পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

দূরের শিক্ষা - দূরবর্তী শিক্ষা

  • 10 July, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 2589 view(s)
  • লিখেছেন : কৃত্তিকা সেনগুপ্ত
বীরভূমের একটি এনজিও আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে। এই ছেলেমেয়েরা সরকারী স্কুলে পড়লেও সবকিছু ভাল বুঝে উঠতে পারে না কারণ বাংলা তাদের মাতৃভাষা নয়।এনজিও টি স্কুল সময়ের বাইরে ঐ ছেলেমেয়েদের তাদের নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদান করে এবং খাবারও দেয়।এই অতিমারীকালেও ওখানকার শিক্ষকরা গ্রামে ঢুকে বাচ্চাদের ছোট ছোট দল করে কোভিড বিধি মেনে দফায় দফায় ক্লাস করিয়েছেন এমনকি শরীর চর্চাও করিয়েছেন। এটাই তো দুয়ারে শিক্ষা।এর থেকে কি কিছু শেখা যায় না?

দুহাজার কুড়ি সালের মার্চ মাসে যখন প্রথম লকডাউন শুরু হয় তখন ঘটনাচক্রে আমি মফস্বলের একটা বেসরকারি স্কুলে প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে সদ‍্য যোগদান করেছি। চিরকাল কলকাতায় বাস এবং কর্ম করে আমার মফস্বল সম্বন্ধে জ্ঞান নেহাতই সীমিত। এছাড়া নতুন কর্মক্ষেত্রে শিক্ষিকা ,ছাত্রছাত্রী এবং তাদের পরিবার ,সবকিছুই অচেনা। কর্মস্থলকে ভাল করে বোঝা এবং করোনা, লকডাউন, দূরশিক্ষা(ডিজিটাল শিক্ষা)--কী, কেন ও কতদিন এই হাতড়াতে হাতড়াতে গরমের ছুটি পড়ে গেল।

দশে মিলি করি কাজ
-------------------------------
এই স্কুলটিতে মধ‍্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ‍্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়ে। শ্রেণি শিক্ষিকারা নতুন ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীকেই চিনে উঠতে পারেননি। প্রথমে ভেবেছিলাম একেবারে শিশু বিভাগের অভিভাবকদের বলা যেতে পারে আপাতত শিশুরা বাড়িতে বসেই মা ঠাকুমার কাছে গল্প শুনুক এবং বাড়ির সহজ কাজগুলোতে সাহায্য করুক।এই সিদ্ধান্ত একেবারে ধোপে টিকলনা, অভিভাবকরা মাইনে দেওয়া প্রায় বন্ধই করে দিলেন।অবশ‍্য শিক্ষিকারা ফোনে খোঁজ নিয়ে জানলেন যে কিছু পরিবারে কর্মহীনতা,আয় সংকোচ, অসুস্থতার কারণে ব‍্যয়বৃদ্ধি, ইত‍্যাদি ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষিকারা মাঝে মধ‍্যে খোঁজ খবর নেবার ফলে অভিভাবকদের সঙ্গে দূরত্ব ধীরে ধীরে কমে এল।পরিবারে কে অসুস্থ, সন্তানদের মানসিক অস্থিরতা সবই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল।স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাঁধা স্কুল টাইমের মধ‍্যে পাঠ‍্যক্রম বহির্ভূত পারিবারিক আলোচনা করার সময় খুব একটা পাওয়া যায় না। এই দুর্দিনে এটাকে শুভ লক্ষণ বলেই মনে হয়েছে।

