পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নিয়ন আলোয় পণ্য হল, ‘যাঁরা’ ছিল সব ব্যক্তিগত

  • 27 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1919 view(s)
  • লিখেছেন : সায়ন্তন দত্ত
আপনার সম্পর্কে জোগাড় করা ভুরি ভুরি তথ্য কিন্তু ফেসবুক বিক্রি করে না। অনেকেই ভাবেন তথ্য বিক্রি করে ফেসবুক টাকা পায় – না তা নয়, যেখানে পণ্য আপনি – সেখানে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো আসলে দরকার আপনার ভার্চুয়াল ওই মডেলের জন্য, যেখানে কম্পানীগুলো নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে আপনার সম্পর্কে, ভবিষ্যতে ঠিক কোথায় কখন, কোন জিনিসটা আপনি করবেন – এবং যাতে করে আরও নিশ্চিতভাবে, আপনাকে ওই বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে।

প্যান্ডেমিকের বাজার। ধরুন, আজ ছুটির দিনের সকাল। প্যান্ডেমিকের মধ্যে আলাদা করে ছুটির দিনের সংজ্ঞা যদিও বদলে গেছে, তবুও, আজ সারাদিন আপনার ছুটিরও ছুটি। সারা সপ্তাহ অনলাইনে, কম্পিউটার স্ক্রীন বা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে আপনার কেটেছে। রবিবারের সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি হয়তো ভাবছেন মানুষকে মানুষের মত না দেখে কম্পিউটার স্ক্রীনে চৌকো খোপে ইমেজ হিসেবে দেখার এই ডিস্টোপিক দুনিয়া ছেড়ে আজকের দিনটা আপনি খানিক মৌজ করে কাটাবেন – হয়তো সারা সপ্তাহে প্রথমবার খবরের কাগজটায় চোখ বোলাবেন, বাড়ির লোকজনদের সাথে ব্রেকফাস্ট করতে করতে খানিক জমিয়ে আড্ডা দেবেন, অলস দুপুরে নেটফ্লিক্সে একটা থ্রিলারও দেখে ফেলতে পারেন। এইসব আগামী সুখের মূহুর্ত ভাবতে ভাবতে ঘুম ঘুম চোখেই আপনি হয়তো বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা তুলে নিলেন, সারা রাত ইণ্টারনেট থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে থেকে সে হয়তো গোবেচারা মুখে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, কখন আপনি আবার ডাটা কানেকশন বা ওয়াইফাই অন করবেন। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে – আপনি ভাবলেন টুক করে পাঁচ মিনিটের জন্য আপনি একটু চেক করে নেবেন, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কী হচ্ছে, ফেসবুকে আপনার নিউজফিডে কী এলো, ইন্সটাগ্রামে আপনার ফলোয়ার বাড়ল কীনা, কেউ দরকারে কোনো মেইল করল কীনা! কতক্ষণ আর লাগে – একএকটা কাজ কয়েক সেকেন্ডের মামলা – ফোন নিয়ে আপনি বিভিন্ন অ্যাপে স্ক্রল করতে লাগলেন। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার – ‘টুং’ – নোটিফিকেশন নিউ ম্যাসেজ, ফেসবুকে দশজনের বার্থডে, আপনার দুটো নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, ইনস্টাগ্রামে নতুন ফলোয়ার, হোয়াটসঅ্যাপে সমস্ত গ্রুপ মিলিয়ে পাঁচশকুড়িটা নতুন নোটিফিকেশন – আপনার লিস্ট বাড়তে লাগল বাড়তেই লাগল। আধঘুমো চোখে, আধশোয়া অবস্থায়, জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা অল্প আলোর আপনার ওই বেডরুমে – এই করতে গিয়েই – হুস – আপনার একঘণ্টা কেটে গেল। আপনার পরিবারের প্রিয় মানুষটা ততক্ষণে, হয়তো দুবার এসে তাড়া দিয়ে গেছেন, তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে, আপনারা একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে চান।

