দিল্লিতে ২৬ জানুয়ারি লাখো মানুষের ট্রাকটর মিছিলের একটা অংশকে পরিকল্পিত ভাবে ঈষৎ ঘেঁটে দিয়ে বিজেপি-আরএসএস ভেবেছিল, এবারে দেশপ্রেমের ধ্বজা তুলে দেশবাসীকে খেপিয়ে দিয়ে কৃষক আন্দোলনকে ভেস্তে দেওয়া যাবে। এই একই পদ্ধতি তারা শাহিনবাগ আন্দোলনের সময়েও নিয়েছিল। এবারে তাদের ধারণা ছিল, সহজ-সরল মনের কৃষকদের মধ্যে যদি এই সুযোগে কিঞ্চিৎ অপরাধ-বোধ জারিত করা যায়, তাহলে তারা নিজেরাই মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে ঘরে ফিরে যাবে। সেই মতো ছক কষে, পেইড দালাল দিয়ে কাজটি তারা করে ফেলতে পারবে বলে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কথায় আছে, অতি চালাকের গলায় দড়ি।
অবশ্য, জনৈক দীপ সিধু ও তার দলবলকে দিয়ে লালকেল্লায় একেবারে চিত্রনাট্য অনুসরণ করে একটা নাটক বিজেপি-আরএসএস করিয়ে ফেলল। সে নাটকের অন্তে ছিল গোদি মিডিয়া এসে হৈ রৈ করে ব্যাটনটা নিজের হাতে নিয়ে রসালো গল্প বলে শেষ ল্যাপটায় একবারে কেল্লা ফতে করে দেবে। ঠিক যেমন যেমন ভাবা গিয়েছিল, তেমন তেমনই সব এগিয়েছে। ২৬ জানুয়ারি দিনের শেষে কৃষকদের একটা অংশের মধ্যে অপরাধ-বোধও দেখা দিয়েছে এবং তাঁরা যে দোষে দুষ্ট নন, তার জন্য তাঁরা নিজেরা আগ বাড়িয়ে ক্ষমাও চেয়েছেন (যদিও বা যেটুকু যা ঘটেছে তা সেদিনের গোটা আন্দোলনের বড়জোর শতকরা ১ ভাগ মাত্র ছিল)। ধীরে ধীরে এবার একটা হতাশার ভাব যেন মোচড় দিয়ে ওই সহজ-সরল মনগুলিকে খেয়ে ফেলতে লাগল। এতটাই ইতস্ততা বোধ তাঁদের ওপর চেপে বসল যে ১ ফেব্রুয়ারির পূর্বঘোষিত সংসদ অভিযানের কর্মসূচিকেও তাঁরা স্থগিত রাখলেন। ২৭ জানুয়ারি দেখা গেল, পরিকল্পিত ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ট্রোল ও ঘৃণা বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। কৃষকদের কোনও কোনও নেতা একটু যেন বেশি কাতর হয়ে পড়লেন এবং অযাচিত ভাবে ২৬ জানুয়ারি যা কিছু ‘অন্যায়’ ঘটেছে (যদিও তার জন্য তাঁরা এতটুকু দায়ী নন এবং যা ঘটেছে তা তেমন কিছু বড় ব্যাপারও ছিল না) তার জন্য একটু বেশিই ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে পড়লেন। ধূর্ত ও নৃশংস বিজেপি বাহিনী সরল মনের কৃষকদের এই স্বঘোষিত অপরাধী ভাবনাকে সুযোগ বুঝে ষোলআনা উশুল করতে মাঠে নেমে পড়ল।
https://twitter.com/RAJUUPMAN14/status/1355208860542197761?s=20