নতুন মাধ‍্যম
-------------------
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সমস‍্যা দেখা দিল।যদিও খুব সামান্যসংখ্যক পরিবারে একটিও স্মার্টফোন ছিল না তবে অধিকাংশ পরিবারে একটি মাত্র স্মার্টফোন ,বাড়ির কর্তা বাইরে গেলে সেটিও বাইরে থাকে। কিছুদিনের মধ‍্যেই এক বোধোদয় হল। কোভিড পূর্ব সময়ে স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতি রীতি নীতিতে অভিভাবকদের পরোক্ষ ভূমিকাটিকে প্রত‍্যক্ষে নিয়ে আসতে হবে।অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা গেল লাইভ অনলাইন ক্লাস করার মত ডিজিটাল সংযোগ
সংখ্যাগরিষ্ঠের নেই।তাই ছোট ছোট ভিডিও করে সেগুলি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।স্বাভাবিক সময়ে স্কুল শনি,রবিবার বন্ধ থাকে কিন্তু ফোনের মালিকদের ঐ দুটি দিনেই বাড়িতে থাকার সম্ভাবনা বেশি বলে ঐসব দিনেই ভিডিও পাঠানো স্থির হল।ছাত্র ছাত্রীদের সুবিধার্থে স্কুলের গতানুগতিক নিয়মে অনেক পরিবর্তন হল।
গুগল ক্লাসরুমের মাধ‍্যমে শিক্ষার আদানপ্রদান হবে সিদ্ধান্ত হল।শিক্ষিকাদের কাছেও একেবারে অচেনা জগৎ,অধিক বয়সে নতুন ভাষা শেখার মত অভিজ্ঞতা।গুগল ক্লাসের জন‍্য অভিভাবকদের ইমেইল ঠিকানা চাইতে গিয়ে শাড়ির দোকান, বিউটি পার্লার ,বুটিকের ঠিকানাও এল।আসলে কিছু অভিভাবকের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট নেই কিন্তু ইচ্ছা ছিল বলে এইভাবে উপায়ও বের হল। দূরশিক্ষা পদ্ধতি সফল করতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অভিভাবকেরা,বিশেষত মায়েরা ,এই ব‍্যবস্থার কেন্দ্রে চলে এলেন। শিশু বিভাগের প্রতিটি ভিডিওতে মায়েদের জন‍্য একটি অংশ রাখা হল,সেখানে পুরনো খবরের কাগজ ,জুতোর বাক্স ইত্যাদি দিয়ে শিক্ষা সহায়ক নানা বস্তু (Montessori materials)বানাতে শেখানো হল।একেবারে রান্নার ভিডিওর মত হিট হয়ে গেল এই উদ‍্যোগ।মায়েদের হাতে তৈরি সেসব জিনিস দেখে চমকে গেলাম, মুগ্ধ হলাম।মায়েরা শিক্ষিকাদের কাছ থেকে শিখতে লাগলেন কিভাবে ওসব জিনিস কাজে লাগিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দিতে হয়।এইসব মায়েদের অনেকেই আট বা দশ ক্লাস অবধি পড়ার সুযোগ পেয়েছেন।এমন বার্তাও এসে পৌঁছল যে এই কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পেরে অনেকেই বর্তমান দুঃসময়ে কিছু দুঃখ ভুলতে পেরেছেন। দূরশিক্ষার কালে শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সেতুবন্ধন করলেন মূলত মায়েরা।