উপরের এই গল্পটা, আমার আপনার, কমবেশী সবার জন্যই সত্যি। অ্যাপগুলোর নাম সামান্য বদলে যেতে পারে, আপনার স্ক্রীনের সাইজ সামান্য বদলে যেতে পারে – সময়ের হিসেব সামান্য এদিক ওদিক হতে পারে – কিন্তু মোটের উপর, আমরা জানি – আমরা সবাই, কমবেশী, সকালে উঠে এই কাজটাই করি। এককালে, ছোটবেলায় যখন ভোরবেলা উঠে স্কুল যেতে হত – তখনও ছুটির দিনগুলোয় আমাদের বিছানা থেকে উঠতে সময় লাগত – মা এসে ডেকে দিয়ে যেতেন প্রায় আধঘণ্টা ধরে, তাও মনে হত আরও একটু যেন ঘুমিয়ে নিই। আজকাল আমাদের উঠতে দেরী হয় না বিশেষ – কী যেন এক অমোঘ আকর্ষণ ঘুমের শেষ মূহুর্তে কাজ করে – সারা রাত – সাত আট ঘন্টা আপনার ফোন আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে – কত কত নতুন জিনিস আপনার কাছে মিস হয়ে যাচ্ছে!

আচ্ছা, প্রশ্নটা আমাদের সবার জন্যই – এই একটি ঘন্টা ঘুম চোখে স্মার্টফোনকে ডেডিকেট করার পর – টয়লেটে বসে আমরা কখনও নিজেদের প্রশ্ন করে দেখেছি – এক্স্যাক্টলি কী অমূল্য, মহার্ঘ্য কোনো বস্তু সকালের ওই এক ঘন্টায় আমাদের নতুন কিছু দিল, যা রোজ সকালে আমাদের এতটা আগ্রহের যোগ্য? কী এমন মহার্ঘ্য খবর নতুন করে ঐ সকালে আমার কাছে এলো, যার ফলে বাকি দিনটা আমাদের জন্য জরুরী হয়ে উঠবে? ওখানে কী খবরের কাগজের মত গতদিনের নানান জরুরী আপনার জন্য সাজানো আছে? ওখানে কী বহুদিন পর পাওয়া বন্ধুর চিঠির মতো কোন ফ্রেশ, টাটকা আবেগের মূহুর্ত আছে? ওখানে কী সদ্য রিলিজ হওয়া কোনো সিনেমা-সিরিজের খবর আছে? হ্যাঁ, আছে তো, সোশ্যাল মিডিয়ায় এগুলো আছেই, আপনি জানেন – যা সেই দিন বা পরবর্তীকালের কিছু দিনের জন্য আপনার জন্য জরুরী হয়ে উঠবে। কিন্তু, এর পাশাপাশি, বা একে ছাপিয়ে আপনার জন্য জরুরী দশটি বিষয়ের সাথে, আপনি দেখবেন, আরও একশোটি বিষয় সেখানে চতুর্দিক থেকে ঠেলে উঠে আসছে – যা হয়তো সারাজীবনেও আপনার আর একটা মূহুর্তের জন্যও কোনো কাজে আসবে না। আপনার নিউজফিডের অসংখ্য ছবি – বিড়ালের ভিডিও – নতুন কাপলের ছবি যাদের আপনি চেননেই না – আপনার ফ্রেন্ডলিস্টের অচেনা দু’হাজার মানুষের দুলক্ষ্য বিষয়ের সম্পূর্ণ অযাচিত, বেশীরভাগ সময়েই পয়েন্টলেস মতামত – আপনার ফ্রেন্ড সাজেশনে এরকম আরও কয়েকশো অচেনা মানুষের বন্ধুত্বের আহ্বান যাঁদের বেশীরভাগের সাথেই ইহজীবনে আপনার একটিও কথা বলার সম্ভাবনা নেই – এরকম অনেক অনেক অনেক কিছু। ছুটির দিনে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে, আপনার জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচটি বিষয়ের সাথে সাথে এই যে পাঁচশটি অনর্থক বিষয়ে আপনি একটি ঘণ্টা ব্যয় করলেন – ব্রেক ফাস্ট খেয়ে হয়তো আরও দেড় ঘণ্টা – দুপুরে রিল্যাক্স করার আগে আরও আধঘন্টা, সন্ধ্যেবেলা আরও দুঘন্টা – আপনার মস্তিষ্কে সেই তোতাপাখির পেটে গজগজ করা কাগজের মতো অপ্রয়োজনীয় পাঁচশ-পাঁচহাজার-পঞ্চাশহাজার নতুন নতুন তথ্য যে ঢুকছে – তা দিয়ে আপনি কী করছেন? কিছুই না – স্রেফ কিচ্ছু না – দশমিনিট পরেই হয়তো ভুলে যাচ্ছেন – অথচ, আপনার বন্ধুর সাথে আড্ডা দেওয়ার পরিবর্তে, আপনার পরিবারের সাথে সময়কাটানোর পরিবর্তে, আপনার পার্টনারের সাথে ডেটে যাওয়ার পরিবর্তে – আপনি অনন্ত সময় ধরে স্মার্টফোনের স্ক্রীনে চোখ আটকে পড়ে রয়েছেন! কী জন্য? আপনি জানেন না। আমিও জানি না, বিশ্বাস করুন – এ গল্পটা আপনার একার না, আমাদের সবার।

