশ্চয় মুন্সিগঞ্জের মহিলাদের পাশে দাঁড়াবেন। যদিও সেই সাহায্য হয়তো অপ্রতুলই হবে, তবুও কিছুটা তো সুরাহা হবে। এই লেখাটা যতজনের কাছে পৌঁছবে, ততটুকুই হয়তো আশার আলো।
MUNSHI GUNGE FIVE STAR CLUB
Savings Account No : 6263018164
IFSC : IDIB000K036
Ph No : 9836548149