পরিবর্তন
-----------------------
প্রাথমিক বিভাগীয় কাজও পুরোদমে শুরু হয়েছিল। তাঁদের পড়ানো বাইরের অনেকেই ভিডিওর মাধ‍্যমে দেখছেন একথা বুঝে শিক্ষিকারাও তাঁদের শ্রেষ্ঠ কাজটি পরিবেশন করার চেষ্টা করতে লাগলেন। নানা পরীক্ষামূলক কাজ দেখিয়ে ভিডিওগুলোকে আকর্ষণীয় করার প্রচেষ্টা জারি রইল।বাড়িতেই বালতির জলে নানা সবজি ফেলে ডোবা,ভাসার পরীক্ষা, ছোলা গাছের বীজ পুঁতে চারার বৃদ্ধি লক্ষ্য করা,গাছের পাতা কাগজে মুড়ে তার রঙের পরিবর্তন দেখা, এসব কাজে বাচ্চাদের উৎসাহ দেওয়া হল।এছাড়া পাঠ‍্যক্রম সহায়ক কাজের মাধ‍্যমেও পাঠ‍্যক্রম অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে শিক্ষাদানের চেষ্টা চলল।সহজলভ্য বস্তু দিয়ে কাজগুলো দেখানো এবং তা ডিজিটাল মাধ‍্যমের উপযোগী করার জন্য সিলেবাসকে ভেঙেচুরে দিতে হচ্ছিল বারবার।এই কাজ করতে গিয়ে সিলেবাসকে আরো ব‍্যবহারিক আর জীপনোপযোগী করার কথাও বারবার মনে হয়েছে।তবে এসব লিখছি যত সহজে, বাস্তব পরিস্থিতি তত সহজ ছিল না। শিক্ষিকারা বছরের পর বছর মেনে নেওয়া প্রথার বাইরে বেরোতে সময় নিয়েছেন এবং অভিভাবকরা এতদিন যে ধরনের পাঠ‍্যক্রম এবং মূল‍্যায়ন দেখতে অভ‍্যস্ত ছিলেন তার ব‍্যতিক্রম মেনে নিতে বারবার আমাদের হোঁচট খাইয়েছেন।আসল জীবনযাত্রাই যখন পুরো সিলেবাসের বাইরে চলে গিয়েছে, সেখানে গতানুগতিক পাঠ‍্যক্রম মেনে শিক্ষাদানও অকেজো হয়ে গিয়েছে।একসময় বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন দিতে আমরা শিক্ষিকারাই বারণ করতাম,এখন সেই আমরাই বলি ভিডিওটা ওকে বারবার দেখান।
এই হল প‍রিবর্তন।

মনখারাপের গল্প
---------------------------
শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীর উভয়পক্ষের মানসিক স্বাস্থ‍্যের উন্নতিকল্পে ছোট ছোট দল তৈরি করে ভিডিও কলের মাধ‍্যমে কথোপকথন শুরু করা হল।সেখানে গান, কবিতা , গল্প বলা ,বানান ধরা সবরকমের চর্চাই চালু হল।সবচেয়ে বেশি বকুনি খাওয়া দুষ্টু বাচ্চাটিও স্কুলে আসার জন‍্য উদগ্রীব।তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীর লেখা 'স্কুল যখন বাড়িতে এল' রচনা পড়ে চোখের জল ধ‍রে রাখা মুশকিল। কোভিডে সে তার দিদাকে হারিয়েছে ,স্কুলকে সে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেনি, তা সত্ত্বেও স্কুল কেন বাড়িতে এল?আর ছোট্ট মেয়েটি যে স্কুল বাড়িতে আসতে এত আগ্রহী ,সেই নেমন্তন্নটা আসছে না কেন?
পরিবারের সদস‍্য বা নিকটাত্মীয়কে হারিয়েছেন এমন পরিবারের সংখ্যা নেহাত উপেক্ষা করার মত নয়।