আপনি হয়তো ভাবছেন, এ আর এমন কী ব্যাপার – নতুন দুনিয়ার নতুন সংযোগের নিয়ম, যুগের সাথে সাথে বদলাতে হবে না? এখনও কী খালি চিঠির দুনিয়ায় পড়ে থাকব নাকি? এই যে এত সহজে নিখরচায় পাঠিয়ে ফেলা যাচ্ছে ই-চিঠি, সকাল বিকেল দুপুর মধ্যরাত – যখন খুশি নিখরচায় বন্ধুর সাথে, প্রিয়জনের সাথে লিখে বা ভিডিও কলে সংযুক্ত হওয়া যাচ্ছে, এ কী খারাপ জিনিস? সবকিছুর খারাপ দিকটা দেখাই যাদের অভ্যেস, তারা সবসময় এমনই বলে।

কিন্তু, প্রশ্নটা বোধহয় এত সহজ নয়।

কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া এক তথ্যচিত্র আমাদের এই মায়াভরা ডিজিটাল দুনিয়ার নানাবিধ জটিল পর্দার কয়েকটি উন্মুক্ত করে দেখাতে চেয়েছে, আমাদের নিরন্তর বেড়ে চলা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডিকশনের ফল ভাঙ্গিয়ে, আসলে কার লাভ হচ্ছে – আসলে কারা নিরন্তর আমাদের এই অদ্ভুত এক জালের মত চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছে, দেখতে পেলেও, বুঝতে পেলেও, মাঝে মাঝে অনুভব করতে পেলেও যে জাল ছিড়ে আমাদের বেরোনোর উপায় নেই। এ যেন খানিক যাবজ্জীবন কারাদন্ড, অথচ কারাগারের কোনো লৌহকপাট নেই। লৌহকপাট যদি চোখেই দেখতে না পাই, তাহলে তা আর ভেঙে বেরোবো কী করে?

এ তথ্যচিত্রে কথা বলেছেন গুগুল, ফেসবুক, টুইটার, পিন্টারেস্ট, ইন্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট – আমাদের রোজকার সঙ্গী চেনা-পরিচিত এই সকল ডিজিটাল প্লাটফর্মের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার, ডেভেলপার, কর্মচারীরা – যাঁরা নিজেদের হাতে কেউ ফেসবুক লাইক বাটন ডিজাইন করতে সাহায্য করেছেন, কেউ জিমেইলের চ্যাট অপশন তৈরী করার টিমে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ পিন্টারেস্টের প্রেসিডেন্ট ছিলেন – সবাই – আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের নিজেদের হাতে তৈরী করা ফ্রাঙ্কেস্টাইন এবার তাদের দিকেই ফিরে আসতে চাইছে – বোতল থেকে বেরিয়ে পড়া দৈত্যকে আর বোতলে পুরে রাখা যাচ্ছে না।

সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল এই মাধ্যম নিয়ে একধরণের সন্দেহ আমাদের জন্য নতুন না। আমরা সবাই কমবেশী জানি, ফেক নিউজ ছড়ানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়, বিভিন্ন পলিটিকাল পার্টি ভোটের ক্যাম্পেনের সময় ফেসবুককে টাকা দিয়ে ভোট নিশ্চিত করতে চায়, ফেসবুক আমাদের সম্পর্কে গাদা গাদা তথ্য জড়ো করে কিছু একটা করতে চায় যা আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না – এরকম নানান আশঙ্কা আমরা কমবেশী করেই থাকি। কিন্তু কমন সেন্স খানিকটা অবধি এই ধাঁধায় আমাদের পথ দেখালেও, বাকি রাস্তা পেরোনোর জন্য আমাদের খানিক অভিজ্ঞ লোকজনের মতামত শুনতেই হয় – এমন একজন হলেন ২০১৫ সালে গুগুল ছেড়ে এসে নন প্রফিট সংস্থা ‘সেন্টার ফর হিউমেন টেকনোলজির’র প্রতিষ্ঠাতা ত্রিস্তান হ্যারিস, যাঁর সম্পর্কে অনেকেই বলেছেন, সিলিকন ভ্যালিতে যদি বিবেক বলে সবচেয়ে কাছাকাছি কিছু থাকে তাহলে, তিনি ত্রিস্তান।

ত্রিস্তান বলছেন, মানুষের ইতিহাসে আগে কখনও এরকম হয়নি যে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে থাকা পঁচিশ থেকে পয়ত্রিশ বছর বয়সের মাত্র পঞ্চাশ জন টেক-ডিজাইনার কার্যত ঠিক করে দিচ্ছেন, দু’শো কোটি মানুষ রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে কীভাবে নোটিফিকেশন চেক করবেন। এই ডিজাইনারদের ছকে দেওয়া পথ অনুযায়ী, আমি আপনি – এই দু’শো কোটির দুইজন – আমরা আমাদের রোজকার অভ্যেস বদলে ফেলব, ঘুমোতে যাওয়ার আর ঘুম থেকে ওঠার সময় বদলে ফেলব – প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলার হিসেব বদলে ফেলব। আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি, আমাদের অনেকেরই একটি ধারণা থাকে – নিয়ন্ত্রক তো আমরা – আমরাই তো নিজেদের ইচ্ছেয় লাইক করছি, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি, বন্ধুর সাথে চ্যাট করছি! ত্রিস্তানরা বলছেন না – এটা আপনি করছেন না, আপনাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। খানিকটা পুতুলনাচের মতো – যার অদৃশ্য সুতোটা থাকছে প্রতিনিয়ত কোটি ডলার কামানো টেক-ইন্ডাস্ট্রির কিছু কোম্পানির হাতে, তারাই আপনাকে বলে দিচ্ছে, কখন নোটিফিকেশন চেক করতে হবে আর কখন মেসেঞ্জারে ওয়েভ পাঠাতে হবে!

