কাতার বিশ্বকাপে এশিয়া মহাদেশের দেশগুলির মধ্যে দুটি দেশ তাদের অভিযান শুরু করে ফেলেছে। কাতার এবং ইরান দুটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশেরই সূচনা হল কিছুটা দুঃস্বপ্নের মত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কাতারই প্রথম দেশ যারা প্রথমবার বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে সরাসরি আয়োজক হিসাবে। কিন্তু উদ্বোধনী ম্যাচেই তাদের যথেষ্ঠ নাস্তানাবুদ করে হারালো ইকুয়েডর। অধিনায়ক এনার ভ্যালেন্সিয়ার প্রথমবার কাতারের জালে জড়ানো বলটি গোল হলনা এবারে বিশ্বকাপেই প্রথম ব্যবহৃত হওয়া অটোমেটেড অফসাইড ডিসিশনের জন্য। কিন্তু তারপর আরও দু’বার ওই এনার ভ্যালেন্সিয়াই কাতারের জালে বল ঢোকালেন। প্রচুর সুযোগ নষ্ট না করলে ইকুয়েডর অনায়াসে আরও বড় ব্যবধানে জেতে।
গ্রুপ-বি-র দ্বিতীয় ম্যাচে ইরান আরও জঘন্যভাবে হারল ইংল্যান্ডের কাছে। বিগত রাশিয়া বিশ্বকাপে (২০১৮)-তে যেমন লড়াকু মেজাজে দেখা গিয়েছিল ইরানকে এবারে এশিয়ার মাটিতে প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেরকম কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেখা গেলনা ইরানকে। শুরুতেই তাদের প্রথম গোলরক্ষকের চোট পেয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে দলের ওপর বড় আঘাত কিন্তু তারপরও ইরানের খেলায় পরিকল্পনার কোনও ছন্দ দেখা গেল না। অন্যদিকে কাতারে পৌছানো থেকে হাজার একটা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের থেকে। কিন্তু মাঠে নেমে তাদের সমর্থকদের কোনওরকম অভিযোগ করার জায়গা রাখলেননা ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা। কার্যত ইরানকে নিয়ে ছিনিমিনি করলেন তারা। রাইস, স্টারলিং, সাকা, হ্যারিকেনরা দাপিয়ে বেড়ালেন সারা মাঠে। প্রথমার্ধেই ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। তবে খেলার ৬২ মিনিটে করা ইংল্যান্ডের চতুর্থ এবং বুয়াকো সাকার ব্যক্তিগত দ্বিতীয় গোলটি বহুদিন থেকে যাবে মনের মণিকোঠায়। অসাধারণ স্কিল-স্পিড এবং ফিনিশিং-এর নজির রেখে সাকা গোলটি করলেন। এরপরেই ইরানের মেহদি তারেমির করা গোলটি রীতিমতো বিশ্বমানের। যদিও তাতে ব্যবধান কিছুটা কমলেও ইরানের খেলায় কোনও ছন্দ ফেরেনি। তবে ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক এই সহজ ম্যাচেও কিছু দৃষ্টিকটু ভুল করলেন। ইংল্যান্ডের গোটা দলের মধ্যে একমাত্র গোলরক্ষককেই নড়বড়ে বলে মনে হচ্ছে। বিশ্বকাপের পরবর্তী খেলাগুলোতে কিন্তু লাস্ট ম্যান অফ ডিফেন্স নড়বড়ে থাকলে থ্রি-লায়ন্সদের খেসারত দিতে হতে পারে। তবে প্রথমার্ধে ১৪ মিনিট ও দ্বিতীয়ার্ধে ১০ মিনিট ইনজুরি বা অতিরিক্ত সময়ের খেলা হয়ে ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ের খেলা হয়ে রইল ইংল্যান্ড-ইরান ম্যাচ যাতে দু’দলের করা গোল সংখ্যা মিলিয়ে ৮ গোল হল। ইরানকে হাফডজন গোল দিলেও দুটি অযাচিত গোলও হজম করতে হল ইংল্যান্ডকে। তবে মাঠের খেলায় হেরে গেলেও মানবিকতার ক্ষেত্রে বিশ্বকাপের মঞ্চে নতুন পরশ রেখে গেল ইরান ফুটবল দল। ইরানে মেয়েদের ওপর বর্বর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে জাতীয় সংগীতে নীরব থেকে প্রতিবাদে সরব হল ইরান ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা। গ্যালারি থেকে উড়ে আসা নানারকম মন্তব্য-টিটকিরি কিছুই তাদের দিয়ে জাতীয় সংগীতের এক কলিও গাওয়াতে পারেনি। অভিনব প্রতিবাদে মানবিকতার নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করল ইরান ফুটবল দল যেখানে তারা মানবদরদী বিশ্বের হৃদয় জয় করে নিল।