যারা অন্ধকারে
-----------------------
লকডাউনের শুরুতে বাড়িতে বসে সিটি কেবল্ চ‍্যানেলে প্রাথমিক শিক্ষার উপযুক্ত একটি অনুষ্ঠান রোজই দেখতাম এবং সেটির মান যথেষ্ট ভাল। এছাড়া একটি দুটি সংবাদ মাধ‍্যমও কিছুদিন মাধ‍্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রম অনুসারী অনুষ্ঠান প্রচার করছিল কিন্তু অজ্ঞাত কারণে অচিরেই সব বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু দূরদর্শন দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের মধ‍্যে সেটিকে এভাবে কাজে লাগানোর কোনও ভাবনা হয়েছিল কিনা জানা নেই।
আমার বাড়ির কর্মসহায়িকা শম্পার দুটি সন্তান কলকাতার একটি সরকরী স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে পড়ে।শম্পা লকডাউন শুরু হবার কিছুদিনের মধ‍্যেই স্মার্টফোন কিনল সন্তানদের লেখাপড়ার জন‍্য। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও সে নিজের আয়ের পঞ্চাশ শতাংশ ব‍্যয় করত ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষকের জন‍্য। লকডাউনে স্বামীর আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার সে গৃহশিক্ষককে অর্ধেক বেতন দেয় এবং তিনিও দুবেলার বদলে একবেলা আসেন।শম্পাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল যে স্কুল থেকে কদিন অন্তর পড়া আসে মেসেজের মাধ‍্যমে এবং ছাত্র ছাত্রীরা উত্তরপত্রের ছবি পাঠিয়ে দেয় কিন্তু কোনদিন কোন শিক্ষক বা শিক্ষিকা ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলেননি এখনও পর্যন্ত। দূর শিক্ষা প্রকৃত অর্থেই!দুপক্ষের দূরত্ব অনেকটা।দুহাজার একুশের জুন মাসে মিড ডে মিল নিতে গিয়ে শম্পা এই প্রথম worksheet নিয়ে আসে যেটিতে কাজ করে আবার জুলাই মাসে মিড ডে মিল নেবার দিন ফেরত দেবার কথা।এবং এই কাজটি করতে শম্পার সন্তানদের অবশ‍্যই সাহায্য করবেন তাদের গৃহশিক্ষক।আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব‍্যবস্থাটি নড়বড়ে এবং কিছুটা বাস্তব প্রয়োজনের থেকে দূরে হওয়ায় সমান্তরাল গৃহশিক্ষা ব‍্যবস্থা এবং কোচিং ক্লাস নামক ব‍্যবসাটি বহুদিন ধরেই ক্রমবর্ধমান।মহামারীকালে সেটি প্রায় অত‍্যাবশ‍্যক হয়ে উঠেছে।বড় বড় কোচিং ক্লাস অনলাইনে চললেও অনেক গৃহশিক্ষক বাড়িতে গিয়ে অথবা নিজগৃহে পড়িয়ে চলেছেন বিশেষতঃ মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে।যাই হোক, টিভিতে শিক্ষা বিষয়ক অনুষ্ঠান এবং শম্পার ছেলেমেয়েদের কথা শুনে ধারণা হয়েছিল পুরোপুরি না হলেও কিছুটা লেখাপড়া হয়তো সর্বত্রই হচ্ছে। ভুল ভাঙল অচিরেই।যারা মফস্বল বা গ্রামের সরকারী স্কুলে পড়ান অথবা পড়ে এমন কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা শুনে বোঝা গেল কলকাতা এবং তার বাইরে যে পশ্চিমবঙ্গ এই দুইয়ের মধ‍্যে বৈষম‍্য আরো প্রকট হয়েছে ,অন্তত শিক্ষা ক্ষেত্রে।
হুগলি জেলার বাসিন্দা পূর্ণিমা পেশায় গৃহপরিচারিকা।তিনি নাতনির লেখাপড়ার জন‍্য ধারকর্জ করে নয়হাজার টাকা দিয়ে মোবাইল কিনেছেন।তারপরেও নাতনি জানাচ্ছে সে মোবাইলের মাধ‍্যমে পাঠ‍্য বিষয় কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তবে দিদিমা জানতে পারছেন নাতনি মোবাইলে অন‍্যান‍্য ভিডিও বা পোশাকের বিজ্ঞাপন দিব‍্যি দেখছে।এবার পরিবার ভাবছে লেখাপড়াই যখন বন্ধ তখন ভাল দিনক্ষণ দেখে নাতনিটিকে পাত্রস্থ করাই শ্রেয়।আরো করুণ কাহিনি শোনা গেল মুর্শিদাবাদের গ্রামের এক সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার মুখে। তাঁর স্কুলের ছেলেরা মোবাইল ডেটার সদ্ব্যবহার করতে পাবজি খেলায় অনেক বেশি আগ্রহী ,শিক্ষা তাদের অগ্রাধিকারের মধ‍্যে পড়ে না।আবার কলকাতাস্থ এক সরকারী স্কুলের মাস্টারমশাই জানালেন সরকারী নির্দেশ বিনা তাঁদের কিছু করার ক্ষমতা নেই।অর্থাৎ নিজের ইচ্ছা মত worksheet পাঠানোর ব‍্যবস্থা করা, পাঠ‍্যক্রমে সামান্য বদল আনা, এমনকি হয়তো ছাত্র ছাত্রীদের সরাসরি ফোন করতেও সরকারী নির্দেশ লাগে।অতএব বর্তমানে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী নানাবিধ কারণে শিক্ষা ব‍্যবস্থার বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিদিন।জানতে ইচ্ছা করে কোনও নজরদারি বা সমীক্ষা হচ্ছে কিনা যাতে এই সংখ‍্যাটির হিসাব পাওয়া যেতে পারে।পূর্বোক্ত ঘটনাগুলো থেকে বোঝা কঠিন গরজের অভাবটা কার--ছাত্র, শিক্ষক না সিস্টেমের?