শুনতে হলিউড সিনেমার মত লাগছে? হয়তো – কিন্তু এই কথা শুনে শিঁরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাবেই। আমরা বুঝতে পারি – একটু একটু করে কীভাবে দানবের মতো এই অনলাইন প্লাটফর্মগুলো বেড়ে উঠেছে – কীভাবে যে কোনো অ্যাপের একের পর এক আপডেটের নতুন ফিচার্সে একটু একটু করে আরও আকর্ষণীয় করে আপনার মনোযোগকে ধরে রাখার নিরন্তর এক প্রতিযোগিতা চলেই যাচ্ছে, চলেই যাচ্ছে। লক্ষ্য করে দেখবেন, আজ থেকে দশ বছর আগে ফেসবুকে হয়তো আজকের নানান ফিচার্সের নব্বই ভাগ ছিলই না – আগে পোস্টে লাইক ছাড়া আর কোনো রিয়াক্ট দেওয়া যেত না, আপনার ছবিতে বন্ধুকে ট্যাগ করার অপশন ফেসবুকের শুরুর দিন থেকে ছিল না। ত্রিস্তান এবং তাঁর সহকর্মীরা বলছেন, আপনার ফোনের স্ক্রীনের ওপারে অসংখ্য কোম্পানী বসেই আছে রোজ কী নতুন নতুন ফিচার্স তৈরী করে আপনাকে আরও বেশী করে ফোনের মধ্যে আটকে রাখা যায়, আরও বেশী করে নিউজফিড স্ক্রল করানো যায়। খেয়াল করে দেখবেন, এককালে বন্ধুর ছবিতে লাইক করাকেই আমরা পছন্দ করা ভাবতাম – ‘লাভ’ দেওয়া বা ‘কেয়ার’ দেওয়ার নতুন ট্রেন্ডে লাইক করাকে আজকাল ততটাও পছন্দ নয়, মাঝারি পছন্দ, আর ‘লাভ’ বা ‘কেয়ার’ অনেক বেশী পছন্দ – এমনটা বলা হয়! লাইকের মানে যে পছন্দ থেকে অতটাও পছন্দ নয়, তার জন্য ‘লাভ’ বা ‘কেয়ার’ সাইন লাগবে – কে বলে দিল আমাদের? আমাদের বন্ধুকে আমরা কতটা পছন্দ করব সেটা লাইক বা লাভ সাইনের উপর নির্ভর করবে? কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাহলে? আপনি লাইক দেবেন কীনা, নাকী, আপনাকে দিয়ে লাইক দেওয়ানো হবে কীনা!

কিন্তু আমাদের প্রশ্ন থেকেই যায় – আমাদের মনোসংযোগ নিয়ে, আমাদের ব্যবহার করার সময় নিয়ে টেক-কোম্পানীর কী লাভ? তারা এ থেকে কী পাচ্ছে? আমাদের তো ফেসবুক বা গুগুল করতে সরাসরি টাকা দিতে হয় না! তাহলে এখানে তাদের লাভের উৎসটা কোথায়?

আপাতত কয়েকটি পরিসংখ্যান। জনৈক চাইনিজ-আমেরিকান এরিক ইউয়ান এ প্যান্ডেমিকের কয়েক বছরে বিলিয়নিয়ার হয়ে পৃথিবীর চারশো ধনীতম ব্যক্তির তালিকায় নিজের নাম ঢুকিয়ে ফেলেছেন। এরিক ইউয়ানের নামটার সাথে আমরা হয়তো অতটা পরিচিত নই, কিন্তু তিনি যে কোম্পানির ফাউন্ডার, তার নাম কমবেশী আমরা সবাই জেনে গেছি। জুম ভিডিও কনফারেন্সিং প্লাটফর্ম – যা এই মূহুর্তে গুগল মিট’র সাথে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যম। কিন্তু, এই গল্পের প্রধাণ টুইস্ট অন্য জায়গায় – একবছর আগেও এরিকের কোম্পানী বা তার ব্যবসা এত ছিল না। শুধুমাত্র ২০২০ সালে, প্যান্ডেমিকের বাজার যেখানে তড়তড় করে বেড়েছে, তাঁর লাভ বেড়েছে ৩৯৫.৫ শতাংশ – অর্থাৎ প্রায় চারশো পার্সেন্টের কাছাকাছি। মাত্র একবছরে নিজের কোম্পানীর লাভের অঙ্ক চারশো শতাংশ বৃদ্ধি করলেন একজন পুঁজিপতি – যেখানে সারা পৃথিবী জুড়ে সাধারণ মানুষের চাকরী নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই, চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, ছোট ব্যবসায়ীরা আত্মহত্যা করছেন? সারা পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ মানুষ যখন হতাশা এবং গ্লানিতে ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন, তখন কেবল একটা ভিডিও কনফারেন্স প্লাটফর্মের সিইও নিজের প্রফিট বৃদ্ধি করলেন চারশো শতাংশ? কীভাবে সম্ভব এটা?

