গোদি-মিডিয়াকে মাথায় চড়ালে কী হয়, সে এখন একদম হাতে-নাতে দেখা যাচ্ছে। এরা যখন আরজিকর নিয়ে গুলবাজি করছিল, তখন বিপ্লবীরা ভেবেছিলেন, আহা গুল তো নয়, যেন সোনায় বাঁধানো বিপ্লব। দেড়শো-গ্রাম বীর্য থেকে লাশের সঙ্গে সঙ্গম অবধি যাবতীয় ঢপ শুধু গোগ্রাসে গেলা নয়, চারদিকে নাগাড়ে ছড়িয়ে বেড়িয়েছেন, যেন ওঁরাই গোদি-মিডিয়ার সেলস-এজেন্ট। তাতে ব্যাটাদের সাহস দুগুণ হল। অপারেশন সিঁদুরের সময় শুরু হল আন্তর্জাতিক স্তরের গুলবাজি। কর্নেল সুমন্দে আর মেজর ময়ূখ একাই যুদ্ধ করে লাহোর-করাচি সব দখল করে ফেললেন। পাকিস্তানকে পাঁচ-টুকরো করে দিলেন। রীতিমতো ভুয়ো ভিডিও ছড়ানো হল। ধরা পড়ার পরও সে কি হম্বিতম্বি। সেই সাহসটা পেলেন, কারণ আমাদের "প্রগতিশীল" বাবু ও বিবিরা সব জেনেবুঝে তারপরও পাউডার মুখে স্টুডিওতে বসতে লাগলেন। কারো মুখে এই চূড়ান্ত গুলবাজি নিয়ে একটি কথাও শোনা গেলনা। যদি আর না ডাকে, ওরে বাবা। সেটুকু হলেও কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেল, সেলস এজেন্ট বা শুদ্ধভাষায় দালালের কর্তব্যটাও ছেড়ে দিতে এঁরা নারাজ। কারণ তারপরই এল পানাগড়ের ইভটিজিং-মৃত্যু। দুর্গাপুরের গণধর্ষণ। সবকটা গুলবাজি শুরু হল গোদি-মিডিয়ায় এবং তারপর ব্যাটন তুলে নিলেন ভদ্রলোক ও প্রগতিশীল বাবু-বিবিরা। সে কী দাপট। গোদি-মিডিয়া বিপ্লব করছে, আর এঁরা তার অগ্রদূত। পথে যে কোনো অন্তরায়ই হল চটি-চাটা।
তো এইসব করে গোদি মিডিয়াকে মাথায় চড়ালেন। গোদি-মিডিয়ার অ্যাজেন্ডা নিয়ে কেউ কিছু বললেই তাকে ধুইয়ে দিয়ে দালালের উপযুক্ত কর্ম পালন করলেন। বখশিস কী পেলেন জানা নেই, হয়তো মুখ-দেখানোর লোভে ফ্রিতেই লেবার দিলেন। তাঁদের বলে বলীয়ান হয়ে গোদি-মিডিয়া নামল কেউটে ধরতে। প্রথমে তিলোত্তমা মজুমদাররা সোচ্চারে জানালেন বাঙালির উপর অত্যাচার কিচ্ছু হচ্ছেনা। সঙ্গে পবিত্র সরকাররা ঢাক-ঢোল বাজালেন, এসব নেহাৎই অর্থনৈতিক বলে। এরপর গোদি মিডিয়া এসআইআর ওরফে এনআরসির উপকারিতা প্রচার শুরু করল। এবং এখন তো জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ডেমোগ্রাফি বিলকুল বদলে গেছে। গুছিয়ে রোহিঙ্গা। মুসলমানদের বসতির পর বসতি নাকি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও প্রসাদধন্য বা প্রসাদোন্মুখ বাবু ও বিবিরা একদম চুপ। গোদি মিডিয়া অবাধে শুভেন্দু অধিকারির অ্যাজেন্ডা প্রচার করে যাচ্ছে। নির্দ্বিধায় অমিত মালব্যের টুইটকে খবর বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এটা অন্তত বছর-খানেক আগেই বলা হয়েছিল, যে, গোদি-মিডিয়ার গুলবাজি ফাঁস না করলে এরপর ওরা নিজেদের অ্যাজেন্ডায় এর চতুর্গুণ করবে। তখন যেই শুনেছেন গুছিয়ে গাল দিয়েছেন, চটিচাটা বলে। এখন হয় বলার কোনো মুখ নেই, কিংবা সঙ্গোপনে সঙ্ঘী বুট চাটছেন।