দুয়ারে শিক্ষা
-------------------
এই দুঃসময়ে অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের সঙ্গে শিক্ষার দারিদ্র্যও আমাদের সমাজকে গ্রাস করছে।এদেশের নিরক্ষর এবং দরিদ্র অভিভাবকরা স্বাভাবিকভাবেই মিড ডে মিলের চাল, ডাল না পেলে যতটা বিচলিত এবং ক্ষিপ্ত হন শিক্ষার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলেও তেমন প্রতিবাদ করেন না। এছাড়া নামী সংবাদ মাধ্যমেও শিক্ষার সংকট শিরোনামে আসেনা। এর ফলে যেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ‍্যমে দূর দূর স্থানে ঘরে ঘরে ত্রাণ ,ওষুধ, খাবার পৌঁছে যায় সেখানে দুয়ারে শিক্ষা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
বীরভূমের একটি এনজিও আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে। এই ছেলেমেয়েরা সরকারী স্কুলে পড়লেও সবকিছু ভাল বুঝে উঠতে পারে না কারণ বাংলা তাদের মাতৃভাষা নয়।এনজিও টি স্কুল সময়ের বাইরে ঐ ছেলেমেয়েদের তাদের নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদান করে এবং খাবারও দেয়।এই অতিমারীকালেও ওখানকার শিক্ষকরা গ্রামে ঢুকে বাচ্চাদের ছোট ছোট দল করে কোভিড বিধি মেনে দফায় দফায় ক্লাস করিয়েছেন এমনকি শরীর চর্চাও করিয়েছেন। এটাই তো দুয়ারে শিক্ষা।এর থেকে কি কিছু শেখা যায় না?

পরীক্ষা বড় বালাই
----------------------------
আমাদের সরকারী শিক্ষা ব‍্যবস্থা বরাবরই মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক।কোভিড কালে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে সেটা নিয়ে যত মাথা ঘামানো হয়েছে, ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষার ছিটেফোঁটা আদৌ পৌঁছচ্ছে কি না সেটা নিয়ে বোধহয় ভাবা হয়েছে অনেক কম।শিক্ষাকে যুগোপযোগী, জীবনোপযোগী করা ,একই ছাঁচে ঢালা শিক্ষা সবার জন‍্য উপযুক্ত কিনা, এসব কথা আবার নতুন করে সামনে চলে এল এইসময়।ভয়ানক কোভিড কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ করে দিল।স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও সাধারণ অনেক ছাত্রছাত্রীকেই গতানুগতিক শিক্ষাধারা আকৃষ্ট করতে পারে নি।এখন তাদের মধ‍্যে অনেকেই নানা অজুহাতে আরো দূরে সরে পড়েছে।এখন তো পরীক্ষা ইত‍্যাদির চাপ নেই ,এই সুযোগে শিক্ষা নীতিনির্ধারকরা
একটু নতুন কিছু ভাবুন এইসব হতভাগ‍্য ছাত্র ছাত্রীদের জন‍্য। যাদের কাছে দুটি শিক্ষাবর্ষ নিষ্ফল হল আগামী পাঁচবছরের পাঠ‍্যক্রম তৈরি করতে তাদের কথাও মাথায় রাখা উচিত। এই ভয়ংকর ক্ষতির বোঝা সামলাতে আমাদের অনেক সময় লাগবে।