একথা নিয়ে ভাবতে গেলেই আমাদের প্রথম প্রশ্ন তৈরী হয়, আচ্ছা জুম তো ব্যবহার করা যায় ‘ফ্রি’-তে, তাই না? চল্লিশ মিনিট অবধি যে কেউ, একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে, চাইলেই ব্যবহার করতে পারেন জুম, তাই তো? ইন্টারনেট কানেকশনের টাকা ছাড়া তো আর কোনো টাকাই দিতে হচ্ছে না নির্দিষ্ট প্লাটফর্মটিকে – যেভাবে ওটিটি প্লাটফর্মে আমরা টাকা দিয়ে ফিল্ম বা সিরিজ দেখি, তার তো কিছুই নেই এখানে। তবে কী করে সম্ভব হল ওঁর এই পাহাড়প্রমাণ লাভ? যেখানে ব্যবহারকারীকে টাকা দিয়ে তার প্রোডাক্ট কিনতেই হচ্ছে না, সেখানে মালিক টাকাটা পাচ্ছে কোত্থেকে?

আচ্ছা এইবার ভাবুন তো, এতক্ষণ আমরা যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম – সেই গোটা ইন্টারনেটের দুনিয়ার একটা বৃহৎ অংশ – গুগলের মত সার্চ ইঞ্জিন, ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপ-ইন্সটাগ্রামের মতো সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া – এসব ব্যবহার করতে আমাদের তো টাকা দিতে হয় না, তাহলে এগুলো কী ‘ফ্রি’? মার্ক জুকারবার্গ বা ল্যারি পেজ কী হঠাৎ একবিংশ শতকের গোড়ায় দানছত্র খুলে বসলেন, সারা পৃথিবীর মানুষের অসীম উপকার করার জন্য ফেসবুক নামক একটা প্লাটফর্ম বা গুগল নামক একটা সার্চ ইঞ্জিন বিনামূল্যে আমাদের ব্যবহার করতে দিয়ে দিলেন? তাহলে এইমূহুর্তে গ্লোবাল বিলিয়নেয়ারের তালিকায় মার্ক জুকারবার্গ পাঁচ নম্বরে, আর ল্যারি পেজ সাত নম্বরে কী করে থাকেন? সারা পৃথিবী জুড়ে সোশাল মিডিয়া বা গুগল নামক কোম্পানী গুলোর এত ব্যবসা কী করে সম্ভব হয়?

এই প্রশ্নের উত্তর এই আলোচনার পরিসরে বোধহয় সবচেয়ে রোমহর্ষক – কারণ লেট ক্যাপিটালিজমের এই ডিস্টোপিক যুগে বিক্রেতা–খরিদ্দার–পণ্যের সেই পুরোনো সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। বাজার থেকে খাসির মাংস কিনে আনার মত করে আপনি খদ্দের, দোকানি বিক্রেতা, আর মাংস পণ্য – এই যুক্তি বোধহয় বিগত শতকের ধারণা। মজিলা ফায়ারফক্সের প্রাক্তন কর্মচারী অ্যাজো রাসকিন বলছেন, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় মূল টাকা লগ্নি করার কাজ করে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতারা। লক্ষ্য করে দেখবেন, আপনি গুগুলে কোনো কিছু খুঁজে এসে ফেসবুক খুললে মূহুর্তে তার বিজ্ঞাপন আপনার নিউজফিডে চলে আসে। আপনাকে কিনতে প্রলুব্ধ করার পাশাপাশি, এই সিস্টেমের জটিল আরেকটি মাত্রা আছে – তা হল এই বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে আপনাকেই পণ্য হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া! এই বিজ্ঞাপনদাতার নির্দিষ্ট একটি প্রোডাক্ট যে আপনার ঐ মূহুর্তে ভালো লাগবে – এইটি সঠিক ভাবে আঁচ করতে পারার উপরেই নির্ভর করছে ব্যবসার সাফল্য। তাই আপনার জিনিস কেনার ইচ্ছেই শুধু নয়, ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কোন ধরণের জিনিস আপনি পছন্দ করতে পারেন, সেই সম্ভাবনাটা - যা তাদের ব্যবসার সাফল্যকে বাড়িয়ে তোলে – সেটাই আজ পণ্য। এই পণ্যের হিসেব সহজ টাকাপয়সার যুক্তিতে পাওয়া যাবে না।