২৮ জানুয়ারি সিঙ্ঘু সীমান্তে হঠাৎ করে উদিত হল একদল ‘স্থানীয়’ মানুষ যারা নাকি কৃষকদের দ্বারা জাতীয় পতাকার অবমাননায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং ‘অতএব’ জানান দিল যে এই জায়গা ছেড়ে কৃষকেরা তোমরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে মানে মানে কেটে পড়ো। গাজিপুর সীমান্তে বিকেল থেকে হাজির হতে থাকল শয়ে শয়ে পুলিশ বাহিনী এবং কৃষকদের বলা হল রাতের মধ্যেই সীমানা খালি করে দিতে। নিভিয়ে দেওয়া হল আলো, জলের বন্দোবস্তকে তছনছ করা হল এবং শৌচাগারগুলিকে পর্যন্ত ভেঙে দিল। ইতিমধ্যে দু-একটি ছোটখাটো কৃষক সংগঠন আন্দোলন থেকে সরে গেছে, এর পরের পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, কৃষক নেতাদের নামে এফআইআর হয়েছে, মনেও কিছু শঙ্কা এসেছে- সবটা মিলিয়ে কিছুটা যেন ছন্নছাড়া ভাব।
https://twitter.com/AdityaRajKaul/status/1354895922589618176?s=20
কৃষকদের এই দুর্বল মুহূর্তকে উগড়ে নিতে শাসক বাহিনী যখন এইভাবে কদম কদম এগিয়ে আসছে তখনই যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কৃষকেরা বেপরোয়া হয়ে আরও একবার রুখে দাঁড়ালেন। নিজেদের ভালমানুষীর সুযোগ যে ধূর্ত শিয়ালেরা আষ্টেপৃষ্টে আদায় করে নিচ্ছে তা তাঁরা এবারে প্রকৃত প্রস্তাবে ভাল মতো বুঝলেন। বলিষ্ঠ কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েতের কন্ঠে এবার অন্য সুর শোনা গেল। সমগ্র কৃষক সমাজের বেদনা ও অঙ্গার যেন তাঁর বাচন ও আহ্বানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেল। বললেন, তাঁর নিজ বাসভূমি থেকে কৃষকভাইয়েরা জল না এনে দিলে তিনি আর জলস্পর্শ করবেন না। মরমী কৃষকের হৃদয়-যন্ত্রণায় যেন মৃত্তিকা উর্বরা হয়ে উঠল। সমস্ত কৃষকদের টিকায়েত ডাক দিলেন গাজীপুরে আক্রান্ত কৃষকদের পাশে সেই মুহূর্তে যেন সকলে চলে আসেন। এ শুধুমাত্র আহ্বান ছিল না, ছিল কনকনে শীতের রাতে এক উদ্দাম লহর। টিকায়েতের ডাক শুনে হরিয়ানার প্রতি ঘর থেকে দলে দলে মানুষ তৎক্ষণাৎ ওই মধ্যরাতেই বাসে, ট্রাকে, ট্রাকটরে, বাইকে, গাড়িতে, সাইকেলে, হেঁটে- যে যেভাবে পেরেছেন এসে পৌঁছতে শুরু করলেন গাজীপুর সীমান্তে। গাজীপুর এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেল। যেন, ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট। পুলিশ বাধ্য হল পিছু হঠতে।
সেই মুহূর্তেই বদলে গেল আন্দোলনের চিত্রটাও। নিমেষের মধ্যে ধ্বস্ত হয়ে গেল শাসকের যাবতীয় প্ল্যান ও ছলছাতুরি। ২৯ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের মুজফফরপুরনগরে লক্ষাধিক কৃষকের মহাপঞ্চায়েত বসল। এই জনপ্লাবন কেউ কস্মিনকালেও দেখেননি। ঘোষিত হল কৃষক আন্দোলনে আরও উদ্দাম লহর তোলার অঙ্গীকার। তবুও ২৯ জানুয়ারি সকালে টিকরি ও সিঙ্ঘু সীমান্তে ‘স্থানীয়’ অধিবাসী সেজে আরএসএস’এর দুষ্কৃতীরা পুলিশের সহযোগিতায় ইট-পাটকেল ছুঁড়ে কৃষকদের আহত করল ও তাঁদের কিছু তাঁবুও ভেঙে দিল। পুলিশ দিল্লি সরকারের পাঠানো জলের ট্যাঙ্ক কৃষকদের কাছে পৌঁছনোর অনুমতি দিল না। তবে বলাই বাহুল্য, কৃষকদের বাড়তে থাকা জমায়েত ও মেজাজের কাছে শাসকের এই সমস্ত প্রয়াস খুড়খুটোর মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ হয়ে গেল। আওয়াজ উঠল: কৃষক টিকায়েত বনাম মোদি ডাকায়েত। ২৮ জানুয়ারি সারা দেশে বহু মানুষ রাত জাগলেন। দিল্লিতে মধ্যরাতে কৃষকদের সমর্থনে মিছিল বেরল।