অথচ যা চলছে, এগুলো সব যে গুলবাজি, এই নিয়ে সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই। এবং মূলধারায় চূড়ান্ত খুল্লমখুল্লা সাম্প্রদায়িকতার নির্লজ্জ প্রদর্শন, এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের মতোই দেখতে কিছু জীব মাথার পিছনে আলো লাগিয়ে নাগাড়ে বলছেন অমুক বস্তি ফাঁকা হয়ে গেল। পরক্ষণেই সেটা চলে যাচ্ছে বিজেপির আইটি সেলে। সমাজমাধ্যমে। বা উল্টোটাও হচ্ছে, প্রথমে বিজেপি বলছে, তারপর আসছে সংবাদমাধ্যম। পুরোটাই খুল্লমখুল্লা, লুকোছাপার বালাই আর কিছু নেই। এই 'খবর'গুলো জানলেন কীকরে? স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন? প্রশ্ন করারও কেউ নেই। বিহারগামী ভিড় ট্রেন দেখিয়ে বলা হচ্ছে বাংলাদেশীরা পালাচ্ছে। বাংলাদেশগামী ট্রেনে কি তবে আজকাল আর ভিসা-পাসপোর্ট লাগেনা? নাকি পাটনার দিকে আলাদা একটা সীমান্ত হয়েছে? প্রশ্ন করার কেউ নেই। ছেয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত সব রোহিঙ্গাতত্ত্বে। শহরের লোকের, যাদের সান্ধ্যকালীন খেউড় দেখা অভ্যাস, তারা খাচ্ছেনও এগুলো। রাস্তাঘাটে শোনা যাচ্ছে ডেমোগ্রাফি বদলের অদ্ভুত সব গল্প। কেউ টিভিতে বলছেন, কেউ সোসাল মিডিয়ায়। জানলেন কীকরে? সে কেউ জানেনা।
এইগুলো হতে পারছে, কারণ, যাঁদের এই গুলবাজিগুলো ধরার কথা, তাঁরা ধরবেন কী, কেউ কেউ তো নিজেরাই ছড়াচ্ছেন। বিখ্যাত লেখিকা থেকে শুরু করে বিখ্যাত ডাক্তারবাবুরা জনবিন্যাস-বদলের তত্ত্ব আওড়াচ্ছেন। যাঁরা বিশ্বাস করেননা, তাঁরাও বলছেন না, কারণ অনেকদিন মেরুদন্ড হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে নিজের মেরুদন্ডটাই হারিয়ে ফেলেছেন। টিভির পর্দায়. চোখে চোখ রেখে গোদি-মিডিয়ার গুলবাজিকে কাউন্টার করার মতো সাহসও নেই। যদি কৃপাদৃষ্টি হারিয়ে ফেলি। যদি বড়দা রুষ্ট হন। ফলে অবাধে ছড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই দাঙ্গাপরিস্থিতি তৈরির প্রচেষ্টা চলছে অবিরাম, অনর্গল। গোদি-মিডিয়া এটা করেই থাকে, কিন্তু অন্যত্র প্রতিরোধও হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের "সচেতন" লোকের কাছে গোদি-মিডিয়াই মাই-বাপ। তারাই ভগবান তৈরি করে। তারাই "প্রগতিশীল"দের কানে ধরে ওঠায় এবং বসায়। তাঁদের হাসিমুখ সম্মতিতেই। গোদি-মিডিয়ার নাড়ুগোপালদের কাছে এঁরা জানু পেতে দিয়েছেন, এবং তার ফলই একদম হাতে-নাতে দেখা যাচ্ছে।
কপাল ভালো, গোদি-মিডিয়ার অঙ্গুলীহেলনে শিক্ষিত ও সচেতন লোকজন ছাড়া আর বিশেষ কেউ চলেন না। শতাংশের হিসেব করলে তাঁরা খুব বেশী হলে মেরেকেটে ১০%। বাকিরা মূলগতভাবে এসআইএর ভয়ে আছেন, ভীত-সন্ত্রস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত। পরের পর আত্মহত্যার মিছিল হচ্ছে। আন্দোলন-চেঁচামেচি যা করার তাও এই অংশই করছেন। বিজেপির বিধায়ককেও বিজেপির বিরুদ্ধে তাই বলতে হচ্ছে। ফলে নেহাৎই কোটিখানেক লোককে বাদ না দিয়ে দিতে পারলে বিজেপি ভোটে গোহারান হারবে। কিন্তু সেটার কৃতিত্ব নিচের তলার লোকের। শিক্ষিত ও সচেতনদের হাতে ছেড়ে দিলে দেশভাগের চেয়েও একটা বড় বিপর্যয় আসন্ন ছিল।
আর হ্যাঁ, দেশভাগের সময় যে পাপ, বিশ্বাসভঙ্গ করা হয়েছিল, সেসব ইতিহার সাফল্যমণ্ডিতভাবে চেপে দেওয়া গেছে। এবার কিন্তু অত সহজ হবেনা। ভারতে ফ্যাসিবাদের ভগীরথ গোদি-মিডিয়া এবং তার তোল্লাইদাতাদের কড়ায় গণ্ডায় বিচার হবেই।