গৃহশিক্ষকেরা
---------------------
আগে যেমন উল্লেখ করেছি ,শহরে বা গ্রামে এই করোনা পরিস্থিতিতেও গৃহশিক্ষকতা কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি ।বিশেষত মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে।মাস্টারমশাইরা পাড়াতেই ছাত্রর বাড়ি গেছেন অথবা ছাত্ররা এক দুজন করে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি এসে পড়েছে। এর একটা বড় কারণ অনেক গৃহশিক্ষকের এটাই একমাত্র উপার্জন।সরকার সিভিক ভলান্টিয়ার বাহিনীর মত শিক্ষা ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারে ,যারা কোভিড বিধি মেনে ঘরে ঘরে শিক্ষা পৌঁছে দেবে। এদের সামান্য প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে তো আরো চমৎকার হবে।আমরা অনেকেই গৃহশিক্ষকদের ব‍্যাপারে একটু নাকউঁচুপনা দেখিয়ে থাকি, কিন্তু এই অন্ধকার সময়ে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে একমাত্র তারাই শিক্ষার আলো দেখাচ্ছেন।

আলোর বৃত্তে যারা
----------------------------
স্বচ্ছল স্কুল এবং স্বচ্ছল পরিবারের ছাত্র ছাত্রীদের কথা এই লেখার বিষয় নয়। তবে এরাও প্রবল মানসিক চাপে আছে। সবাই বন্ধুদের অভাব অনুভব করছে।কিছু অভিভাবক অবশ‍্য এই দুঃখে কাতর যে তাঁদের সন্তানরা এত লেখাপড়া করার পর পরীক্ষায় ফাটিয়ে দিয়ে সবাইকে দেখানোর সুযোগ পেল না। শুনলাম কেউ কেউ আবার অনলাইন পরীক্ষার সময় ছাত্রের টেবিলের তলায় ঘাড় গুঁজে বসে উত্তর প্রম্পট করার ঝক্কিও সামলাচ্ছেন।মাস্টারমশাই আর দিদিমণিরা নতুন নতুন বজ্র আঁটুনি উদ্ভাবন করছেন।এমন স্বচ্ছল পরিবারের এক ছাত্রের মা আমাকে নিজমুখে জানিয়েছেন যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলেও উনি ছেলের জন‍্য অনলাইন কোচিং ক্লাসই বেছে নেবেন। উনি একা নন,অনেক লম্বা লাইন পিছনে। অনলাইন কোচিং ক্লাসে যাতায়াতের খরচ,ঝামেলা বাঁচে, শিক্ষক কীরকম পড়াচ্ছেন তার উপর নজরদারি করা যায় ,এছাড়া বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা যার তার সঙ্গে মিশে বয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে, ফলে কেরিয়ারের বারোটা।তাহলে দেখা যাচ্ছে এই সর্বনাশের সময়েও কারো কারো পৌষমাস হয়েই যাচ্ছে।


শেষের কথা
--------------------
এই লেখা কোন গবেষণার ফসল নয়। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং চারপাশের মানুষদের দেখে যা উপলব্ধি হল, তার প্রকাশ। মনে এখনও আশা রাখি, কারণ জানি যে কিছু বিজ্ঞ মানুষ এবং সংস্থা নিরলসভাবে এই সংকটের সময় দিশা খুঁজে চলেছেন।

0 Comments

Post Comment