ইতিমধ্যে ৬০ দিনের বেশি অবস্থান চলেছে। ১৫০’র ওপর কৃষক অবস্থানস্থলে মারা গেছেন। রাতের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবুও অন্নদাতারা স্থিতধী রয়েছেন। চোখে স্বপ্ন ও হৃদয়ে মমতা নিয়ে। দেশ জুড়ে আত্মহত্যায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন কৃষকেরা। অধিকাংশের ঋণের বোঝা বওয়ার ক্ষমতা আর নেই। বিপর্যস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সন্তানেরা সস্তার মজুর হয়ে শহরের বুকে দুঃসহ জীবন অতিক্রম করছেন। বার বার শাসক, মিডিয়া ও গবেষকেরা বোঝাতে চাইছেন কৃষিতে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কর্পোরেটদের হাতে কৃষি ব্যবস্থাকে তুলে দাও। বলা হচ্ছে, বাজারে গিয়ে ফসল বেচো, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কথা ভুলে যাও। সস্তায় নিজের ফসল বেচে সেই ফসলই আবার বাজার থেকে বেশি দামে কিনে খাও। সমস্ত দেশবাসীকে কর্পোরেট বাজার ব্যবস্থার ইচ্ছে-অনিচ্ছের সওয়ার করে দাও। আর সে লক্ষ্যেই তিন কৃষি আইন। তাই, অন্নদাতারা জীবন বাজী রেখে নিজেদের ও আপামর দেশবাসীকেও আজ রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই লড়াই কর্পোরেট শক্তির সঙ্গে কৃষক সমাজের লড়াই। যদি আমরা আজ কৃষকদের পাশে থেকে এই মরণপণ লড়াইয়ে সামান্য সাহায্যটুকুও না করি, ইতিহাস আমাদের কোনওদিন ক্ষমা করবে না। কৃষক সমাজ শেষ হয়ে গেলে ধরিত্রীর মাটিও শুকিয়ে কালো হয়ে যাবে।
আশার কথা, কিছুটা আচম্বিত ধাক্কা খেয়ে আবারও কৃষকেরা এ লড়াইয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। গান্ধীজী স্মরণে ৩০ জানুয়ারি তাঁরা দেশবাসীকে অনশনের ডাক দিয়েছেন। সীমান্ত ঘিরে আবারও জনজমায়েতে কল-কলরবে সকলে গেয়ে উঠবেন। গোদি মিডিয়া নতুন নতুন মিথ্যার ডালি সাজাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃষকেরা নিজেদের হক বয়ান রেখে যাবেন। সে বয়ান আমাদের পড়ে নিতে হবে। বুঝে নিতে হবে যে, কৃষকেরা এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে আমাদের নিয়ে চলেছেন। এক নতুন উজ্জ্বল দিনের দিকে আমাদের যাত্রা। কৃষকদের জিততেই হবে। না হলে আমরা বাঁচব না।
https://twitter.com/sumonseng/status/1355115661220052992?s=20
জয় কিষাণ।
লেখাটি একক মাত্রা ব্লগ থেকে সংগৃহীত।