এক প্রযুক্তিবিদ বলছেন, ফেসবুকের নতুন আপডেট ডিজাইন করার জন্য আপনি তো আর ফেসবুককে টাকা দিচ্ছেন না – টাকা দিচ্ছে বিভিন্ন অর্থকরী সংস্থা, যার মধ্যে অন্যতম প্রধাণ বিজ্ঞাপনদাতারা। ফেসবুক সহ এই সব সংস্থা – ঘুরিয়ে, বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করছে আপনাকে, বা আপনার আদলে তৈরী একটি ভার্চুয়াল মডেলকে – যা বিক্রি করে টাকা আসবে সেই গোটা সিস্টেমের। ত্রিস্তান সেই প্রবাদ বাক্য আমাদের মনে করান, পণ্য ব্যবহার করার জন্য আপনি যদি টাকা না দেন, হ্যাঁ, তাহলে আপনিই পণ্য।

জীবনের কতক্ষণ সময় আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ডিজিটাল দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকবেন – সেই সময়কে কেনার জন্য মারপিট করছে ফেসবুক, গুগুল, স্ন্যাপচ্যাট, জুম, গুগল মিট সহ অসংখ্য ইন্টারনেট প্লাটফর্ম। এখানকার কর্মচারীরাই বলছেন, এই সমস্ত কম্পানীর ব্যবসার মডেল হল, কত বেশী সময়, আরও কত বেশী সময়, আরও আরও কত বেশী সময় আপনার থেকে কেড়ে নেওয়া যায় – যেখানে আপনি স্ক্রল করেই যাবেন – বিরতিহীন, সমাপ্তিহীন অনন্ত সময়ের স্ক্রল – এবং আপনার এই প্রতি সেকেন্ড সময় অনলাইনে থাকার জন্য, আসলে টাকা তৈরী হচ্ছে – জায়ান্ট কম্পিউটার স্ক্রীন বসে আছে আপনাকে, আপনার সময়কে টাকার সংখ্যায় পরিবর্তন করে নেওয়ার জন্য।

টেন আরগুমেন্টস ফর ডিলিটিং ইয়োর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট রাইট নাও বইয়ের লেখক জ্যারন ল্যানিয়ার বলছেন, প্রতিদিন ফেসবুক সহ সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকাকালীন আপনার স্বভাবে এবং মস্তিষ্কে যে ধীরগতিতে, সুক্ষ্মভাবে, প্রায় বোঝা যায় না – এমন পরিবর্তন ক্রমাগত হয়ে চলেছে – যাতে করে ক্রমশঃ আরও বেশী সময় আপনি অনলাইনে সবুজ ফুটকি হয়ে থাকছেন – আপনার স্বভাব আর এই মস্তিষ্কটাই হল এই কম্পানীগুলোর কাছে প্রধাণ পণ্য। আপনি কে, আপনি কী করেন, আপনি কী করবেন – সমস্তকিছু, সমস্তকিছু সুক্ষ্মভাবে বদলাচ্ছে – বদলে দিচ্ছে সিলিকন ভ্যালিতে বসে থাকা সেই পঞ্চাশজন ডিজাইনার। নিয়ত আপনার এই বদল বিক্রিত হচ্ছে নামহীন, মুখহীন সেই বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে।

এবং আপনাকে নিয়ত বদল করার জন্যই – সবার আগে কম্পানিগুলোর কী দরকার? দরকার আপনার সম্পর্কে, আপনার পরিচিত দুশো জন সম্পর্কে, আপনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া সমস্তকিছু সম্পর্কে তথ্য। হ্যাঁ, ডেটা – যা নিয়ে ইন্টারনেট তোলপাড় এখন – যা আমরা স্বেচ্ছায় ফেসবুকে রোজ, প্রতি ঘন্টায় স্টেটাস আপডেটের সাথে সাথে দিয়ে থাকি – ফিলিং ডিপ্রেসড, ফিলিং হ্যাপি, ওয়াচিং অমুক, ডুইং তমুক, চেকিং ইন হেয়ার, মেকিং ফ্রেন্ডস দেয়ার! আমার বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু, প্রেমিক, প্রেমিকা, আমার খাওয়ার যায়গা, ঘুমানোর জায়গা, কী লেখা পড়ছি, কী ফিল্ম দেখছি, এবং তার সাথে আমাদের ক্লাসরুম – সবকিছু আমরা, স্বেচ্ছায় তুলে দিচ্ছি এই ডিজাইনারদের হাতে, যাতে করে আরও বেশী করে আপনাকে বিজ্ঞাপনদাতাদের পণ্য হিসেবে নিশ্চিতরূপে বিক্রি করে দেওয়া যায়। নিয়ন আলোয় আর আপনার ব্যক্তিগত পণ্য হয় না, ল্যাপটপ মোবাইলের ঝকঝকে স্ক্রীনে, আপনিই নিয়ত পণ্য।

আপনার সম্পর্কে জোগাড় করা ভুরি ভুরি তথ্য কিন্তু ফেসবুক বিক্রি করে না। অনেকেই ভাবেন তথ্য বিক্রি করে ফেসবুক টাকা পায় – না তা নয়, যেখানে পণ্য আপনি – সেখানে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো আসলে দরকার আপনার ভার্চুয়াল ওই মডেলের জন্য, যেখানে কম্পানীগুলো নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে আপনার সম্পর্কে, ভবিষ্যতে ঠিক কোথায় কখন, কোন জিনিসটা আপনি করবেন – এবং যাতে করে আরও নিশ্চিতভাবে, আপনাকে ওই বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। আগে উল্লেখিত তথ্যচিত্রে অ্যানিমেশনে একটি ভার্চুয়াল রোবট দেখানো হয়, যা আপনার আদলে তৈরী, যেখানে আপনার সম্পর্কে পাওয়া সমস্ত এই তথ্যকে একসাথে করে আপনার ভার্চুয়াল ক্লোন তৈরী হচ্ছে, যাতে আপনার এই ভার্চুয়াল মডেলটি বিজ্ঞাপনদাতারা কিনে নিয়ে তাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে পারে – আমাজন সঠিক ভাবে যেনে যেতে পারে ফেসবুকে কোন ছবি একটু বেশী দেখলে আপনি হয়তো একটা নতুন জামা অর্ডার করবেন, কোন ধরণের খাবারের ছবি কোন সময় দেখছেন – সেই হিসেব করে সুইগি বা জোম্যাটো আপনাকে ঠিক সেই খাবারের নোটিফিকেশন পাঠাবে! আপনি যা করছেন, সবকিছু নজর রাখছে এই টাকা তৈরীর মেশিন – যাতে সবুজ ফুটকি হওয়া আপনাকে ক্লোনিং করে ক্রমাগত বেচে দেওয়া যায় কোম্পানির কাছে! পরিভাষায় একেই বলে টার্গেটেড অ্যাডভার্টাইজিং – যা চিরকালীন সাধারণ বিজ্ঞাপনের চেয়ে কয়েকগুণ আলাদা। ভেবে দেখুন, খবরের কাগজে কিন্তু আমরা সবাই একই বিজ্ঞাপন দেখি। সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রত্যেকের বিজ্ঞাপনের ফিড আলাদা।

তাই সাবধান, ছুটির সকালে উঠে কিউট বিড়ালের ভিডিও দেখার একটি ঘন্টা সময় কিন্তু শুধুই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার মত এক ঘণ্টা না – এই একঘন্টায় অত্যন্ত জটিল, প্রায় দুর্বোধ্য একটি মেশিনের সামনে আপনি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে আসছেন! আপনার পছন্দের, অতি প্রিয় এই মোবাইল ফোন সন্তর্পণে আপনাকে একটু একটু করে বিক্রী করছে এই মেশিনের কাছে, আপনি টেরও পাচ্ছেন না। তাই নেক্সট টাইম কিউট বিড়ালের ভিডিও দেখার আগে একবার খেয়াল করে রাখুন, সেই ভিডিওর ঠিক কোন সম্ভাব্য পণ্যটি বিক্রির জন্য আপনার কাছে নোটিফিকেশন আসে!

0 Comments

Post Comment