নেদারল্যান্ডসও জয় দিয়েই শুরু করল গ্রুপ-এ তে তাদের বিশ্বকাপ অভিযান প্রত্যাশামতই, কিন্তু কমলা জার্সির বিরুদ্ধে সাদা জার্সিতে আফ্রিকান সিঙ্ঘদের লড়াই মনে থেকে যাবে। ২০০২ সালে এশিয়ার মাটিতে কোরিয়া/জাপান বিশ্বকাপে প্রথম আবির্ভাবেই সেবারের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দল জিদানের ফ্রান্সকে হারিয়ে দিয়ে তাদের গ্রুপ পর্যায় থেকেই বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল আফ্রিকান সিংহ সেনেগাল। সেই সেনেগাল এবারেও প্রবল বিক্রমে শুরু করতে চেষ্টা করল তাদের এশিয়ার মাটিতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ অভিযান। অসাধারণ লড়াই করল সেনেগাল। গতিতে-ছন্দে-পাওয়ার ফুটবলে তারা সমানে সমানে টক্কর দিল কমলা জার্সিধারীদের। শুধু তারা মার খেয়ে গেল ফিনিশিং-এ। ম্যাচের ৮৪ মিনিটে কোডি গাকপোর নিখঁত হেড এগিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডসকে। তারপর সেনেগাল সেই গোল শোধ করতে মরিয়া হয়ে সর্বস্ব বাজি রেখে আক্রমণে উঠে গেলে প্রতি-আক্রমণে নিদারুণ গতি ও তালমিল থেকে খেলার শেষমুহুর্তে নিজেদের দ্বিতীয় গোল করে কমলা জার্সির জয়কে সুনিশ্চিত করেন ১৪ নম্বর জার্সিধারী ক্লাসেন। তবে নেদারল্যান্ড-সেনেগাল ম্যাচেই প্রথম এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা গেল, যা সংকেত জানিয়ে গেল আগামী সময়ে আরও হাড্ডাহাড্ডি ফুটবল যুদ্ধ দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে ফুটবল বিশ্বকে।
১৯৫৮ সালের পর আবার ফিফা বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে ওয়েলস। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে তারা নজর কেড়েছিল লড়াকু মেজাজে। তারপর ইউরো ফুটবলে তারা বেশ কয়েকবার আবির্ভূত হলেও বিশ্বকাপের মূলপর্বে এটাই তাদের দ্বিতীয় আবির্ভাব। গ্যারেথ বেল, বেন ডেভিস, জনসনের মত ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের তারকা খেলোয়াড়রা কিন্তু প্রথম ম্যাচে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে খেলা অমীমাংসিত রেখেই সন্তুষ্ট থাকলেন। তাও আবার প্রথমার্ধে এগিয়ে গিয়েছিল ইউএসএ-ই। প্রচন্ড রুদ্ধশ্বাস গতিতে খেলা হলেও দু’দলেরই আক্রমণ তৈরি করার ব্যাপারে যথেষ্ঠ পরিকল্পনার অভাব চোখে পড়ল। তবে এই ম্যাচে গ্যালারী থেকে দু’পক্ষের বিশেষত ওয়েলসের সমর্থকদের খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধকারী যে গান ভেসে আসছিল তা ভীষণভাবে মনে করাচ্ছিল ফুটবলময় এক অনাবিল ছন্দকে। তবে এই ফুটবল মহোৎসবের মধ্যে, এত বৈভব, এত বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যে কোথাও যেন ধ্বনিত হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্ত চিৎকার। তাদের অধিকার লঙ্ঘন, তাদের জীবনের ঊপর দিয়ে কাতার সরকারের এই বিশ্বকাপ আয়োজন। বিশ্বকাপের আগেই যা সারা বিশ্বের সমালোচনার মুখে পড়েছিল। কাতার সরকার কিছুটা সংশোধন করলেও আইনের মূল পরিকাঠামো কিন্তু একই রয়ে গেছে। তাই গ্যালারীতে ফুটবলপ্রেমী মানুষের ফুটবল উন্মাদনার আওয়াজের মধ্যে যেন মিশে যাচ্ছে সেইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের হাহাকার। একদিকে ইরানের খেলোয়াড়দের মানবিক প্রতিবাদ অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের যন্ত্রণাকাতর হাহাকার এ যেন মানবিকতা আর শোষণযন্ত্রের এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক কোলাজ। কাতারের বাতাসে কান পাতলে যেন এই অদ্ভুত এক ইতিহাসের উপস্থাপনা সুষ্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে।